Tuesday 1 December 2020

দেশ যখন বিপন্ন

কৃষি ও কৃষক বনাম সরকার ও কর্পোরেট

সোমনাথ গুহ


রাজধানী দিল্লির চারপাশ এখন এক আন্তর্জাতিক সীমান্তের রূপ নিয়েছে। হাজারো কৃষক শহরের বাইরে অপেক্ষায়। রাজধানীতে ঢোকার প্রবেশপথ ব্যারিকেড করে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হরিয়ানা সরকারের যাবতীয় দমনমূলক পদক্ষেপ-- জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, ব্যারিকেড, কাঁটাতার, পুলিশি নিপীড়ন, হাইওয়ের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে ট্র্যাফিক জ্যাম করা-- কোনও কিছুই কিষাণদের দিল্লি অভিযান বন্ধ করতে পারেনি। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকদের কাছে এ এক মরণপণ লড়াই। কয়েক দশক ধরে কৃষিতে আয় ক্রমাগত নিম্নমুখি সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে প্রণয়ন করা তিনটি নতুন কৃষি আইন এই সংকটকে আরও ঘনীভুত করেছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতীয় কৃষিতে ক্রয়বিক্রয়, বিলিবন্টন এবং সামগ্রিক পরিকাঠামোয় অনেক গলদ ছিল কিন্তু সেটাকে সংস্কারের নামে পুরো ব্যবস্থাটাই বাতিল করে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বিপুল, বিশাল কৃষিক্ষেত্রকে বাজার ও কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া মনস্থ করেছে।

বাস্তবে এই তিনটি কৃষি আইন শুধু কৃষিজীবী নয় সমগ্র সমাজের জন্য অতি বিপজ্জনক। একটি আইনে বলা হচ্ছে ‘এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেটিং কমিটি’ (APMC) চালিত যে কয়েক হাজার মান্ডি ছিল সেগুলি ব্যতিত রাজ্যের মধ্যে বা বাইরে সর্বত্র কৃষক ফসল বিক্রি করতে পারবেসরকারের যুক্তি, এর ফলে একজন কৃষককে নিকটবর্তী মান্ডিতেই যেতে হবে এরকম কোনও বাধ্যবাধকতা থাকবে নাতিনি স্বাধীন, তাঁর পছন্দমতো যে কোনও জায়গায় তিনি ফসল বিক্রি করতে পারবেনদ্বিতীয় যুক্তি, ফড়েদের দাপট থেকে চাষিরা মুক্তি পাবেনএছাড়া প্রধানমন্ত্রী বলছেন, সারা দেশই এখন একটা মান্ডি হয়ে যাবে- এক দেশ, এক মান্ডি। 

কৃষকদের বক্তব্য, ১৯৭৬ সাল থেকেই চাষিরা ভৌগোলিক বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত, বিজেপি সরকার নতুন কিছু করেনি এই বিধিনিষেধ বাতিল করার লক্ষ্যে ঐ বছর ব্যাপক আন্দোলন হয় যা আদালত অবধি গড়ায়। নভেম্বর মাসে হাইকোর্ট রায় দেয় যে দেশের যে কোনও অঞ্চলে কৃষক তাঁর ফসল বিক্রি করতে পারেন, সরকার তাঁকে বাধা দিতে পারে না। পাঞ্জাবের চাষিরা ফড়ে বা ‘বিচোরিয়া’র অস্তিত্ব স্বীকার করছেন। কিন্তু তাঁরা বলছেন, এঁরা পরিষেবা প্রদানকারী (service provider), যাঁরা চাষিকে ট্র্যাকটারে ফসল তুলতে, নামাতে, গাড়ি পরিষ্কার করতে, মান্ডিতে দরাদরি ইত্যাদি বহুবিধ ভাবে সাহায্য করে। এই পরিষেবা প্রদান করতে তাঁরা পারিশ্রমিক নেন, যেটা অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি। একই সাথে এটা অনস্বীকার্য যে ফড়েদের দৌরাত্ম্য আছে। চাষিদের নানা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা তাঁদের নিম্নমূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করেনভালো দাম পাওয়ার জন্য ছোট, মধ্য চাষি ফড়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই চাষি আর ফড়ের মধ্যে একটা টানাপোড়েনের সম্পর্ক তৈরি হয়। ফড়ে তাঁকে বঞ্চিত করছে এটা জানা সত্ত্বেও চাষি চায় না যে তাঁর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হোক। কৃষি বাজার কর্পোরেটদের হাতে চলে গেলেও ফড়ে থাকবে কারণ এটা ভাবাই যায় না যে একজন ছোট চাষি দূরদূরান্তের একটি গ্রাম থেকে কোম্পানির ঝাঁ চকচকে অফিসে নিজে ফসল বিক্রি করতে যাবেন। তখন হয়তো ফড়ের নামকরণ হবে এজেন্ট যে চাষির ঘরে গিয়ে তাঁর ফসল কিনে নেবে। সরাসরি বিক্রি করতে পারলে চাষি হয়তো পেতেন ১৫০০ টাকা, এজেন্টকে দিলে পাবেন ১২০০ টাকা। ফড়ে/এজেন্ট আগেও ছিল, নতুন ব্যবস্থাতেও থাকবে। ফড়েরাজ তুলে দিলাম এটা বুক ঠুকে না বলে এই ব্যবস্থাটাকেই কৃষকের পক্ষে কী করে আরও সহায়ক করে তোলা যায় সেটা ভাবতে হবে, পুরোটাই বাতিল করে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। আর ‘এক দেশ এক মান্ডি’র জায়গায় এখন তৈরি হবে ‘এক দেশ দুই মান্ডি’। দ্বিতীয়টি হবে কর্পোরেট চালিত, যা তাদের বিশাল ধনরাশির জোর, বিপুল প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুরো কৃষি বাজার দখল নিয়ে নেবে; সরকারি মান্ডিগুলি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে, যেভাবে বেসরকারি প্রতিদ্বন্দ্বীদের একচেটিয়া সুবিধা, সরকারি আনুকূল্যের ফলে বিএসএনএল, এয়ার ইন্ডিয়া প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মান্ডি ব্যবস্থা গুরুত্বহীন হয়ে পড়লে এফসিআই'এর গুদামে আর শস্য উপচে পড়বে না, রেশন ব্যবস্থা, মিড-ডে-মিল বিঘ্নিত হবে, খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। অদূর ভবিষ্যতে ভারত হয়তো একটি খাদ্য আমদানিকারি দেশে পরিণত হবে। তাই আবারও বলা দরকার, এটা শুধুমাত্র কৃষকের সমস্যা নয়, সমগ্র সমাজের সমস্যা।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যর (এমএসপি) ওপর স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট গত ২০০৬ সাল থেকে সংসদে পড়ে আছে। এতে প্রস্তাব আছে যে ফসল উৎপাদনের খরচের ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করে এমএসপি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। গত চোদ্দ বছরে কোনও সরকারই এটি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি, এদিকে ইউএপিএ'র মতো দানবীয় আইন কয়েক মিনিটে সংসদে পাস হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলেই তারা কমিটির সুপারিশ কার্যকর করবে। ২০১৫ সালে তারা বলল, খরচার ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করলে তা বাজার দরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। সেই ক্ষতিকর প্রভাবটি যে কী তার কোনও ব্যাখ্যা নেই২০১৬তে কৃষিমন্ত্রী সরাসরি অস্বীকার করেন যে এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ২০১৮ সালে এমনটাও দাবি করা হয় যে সুপারিশ কার্যকর করা হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ২০১৭র অক্টোবরে মধ্যপ্রদেশের চাষিরা এমএসপির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করলেন। মন্দাসোরে পাঁচজন কৃষক পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন। চাষিদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে এমপি সরকার ‘ভাবান্তর ভারপাই যোজনা’ নামক একটা স্কিম আনল যাতে চাষি যে দামে ফসল বিক্রি করছেন তার সাথে এমএসপি'র যা ফারাক সেই টাকাটা সরকার চাষিকে দিয়ে দেবে। কেন্দ্রীয় সরকার স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্টের পরিবর্তে এই যোজনার গুণগান শুরু করল। কয়েক মাস বাদেই নাসিক থেকে মুম্বাই সেই বিখ্যাত পদযাত্রা দেশ প্রত্যক্ষ করল যখন মুম্বাই শহরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ-- চিকিৎসক, আইনজীবী, ছাত্র-যুব-- কৃষকদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ালসেখানেও এমএসপি কার্যকর করা ছিল অন্যতম দাবি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এমএসপি নিয়ে কৃষক সমাজ বারবার সরব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন এমএসপি থাকবে, কিন্তু আইনে কোথাও তার উল্লেখ নেই। কৃষকদের ন্যায্য দাবি এমএসপি যে থাকবে এটা আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে।

একটি সংবাদপত্র লিখছে যে চতুর্থ একটি আইন করে দাও যাতে এমএসপি যে বহাল থাকবে এটা নির্দিষ্ট ভাবে বলে দেওয়া হবে, এতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেনা, শুধুমাত্র এটুকুতেই যদি আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকে সেটা মস্ত ভুল হবে। কৃষি রাজ্য ও কেন্দ্রের সম্পর্কে যৌথ তালিকায় পড়ে। রাজ্য সরকারগুলির সাথে কোনওরকম আলোচনা না করেই বিজেপি সরকার এই আইন প্রণয়ন করে ফেডারাল ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। এদের সাথে কোনও আলোচনা না করে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন তারা বাতিল করেছে। ২৩টা পণ্যের দাম (চাল, ডাল, গম, দানাশস্য, ভোজ্য তেল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি) এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত যার অন্যথা হলে রাজ্য সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারত। এখন সরকার নিজেই ব্যবসায়ীদের বলে দিচ্ছে যে তারা ৫০ শতাংশ অবধি দাম বাড়াতে পারে, সরকার কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। এর অর্থ, সরকার ব্যবসায়ীদের অনুকূলে আইন প্রণয়ন করছে। আমরা অধিক মূল্যে আলু পেঁয়াজ কিনতেই থাকব যতদিন না তার যা মূল্য হওয়া উচিত তার ৫০ শতাংশ তা না বাড়ছে।

এই আইনের ফলে চুক্তি চাষ মান্যতা পেল। যে চাষি কয়েক পুরুষ ধরে জমিতে ধান চাষ করতেন তিনি এখন কোনও ধনকুবেরের উস্কানিতে লোভে পড়ে তামাক চাষে নেমে পড়বেন। প্রথম কয়েক বছর তাঁর তিন চার গুণ লাভ হতে থাকবেচাষি বেজায় খুশি হবেন, সংসার দিনে দিনে সচ্ছল হবেএক দশক বাদেই দেখা যাবে ফলন ক্রমশ কম হচ্ছে, যথেচ্ছ সার, কীটনাশক দিয়েও উর্বরতা বাড়ানো যাচ্ছে না। সবুজ বিপ্লবের খোয়াব কেটে যাওয়ার পর পরবর্তী কয়েক দশকে এইরকম বহু উদাহরণ দেখা গেছে এবং এখনও দেখা যাচ্ছে। সেই কুফলের কারণে ভারতের কৃষি এখনও ধুঁকছে। পরম্পরাগত চাষ থেকে বিচ্যুত হয়ে অর্থকরী ফসলে ঝুঁকে পড়ার কারণে বহু জায়গায় কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে, পরিবেশের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। নতুন শস্য চাষ করার ফলে জলসংকট দেখা গেছে, মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চল তুলা চাষের কারণে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, বহু কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। চাষের উপকরণের প্রায় সব কিছুই বহুজাতিক সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এটা আশ্চর্য হওয়ার কিছু নয় যে চাষের খরচ গত এক দশকে ৩০০ শতাংশ থেকে ৫০০ শতাংশ বেড়ে গেছে, কৃষি অলাভজনক হয়ে পড়েছে। চাষি চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে বা ঋণগ্রস্ত হওয়ার ফলে তুলো বা সয়াবিন ছেড়ে অন্য কোনও শস্য চাষে সরতে পারছে না। এর ফলে গ্রাম শহর থেকে ব্যাপক মানুষ পুনে, মুম্বাই এবং অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিচ্ছে। সমাজ, পরিবার ভেঙে পড়ছে।

এটাই তো লক্ষ্য! কৃষিকে অলাভজনক করে দাও যাতে তারা অন্য পেশায় চলে যায়। কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষ কমিয়ে আনো যাতে পুরো কৃষিব্যবস্থা কর্পোরেটদের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে অন্য পেশা আর কোথায়? তাই অনিবার্যভাবে দরিদ্র থেকে সচ্ছল, সব ধরনের কৃষক এই ব্যবস্থায় গ্রাম-শহরে বিশাল বিপুল বাইবেলিয় এক অদৃশ্যপ্রায় মজুর বাহিনী হয়ে বিচরণ করবে।  


3 comments:

  1. অন্য পেশা নেই বলে কৃষি তে বেশি লোক থাকবে এই যুক্তি গ্রহণীয় নয়।কৃষকের কাছে চাষবাস লাবজনক হোক , MSP সঠিক হারে বাড়ুক।কিন্তু কৃষি থেকে বাড়তি শ্রমের বোঝা কমানো দরকার

    ReplyDelete
  2. সল্পপরিসরে লেখাটায় সামগ্রিক ভাবে একটা আউটলাইন পাওয়া গেছে। ভালো! সরকার যেখানে সোশাল ওয়েলফয়ার স্টেট কে পুরোমাত্রায় জলাঞ্জলি দিয়ে সবকিছুতে মায় ডিফেন্স সেক্টরেও প্রাইভেটাইজেশন এর পথে হাঁটছে সেইখানে দাড়িয়ে নয়া কৃষিনীতি একটা অংশমাত্র!

    ReplyDelete
  3. সবকিছু গুলিয়ে দিতে পারলে, আখেরে লাভ এই কর্পোরেটদের!

    ReplyDelete