Tuesday 12 January 2021

প্রতিপক্ষ যখন দুষ্ট ক্ষত

সজাগ থাকার সময়

প্রবুদ্ধ বাগচী

 


নতুন ইংরেজি বছরের সব থেকে বড় স্বস্তির খবর কোভিডের টিকা। এর পেছনে রয়েছে সারা দেশ ও দুনিয়ার বিজ্ঞানীদের মেধা ও নিবিড় গবেষণা যা একটা ঘরবন্দী বছরের শেষে আমাদের সবার মনেই কিঞ্চিৎ খুশির ছোঁয়া এনে দিচ্ছে। যদিও জানি না, সবাইকে টিকা দেওয়ার প্রশ্নে সরকার সদয় হবেন কি না, সেই বিষয়ে এখনও আলো-আঁধারি। জানি না হালের রীতি মেনে টিকার দাম বাজারের ওঠাপড়ার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে কি না। আর কীভাবেই বা এত বড় দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া যাবে প্রতিষেধক, কাজটা ভোট করানোর থেকেও কঠিন। আর এও জানি না, বিহারের ভোটের সময় যেমন টিকা চলে এসেছিল নির্বাচনী রাজনীতির উঠোনে, এবার তেমন কিছু ঘটবে কি না । কারণ, এই বছর শুধু কোভিডের টিকা দেওয়ার বছরই নয়, পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনেরও বছর। আর আমাদের রাজ্যে তার উত্তাপ ইতিমধ্যে এতটাই যে প্রথাগত পৌষের শীতে হাল্কা করে ফ্যানের হাওয়াও মিঠে লাগতে আরম্ভ করেছে। 

হ্যাঁ, টিকা নিয়ে কিছু সমস্যা আছে, সেটা বৈজ্ঞানিক নয় অবশ্যই। আর সেটা বুঝে নেওয়ার জন্য একটু পেছন ফিরে তাকানো দরকার। ১৯৯৫ সাল থেকে পোলিও দূর করার লক্ষ্যে পালস পোলিও টিকাকরণ শুরু হয়েছিল সারা দেশ জুড়ে। তার ব্যবস্থাপনা ছিল অতি সহজ। পাড়ায় পাড়ায় স্থানীয় বুথে স্বাস্থ্যকর্মীরা দু' ফোঁটা ড্রপ খাইয়ে দেবেন পাঁচ বছরের নীচে থাকা সব শিশুদের, একই দিনে । কিন্তু এই টিকা দেওয়া যখন শুরু হয় তখন সারা দেশে পোলিও রোগের ভয়াবহতা নিয়ে সচেতনতা ছিল বেশ কম। সময় মতো টিকা না খাওয়ালে যে সারা জীবনের মতো একটা শিশু শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যেতে পারে এবং একবার তা ঘটে গেলে আর তাকে সারিয়ে তোলার কোনও সম্ভাবনা থাকে না, এটা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানলেও সাধারণের মধ্যে সেই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ায় খামতি ছিল। এর প্রকাশ ঘটল প্রতিরোধে। টিকা দিতে গেলে একদল বাধা দিতে আরম্ভ করলেন, বাচ্চাকে আটকে রাখলেন ঘরের মধ্যে, নিজেরা উদ্যোগ করে বুথে এলেন না । 

শুনতে খারাপ লাগলেও এই প্রতিরোধ প্রধানত এসেছিল একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের কাছ থেকে। যদিও আর সবাই নির্বিবাদে এটা গ্রহণ করেছিলেন আদৌ তা নয়। অনেক জায়গায়, স্থানীয় সমস্যা, দাবি-দাওয়ার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছিল টিকা নেওয়া বা বয়কটের বিষয়টা। অনেকটা ভোটের মতো। শহরাঞ্চলের সম্পন্ন পরিবারগুলি সরকারি টিকাকর্মীদের তাদের বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না, বহুতলের মেন গেট বন্ধ করে রাখা হত, আজও হয়। কিন্তু দোষ বেশি পড়েছিল বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর। অবশ্যই বলা দরকার, শিক্ষা ও সচেতনতা, জনস্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আর্থ-সামাজিক ভাবেই চোখে পড়ার মতো পিছিয়ে। ফলে, বিভিন্ন এলাকায় এইসব মহল্লায় সুকৌশলে অপপ্রচার করা হয়েছিল যে পোলিও টিকা নিলে নাকি শিশুরা প্রজনন ক্ষমতা হারাবে। শিক্ষাহীন মানুষ সেইসব বিশ্বাস করেছিলেন। প্রতিরোধ এমন জায়গায় গিয়েছিল যে, স্থানীয় ধর্মগুরু মৌলবি, ইমামদের সঙ্গে সরকারিভাবে বৈঠক করে তাঁদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছিল। পাশাপাশি এটাও বলা দরকার, দশ-বারো বছর অক্লান্ত চেষ্টার পরে এই অনাস্থার বেড়া টপকানো গিয়েছিল। একটা সময় পালস পোলিওর দিন সকালে স্থানীয় মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা করে এলাকার সবাইকে টিকা নেওয়ার কথা বলা হত, এই ঘটনায় আমি নিজে সাক্ষী। মৌলবি সাহেব স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে গিয়ে বাড়ি বাড়ি টিকা খাওয়াচ্ছেন এই ঘটনাও আমি দেখেছি। সেইসব এখন ইতিহাস, দেশ আজ পোলিও মুক্ত। যদিও টিকাকরণ আজও চলছে। 

কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, কোভিডের টিকাকরণ অতটা সোজা ব্যাপার নয় যে দু' ফোঁটা ড্রপ খাইয়ে দিলেই চলবে। নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে হাতে সিরিঞ্জ দিয়ে টিকা ইঞ্জেকশন দিতে হবে। তারপর কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হল কি না দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আধ ঘণ্টা। যেটুকু খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে একজনের জন্য প্রায় চল্লিশ/পয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যাবে। এবং সাধারণভাবে ইঞ্জেকশন নেওয়ার ক্ষেত্রে আমজনতার যে ভয় থাকে (যা আসলে অমূলক) সেটা এখানে একটা ফ্যাক্টর। আর ওই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টাও, বিজ্ঞানসম্মতভাবে যাই হোক,  টিকা ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে সমস্যা। কারওর সামান্য কোনও সমস্যা দেখা দিলেও তা থেকে বড় গোলমাল বেঁধে যেতে পারে, তৈরি হতে পারে অবাঞ্ছিত অশান্তি। সরকার কী টিকা দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন এ নিয়ে বেশিরভাগ মানুষের কোনও ধারণা নেই। সকলেই খবরের কাগজ পড়েন না, টিভি চ্যানেল দেখেন না। কথাটা বলছি কেন? কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক্রমে শিশুদের জন্য একটি মিজলস (হাম)'এর টিকা সারা রাজ্যে (সম্ভবত সারা দেশেই) প্রচলন করার কথা হয়েছিল ২০১৮'র শেষার্ধে। এই বিষয়ে যাবতীয় প্রশাসনিক প্রস্তুতি, সমস্ত স্তরের স্বাস্থ্যকর্মী, আধিকারিকদের প্রশিক্ষণ সব সারা হয়ে গিয়েছিল। টিকা দেওয়ার তারিখ অবধি ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল। সেই টিকার ব্যবস্থাপনাটাও ছিল ঠিক এইরকম। ইনজেকশন দিয়ে টিকা দেওয়া হবে, আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য। কিন্তু কোনও একটা রহস্যজনক কারণে এতদূর প্রস্তুতির পরেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেই টিকাকরণ বাতিল করার নির্দেশ দেন। আজও সেই টিকা শিশুদের দেওয়া যায়নি। তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করেন, ওই সময় ওই ধরনের টিকা দিতে গেলে জেলায় জেলায় ভিন্ন উপদ্রব শুরু হতে পারত। কারণ, একদল টিকা ঘিরে চোরা প্রচার করত, অন্যরা তার ফায়দা লুঠত। সমীকরণ খুব স্পষ্ট। 

কথাটা উঠছে এই কারণে যে এই রাজ্যে যেভাবে আজ মৌলবাদীদের চাষবাস এবং একপক্ষের যেমন ভীষণ তাড়া মসনদে বসার, তার জন্য তাঁরা যা কিছু করা সম্ভব করতে পেছপা নন। এইখানে এসে ভয়। সামনে পেছনে দুদিকে ভয়। যে কোনও ইস্যুতে যত মেরুকরণ তীব্র করা যায়, দুই পক্ষেরই নজর সেইদিকে, তার মধ্যে হিন্দু মৌলবাদীদের পাল্লা ভারী। মনে করে দেখা যেতে পারে, করোনা সংক্রান্ত লকডাউনের প্রথম দিকে কীভাবে তবলিগি জমায়েত থেকে সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে এই প্রচার সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। সেই সময় কলকাতার কিছু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় বাসিন্দারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, লকডাউন উপেক্ষা করছেন (কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতা ছিল, এটা সত্যি) - এই নিয়ে ফেক ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অবিরত। বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু প্রধান বস্তিতে করোনা সাঙ্ঘাতিক ভাবে নাকি ছড়িয়ে পড়েছে। আসল ঘটনা মোটেও তেমন ছিল না। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সরকারি স্তরে বাসিন্দাদের খাদ্যশস্য দেওয়ার সময় অন্য বাসিন্দারা সংখ্যালঘু এলাকার সামনে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড করে দিয়েছেন যাতে তারা সেগুলো নিতে আসতে না পারেন।  যারা এগুলো করেছে, তাদের করোনা সংক্রমণ নিয়ে আদৌ চিন্তা ছিল তা তো আর নয়, তারা চেয়েছে বিদ্বেষের একটা বিষাক্ত কুয়াশায় আমাদের ঘিরে রাখতে যাতে আমাদের ক্ষোভের সূচিমুখ হয়ে থাকে কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের আচরণের দিকে, অন্য সব প্রকাণ্ড অন্যায় আর শয়তানির দিকে ততটা আর নয়। 

আজ নির্বাচনের দামামায় সেই সাম্প্রদায়িক কৃমিকীটদের নড়াচড়া অনেক বেশি। অনগ্রসর সংখ্যালঘুদের মধ্যে যদি সুকৌশলে একটা অপপ্রচার ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাঁরা হয়তো আড়ষ্ট হয়ে যাবেন আর তখুনি বলা হবে, দেখলেন তো 'ওরা' টিকা নেয় না, তার মানে রোগ ছড়িয়ে দিতে চায়! কোভিড থেকে সতর্ক তো থাকতেই হবে কিন্তু এইসব সম্ভাবনা থেকেও সজাগ না থাকলেই নয়। প্রতিপক্ষ আসলে খুব শক্তিশালী, করোনা ভাইরাসের থেকেও।

 

No comments:

Post a Comment