কারা চালাচ্ছে দেশ?
সোমনাথ গুহ
সীমাহীন গলাবাজি, হিস্টিরিয়া-গ্রস্ত, তাক লাগানো খবর, দিনের মোক্ষম সময়ের ‘বিতর্কসভায়’ মৌখিক হামলাবাজি করে যিনি বক্তাদের ভেড়ায় পরিণত করতে অভ্যস্ত, শাসক দলের নির্লজ্জ তাঁবেদারি করে যে ব্যক্তিটি টিভি চ্যানেলের স্টুডিওকে বিরোধীদের বধ্যভূমি করে তুলেছেন, রিপাবলিক টিভির কর্ণধার সেই অর্ণব গোস্বামী আজ নিজেই খবর। অর্ণব এবং BARC (ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল)'এর ভূতপুর্ব সিইও পার্থ দাশগুপ্ত'র ৩৪০০ পাতা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ মুম্বাই পুলিশের হস্তগত।
অর্ণব ও পার্থ টাইমস গ্রুপে সহকর্মী ছিলেন। ৬ মে ২০১৭তে অর্ণব রিপাবলিক টিভি শুরু করেন। এর আগেই অন্য একটি চ্যানেলে তিনি টিভি সাংবাদিকতার এক নতুন স্টাইল উন্মোচিত করেন। এই স্টাইল উৎকর্ষতার পরোয়া করে না, এ হচ্ছে পাতি ঢক্কানিনাদ, যেখানে খবর নয় খবরদারি, নিউজ নয় নয়েজ হচ্ছে নির্ণায়ক। পরিশীলিত অফিস কর্মী বাড়ি ফিরে রাত নটার প্রাইম টাইমে এই ধরনের শালীনতাহীন ধুন্ধুমার বাকযুদ্ধ দেখতে অস্বস্তি বোধ করেন। তাঁরা রিমোটের সুইচ টিপে অন্য চ্যানেলে চলে যান যেখানে যুক্তিতর্কের একটা রেওয়াজ আছে। তথ্যের বিকৃতি, লাগামছাড়া আগ্রাসন, চিলচিৎকার করে পরস্পরের প্রতি দোষারোপ এই ধরনের তামাশা দেখবার জন্য প্রয়োজন হয় ভিড়, MOB, এবং সেটা করার একটিই উপায় টিআরপি বাড়ানো। যত বেশি মানুষ রিপাবলিক টিভি দেখবে তত সেটার টিআরপি বাড়বে, যত টিআরপি বাড়বে তত বিজ্ঞাপন আসবে।
এখানেই শুরু হয় অর্ণব ও পার্থর যোগসাজশ। অর্ণবের প্রয়োজন টিআরপি বাড়ানো এবং বার্কের প্রধান হিসাবে পার্থ সেটা অনায়াসে করতে পারেন। অর্ণবকে সাহায্য করে পার্থ'র নিজের স্বার্থসিদ্ধি কী ভাবে হবে? অভিযোগ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে মিডিয়া অ্যাডভাইসার হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এমনও অভিযোগ যে পার্থ দাশগুপ্ত'র এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা অর্ণবের বাঁ হাতের খেল কারণ সমস্ত মন্ত্রীরাই তাঁর হাতের মুঠোয় এবং উচ্চতম দুই ব্যক্তির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ। মুম্বাই পুলিশের চার্জশিটে উল্লিখিত কথোপকথন অনুযায়ী পার্থ তাঁর অফিসিয়াল পদের সুযোগ নিয়ে ‘রিপাবলিক ভারত ইন্ডিয়া’ এবং ‘রিপাবলিক ইন্ডিয়া’ (ইংলিশ)'র টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) নানা ফন্দি করে বাড়িয়ে দেন, প্রতিদ্বন্দ্বী চ্যানেলগুলিকে চেপে দেন যার ফলে রাতারাতি ঐ দুটি চ্যানেলেরই দর্শক সংখ্যা চড়চড় করে বাড়ে। এতে অন্য চ্যানেলের গাত্রদাহ হয়, যদিও এদের মধ্যে বেশির ভাগই কৃত্রিম উপায়ে টিআরপি বাড়ানোর দোষে দুষ্ট। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে অন্তত কিছু তো একটা করে দেখাতে হয়। TRAI (টেলেকম রেগুলেটারি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া) ঠিক করে যে কেবল অপারেটর গ্রাহকের টিভিতে একটা চিপ লাগিয়ে দেবে যেটা কে কোন চ্যানেল কতক্ষণ দেখছে তার হিসাব রাখবে। অর্থাৎ, ব্যাপারটা ডিজিটাল হয়ে গেল, অফিসে বসে আমার কাছের লোকের রেটিং বাড়াব, প্রতিযোগীদেরটা কমিয়ে দেব, এটা করা অসুবিধা হয়ে গেল। পার্থ জানায়, যে কোনও উপায়ে এই নতুন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ অনুযায়ী এখানে এএস (AS)'এর সাহায্য নেওয়ার প্রসঙ্গ আসে যে এটা অনায়াসে ধামাচাপা দিয়ে দিতে পারে। রহস্যজনক কে এই এএস?
রিপাবলিক টিভির বিরুদ্ধে এর আগেও সরকারি আনুকূল্য কাজে লাগিয়ে শ্রোতা-দর্শক সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টার অভিযোগ এসেছে। দূরদর্শনের DTH সার্ভিস ব্যবহার করার জন্য সময়সীমা নিলাম করা হয়। কোটি কোটি টাকার মূল্যে বিভিন্ন সংস্থাকে সময় প্রদান করা হয়। অভিযোগ- রিপাবলিক টিভি নিলামে অংশগ্রহণ না করেও DTH সার্ভিস ব্যবহার করেছে যার ফলে প্রসার ভারতীর প্রায় ৫৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ঐ সময়েও এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয় যা মন্ত্রীসভার কোনও এক ‘রাঠোর’ ধামাচাপা দিতে সাহায্য করে।
হোয়াটসঅ্যাপ'এর ঐ কথোপকথনে বিস্ফোরক সব তথ্য পাওয়া গেছে। পুলওয়ামায় সিআরপিএফ'এর ওপরে বিধ্বংসী আক্রমণের পর অর্ণব নাকি উল্লসিত হয়ে বলে উঠেন, এই হামলা আমাদের পক্ষে উন্মাদের মতো সহায়ক হবে। চল্লিশ জন সেনার মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণে সারা দেশ যখন শোকস্তব্ধ তখন এই ধরনের প্রতিক্রিয়া বিস্ময়কর। ‘আমাদের’ বলতে উনি কাদের বোঝাচ্ছেন, কাদের পক্ষে ‘সহায়ক’ হবে বলছেন? এই হামলার প্রত্যুত্তরে ভারতীয় বায়ু সেনা ২৬ ফেব্রুয়ারি বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক করে। অভিযোগ, অর্ণব এর তিন দিন আগে পার্থকে বলেন, বড় কিছু একটা হবে। পার্থ'র জিজ্ঞাসা, দাউদ? অর্ণব জানান আরও বড় কিছু, মানুষ উল্লসিত হয়ে যাবে। এতদিন অবধি আমরা জেনে এসেছি প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তারা ছাড়া এই স্ট্রাইকের কথা আর কেউ জানতেন না। টিভির একজন সঞ্চালক এত বড় একটা খবর কী করে পেয়ে গেলেন? এ তো দেশের নিরাপত্তা নিয়ে ছেলেখেলা করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করার দায়ে ওনাকে ১৯২৩'এর ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ অনুযায়ী গ্রেফতার করা যেতে পারে।
আরও চমকপ্রদ তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। ধারা ৩৭০ যে রদ হবে এটা নাকি তিনি দু' দিন আগেই জানতেন, যে কারণে অন্য সব সংবাদ মাধ্যমের আগেই তিনি রিপাবলিক টিভি'র ৫০ জন কর্মীকে জম্মু-কাশ্মীরে মোতায়েন করতে পেরেছিলেন। অভিযোগ, তখন তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। দুই বছরের অধিক সময় ধরে চলা তাঁদের এই কথোপকথনে অর্ণব এবং পার্থ কাউকেই রেয়াত করেননি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি'র দক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন এমনকি তাঁর মৃত্যু বিলম্বিত হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বিশিষ্ট টিভি সাংবাদিকদের সম্পর্কে তীর্যক, অপমানজনক মন্তব্য করেছেন, যে তালিকায় তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীরাও আছেন। পার্থ যখন বলেছেন তিনি আদালতের একটি কেসে ফেঁসে আছেন, তখন বিচারককে কিনে ফেলার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
রিপাবলিক টিভি শীঘ্রই বাংলায় পদার্পণ করছে। ইউটিউবের একটি বাংলা চ্যানেল জানাচ্ছে যে পার্থ দাশগুপ্ত পশ্চিমবাংলার ওপরে কিছু করার জন্য বারবার জোর দিয়েছেন। অর্ণব নাকি তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন এবং বলেছেন উদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া এবং বসিরহাটের ‘দাঙ্গা’র কথা উল্লেখ করেন। টিভি সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ছলেবলে কৌশলে করায়ত্ত করে, ফেসবুকের ওপর নিজেদের প্রতাপ কায়েম করে নিজেদের পক্ষে জনমত গঠন করাতে বিজেপি সিদ্ধহস্ত। এটা আজ পরিষ্কার, দু' দুটি লোকসভা নির্বাচন জিততে, সারা দেশ জুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়াতে, জাতপাতের বিভাজন, নারী ও দলিতদের প্রতি বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলতে এই সব চাটুকার সংবাদমাধ্যম নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
সাংবাদিকতায় নিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা কথার কথা ছিল মাত্র। কিন্তু পক্ষপাতহীনতার একটা ভড়ং ছিল, কোনও বিশেষ পক্ষের হলেও নিজের বা সংস্থার মতামতকে লুকোছাপা করার একটা প্রয়াস ছিল। রাজনীতি যত উগ্র হয়েছে, সাংবাদিকতাও তাল মিলিয়ে উগ্র হয়েছে। নেতানেত্রীদের মুখের ভাষা যত অশালীন হয়েছে, সাংবাদিকের ভাষ্যেরও ততোধিক অবনমন ঘটেছে। সমস্ত মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বহু সাংবাদিক, বিশেষ করে টিভির সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, একটা বিশেষ দলের হয়ে সরাসরি প্রচার করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার শুরু নতুন শতাব্দীর গোড়া থেকে যা ২০১৪ সালে প্রাক-নির্বাচনের সময় ত্বরান্বিত হয় এবং যা এখন অভুতপূর্ব পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অর্ণবের সাফল্যের ফরমুলা অনুসরণ করে প্রায় সব টিভি চ্যানেল সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে উঠেছে, গোদি মিডিয়ার জন্ম হয়েছে। ভিড়তন্ত্র, মবোক্রেসি আজ টিভি স্টুডিওতেও পৌঁছে গেছে। প্রত্যহ সন্ধ্যায় সেখানে আজ মার মার কাট কাট রব! মিডিয়া এখন বিচারব্যবস্থার কাজও নিজের হাতে তুলে নেয়। প্রাইম টাইমের টিভি স্টুডিও আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ঘটনার বিচারকক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। মিডিয়া ট্রায়ালে সঞ্চালক ও তাঁর আজ্ঞাবহ বক্তারা ঠিক করে দেন রিয়া চক্রবর্তী সুশান্ত সিং রাজপুতকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন। তাঁরাই রায় দেন জাকির নায়েকের পয়সা দিয়ে শাহিনবাগের সংগঠকরা দিল্লিতে দাঙ্গা করেছেন। চিলচিৎকার করে তাঁরাই দেশকে বারবার জানান যে খালিস্তানিরা কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করছেন, জেএনইউ'র নেতানেত্রীরা দেশকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে চাইছেন। তাঁরাই সত্যান্বেষী পুলিশ অফিসারকে মুসলিমদের দালাল বলে দেগে দেন, ফ্রিজে মাংসটা পাঁঠা নয় গরু ছিল জানিয়ে দেন, চমকপ্রদ প্রচার করেন যে মহিলার মৃত্যুকালীন জবানবন্দী ভুল, আসলে কোনও ধর্ষণই হয়নি।
এই পঙ্কিল পরিস্থিতিতে অর্ণব গোস্বামীরা রাজ করবেন না তো কে করবে। হোয়াটসঅ্যাপ'এর মেসেজের ওপর ভিত্তি করে যদি উমর খালিদকে গ্রেফতার করা যায়, তাঁকে যদি ইউএপিএ'তে অভিযুক্ত করা যায় তাহলে অন্যদের কেন নয়? রাজপথে, অলিতে গলিতে গলা ফাটিয়ে আজ বলার দরকার: দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো।
আপনি অর্ণব গোস্বামী সম্বন্ধে যা লিখেছেন খুবই প্রাসঙ্গিক এবং যথাযথ! এখন দেখা যাক পরের লাইনটা আপনাকে কি লিখতে হয়!বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে না আশার আলো!
ReplyDelete