Tuesday 22 December 2020

সার্বিক পরিবেশ সমস্যা

সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন

বিধান চন্দ্র পাল

এই বছর (২০২০) মে মাসে বাংলাদেশে গত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হেনেছিল। তাতে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। এরপর জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় দেশের ইতিহাসের অন্যতম বন্যা। বন্যায় দেশের অর্ধেকের বেশি জেলা সমূহ প্লাবিত হয় এবং লাখ লাখ লোক দীর্ঘ সময় (দেড় মাসেরও বেশি) ধরে পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটায়। সেই বন্যা চলাকালেই আবার মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সাগরে অস্বাভাবিক জোয়ারের সৃষ্টি হয়। ফলে, উপকূলীয় জেলাগুলোতে জোয়ারের পানি গ্রাম ছাপিয়ে শহরের অলি-গলি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যায়। এটা সুস্পষ্ট যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে। আগে কিন্তু অনেক বছর পর পর বন্যা হত এখন তা প্রায় প্রত্যেক বছরই লক্ষ করা যাচ্ছে। এছাড়া বন্যা দীর্ঘায়িত হতেও আমরা দেখছি। যা মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে এবং একইসাথে একটি দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। এ সকল পরিবর্তন যে হঠাৎ করেই হচ্ছে তা নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মক ভাবে বিনষ্ট হওয়ার ফলশ্রুতিতেই এগুলো ঘটছে বলেই বিজ্ঞানীদের অভিমত। শুধু তাই নয়, এ সব সমস্যা ক্রমেই আরও জটিল ও ভয়াবহ হচ্ছে।

ধারণা করা হয়ে থাকে যে, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে অবমাননা করার ফলে পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হবে কিংবা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কারণ, একদিকে বাংলাদেশের ওপর রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের বিশেষত শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিশেষ প্রভাব, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরেও রয়েছে জনসংখ্যার আধিক্য, মানুষের ভোগের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, সচেতনতার অভাব ইত্যাদি সমস্যা। যা প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রাখছে। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দেন-দরবার করার পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবন্ধ করাও আমাদের জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাকৃতিক পরিবেশের বিষয়টি আজ সারা পৃথিবী জুড়েই সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত একটি বিষয়। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশের গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, আবার অন্যদিকে শীতকালে ক্রমান্বয়ে তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে, ঢাকা সহ অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির অভাব দেখা দিচ্ছে, বিজ্ঞানীদের নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনে জলবায়ু সম্পর্কযুক্ত দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, বজ্রপাত ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছরই প্রাণ দিতে হচ্ছে শত শত মানুষকে। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে হাজারো পরিবার। বিনষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা যেন ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বাড়তে পারে বলেই অনেক পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি আমারও আশঙ্কা হয়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, একসময় প্রাকৃতিক পরিবেশে যে সকল পরিবর্তন লক্ষ করা যেত সেগুলো প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটত। মানুষের ক্রিয়ার ফল ছিল নিতান্তই নগণ্য। কিন্তু এখন পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালের ১৭ জুন প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৭০ কোটি। আগামী ৩০ বছরে আরও ২০০ কোটি যোগ হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে মোট জনসংখ্যা হবে ৯৭০ কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৪ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৩৮ লাখ এবং নারী ৮ কোটি ৩৬ লাখ। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেন যে, পৃথিবীর যা সম্পদ রয়েছে তা সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি মানুষের জন্য যথাযথ।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে খাদ্যের অভাব একসময় পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল। অন্যদিকে জনসংখ্যা তাড়াতাড়ি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে কৃষি বিপ্লব। বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে সব মানুষের খাদ্যের সংস্থান তেমন একটা সমস্যা নয়। তবে সমস্যা হল বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যার ফলে অনেক সময়ই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য মজুদের অভাবে নষ্ট হবার কথা শোনা যায়।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, খাদ্যের অভাবগ্রস্থ মানুষদের কাছে যথাযথভাবে উদ্বৃত্ত খাদ্যও অনেক সময় পৌঁছয় না। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমশই বাড়ছে। সেই সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব, বিবাদ, জোরপূর্বক অভিবাসন ও প্রভাব বিস্তারের ফলে নতুন নতুন সমস্যারও সৃষ্টি হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রকৃতির ওপরও নানামুখি নির্যাতন বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা দুর্যোগও আমাদের ভেতরে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ও চিন্তার সৃষ্টি করেছে। ফলে সার্বিক বিবেচনায় ধীরে ধীরে জনসংখ্যা কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। কারণ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য দারুণভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে এই ভারসাম্য এমনভাবে বিঘ্নিত হয়েছে যে, তা প্রকৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত প্রদান করছে।

বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতি হল ‘মা’এর মতো। ‘মা’ তার সন্তানকে পূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে আগলে রাখেন। আবার সন্তান দৃর্বৃত্ত হলে, সীমাহীনভাবে অন্যায় শুরু করলে মা’য়ের পক্ষে তা সামলানো যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে প্রকৃতির এ সকল পরিবর্তন যদি কম মাত্রার হত তাহলে বোধহয় সে তার আপন নিয়মেই সব কিছু সামলে নিতে পারত। তাতে হয়তো খুব বেশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হত না। কিন্তু এখন প্রকৃতির প্রতি অন্যায়, অবিচারের এক মহোৎসব চলছে যেন প্রায় সবখানেই। যেমন: বন-জঙ্গল কমে যাবার বিষয়টি এখন আমরা একেবারেই চোখের সামনে লক্ষ করছি।

বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী বনভূমি ও বনজ সম্পদ দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, রোহিঙ্গাদের বসতির কথা। বসতি স্থাপনের কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ হাজার একর বনও। এছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে গত ২০১৯ সালের মার্চ মাসে বন বিভাগ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল।

শুধু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাই নয়, কোনও দেশের অর্থনীতিতে বনজ সম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এই সম্পদ এক অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারেই মোট বনভূমির পরিমাণ এখন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে প্রকৃত বনের পরিমাণ আরও কম। যেখানে ১৯৭১ সালে ১৮ ভাগের বেশি বনভূমি ছিল আমাদের, যা বৃদ্ধি তো দূরের কথা ক্রমেই আরও হ্রাস পাচ্ছে। প্রসঙ্গত একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে, এখন পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলায় কোনও রাষ্ট্রীয় বনভূমি গড়ে ওঠেনি। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের বনভূমির পুরোপুরি মূল্যায়ন করা ছাড়া কোনও বনভূমি ইজারা না দেওয়া এবং বেদখল হওয়া বনভূমি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে উদ্ধার করার জন্য সরকারের দিক থেকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ থাকাটা খুবই জরুরি হবে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় তার বিরূপ প্রভাব মানুষ, পশু-পাখি ও আবহাওয়ার ওপর পড়ছে। অন্যদিকে মানুষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি অনেকটা একইতালে কল-কারখানা বাড়ার ফলে পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানি (যেমন: কয়লা, তেল, গ্যাস ইত্যাদি) পোড়ানোর পরিমাণও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আর বেশি পরিমাণে জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে দুষণ খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ও তাপমাত্রা। এছাড়া ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন, সংশ্লেষী পণ্যের ব্যবহার (যেমন: তরল কার্বন ডাই অক্সাইড), নির্দিষ্ট জীবনধারা এবং ভোগের স্বভাব প্রাকৃতিক পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়াকে আরও তরান্বিত করছে।

প্রকৃতপক্ষে, আমাদের প্রকৃতিতে যদি ধীরে ধীরে পরিবর্তনগুলো ঘটত তাহলে গাছপালা, মানুষ, পশুপাখি সে সব পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিতে পারত। কিন্তু এসব পরিবর্তন বর্তমানে দ্রুতগতিতে ঘটার কারণে এগুলো ‘মেনে নেওয়া’ ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় থাকে না- ফলে বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেক নদী-নালা শুকিয়ে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি কাজের সেচের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক এ সকল পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির বিশেষত সুপেয় পানির অভাব ঘটবে এবং কৃষি কাজে সেচে মারাত্মক সমস্যা দেখা যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার কারণে নিম্ন সমভূমিগুলো বা সমুদ্রপিষ্ঠ থেকে উচ্চতা কম যে সব অঞ্চলে সেগুলো জলমগ্ন হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। উপরন্তু শুষ্ক মৌসুমে আর্দ্রতা বাড়ার ফলে বাড়বে খরার তীব্রতা ও হার। এ ধরনের সমস্যা বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত (এলডিসি) ও উন্নয়নশীল দেশেই যে শুধু দেখা দিচ্ছে তাই নয়, উন্নত দেশগুলিতেও দেখা দিচ্ছে। নানা দেশে সমস্যার ধরনে হয়তো কিছুটা বৈচিত্র্য এবং একটু বেশ-কম আছে। যেমন: সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা সহ বিভিন্ন উন্নত দেশে অস্বাভাবিক তুষার ঝড়, আকস্মিক বন্যা, জলোচ্ছ্বাস এবং তাপদহের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে। যদিও ওইসব দেশগুলোকেই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে।

যাই হোক, বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতিতে আর পরিবেশে যে সকল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, সেগুলো অনেকটাই মানুষের সৃষ্ট এবং যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এমন একটি সময় ছিল যখন- বিভিন্ন দুর্যোগের যেমন: সিডরের তীব্রতা কেন বাড়ল? বন্যায় বেশি এলাকা কেন প্লাবিত হচ্ছে? এ সকল বিষয় সাধারণ মানুষের জানার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টেছে, এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হচ্ছে। আজ তাই বিষয়টি সম্পর্কে সকলেরই গভীরভাবে উপলব্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে।

আমাদের দেশের আবহাওয়া বদলে যাবার খুব সহজ কারণ যদি খুঁজতে যাই তাহলে দেখতে পাব: বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য, বিশেষ করে ট্যানারি ও রাসায়নিক কারখানার বর্জ্য থেকে নদীর পানি প্রতিনিয়ত দুষিত হচ্ছে। ফলে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, কর্ণফুলি থেকে শুরু করে সারা দেশের নদীগুলো আজ ভয়ংকর রকমের দুষণের শিকার। ইটের ভাটার ধোঁয়ায় অনেক গ্রামের বাতাস ও মাঠের মাটি দুষিত হচ্ছে। এছাড়া অনুন্নত যানবাহন ও অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার দরুণ ঢাকার বাতাসে প্রতিনিয়ত দুষণ বাড়ছে, সেই সাথে যানবাহনের হর্ন ও মাইকের বিকট শব্দের কারণে শব্দদুষণও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নিষিদ্ধ পলিথিন পচনশীল নয়, তাই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ফলে যত্রতত্র ফেলে দেওয়ায় ড্রেন, ম্যানহোল বন্ধ হয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন ভাবে পরিবেশকে দুষিত করছে, চাষাবাদের ক্ষেত্রে সাময়িক ফলন বাড়ানোর তাগিদে জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার এবং সেইসাথে রয়েছে কৃত্রিম কীটনাশকের ব্যাপক প্রয়োগ। এই বিষাক্ত কীটনাশকের ফলে ভূমি ও খাল-বিল-নদীর পানি মারাত্মকভাবে দুষিত হচ্ছে। এছাড়া মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে গাছপালা কেটে ফেলা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাওয়া দেশের আবহাওয়া বদলে যাবার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রাখছে বলেই অনেকের ধারণা। প্রকৃতির অকৃপণ দান যেন মানুষ দু’ হাত ভরে লুট করে নিচ্ছে আর ফলশ্রুতিতে প্রকৃতিও রিক্ত ও বিকৃত হয়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে।

যাই হোক, আমি পূর্বেই বলেছি যে, এ সকল সমস্যা ধীরে ধীরে আরও বাড়ছে। ফলে, এসব সমস্যার সমাধানের কথা সবাই মিলে ভাবতে হবে। জানতে হবে ও জানাতে হবে সবাইকে। একইসাথে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে পৃথিবীব্যাপী একযোগে। দূষক ও দূষণ সংক্রান্ত সমস্যা আজ একটি ট্রান্স বাউন্ডারি সমস্যা- অর্থাৎ, আজ এটি কোনও দেশের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নেই। কাজেই সারা পৃথিবীর মানুষকে এ সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

আমরা দেখতে পাই, দেশের যে কোনও সংকটের মুহূর্তে তরুণ-তরুণীরাই এগিয়ে গেছে সর্বাগ্রে, রচনা করেছে রক্তিম ইতিহাস। তাই আজ সময় এসেছে ‘প্রকৃতির বন্ধু’ খুঁজে বের করার, অর্থাৎ মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবার। এছাড়া গ্রাম থেকে শহরে সকলকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষেত্রে সৃষ্ট পরিবর্তন ও করণীয় সম্পর্কে জানাবার। এ ক্ষেত্রে সারা বছর ও দেশব্যাপী একটি ক্যাম্পেইন পরিচালিত হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে কেবল তরুণ-তরুণীরাই পারে এগিয়ে এসে, দায়িত্ব নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে।

প্রকৃতির ক্ষতি করে সুন্দর জীবনধারণ কখনই সম্ভব নয়। তাই সার্বিক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে, পরিবেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করার ক্ষেত্রে ও সারা বিশ্বব্যাপী গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি সকলকে জানাতে মিডিয়াকে আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সংগঠন সমূহকে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব সহ সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে- সম্পদ হিসেবে পরিবেশকে যে কোনও মূল্যে রক্ষা করার জন্য। একইসাথে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বিষয়টির প্রতি আরও গুরুত্ব দিতে হবে।


No comments:

Post a Comment