Thursday 10 December 2020

অবরুদ্ধ কৃষক

এ লড়াই সকলের লড়াই

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়


লড়াইটা সামনে এসে গেছে, এতদিন যা ছিল আড়ালে: এ দেশের সামন্ত পুঁজির সঙ্গে কর্পোরেট পুঁজির। এ দেশের কৃষি ক্ষেত্রে এবার অশ্বমেধ ছোটাতে চায় আন্তর্জাতিক পুঁজি। এতদিন যে ক্ষেত্রটি ছিল সামন্ত পুঁজির শক্ত নিয়ন্ত্রণে সেটাই ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। ভেঙে দেওয়া হচ্ছে কৃষি উৎপাদন বিপণন মজুতদারির এতদিনকার চালু ব্যবস্থা। উদ্দেশ্য একটাই, বিপন্ন চাষিকে কর্পোরেট চুক্তির আওতায় এনে কর্পোরেট ফার্মিং'এর সুবিধা নিয়ে ফসলের উৎপাদন যতটা সম্ভব কম করে ফেলা এবং তারপর যথেচ্ছ মজুতদারির মাধ্যমে মুনাফা সর্বাধিক করা। সরকার ক্রমশ মান্ডি এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে সেটিকে অকার্যকর করে তোলার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে; যাতে কেউ বলতে না পারে যে সরকার সে ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই হবে। সমস্ত ক্ষেত্রে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে খোলাবাজারে দামের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আর তার জন্যই একই সঙ্গে চালু হল চুক্তি চাষের সঙ্গে যথেচ্ছ মজুতদারি করে মুনাফা সর্বাধিক করে নেওয়ার ক্ষমতা। 

মনমোহিনী সংস্কারে নয়া উদারনীতি কৃষিকে কোণঠাসা করে ধীরে ধীরে চাষিকে বাধ্য করছিল চাষের কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে। এতে ছোট ও মাঝারি চাষির দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা তৈরি হচ্ছিল। প্রতি বছরই চাষের নানা খরচ বাড়ছিল, একই সঙ্গে সরকার নিজেও ভর্তুকি কমাচ্ছিল। অতএব, বিদ্যুৎ, জল, সার ক্রমশ মহার্ঘ্য হচ্ছে, চাষির আয় কমছে। এমন অবস্থায় চাষিদের বোঝানো হয়েছিল যে মোদিকে ক্ষমতায় আনা হলে তিনি তাদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন। সরল বিশ্বাসে সেটাই ভেবে নিয়েছিল এ দেশের চাষি। তাই আজ তারা এই হাড়-কাঁপানো শীতে দিল্লির পথে বসে আছে। সরকার দেখছে, কতদিন ধৈর্য ধরে থাকে দেখি? সরকার এখন ক্ষেতে ক্ষেতে কর্পোরেট ফার্মিং শুরুর দামামা বাজিয়ে দিয়েছে। ছোট চাষিকে কোণঠাসা করে বড় চাষির হাতে জমি তুলে দেওয়া নয়, এবার গোটা কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে উদ্যোগী মোদি সরকার। 

পরিবর্তন কতটা হচ্ছে সেটা বুঝতে গেলে প্রথমে জানা দরকার যে এ দেশের কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে এক  এক রাজ্যের পরিস্থিতি এক এক রকম। যেহেতু কৃষি ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য তালিকার অন্তর্গত তাই স্থানীয় কৃষির প্রয়োজন, চাষীদের অবস্থা বুঝে এক এক রাজ্য এক এক রকম আইন তৈরি করেছে। অবশ্যই এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয় রাজনীতি এবং রাজনীতির সমীকরণে কৃষকের ভূমিকা ও গুরুত্ব। ঠিক সেই কারণেই বিহার বা ছত্তিশগড়ে কৃষকের যা পরিস্থিতি, পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরাখণ্ডে তা নয়। বিভিন্ন রাজ্যে কৃষি ব্যবস্থার চরিত্র তৈরি হয়েছে এভাবেই। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে গড়ে ওঠা পুঁজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পর উদ্বৃত্ত হিসেবেই রয়ে গেছে সম্পন্ন ও ধনী কৃষকের কাছে। গ্রামীণ অর্থনীতির প্রকরণে তাই কোনও পরিবর্তন আসেনি।

মোদি সরকার কার্যত কৃষির এই তিন আইন এনে শুধু কৃষি ক্ষেত্র নয়, স্বাভাবিকভাবেই গ্রামীণ উন্নয়নের ধারাটাও বদলে দিতে চাইছে। তাঁর বক্তব্য, পুরনো আইনে আর আগামীর উন্নয়ন হবে না। গ্রাম উন্নয়নের জন্য কর্পোরেট লগ্নি চাই। চুক্তি চাষ মানে পাশাপাশি ছোট ছোট চাষের জমির মালিককে একজোট করে চুক্তি করতে পারলে এলাকা জুড়ে বড় মাপের 'কর্পোরেট মেকানাইজড ফার্ম অ্যাকটিভিটি' সম্ভব হবে। এই ইংরেজি শব্দবন্ধ- 'কর্পোরেট মেকানাইজড ফার্ম অ্যাকটিভিটি' এখন মোদির স্বপ্ন। অর্থাৎ, জমি নিরানি থেকে লাঙ্গল দেওয়া, বীজ বপন, সার দেওয়া, বিষ তেল দেওয়া, ফসল কাটা, ঝাড়া, রাখা সমস্ত কাজে যন্ত্র লাগানো যাবে। ভাবুন একবার। ড্রোন উড়ছে ক্ষেতে বিষ তেল দিতে! এরকম একটা কৃষিক্ষেত্র চাইলে তো ছোট চাষির ক্ষেত রাখা যায় না। আর ভারতীয় কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে তো এই পথই দরকার। পুঁজিবাদী কৃষিবিদদের এই আপ্তবাক্য মেনে যদি কৃষির কর্পোরেটকরণ ঘটানো যায় তাহলে গ্রামে প্রচুর অর্থ লগ্নি হবে। রাস্তা, হিমঘর, বেসরকারি কৃষি বাজার তৈরি হবে। আর এটা ক্রমশ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে যখন এই কৃষি ফসলটাই আদানি আম্বানিদের ব্যবসার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গেই রয়েছে বিশ্বজোড়া পুঁজি অধিপতি গুগল, অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট।

তবে সেই অর্থ লগ্নির ফলে গ্রামের কৃষিজীবী মানুষের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে না, বরং বিপন্ন হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রবল। কীভাবে সেটা সরকার জানে, তাই আইনে সুরক্ষার পাশাপাশি চটজলদি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার আওতায় কৃষকদের রাখাটা যে জরুরি, এটা তারা ভুলে গেছে। চুক্তি চাষের আওতায় এনে কর্পোরেট যদি কৃষকের সঙ্গে কথার খেলাপ করে, যথাযথ চুক্তিমতো দাম না দেয়, তাহলে কৃষকের সঙ্গে দানবীয় কর্পোরেটের লড়াইতে কে জিতবে? চোখ বন্ধ করে বলা যায়, সেই মামলার রায় দেওয়ার আগেই ছোট ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক শুকিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ করার ব্যবস্থা রাখা হয়নি নতুন আইনে।

লাগাতার বিক্ষোভ আন্দোলন ধর্ণা এবং কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে বারংবার বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার কতকগুলো সংশোধনী আনতে চাইল। যেমন, চুক্তি আইন নিয়ে সংশোধনী আনতে চেয়েছে এই মর্মে যে চুক্তি শর্ত অনুযায়ী কোনও বিতর্ক দেখা দিলে সমাধানের জন্য চাষি দায়রা আদালতে যেতে পারবে। ভাবুন, দায়রা আদালতে গেলে কী হবে! যতকাল মামলার মীমাংসা না হবে, ততদিন ওই জমিতে চাষ বন্ধ থাকবে। তাহলে চাষি খাবে কী? সরকার এটা বুঝেও সংশোধনীর নামে ঘুরপথে আরেকটা এমন প্রস্তাব দিল যেটা গ্রহণ করা মানে নিজের শর্তেই নিজের মৃত্যুবরণ করা। জমি থেকে উৎপাটিত হতে হবে শুধু নয়, ঘটি মাটি যাবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পরিমাণ ও গুণমান অনুযায়ী ফসল না দিতে পারলে। আবার চুক্তিকারী কোম্পানি যদি নিজেই লাটে ওঠে, কম দাম ধরে দিয়ে বলে পরে মেটানো হবে, তখন চাষি কোথায় যাবে? সমস্যা এরকম আরও আছে নতুন আইনের ফাঁকে ফাঁকে। যেমন ধরা যাক, কেউ একজন বেসরকারি মান্ডিতে এসে তার ফসল বেচতে চাইল না। সে যদি সরকার নির্ধারিত দাম নিয়ে সরকারি মান্ডিতে বিক্রি করতে চায় সেই দাম কখনই কর্পোরেটের স্বার্থে কর্পোরেট নির্ধারিত দামের চাইতে বেশি হবে না। তা যদি কখনও হয়ে পড়ে, তাহলে মাথা নিচু করতে হবে রাষ্ট্রকে। এরই নাম কি উন্নয়ন? তাহলে এই উন্নয়নের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য একটাই- আম্বানি আদানিদের মতো দেশিয় পুঁজি বা অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট'এর মতো খুচরো ব্যবসায় বৃহত্তম দুই আগ্রাসী আন্তর্জাতিক পুঁজির হাতে এ দেশের কৃষকরা মশা-মাছির মতো মারা যাবে। চাষিরা এটা বুঝে গেছে। তাই তারা আর এই সরকারকে বিশ্বাস করতে চায় না।

কিন্তু বিশ্বাস করা না করার চাইতে বড় কথা কৃষকদের নিজেদের শক্তি। এই আন্দোলন সারা দেশে যত ছড়িয়ে পড়বে, বিভিন্ন রাজ্যের কৃষক এসে মিলিত হবে, এই আন্দোলন তত সর্বব্যাপ্ত হবে এবং একটি জাতীয় শক্তি হিসেবে এই দেশকে কর্পোরেট খাদ্য বানিয়ে তোলার খুল্লাম খুল্লা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কারের জোরালো বিরোধী স্বর হিসেবে দেখা দেবে। কৃষক সমাজের এই লড়াই তাই বাঁচার লড়াই। শুধু তাই নয়। মজুরি আইন বদলের সাথে চুক্তি চাষের আইন জুড়ে দিলে যে কী সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া খুচরো বাজারে পড়তে পারে, তা একবার যদি কেউ বিশ্লেষণ করে দেখে তাহলে দেখা যাবে, শুধু কৃষক বা খুচরো ব্যবসায়ী দোকানদার নয়, এই আইনের ফলে প্রতিটা মানুষ আক্ষরিক অর্থে প্রতিদিন বেশি গুনাগার দিয়ে জিনিস কিনে নিজের সঞ্চয় কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে। চুক্তি চাষে যদি দেখা যায়, খাদ্যশস্য ফলানোর চাইতে রেশম গুটি চাষ করা অনেক বেশি লাভজনক, তখন খাদ্যশস্যের জোগান বাজারে কমে যাবে। ফলে, দাম বাড়তে থাকবে বাজারে। 

তাই এই লড়াই শুধু কৃষকের নয়। কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের। এখনও যদি মানুষ সেটা না বুঝে নিজেকে দূরে দূরে রাখে তাহলে এই মোদি সরকার সুকৌশলে আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরে কৃষকদের রাস্তার ঠান্ডায় দম ফুরিয়ে ফেলানোর অপেক্ষায় থাকবে। তাই কৃষকরা যতই 'ইয়েস অর নো' বলে মন্ত্রীর মুখের সামনে প্ল্যাকার্ড ধরুক, এবার তাদের লড়াই তাদের নিজেদের সঙ্গে। সামন্ততন্ত্রের শক্তি দিয়ে কি আর কর্পোরেট দৈত্যকে প্রতিহত করতে পারা যায়? সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে গেলে তাই সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিতে হবে এই লড়াইয়ে। কৃষক শ্রমিক ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। না হলে, এ দেশের ফসল বিদেশে রফতানি করেই হোক বা লাগামহীন মজুতদারি করে, পুড়তে হবে আপামর জনগণকে। এটা অবশ্যম্ভাবী। তাই এখনই সর্বস্তরের কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমবেদনা নয়, সর্বস্তরে সদর্থক সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।

4 comments:

  1. শ্রমিক কৃষক আর সাধারণ মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে পারে একটি পার্টি।কমিউনিস্ট পার্টি। কোথায় সেই পার্টি ?তাই স্বপ্ন আছে থাকবে।কিন্তু ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন?জানিনা সেই স্বপ্ন সফল হবে কি না

    ReplyDelete
  2. আশা আছে। বড়লোকেরদের দিয়ে নয়, যদি কিছু হয় তবে এই চাষা-ভূষা,শ্রমিকদের দিয়েই হবে।

    ReplyDelete
  3. কৃষি যৌথ তালিকা অন্তর্ভুক্ত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. '14.2.01 In the Constitution, ‘Agriculture’ has been placed as Entry 14 in the State List along with several ancillary matters, while some agriculture-related items have been included in the Union List and the Concurrent List.'
      - Chapter XIV, Agriculture; www.interstatecouncil.nic.in

      Delete