নতুন পরিসর কি গড়ে তোলা সম্ভব?
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
এখন থেকে প্রায় একশ' বছর আগে (বৈশাখ, ১৩২৮) আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' পত্রিকায় যার শুরুতে আচার্য দেব লিখেছেন- 'এই যে সমস্যা আজ আপনারা আমার সম্মুখে উপস্থাপিত করেছেন এর মীমাংসা করা, বিশেষত এইরকম অল্প সময়ে, অত্যন্ত দুরূহ।'
দুঃখের হলেও সত্য এই যে, এখনও সমস্যাটির মীমাংসা হয়নি। হয়তো নয়, নিশ্চিতভাবেই সমস্যাটি গুরুতর আকার নিয়েছে। ওদিকে, মীমাংসার জন্য সময় কমেছে।
সমস্যাটা কী?
আচার্যদেব লিখেছেন, 'আমরা চিন্তাশীল হিন্দু, আমরা অত্যন্ত আধ্যাত্মিক' বলে গর্বস্ফীত ভাব একটা রয়েছে। সেটাই সমস্যা। সে ভাবটা দেশের প্রায় প্রতিটি অংশে আজও আছে শুধু তাই নয়, তা অবশ্যই দৈর্ঘে-প্রস্থে বেড়েছে। বলতেই হচ্ছে যে সমস্যাটি এ কালে গুরুতর আকার নিয়েছে। এ কালের কুচিন্তা-মগ্ন কিছু হিন্দু আধ্যাত্মিকতার নামে নৈরাজ্য বিস্তারে মন দিয়েছে। তারা হয়ে উঠতে চলেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। কেন এমন হল?
সে কালে যারা ছিল শাসক সেই ব্রিটিশ শক্তির প্রয়োজন ছিল তাই তারা সাম্প্রদায়িকতায় উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু এ কালে ব্রিটিশ রাজশক্তির সেই গৌরবদিন আর নেই। এ কালে তার জায়গা নিয়েছে কর্পোরেট শক্তি। তার সাথে সারা বিশ্ব জুড়েই হাত মিলিয়েছে রাষ্ট্র- দুয়ে মিলে (বাজার ও রাষ্ট্র) গড়ে তুলেছে নয়া ফ্যাসিজম। ধর্মের উপস্থিতিতে মীমাংসা বুঝি আরও দূরে সরেছে। এমনকি সমস্যাটি ভেঙ্গে ছোট ভূখন্ডে দেখতে গেলেও দেখি মীমাংসা দূরে থাকে।
চিন্তাশীল বলে বাঙালির গর্ব খুব। তাই এই ভূখন্ড নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ করি।
বাংলার বহু সমস্যা- অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক। তাতে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার সমস্যা, সংস্কৃতির সমস্যা। দোষ দেব কাকে? রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছে তাদের দোষ বা দায় তো মানতেই হয়, তবে যারা শাসক নয়, বর্তমানে যারা শাসক-বিরোধী তারাও সমভাবে দায়ী নিশ্চয়। শাসকের অপরাধ কেবল এই নয় যে আত্মম্ভরিতায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে সে আমাদের এক মোহময় মিথ্যার জগতে টেনে এনেছে। এই কথা ভারতবর্ষ বিষয়ে যতখানি সত্য বাংলা সম্পর্কে ততোধিক সত্য।
একজন বলেছিলেন: What Bengal thinks today...। আমরা সেই কথাতে নেচে উঠি। ভারতীয় রাষ্ট্রনায়ক তথা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কলকাতা সম্পর্কে বলেছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। গর্বে আমাদের যেন আর মাটিতে পা পড়ে না। শাসক দলের প্রধান কর্তারা তারই সুযোগে যেন, আমাদের বাঙালিয়ানায় সুড়সুড়ি দিতে, কখনও রবীন্দ্রনাথ সাজছেন, কখনও বিচিত্র বাংলায় কথা বলছেন, কখনও গরিব আদিবাসী মানুষের আপনজন হতে তার বাড়িতে পাত পাড়ছেন। অথচ, আজ এ কথা স্পষ্ট যে, বঞ্চনায়, অবহেলায় বাংলা ও বাঙালি ক্রমে কোণঠাসা (অন্তত, সেই দেশভাগের সময় থেকে)। এদিকে, আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে, আমাদের তেজ ও তারুণ্য, আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি, আমাদের ভয়হীনতা ও প্রত্যুতপন্নতা দেশের সেরা, কালের সেরা। শুধু কি তাই? আমাদের কবি বিশ্বকবি, আমরা শান্তির পূজারী হলেও আমাদের বিবেকানন্দ, আমাদের সুভাষচন্দ্র প্রয়োজনে হিংসার পক্ষে দাঁড়াতে মানা করেননি এবং তাই আমরা এক বীরোত্তম ও সংস্কৃতিবান জাতি।
নেতাজি জন্মদিনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানের পর বাঙালির এমন ভাবনা যে অসার তা আর একবার স্পষ্ট হল। নেতাজির জন্মদিন জাতীয় ছুটির দিন হল না, পেলাম এক 'পরাক্রম দিবস' নামের 'দিল্লিকা লাড্ডু'। তাতেই উল্লসিত একদল নেতাজির নামে জয়ধ্বনি দিতে ভুলে গিয়ে মেতে উঠলেন 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনিতে। এভাবে আমার মতো বাঙালির দুশ্চিন্তা নিশ্চয় অনেক গুণ বেড়ে গেল।
ওদের অপরাধ কেবল এই নয় যে ওরা আমাদের গর্বে আঘাত হানতে চায় বা ওরা আমাদের গরিমায় ভাগ বসিয়ে রবীন্দ্রনাথের বদলে মনমোহন বসুকে বাংলার সেরা কবি রূপে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত, ব্যস্ত 'গদ্দার' শ্যামাপ্রসাদকে জাতীয় নেতারূপে প্রতিষ্ঠা করতে বা বিবেকানন্দের অন্যতম নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা ভুলিয়ে দিতে। সে সব তো আছেই, তবে আরও আছে। ওরা জাতীয়তাবাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের দেশপ্রেম ভোলাতে চায়। তারা নেতাজি নামাঙ্কিত নদী-বন্দরের নাম বদলায়, নতুন এক শিক্ষানীতি দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিলোপ ঘটাতে চায়, জাতীয় পরিকল্পনা পর্ষদ ভেঙ্গে নীতি-আয়োগের বিস্তার চায়। এমন আরও অনেক চাওয়া আছে তাদের। সেই সব চাওয়া পূর্ণ করতে তারা এই রাজ্যের শাসনক্ষমতা হাতে পেতে চায়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সে চাওয়াও দোষের নয়, কিন্তু যে পদ্ধতিতে তারা সবের দখল চায় তা যে গণতন্ত্রের মূল আদর্শের পরিপন্থী তা যেন তারা ভুলেছে ও আমাদের ভোলাতে চায়। এই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে রুখতে বাংলা ও বাঙালির কিছু করতেই হয়। কী করা যায়? রাজ্যের-শাসক-বিরোধী শক্তি যা করছে তেমন কিছু?
এখানে শাসক বিরোধী শক্তির দুটো প্রধান স্রোত। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী। দুটো স্রোতই একসঙ্গে যেন শাসকের বানানো খেলায় বা ছকে অথবা ন্যারেটিভে মেতেছে। মূলত বামমনস্ক (বাঙালি যে স্বভাবত বামপন্থী) প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ভুলেই রয়েছেন 'প্রিন্সিপাল এনিমি' তত্ত্ব, তাঁরা খোয়াব দেখছেন 'এবার রাম, পরের বার বাম'। আর বর্তমান শাসক দল গান ধরেছে- হরে কৃষ্ণ হরে রাম/ দূর হঠো মেকি বাম।
ওদিকে, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী কেবল যেন জেগে বা মেতে রয়েছে ‘সোস্যাল মিডিয়া’য় যখন দেশের কৃষকরা শ্রমিক ঐক্যের ডাক দিয়ে দিল্লী অভিযানে নেমেছেন। আর কি উদাসীন বা নিরপেক্ষ থাকা উচিত?
সব দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাকে মুক্তির পথ দেখাতে, প্রকৃত বহুস্বর গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে, নিরামিষ পথ ছেড়ে প্রতিরোধের আগুন জ্বালাতে তৃতীয় শক্তির উত্থান আসন্ন ও বিশেষ প্রয়োজন। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’।
ঠিকই বলেছেন।
ReplyDeleteজরুরি লেখা। চমৎকার আলোচনার উপস্থাপনা। ঐ যুযুধান পক্ষের বিপ্রতীপে টানাটানির মধ্যেথেকে তৃতীয় শক্তির উত্থান অবশ্যম্ভাবী। সেই আশায় তাকিয়ে আছি আগামীতে ্্র্্্্র্্্র্্্্র্্র্্্্্্্্র্্্র্্্্র্্্র্্্্র্্র্্্্্্্্র
ReplyDelete