আগুয়ান কৃষক বিভ্রান্ত সরকার
অতনু চক্রবর্তী
পঞ্চাশ দিন পার করে আন্দোলন ও সরকারের সাথে আট-আটটা আলাপ-আলোচনায় কোনও সমাধানের ঠিকানা না পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট আসরে নামল অনেকটা রবাহূত অনাহুতের মতো। আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলো প্রথম থেকেই জানিয়েছিল, তারা শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হবে না। কিন্তু রহস্যজনক তৎপরতার সাথে সুপ্রিম কোর্ট নিজের গণ্ডি ভেঙে এমন একটা সীমানায় ঢুকে পড়ল, যা নজীরবিহীন। সম্ভবত আজ পর্যন্ত ভারতের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে যার নজীর খুঁজে পাওয়া ভার।
কেন?
এই প্রশ্নে যাওয়ার আগে বলতেই হয়, কৃষক আন্দোলনের অভিঘাত যে দেরিতে হলেও শীর্ষ আদালত কিছুটা টের পেয়েছে তা বোঝা গেল যখন তারা ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে ট্রাকটর র্যালি নিয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পিছপা হয়ে বলটা ঠেলে দিল কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে। অন্তত গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আঘাতের নির্দেশ দিতে তাদের বিবেকে হয়তো বিঁধেছে। অথবা লাখ লাখ কৃষকের মুখোমুখি বিরোধিতায় দাঁড়াতে তাদের অস্বস্তি হয়েছে।
তবে, কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইনের সাংবিধানিক বা আইনগত বৈধতাকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনেই তার রূপায়নের উপর দু' মাসের জন্য যে স্থগিতাদেশ শীর্ষ আদালতের তরফে জারি করা হল, তা নিয়ে নানা মহল রীতিমতো প্রশ্ন তুলেছে। বলাই বাহুল্য, যে সুপ্রিম কোর্ট সিএএ, নির্বাচনী বন্ড, জম্মু কাশ্মীর রি-অর্গানাইজেশন অ্যাক্ট, বা সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখন্ড সরকারের 'লাভ জিহাদ' সংক্রান্ত অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আনা আবেদনগুলো নিয়ে মামলা শুরু করলই না নানা বাহানা দেখিয়ে, সেই আদালতই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কৃষি বিষয়ে নাক গলিয়ে ফেলল। সংবিধানে কৃষি রাজ্য তালিকাভুক্ত। সংবিধানের লিস্ট (ii)'র সপ্তম শিডিউলে তা অন্তর্ভুক্ত। তাই, সংসদ তা নিয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। এই সাংবিধনিক অন্যায্যতা, অবৈধতাকে বিন্দুমাত্র আমল দিল না শীর্ষ আদালত। আর, সাংবিধানিক আদালতের কাজই হল প্রশাসন বা আইনসভার কোনও বিচ্যুতি, আইনি সীমানা লঙ্ঘনকে বিচার করা, তার উপর নিজের রায় ঘোষণা করা। কিন্তু এই প্রথম সাংবিধানিক শীর্ষ আদালত তা বাছবিচার না করে এমন একটা ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ল যা প্রশাসনের জন্য বরাদ্দ।
আদালত তার রায়দানের সময় জানায়, 'আমরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে হয়তো দমন করব না। আমরা আশাকরি কৃষি আইনগুলোকে স্থগিতাদেশ দেওয়ার এই নজীরবিহীন রায় আন্দোলনকারীদের ভেতরে একটা সফলতা হিসাবে বিবেচিত হবে আর তাঁরা তাঁদের কর্মীদের স্ব স্ব স্থানে, নিজ নিজ জীবিকায় ফিরে নিজেদের জীবন ও অন্যদের সম্পত্তি রক্ষা করতে উৎসাহিত বোধ করবেন।' প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি প্রতিবাদকে দমন করাটা সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনার মধ্যে রয়েছে? তাহলে কি সর্বোচ্চ আদালতের উদ্দেশ্যই ছিল চলমান প্রতিবাদী আন্দোলনের ইতি টানার জন্য এক বিকল্প পদ্ধতির রাস্তা দেখানো, যা অনেক সময় প্রশাসন করে থাকে? আদালতের এই রায়ই স্পষ্ট করে দেখাল যে সমাধান খুঁজতে ব্যর্থ হওয়া সরকারের কাজটাকেই সুপ্রিম কোর্ট নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রশাসনিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হল, যা শুধু তার এক্তিয়ার বহির্ভূতই নয়, আদালতের মর্যাদাকে একই সঙ্গে নামানো হল অনেক নীচুতে।
চার সদস্য নিয়ে যে কমিটি শীর্ষ আদালত গঠন করল, ইতিমধ্যে তার একজন সদস্য পদত্যাগ করে বসলেন। আরও বিস্ময়কর হল, তাঁদের নিয়োগ করার আগে কারুরই সম্মতি নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের পেটোয়া, কৃষি আইনের উদ্বাহু সমর্থক এই টিম সদস্যরা যে নিরপেক্ষ হয়ে বিক্ষুব্ধ, আন্দোলনরত কৃষকদের আস্থাভাজন হবেন না, তা কি আদালত জানত না?
আরও একটা ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিল আদালত। ১১ তারিখে শুনানি পর শীর্ষ আদালত তার পরের দিনের জন্য যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে জানায় যে ১২ তারিখ অমুক অমুখ মামলাগুলোর শুধুমাত্র রায় ঘোষিত হবে, শুনানি হবে না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে দেখা গেল, এতদিনকার সমস্ত রীতিনীতি, আচার বা প্রচলিত পদ্ধতিকে তোয়াক্কা না করে ফের শুনানি হল। বেশ কিছু আইনজীবী, যারা কৃষক আন্দোলনের সমর্থক, তারা ওই দিন আদালতে হাজির হননি এই কারণে যে লিস্টেই বলা হয় ১২ তারিখে শুনানি হবে না বলে। অথচ দেখা গেল সেদিন সংক্ষিপ্ত শুনানির শেষে ঘোষিত হল রায়। ভারত সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন যে এই আন্দোলনে শিখ উগ্রপন্থী খালিস্তানিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, আর কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ সে সম্পর্কে খবরাখবর দিয়েছে। আদালত সে বিষয়টা খারিজ না করে হলফনামা জমা দিতে বলেছে। প্রশ্ন জাগে, কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সরকারি ভাবেই জানিয়েছেন যে আন্দোলনকারী ও শিখদের সম্পর্কে যে সমস্ত অপবাদ দেওয়া হচ্ছে তা অনুচিত। শিখদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। আজ অ্যাটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্য শুনে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, তাহলে সরকারের আসল মুখ কোনটা? প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন? সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশের গল্প ছড়িয়ে পরাভূত কেন্দ্রীয় সরকার কি গোপনে আন্দোলনকে বলপূর্বক দমন করার ফন্দি আঁটছে?
আরও একটি আপত্তিকর মন্তব্য সুপ্রিম কোর্ট করেছে, যা নিয়ে এমনকি নারী সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়েছে। প্রধান বিচারপতি খুবই বিরক্তি নিয়ে বলেছেন যে মহিলাদের কেন এখানে আটকে রাখা হয়েছে? তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। ভারতের নাগরিক হিসাবে, সংবিধানে বিধৃত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অধিকার কি মহিলাদের নেই? মহিলাদের 'আটকে' রাখার শব্দবন্ধও আপত্তিকর।
সুপ্রিম কোর্ট আরও জানিয়েছে, এই পর্যায়ে (অর্থাৎ দু' মাসের মধ্যে) এমএসপি পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে, কৃষকেরা তাদের অধিকারের জমি হারাবে না! এতদিন সরকার যে সব কথা বলে আসছিল, তাহলে কি সেই সব মিথ্যে? দু' মাস পর আবার যে বিরাট অনিশ্চয়তা ও বিপন্নতা নেমে আসবে, এটা কি তারই ইঙ্গিতবাহী?
শুধু সরকারই নয়, গোটা ভারতীয় রাষ্ট্র আজ যুদ্ধে নেমেছে কৃষকদের বিরুদ্ধে। প্রায় ৬০ জন কৃষক মারা যাওয়া সত্ত্বেও, আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী একটা ট্যুইট করেও তাঁদের প্রতি কোনও সহানুভূতি দেখাননি। আইনসভা তার আগেই এই মারাত্মক আইনটাকে গা-জোয়ারি করে পাশ করালো দু' দুটি কক্ষে। গোটা সংঘ ব্রিগেড নেমেছে কৃষকদের বিরুদ্ধে। আর, রাষ্ট্রের শেষ স্তম্ভ বিচারালয় এবার আসল মূর্তি ধারণ করল।
চলমান এই আন্দোলন কিন্তু শুধুমাত্র এমএসপি'র মতো আর্থিক দাবি-দাওয়ার উপর কেন্দ্রীভূত নয়। এর মর্মবস্তুতে রয়েছে এক রাজনৈতিক, দেশপ্রেমিক, ফ্যাসিবাদ বিরোধী দাবি: ফিরিয়ে দাও আমাদের প্রজাতন্ত্র! রিক্লেইম আওয়ার রিপাবলিক। মোদী রাজ আজ কর্পোরেট ক্রোনিদের স্বার্থে সব কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে- গণতন্ত্র, জনগণের সাংবিধানিক অধিকার, রুটি রুজি, যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো। এর বিরুদ্ধে কৃষকেরা রুখে দাঁড়িয়েছেন, পাশে আছে গোটা দেশ, আসমুদ্রহিমাচলের আবালবৃদ্ধবনিতা। সমস্ত স্তরের জনতা। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারে হাজারে কৃষক রোজ এসে যোগ দিচ্ছেন এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে। সারা বিশ্বের কাছে এই আন্দোলন নানা অর্থে এক যুগান্তকারী স্মারক হয়ে উঠছে। ২০ জানুয়ারি আবারও সরকারের সঙ্গে কৃষকদের বৈঠকের কথা। ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে ট্রাকটর র্যালির সমস্ত প্রস্তুতি কৃষকেরা নিয়ে রেখেছেন। গত ১৮ জানুয়ারি মহিলা কৃষকেরা ব্যাপক সংখ্যায় জমায়েত করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা এই আন্দোলনে সমানে সমানে আছেন ও সম-শরিক। দেশব্যাপী এমন অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান আগে কখনও দেখা যায়নি। সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য। ২৬ জানুয়ারি কি সরকার দিল্লিতে কৃষকদের ট্রাকটর র্যালি বন্ধ করতে দমন-পীড়ন নামাবে?
দেখা যাক, কে জেতে। কোথায় এর শেষ।
সুন্দর যুক্তিপূর্ণ লেখা। এখন প্রশ্ন ওঠে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলি কেন রাজ্যে রাজ্যে গ্রামীণ এলাকায় এই কৃষক আন্দোলনের স্বপক্ষে বড় আন্দোলন গড়ে তুলছে না। দেশীয় কৃষি পুঁজিপতিদের সাথে কর্পোরেট পুঁজির সরাসরি লড়াইয়ে শ্রমিক শ্রেণীরও যুক্ত হওয়া উচিত।
ReplyDelete