বক্ষকাহন
অমৃতা ঘোষাল
তখন শিশুটির বয়স মাত্র এক মাস। এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছি তাদের ফুটফুটে কন্যার মুখ দেখতে। শিশুর পরিচর্যাকারী আয়া দেখলাম একটি তামার পয়সা মোমের আগুনে একটু ধরে শিশুটির বুকের ওপরে চেপে চেপে রাখছে। শিশুটির মা সামনেই বসে। আর শিশুটির একনাগাড়ে অসহ্য কান্না। শিশুটির মা বেশ পৃথুল চেহারার। তিনি আমাকে বললেন যে, বড় হলে তার কন্যার বুক যেন অতিরিক্ত আয়তনে না বাড়ে, সেজন্যে এই ব্যবস্থা। কারণ, সেই মা চান না যে তার শিশুকন্যা তারই মতো মেদবহুল দেহ আর বড় আয়তনের বক্ষ ধারণ করুক। তাদের বাড়ি পুনরায় যাওয়ার দুর্ভাগ্য আমার আর হয়নি।
এর ঠিক উল্টো একটা গল্প শোনাই। কৌশিক গাঙ্গুলী পরিচালিত 'শূন্য এ বুকে' ছবিতে পুরুষ মনস্তত্ত্ব নারীবক্ষের ফ্যান্টাসিতে কী বিচিত্র রকমের আন্দোলিত! স্ত্রীর বক্ষ কতটা উচ্চ আর কতটা সমতল- সেই দেহ-ভৌগোলিক গবেষণায় ভেঙে যায় দাম্পত্য। তার মানে একটা সম্পর্কে ফাটল ধরাতে বক্ষেরও ভূমিকা থাকে!
আফ্রিকার ক্যামেরুনে যেমন নারীর বক্ষ-রক্ষার এক অদ্ভুত চর্চা মেলে। ব্রেস্ট আয়রনিং। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিংবা সদ্য ঋতুমতী হওয়া মেয়েদের ওপর চালানো হয় বক্ষ-সমতলীকরণের প্রক্রিয়া। বেশ তীব্র মালিশ করে বক্ষের বিকাশকে কখনও কখনও রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। এর থেকেও জটিল একটা প্রক্রিয়া আছে। খুব উত্তপ্ত পাথর কিংবা ভারি কিছু বসিয়ে দেওয়া হয় মেয়েটির বুকের ওপরে। কিংবা ভীষণ শক্তভাবে কাপড় বা রবার দিয়ে বেঁধে সদ্য জেগে ওঠা বুকের বেড়ে ওঠাকে আটকে দেওয়া হয়। সাধারণভাবে বাড়ির মা, ঠাকুমা কিংবা প্রবীণ অভিজ্ঞ মহিলারাই এই কাজের যাবতীয় দায় গ্রহণ করেন। খুব ভোরে কিংবা সন্ধ্যের দিকে আলো-আঁধারে চলে এই প্রক্রিয়া। স্থান রান্নাঘর কিংবা ঘরের ভিতরকার কোনও লুকোনো স্থান। লুকোনো যাতে ঘরের পুরুষদের চোখ না পৌঁছয়। কিন্তু এত আয়োজনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? ঘরের মেয়েকে আগলে রাখা। সে যাতে কখনও কোনও বিকৃতির শিকার না হয় সে জন্যেই এই প্রক্রিয়া। মনে করা হয়, বক্ষ বর্ধিত হলে সে পুরুষের কাছে আকর্ষক হয়ে উঠবে, সুতরাং যৌন লালসার বস্তু হয়ে উঠবে। তাই তার বক্ষকে একেবারে দেহের সঙ্গে চেপে চেপে মিশিয়ে দেওয়ার আয়োজন। আফ্রিকার বহু অঞ্চলে, এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই প্রক্রিয়া এখনও সমস্ত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেশ নির্বিচারে চলে। নারীর দেহে এ পদ্ধতির পরিণতি যা-ই হোক না কেন, ধর্ষণের পরিসংখ্যান কিন্তু কিছু মাত্র কমেনি! ব্রেস্ট আয়রনিং পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাওয়া মেয়েদের ক্ষেত্রে সুস্থ যৌন জীবন-যাপন কিংবা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিঃসন্দেহে দুটোই কষ্টকর হয়ে ওঠে। নার্ভ-মাসল প্রভৃতির রোগে আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবু, সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।
একবার এক জ্ঞানী পুরুষ বিবাহে উন্মুখ আরেক পুরুষকে নারীর তিন বক্ষ ক্যাটেগরির কথা শুনিয়েছিলেন- প্রথমত 'উন্নত', দ্বিতীয়ত 'অবনমিত', তৃতীয়ত 'পরাজিত'। না না, এ কোনও অ্যাডাল্ট জোকস নয়। এ ছিল এক উচ্চশিক্ষিত মানবদরদীর নিজস্ব বিভাজনরীতি। এবার সমস্যাটা হল, বিবাহে উন্মুখ পুরুষটি যেই বিয়ের জন্যে পাত্রী দেখতে যায়, অমনি তার চোখ গিয়ে স্থির হয় নারীর বক্ষের ওপর। উন্নত ক্যাটেগরি খুঁজতে গিয়ে হতভাগ্য হিমশিম খায়। বেচারার আর বিয়ে করাই হয় না।
গালভারি নামটা ছিলো 'মূলাক্করম', অর্থাৎ 'ব্রেস্ট ট্যাক্স'। এক কালে দক্ষিণ ভারতের ট্রাভাঙকুর অঞ্চলে (বর্তমানে কেরালার অন্তর্গত) নিম্নবর্ণের হিন্দু নারীদের থেকে বক্ষ কর আদায় করতেন উচ্চবর্গ ব্রাহ্মণ পুরুষেরা। ব্রাহ্মণদের যুক্তি ছিল, নিম্নজাতের নারীকে (শুদ্র কিংবা অস্পৃশ্য মূলত) জনসমক্ষে বক্ষ ঢাকতে হলে কর দেওয়া বাধ্যতামূলক, কারণ তাদের বক্ষ ঢাকার অধিকার নেই। 'চণ্ডালের ঝি'-দের নাকি নগ্ন থাকারই রেওয়াজ! যাই হোক, যেমন বক্ষের পরিমাপ, সেই মতো নির্ধারিত হবে তাদের কর। পরিমাপ মাপবে কে? উচ্চবর্গ, আবার কে? এক বিদ্রোহী এর মধ্যে আগুন লাগালো। নাঙেলি নামের এক রমণীর বুকের ভেতর আগুন ছিল। কলাপাতায় মুড়ে নিজের কাটা স্তন দুটোকে তুলে দিল ক্ষমতাবানের হাতে। অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে মরল সেই অগ্নিকন্যা। চিরুকন্দন তার স্বামী। দেহের চেয়েও যে আত্মাকে ভালোবেসেছিল। সেও মরল। কিছু পাগল প্রেমিক থাকেই যুগে-যুগান্তরে। 'ব্রেস্ট ট্যাক্স'-এর রীতিও মরল।
মরেনি আমাদের ভেতরের চড়াই-উৎরাই। পৃথুলা মহিলারা এখনও বক্ষ-আবরণী কিনতে গিয়ে মিনিমাইজার খোঁজেন। অনেক পুরুষ এখনও একমাত্র উন্নত বক্ষেরই সঙ্গিনী খোঁজেন। অনেক ছিপছিপে তরুণী এখনও ওষুধের দোকানে গিয়ে চুপি চুপি বক্ষ-মালিশ তেল কেনেন। এই বক্ষ-সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে একটু নতুনভাবে ভাবতে পারি তো! তখন দেখব, এই ভাবতে ভাবতেই 'বক্ষ' শব্দের চেয়ে 'আশ্রয়' শব্দটা দামি হয়ে উঠবে।
সুন্দর লেখা। নতুন বিষয়। ভাবনা জাগায়
ReplyDeleteতথ্যসমৃদ্ধ লেখনী।
ReplyDeleteগীতগোবিন্দম তে মহাকবি জয়দেব তাঁর ময়ূর পালকের কলমে যখন শ্রীকৃষ্ণের লীলা বর্ণন করছিলেন সেখানেও তিনি নল কিশোর কিভাবে মদন মোহন হতে গিয়ে ' পিন পয়োধর: পরিসর মর্দন: ' করলেন সেই কথাটা কে সূচারু রূপে ব্যবহার করেছিলেন।
হিন্দি ' সারিতা ' নামক পত্রিকার একটা ভাগ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ফলের আকার এর সাথে নারীদের যুগল স্বর্ণকলসের তুলনা করে। যা অন্তত এটা প্রমাণ করে পেঁপে থেকে লেবু.... প্রতিটি ফলই জীবনদায়ী রস বহনকারী!
নারায়ন সান্যাল(দেবদাসী সুতনুকা), বুদ্ধদেব বসু(ভোর রাতে বৃষ্টি), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়(বিভিন্ন কবিতার চরনে), চাণক্য সেন(মধ্য পঞ্চাশ), সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর আশিতি পর বয়:ক্রমে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর (কেতকী কুশারী ডাইসন) স্বর্ণ কমল বক্ষস্থল দেখে শান্ত থাকতে পারেননি!
তোমার উপসংহারটা অত্যন্ত সুন্দর। এবং আমি স্বীকার করি।
বাল্যে যা প্রাণ দায়ী, কৈশোরে আসন্ন আশ্রয়স্থল, যৌবনে রতি ক্রীড়ায় হৃদয়দেহ প্রদাহ ও মন: শান্তির, পৌড়ে নিরব সমর্পণ আর বার্ধক্যে সকল বাস্তুহারা(!)র শান্তির একমাত্র আশ্রয়স্থল বলে মনে হয়।
যে অস্বীকার করে, সে বিশ্ব নিন্দুক!
বক্ষ যুগল নিয়ে তোমার লেখা পড়ে আমরা আরও সমৃদ্ধ হবো, এই প্রতীক্ষায় থাকলাম।
ধন্যবাদ...
ReplyDeleteখুব সুন্দর লিখেছ অমৃতা। তথ্য সমৃদ্ধ। এখনো তেমন উচ্চ ভাবনায় আমরা পৌঁছতে পারিনি। বয়ঃসন্ধি কালীন সময় ছেলেদের মেয়েদের মধ্যে পাওয়া যায় একধরনের ব্রেস্ট রিলেটেড ফ্যান্টাসি। বডি শ্যামিং এখনো উপস্থিত শিক্ষিত মহলে, তার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন শপিং মলে। এই বডি স্যামিং এর সাথে যুক্ত এক বৃহত্তর পুঁজিবাদী ভোগবাদী তরঙ্গ, যারা এই বডি শ্যমিং থেকে লাভ সংকলনের রাস্তা খোজে। সবটাই এক বৃহত্তর পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি।
ReplyDeleteবক্ষ কর আদায়ের ব্যাপারটা কিছুটা মুভিতে দেখেছি। বাস্তবে এই যে বক্ষকে নিয়ে এত কুসংস্কার আছে সমাজে জানতাম না। আমাদের সমাজের একটা নতুন বিষয় জানলাম।খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteধন্যবাদ ম্যাডাম