Thursday 3 December 2020

ভোটের বাজার

জীবন-জীবিকার লড়াই’ই মূল কথা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

এ কথা বারবার বলার চেষ্টা করেছি, আমরা এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। পুরনো জমানার বহু কিছুকে পিছনে ফেলে আমরা এমন এক দুর্লভ ও নতুন জগতে প্রবেশ করছি যেখানে পদে পদে বিস্ময় আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তা যেমন আমাদের কর্মজগতে, তেমনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিসরেও।

এই মুহূর্তে আমাদের দেশে এক বিপুল সংখ্যক কৃষক দিল্লির চারপাশে অবরোধ তুলে দণ্ডায়মান। এই অবরোধের সামনে সরকার আপাতত ভীত ও বিব্রত। কারণ, করোনার সুযোগে দিল্লিশ্বর যে তিনটি কৃষি বিলকে তাড়াহুড়োয় আইনে পরিণত করেছে, আশঙ্কা, তার জন্য তাকে কঠিন মূল্য চুকোতে হবে। কৃষকেরা লম্বা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে সমবেত হয়েছেন। এ এক অনন্য নজির। এরই পাশাপাশি আগামী বছর বাংলা ও অসমে নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়ে গেছে তোড়জোড়। এখন পর্যন্ত যতটা না এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণজনের মধ্যে হৈচৈ দেখছি, ঠিক ততটাই মিডিয়াগুলি একেবারে সাজোসাজো রব শুরু করে দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ বোধহয়, শকিং নিউজ তৈরি না করতে পারলে আজকাল বাজারে কদর ও বাণিজ্য দুইই রসাতলে; পাশেই দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়া- যাদের দাপটে ও বহরে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ক্রমেই সংকুচিত। জনমত নির্মাণ ও তার হদিশ পাওয়ার রীতিনীতিই গেছে আমূল বদলে।

যখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া দিল্লির বুকে কৃষক আন্দোলন নিয়ে ততটা উচ্চকিত ছিল না, বরং তার মধ্যে নানাবিধ ছিদ্র অন্বেষণে সদা ব্যগ্র, তখন সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে কৃষক জনতার আওয়াজ সারা দেশে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ফলে, এখন উপায়ন্তর না পেয়ে বড় মিডিয়াও কিছু কিছু বাস্তবতা দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। সচেতন কৃষক জানেন এই বড় মিডিয়ার (তাঁদের ভাষায় ‘গোদি মিডিয়া’) পক্ষপাতদুষ্টতা ও কর্পোরেট হাউজের কাছে তাদের বাঁধা থাকার কথা, তাই কোনও কোনও মিডিয়াকে কোনওরকম বাইট দিতেও তাঁরা অপারগ। কিছু ক্ষেত্রে তো তাঁদের ‘গোদি মিডিয়া দূর হঠো’ বলে তাড়িয়ে দিতেও দেখা গেল। এই সবটা মিলিয়ে আগত কনকনে শীতে উত্তর ভারত এখন কৃষক অভ্যুত্থানের কলরবে সরগরম।

সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যখন এক সাংঘাতিক রাজনৈতিক আগ্রাসনে দেশিয় স্তরে বিরোধী রাজনীতির স্বর ক্রমেই বিলীয়মান ও কংগ্রেস নামক তথাকথিত জাতীয় দলটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত, তখন কিছু কিছু রাজ্যে অবশ্য নতুন মুদ্দা নিয়ে উঠে আসা কোনও কোনও শক্তি আশার আলো জাগাচ্ছে। যেমন, গত বিহার নির্বাচনে আমরা বলিষ্ঠ কিছু অন্যতর উদ্যোগ ও সফলতা প্রত্যক্ষ করলাম। তা ব্যতিরেকে কৃষকদের এই মহাজাগরণ এক নতুন রাজনৈতিক অভিঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কথাই ছিল, যদি শ্রমজীবী মানুষ সংগ্রামের ময়দানে অবতীর্ণ না হন তাহলে কোনও পরিবর্তনই সার্থক হতে পারে না। শুধু পরিবর্তন বা সার্থকতা বলি কেন, বলা ভাল, কোনও সদর্থক অভিমুখ বা অর্থপূর্ণ আলোড়নও তৈরি হয় না।

এই আবহেই এ রাজ্যে আগামী ছ’ মাসের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে এক বাড়াবাড়ি রকমের সোরগোল পড়ে গেছে। সোরগোলটা যতটা না রাজনৈতিক দলগুলি ও তাদের অনুগামী এবং মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মধ্যে ততটা আমজনতার মধ্যে এখনও নয়। তার কারণও আছে। ‘চালাকচতুর’ বা ‘সেয়ানা’ পদবাচ্যটি এখন অনেকেই জনসাধারণের মতিগতি বোঝাতে আকছার ব্যবহার করে ফেলেন। তা মন্দ করেন না। এটা বাস্তব, দশ ঘাটের জল খেয়ে আমার-আপনার মতো নিতান্তই সাধারণ মানুষেরা রাজনৈতিক দলগুলিকে পালটা ব্যবহারের কৌশলও বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসে, ততই যেন রাজনৈতিক দলগুলির আশঙ্কা ও টেনশন বাড়ে এবং সেই সুযোগে জনতাও একটা বাড়তি (মেকি হলেও) কদর পেতে থাকেন। এই রীতি এখন বেশ উপভোগ্য একটি ঘরানা হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। আর তাই, ভাবেসাবে মনে হবে, জনতার যেন নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা নেই আপাতত। হয়তো মাথাব্যথা আছে, কিন্তু তার প্রকাশ নেই তেমন। কারণ, আগেভাগে পক্ষপাতিত্ব বুঝিয়ে দিলে দরকষাকষির জোরটা কমে আসে যে! তাই নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই জনতা আরও নীরব (যা আসলে সরবতার ভাষা) ও ‘সেয়ানা’ হয়ে উঠবেন। ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় এই রেওয়াজটি এখন বেশ পরিপক্ক।

অতএব, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে জনগণ খুব মোহগ্রস্ত হয়ে বা ভুল বুঝে নির্বাচনী যুদ্ধে আজকাল এমন এক রাজনৈতিক শক্তির পক্ষ নিচ্ছে যা অতি-বিপর্যয়ের সমার্থক। রাজনৈতিক শক্তি চয়নের প্রশ্নে জনগণ অতীব সজাগ এবং যা হচ্ছে, আমি অন্তত তার মধ্যে জনগণের দিক থেকে তেমন কোনও মূঢ়তার চিহ্ন দেখি না। অবশ্য, এই চয়নের মধ্য দিয়ে যে ভয়ঙ্কর বিপদ ও পশ্চাদপদতার রাজনীতি ও অর্থনীতি ক্রমেই জীবন-জীবিকার অঙ্গনকে চেপে ধরছে, সে কথাও ধীরে ধীরে জনগণ বুঝছেন। কিন্তু এমন এক চয়নে তাঁরা প্ররোচিত হয়েছেন মূলত দুটি কারণে: ১) পুরনো জমানার তথাকথিত উদারবাদের কালে মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার শর্তগুলি এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল যে অন্য এক পথ, মত বা রাজনৈতিক আধারকে চয়ন করার এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছিল; ২) রক্ষণশীল শক্তির উত্থাপিত নতুন বিচার-বিশ্লেষণগুলি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে স্পর্শ করেছিল। এই দুই মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের অন্যত্র বিপজ্জনক রক্ষণশীলেরা ও এ দেশে হিন্দুত্ববাদী শক্তি একটা বড় পরিসর জুড়ে ক্ষমতাকে বিস্তৃত করতে পেরেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই ক্ষমতা অটুট ও স্থায়ী। ইতিমধ্যেই তার জানান পাওয়া যাচ্ছে এবং অবস্থা ও পরিস্থিতির নিরিখে মানুষও উপযুক্ত জবাব দিচ্ছেন। আদপে বিষয়টি নির্ভর করছে- আপাত ভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে এবং জনতার চাপে ও তার প্রতি দায়বদ্ধতার গুরুত্ব বুঝে এমন কোনও রাজনৈতিক শক্তি যদি নিজেকে ইতিবাচক অর্থে তুলে ধরতে পারে তাহলে তার দিকে চয়নের অভিমুখ অবশ্যই ঘুরছে। এটাই তো গণতন্ত্রের বনিয়াদ, সে যত আংশিকই হোক না কেন! অর্থাৎ, ইভিএমে কারচুপি বা জনতার নির্বুদ্ধিতা- এইসবকে কারণ না ভেবে নিজেদের গাফিলতি ও ভ্রান্তির দিকে তাকানোটাই প্রাজ্ঞজনের কাজ। যদি কংগ্রেস মনে করে থাকে, তার সর্বোচ্চ নেতার নিছক কিছু ট্যুইটে জনতা আশ্বস্ত হয়ে তাদের দিকে ঝুঁকবে, তা শুধু রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক নয়, চরম আত্মঘাতী। আর সে আত্মঘাতের পরিচয় আমরা পাচ্ছিও। কথায় বলে, ‘চোরায় না শোনে ধর্মের বাণী’।

ফলত, পশ্চিমবঙ্গে আপাত যে আবহ তৈরি হয়েছে, সেখানে এই মুহূর্তে মিডিয়ার দাপাদাপি ও রাজনৈতিক দলগুলির অতি-সক্রিয়তা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। তারই এক অন্যতম অভিব্যক্তি ‘দুয়ারে প্রশাসন’ মারফত জনতার দরবারে পৌঁছনোর প্রয়াস। এ তো ভাল কথা। ভোটের ভয়ে যদি সরকারগুলি আরও বেশি বেশি সদর্থক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, সে তো মন্দের হলেও ভাল। গণতন্ত্রের পোয়াবারো। বিপরীত দিকে বিরোধী দলগুলিও অভাব-অভিযোগের কথা তুলে সরগরম। মিডিয়াও এই আবহের উত্তেজনা ধরতে, দেখা গেল, এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চাওয়া-পাওয়া, তাঁর দলবদলের টানাপোড়েন, এই আছি এই নেইয়ের অতি-নাটকীয়তায় একেবারে স্বপনকুমারের রহস্য-রোমাঞ্চের মশলা নিয়ে আসরে হাজির। হয়তো উপভোগ্যতার বিচারে তার কদর জুটছে, টিভিওয়ালাদের টিআরপি’ও উঠছে, কিন্তু জনতা আসলে কী ভাবছেন, তার নাগাল পাওয়া অত সহজ নয় আর। তাই কি এত নাচনকুদন!

কিন্তু জনতারও নানারকম ভাবনা আছে। সকলেই জানি, সবটা পেরিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে দল বা জোটকে ভোট দেবেন তাদেরই জয়। কোন মুদ্দাগুলি এবারে প্রধান হবে, কোন বিষয়গুলিকে মানুষ অগ্রাধিকারে রাখতে চাইবেন- রক্ষণশীলদের হিন্দু-মুসলমান বাইনারি নাকি উদারবাদী ও বামপন্থীদের অর্থনৈতিক-সামাজিক দাবি-দাওয়া- তা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নানান ওঠাপড়ার পর এ রাজ্যে দ্বন্দ্বটা আজ অনেকটা এসে দাঁড়িয়েছে দুই বিপরীত ধারণার মধ্যে: একদিকে গত ছ’ বছরে রক্ষণশীলদের শাসনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে জাতীয় বিপর্যয় আর অন্যদিকে বিরুদ্ধবাদী এখানকার স্থানীয় শক্তিগুলি কী সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে জমায়েত হওয়া কৃষকেরা অবিচারের বিপক্ষে যে দুর্দমনীয় প্রতিরোধের দেওয়াল তুলেছেন তা এক অন্য মৌলিক তাৎপর্যের দিকে ভারতীয় রাজনীতিকে আকর্ষিত করছে। ক্রমেই অর্থনৈতিক মুদ্দাগুলি আবারও আলোচনার প্রাণকেন্দ্রে ফিরে আসছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আন্দোলনগুলি আরও জোরদার হচ্ছে। এই সম্ভাবনাগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে যে সমস্ত চিন্তাবিদেরা (ডান-বাম যাই হোক) এখুনি এ রাজ্যে এ জোট সে জোটের আঙ্কিক বিশ্লেষণে মুখ গুঁজে আছেন ও হঠাৎ হঠাৎ নানারকম নিদান হাঁকছেন, তাঁদের দিনও সমাগত প্রায়। কারণ, জনতা নানাবিধ জোটের ম্যাজিকে ভরসা রাখছেন না, খুঁজছেন নিজেদের রুটি, রুজি ও আশ্রয়ের বাস্তবস্থল। এই পরিসরেই এবারে রাজনৈতিক দলগুলিকে নিদারুণ পরীক্ষা দিতে হবে।    

1 comment: