'মেক ইন ইন্ডিয়া' থেকে 'মেড ইন চায়না'
পি জে জেম্স
গত ৪৫ বছরে চীনের সাথে ভারতের তুমুল সংঘাতের পরে গৈরিক কেন্দ্রগুলির তরফ থেকে দেশ রক্ষার্থে যে সব কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা নেহাত কম কিছু নয় বলে মনে হতে পারে। যদিও এদিকে ভারতের ভূখণ্ডে চীনের অনধিকার প্রবেশ দিন দিন আরও বেশি স্বতঃসিদ্ধ বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এই চীন বিরোধিতার অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক ভাবে চীনকে প্রত্যাঘাত করার একটা প্রচার কর্মসূচি পুরোদমে চলছে। এই প্রচার কর্মসূচি মূলত চীনা দ্রব্য বয়কটের ডাক দিচ্ছে। যেমন, আরএসএস প্রভাবিত কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (সিএআইআইটি) মূলত ৪৫০ ধরনের চীনা পণ্য সোজাসুজি বর্জন করার ডাক দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রসাধন সামগ্রী, খেলনা, ফার্নিচার, জুতো, ঘড়ি ইত্যাদি সবশুদ্ধ ৩৫০০ ধরনের পণ্য। চীনা পণ্য বর্জন করার উদ্দেশ্য হল ওদের আমদানি ২০২১'এর ডিসেম্বরের মধ্যেই ১৩ বিলিয়ান ডলার বা এক লক্ষ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা, যেখানে ২০১৯-২০'তে ভারতে চীনা পণ্যের আমদানির পরিমাণ ৭০ বিলিয়ান ডলার বা ৫২৫,০০০ কোটি টাকা। তবে এ কথা সবার আগেই বলা যায় যে এই সব পদক্ষেপ শুধুই বাক্সর্বস্ব, কারণ, চীনের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা এবং একাত্মতা এতটাই সুদূরপ্রসারী এবং জটিল যে 'মেক ইন ইন্ডিয়া'র ঢক্কানিনাদ বা আরও সম্প্রতি 'আত্মনির্ভর ভারত'এর কথা হওয়া সত্ত্বেও চীনা বিনিয়োগ এবং পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ভারতের পক্ষে একরকম অসম্ভব।
ভারতের পক্ষে চীন দেশিয় জিনিসের বাজারে পরিণত হওয়া এবং চীনের বিনিয়োগের মূল লক্ষ্যস্থল হয়ে ওঠা একবিংশ শতাব্দীর এক অসামান্য ঘটনা। এই ঘটনা নব্য উদার বিশ্বায়নের অধীনে চীনের সমগ্র বিশ্বের কর্মশালা হয়ে ওঠার সঙ্গে জড়িত। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ এবং আরও বিভিন্ন বিরোধ, যেমন বলা যায় ১৯৬৭-র চোলার ঘটনা, সিকিম ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে ওঠার সময় ১৯৭৫ সালে চরম পরীক্ষা, আর ১৯৮৭-র ভারত-চীন লড়াইয়ের মতো ঘটনার কারণে বিংশ শতাব্দীতে ভারত-চীন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারেই আশাপ্রদ ছিল না। ২০০১ সালে ডব্ল্যুটিও’তে চীনের আনুষ্ঠানিক প্রবেশই চীনকে অন্য সব দেশের সঙ্গে এক হতে সাহায্য করেছে, চীনেরই 'কম্প্যারিটিভ অ্যাডভান্টেজের (অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানের)' ভিত্তিতে। এর ফলেই চীন তার প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাজারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার উৎসাহ পেয়েছে। ফলত, চীনের প্রিমিয়ার জু রংজি’র ভারত সফরের বিনিময়ে ২০০৩ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী গেলেন চীন সফরে। তার পরবর্তী সময়ে ভারত এবং চীন দু দেশের প্রতিনিধিরা একে অপরকে অনুসরণ করার জন্য এবং অসংখ্য দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের চুক্তি স্বাক্ষর করার উদ্দেশ্যে একে অপরের দেশে নিয়মিত সফরে গেছেন।এর ফলে, ২০০০ সাল থেকেই ভারত এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্যের গতি, অন্যান্য দেশের গোটা পৃথিবীর সঙ্গে বাণিজ্যের থেকে দ্বিগুণ মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮ সালেই মার্কিন দেশকে ছাপিয়ে চীন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য ক্ষেত্রে অংশীদার (বিজনেস পার্টনার) হয়ে উঠল। ইতিমধ্যে ভারত-চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০০০-০১'এ ২ বিলিয়ান ডলার থেকে ২০১৩-১৪'এ ৬৫ বিলিয়ান ডলারে গিয়ে পৌঁছেছিল। এই সময়ে চীন আর ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য (আমদানি-রফতানি সহ) চীন-মার্কিন বাণিজ্যের থেকে তিন গুণ বেশি দ্রুত এগোচ্ছিল। ২০১৪ সাল থেকে মোদি শাসনের সূচনা হওয়ায় বাণিজ্য ক্ষেত্র আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭-১৮তে চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ, শুধুমাত্র হংকং (৩৪ বিলিয়ান ডলার)'কে বাদ দিলে, বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯.৭৬ ডলারে। ২০১৮-১৯'এ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কিছুটা হ্রাস পেয়ে ৮৭.০৭ ডলার হলেও ঐ বছরেই ভারতের সাথে চীনের বাণিজ্যিক ঘাটতি ৫৩.৫৭ বিলিয়ান ডলার (মোটামুটি ৪০১,৭০০ কোটি)। তার কারণ, চীন থেকে ভারতের আমদানির মূল্য যেখানে ৭০.৩২ বিলিয়ান ডলার, সেখানে ভারত থেকে চীনে রফতানি মোটে ১৬.৭৫ বিলিয়ান ইউএস ডলার। এমনকি আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ভারতের সঙ্গে চীনের বড় রকমের বাণিজ্যিক ঘাটতিতে সামান্যই পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। সেভাবে দেখতে গেলে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান সত্যিই প্রতিকূল।
আইএমএফ'এর হিসেব (২০১৯ সালের তথ্যের ভিত্তিতে) অনুযায়ী চীন থেকে ভারতবর্ষে রফতানি ও ভারতবর্ষ থেকে চীনের আমদানি যথাক্রমে তার মোট রফতানি এবং আমদানির ৩ শতাংশ ও ০.৯ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই মতোই ভারতের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ হল ৫.১ এবং ১৩.৭ শতাংশ (সংখ্যাগুলো ২০২০'র ফেব্রুয়ারিতে ৫.৩৩ শতাংশ এবং ১৪.০৯ শতাংশ)। স্পষ্টভাবে দেখতে গেলে, ২০২০ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট আমদানি ৭৫.৮ শতাংশের মধ্যে ইউএস থেকে ভারতের আমদানি হল চীনের থেকে ভারতের আমদানির অর্ধেক। এর থেকেই বেশ বোঝা যায় যে চীনের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা মার্কিন দেশের তুলনায় বেশি, যার সাথে জুনিয়র অংশীদার হিসেবে ভারতের রণনীতি সংক্রান্ত সামরিক সম্পর্ক আছে। চীনের থেকে ভারতের আমদানির দ্রব্যাদি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে এই অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার গুরুত্বকে বোঝা যায়। যেমন ৭৬.৩ শতাংশ জীবাণুনাশক এবং ওষুধপত্র ভারত চীন থেকে আমদানি করে। চীনের ওপর ভারতের এই নির্ভরশীলতা যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে ৮৪ শতাংশ, নাইট্রোজেন কম্পাউন্ডের ক্ষেত্রে ৬৮ শতাংশ, ডায়োড এবং ট্রানজিস্টরের ক্ষেত্রে ৬৪ শতাংশ, লোহা ও স্টিলের পাইপ এবং টিউবের ক্ষেত্রে ৬৩ শতাংশ, বিদ্যুৎ পুঞ্জীভবনকারী যন্ত্রের (ইলেক্ট্রিক অ্যাকিউমুলেটর) ক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ, টিভি'র এলসিডি, এলইডি ও এলইডি প্যানেলের ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ, কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ, ডেটা প্রসেসিং মেশিন, এসি ও ফ্যান'এর ক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ। এভাবেই আরও বিভিন্ন ধরনের জিনিসের কথা বলা যায়। ভারতবর্ষের এই সব আমদানির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই যে, অনেক কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী জিনিসপত্রও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, যা কিনা উৎপাদনের জন্য এবং অন্যান্য বাজারে জিনিস রফতানি করার জন্য জরুরি। অন্য ভাবে বোঝাতে গেলে, ভারত যেখানে চীন দেশের থেকে আমদানির ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল, চীনের কিন্তু ভারতের ওপরে সেরকম কোনও নির্ভরশীলতা নেই। সুতরাং, অর্থনৈতিক ভাবে চীনকে বয়কট করা অদূর ভবিষ্যতে কোনওভাবেই সম্ভবপর নয়, বিশেষ করে এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখা যাচ্ছে ভারতের বৃদ্ধির হার ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে ৫ শতাংশে নেমেছে। ভারতের অনেক অটো, ফার্মা এবং বৈদ্যুতিন জিনিসের কোম্পানি আছে, যারা চীনের থেকে আমদানি করা জিনিসের ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করে। বিকল্প ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে তারা এরকম একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিরুদ্ধে বিপদসংকেত দিয়ে দিয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, চীন থেকে আসা কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে থাকা যে সব মার্কিন কোম্পানি ভারতে কাজ করে, তারা চীনা দ্রব্য বর্জন করার এই প্রস্তাবিত পদক্ষেপের ব্যপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ।
শুরুর থেকেই অতি দক্ষিণপন্থী অর্থনৈতিক অবস্থান, সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের প্রতি আরএসএস’এর চাটুকারিতা বা দাসসুলভ মনোভাব; ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশদের প্রতি, আর যুদ্ধ পরবর্তী নব্য ঔপনিবেশিক যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আরএসএস'এর মনোভাব একেবারেই বিতর্কের অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং, আরএসএস-চালিত মোদি সরকারের মার্কিন দেশের প্রতি আনুগত্য, এই সরকারের অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে এ কথা সত্যি যে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দীর্ঘমেয়াদী শাসনকালে তিনি বেসরকারিকরণ/ কর্পোরেটাইজেশনের অতি দক্ষিণপন্থী মডেলের জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু গুজরাট কাণ্ডের পরে, আমেরিকার ভিসা অনুমোদিত না হওয়ায় মোদি মার্কিন দেশের মাটিতে পা রাখতে পারেননি। এ ব্যপারটাই হয়তো তাকে চীনের শাসকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য উৎসাহিত করেছে, যার জন্যে মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চার বার এবং ফের ২০১৫-১৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বার চীন সফরে গেছেন।
২০১১ সালের নভেম্বরে মোদির ৫-দিনের চীন সফর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, কারণ এই সফর তার চীনে যাওয়ার ওপর মনমোহন সরকারের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ছিল। মোদি চীনে যান হংকং হয়ে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে বেইজিং'য়ে ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে পৌঁছলেন আর এই সফরের দরুণ তিনি এমন অনেক চীনা কোম্পানির সাথে সাক্ষাৎ করলেন, যারা কিনা গুজরাটে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এর পরে এল ২০১৩ সালের ভাইব্র্যান্ট গুজরাট আর ২০১৪ সালেই রাজ্যে চীন দেশীয় বিনিয়োগের ব্যাপারে ৯,০০০ কোটি টাকার চুক্তিতে পৌঁছলেন মোদি। গ্রেট ওয়াল মোটর্স কোম্পানি লিমিটেড এবং সাংহাই অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন রাজ্যে যানবাহন তৈরির অনেক বড় কারখানা স্থাপন করতে রাজি হয়, আর তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আদানির মুদ্রা পোর্টে কৌশলগত চীনের বিনিয়োগ। যেখানে মুম্বই এবং তুতিকোরিনের মতো পোর্টগুলো নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ের কারণে চীনা বিনিয়োগের অনুমতি পায়নি, মুদ্রা পোর্টের ওপর চীনের বিনিয়োগ একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। সত্যি বলতে কি, চীনা বিনিয়োগের জন্য ব্যাপক হারে রেড কার্পেট বিছিয়ে দেওয়াও কিন্তু কেন্দ্রে তৎকালীন ইউপিএ সরকারের বিরোধ উপেক্ষা করেই। আর গুজরাটকে চীনা বিনিয়োগের হটস্পট বানানোর অংশ হিসেবেই মোদি মান্দারিন (চীনের রাষ্ট্রভাষা) কোচিং ইন্সটিটিউট এবং গুজরাটের বিশ্ববিদ্যালয়ে মান্দারিনের পাঠ্যক্রম চালু করারও সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন।
কোনও সন্দেহ নেই যে এই 'গুজরাটি চীনি ভাই ভাই' প্রোজেক্টের গতি মোদি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়াতে আরও বেড়ে গেল আর তার নির্বাচনে চীনের মিডিয়া ‘গুজরাট মডেল’কে সাধুবাদ জানাতে থাকল। এরপর ২০১৪ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি আহমেদাবাদে এলেন, যার ফলে গুজরাটে চীন দেশীয় বিনিয়োগ অগ্রগতির মুখ দেখল আর ভারত চীনা পণ্যের একটি আস্তাকুঁড়ে পরিণত হল। ২০১৯ সালের ভাইব্র্যান্ট গুজরাট সামিটে এসে হুয়াওয়েই সহ চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তিবদ্ধ বিনিয়োগের পেছনে কিন্তু ছিল ১৭০০০ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি। এছাড়া, ২১,৪০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব তো ছিলই, যা কিনা ঢোলেরা স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট জোনে চিনের সোলার জায়ান্ট ইস্ট হোপ গ্রুপ এবং ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানির পাওয়ার প্লান্টের সম্মিলিত বিনিয়োগ। এটা ২০১৭ সালের সেই ২২৫০ কোটি টাকার সেই চুক্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, যে চুক্তি আদানির সাথে চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়েছিল। চীনের সাথে এই যোগাযোগের আরও অন্য দিকও নিশ্চয়ই ছিল।
ইতিমধ্যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা পাওয়ার পরেই মোদি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা হল তার অতি দক্ষিণপন্থী গুজরাট মডেলের ভারত-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তা, যা মনমোহনমিক্স থেকে মোদিনমিক্সে অবস্থান্তরের একটি পূর্বাবস্থা। একই সাথে এটাও সত্যি যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আরএসএস'এর ঐতিহাসিক আনুগত্যের রীতি মেনেছেন মোদি, এমনকি অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে শি’র সঙ্গে সৌহার্দ্য এবং চীনের সাথে সুযোগ-সন্ধানী সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারেও তা সত্যি। আর এভাবেই বিগত ৬ বছরে মোদি মার্কিন দেশের কৌশলগত জুনিয়ার অংশীদার হিসেবে দেশের অবস্থান পোক্ত করেছেন, চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক মতান্তরের ব্যপারে ওয়াশিংটনের সাথে অনেক সামরিক পার্টনারশিপে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে। অতঃপর ৬৪ বছরের পুরনো যোজনা আয়োগ তুলে দেওয়া সহ নেহেরুপন্থী রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের নকশার পড়ে থাকা যা কিছু অংশ, সব একটু একটু করে সরিয়ে ফেলে রাষ্ট্রকে ‘কর্পোরেট সহায়ক’এ রূপান্তরিত করা হল। এর পরে ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরে প্রবল ঢক্কানিনাদের মাধ্যমে মোদি তার আকর্ষণীয় পরিকল্পনা 'মেক ইন ইণ্ডিয়া' নিয়ে এলেন। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের স্বল্পমূল্যের কর্মশালা হিসেবে চীনের অভিজ্ঞতাকে অনুসরণ করে ভারতকে বিশ্বের এমন একটি কারখানায় পরিণত করা, যেখানে নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিকদের দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো হয়। এর লক্ষ্য ছিল 'সহজে ব্যবসা করার' বিষয়টাকে আরও উন্নত করে, বিদেশি পুঁজির প্রবেশ এবং প্রস্থানের পথে সমস্ত বাধা সরিয়ে ফেলে, আর বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভারতকে স্বল্প মূল্যের শ্রমিক তৈরি করার কারখানা হিসেবে দেখানো। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নেওয়া সে সব পদক্ষেপ হিসেবে, শ্রমের ব্যাপক উদারীকরণ, বিভিন্ন বহুজাতীয় কোম্পানি ও তাদের ভারতীয় জুনিয়ার অংশীদারদের জন্যে পরিবেশ এবং শ্রমের অবাধ শোষণের সুবিধার্থে নিয়ে আসা কিছু পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের কথা বলা যায়। নব্য উদারনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে মোদির উঁচুদরের সফরগুলোর সঙ্গে সঙ্গে 'মেক ইন ইণ্ডিয়া'র যে পূর্বাভাস, তা শাসক দলের এই মেকি জাতীয়তাবাদের মাঝে আন্তর্জাতিক পুঁজির ওপর ভারতের ভয়াবহ রকমের নির্ভরশীলতার একটি পথনির্দেশিকা তৈরি করে দিয়েছে।এই পরিপ্রেক্ষিতেই চীন একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হওয়ার সুবাদে, আর জিডিপিতে তাদের উৎপাদনের ৩০ শতাংশ (যেখানে ইউএস'এর ক্ষেত্রে সেই পরিমাণটা হল ১১ শতাংশ) অবদান রাখার সুবাদে, মোদির 'মেক ইন ইন্ডিয়া'র সুবিধা নেওয়ার মতো অবস্থানে আছে। এর পটভূমিকা ইতিমধ্যেই মোদি আর শি’র বন্ধুত্বের মাধ্যমে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে মোট ১৮টি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মোদির সাথে হওয়া শি’র মিটিংগুলির কথাও উল্লেখযোগ্য! পশ্চিমি দেশের তুলনায় আরও কম দামের এবং বেশি কর্মদক্ষ প্রযুক্তি চীনকে ভারতবর্ষে বাজার দখল করতে সাহায্য করেছে। খুব সম্ভবত, এ ক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ হিসেবে ২০১৭ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে বেইজিং প্রোটেক লিমিটেড সায়েন্স কোম্পানির চুক্তির কথা বলা যেতে পারে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হল বুলেট প্রুফ জ্যাকেট বানানোর জন্য মেটিরিয়াল ফ্যাব্রিক এবং বোরন-কার্বন হোয়াইট পাউডার আমদানি করা (www.thepolicytimes.com)। আগে এইসব কাঁচামাল/মধ্যবর্তী জিনিসপত্র নেদারল্যান্ডস বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আমদানি করা হত। কিন্তু এই পরিবর্তন অপরিহার্য করে তোলা হয়েছিল, কারণ চীনের জিনিসপত্র ৬০-৭০ শতাংশ বেশি সস্তা। আর ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস'এর তৈরি করা গুণের মাপকাঠি অনুযায়ী জিনিসের গুণমান নির্ধারণ করার জন্য নানান পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাবার পরেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গিয়েছিল। যখন চীনের এই চুক্তির ব্যাপারে যথারীতি সেই নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠল, ভি কে সারস্বত (নীতি আয়োগের সদস্য এবং ডিআরডিও’র প্রাক্তন প্রধান) সরকারের ‘অসহায়তা’কে এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন: 'এটা একটা বাজারগত শক্তি, এ ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ কিছুই করার নেই। শুধুমাত্র, যদি আমরা দেখি যে এই বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটগুলো খুব একটা ভালো নয়, তবেই আমাদের কিছু বলার আছে। তবে এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনও পরিস্থিতি আসেনি।' চীনের দ্বারা ব্রাজিল, পোল্যান্ড, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি ভারতের নোট ছাপানোর খবর (চীন হল একমাত্র দেশ, যে কিনা ব্যাঙ্ক নোটের দুদিকেই নোট ছাপানোর ইন্ট্যাগ্লিও স্টাইল কালার ডান্সের মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারে নোটের নিরাপত্তার জন্যে) মিডিয়ায় এসেছিল (ডেকান ক্রনিক্ল, ১৮ই এপ্রিল ২০১৮)। কিন্তু একজন কর্তাব্যক্তি, তার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে, পরে বিষয়টাকে অস্বীকার করেছেন।
সেই বাজারের আইন, যা কিনা এখন নব্য উদারপন্থী বিশ্বায়নকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা শেষ অবধি 'মেক ইন ইন্ডিয়া'র আবরণ সরিয়ে তাকে 'মেড ইন চায়না' হিসেবে প্রকাশ করে দেওয়ার পক্ষে চূড়ান্ত নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। মোদির শাসনব্যবস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক আরও মজবুত করে ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিক ষড়যন্ত্রের কৌশলগত বুনিয়াদে পরিণত করেছিল। কিন্তু মার্কিন দেশ অনেক অতিপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিল, আর সেই সাথে ছিল বেশি দামের সমস্যা। এই বিষয়টাই বিভিন্ন বিনিয়োগের ক্ষেত্র থেকে বাস্তবসম্মত ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দেওয়াতে চীনকে সক্ষম করেছিল। সেই মতোই, ভারতে মোট চীনের বিনিয়োগ ২০১৪ সালে ১.৬ বিলিয়ান ডলার থেকে ২০২০ সালে ৮ বিলিয়ান ডলারে গিয়ে পৌঁছেছিল। যদি পরিকল্পিত এবং প্রস্তাবিত বিনিয়োগ এর সাথে যোগ করা হয়, তাহলে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬ বিলিয়ান ডলারে (এ হল প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা, আর ওদিকে হিসেব মতো ভারতীয় বিনিয়োগ মোটে ৭০০০ কোটি টাকা)। তবে এ কথা ঠিক যে, কোনও কোনও পর্যবেক্ষকদের মতে, চীনের পুঁজিবাদী বিনিয়োগের একটা বড় অংশ অনেক সময়েই অন্য পথে নিয়ে যাওয়া হয়, মানে তা করা হয় সিঙ্গাপুরের মতো কোনও তৃতীয় দেশ থেকে। প্রকৃত অর্থে সিঙ্গাপুর এখন ভারতের জন্য বিদেশি বিনিয়োগের বৃহত্তম উৎসস্থল। ইউপিএ’র শাসনকালে মরিশাস ছিল ভারতের জন্য এফডিআই'এর সব থেকে বড় উৎস, যাকে কিনা ভারতে মার্কিন পুঁজি রফতানি হিসেবে ছদ্ম আবরণ দেওয়া হয়েছিল (এটা করা হয়েছিল ভারত এবং মরিশাসের মধ্যে ট্যাক্স অ্যাভয়ড্যান্স ট্রিটির সুযোগ নিয়ে)। এখন মোদির শাসনে সিঙ্গাপুরের দ্বারা ভারতে সব থেকে বড় পুঁজি রফতানিকারী দেশ হিসেবে মরিশাসের স্থান দখল করে নেওয়ার বিষয়টা চীনের ওপর ভারতের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার পাশাপাশি পাঠযোগ্য। যদিও এ বিষয়ের ওপর নির্ভরযোগ্য তথ্য খুবই কম এবং বিরল।
এখন মূলত প্রযুক্তির খাতে জোর দেওয়া চীনের বিনিয়োগের বিষয়ে নজর দিলে বলা যায় যে এই চিত্রটা খুবই জটিল। ২০০৮ সালের মধ্যেই ১০০০ কর্মচারী-সমন্বিত ভারত (ব্যাঙ্গালোর) শেনজেন-ভিত্তিক হুয়াওয়েই টেকনোলজিস কোম্পানি লিমিটেডের কাছে সব থেকে বড় বিদেশি গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে। ফাইভ জি’র ক্ষেত্রে বিশ্বে অগ্রগণ্য হুয়াওয়েই টেকনোলজিস কোম্পানি লিমিটেড'কে সব থেকে বড় কৌশলগত ফ্রণ্টিয়ার প্রযুক্তি হিসেবে ধরা হয়। ইতিমধ্যেই ভারতে এই কোম্পানির ফাইভ জি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খবর পাওয়া গেছে, যা অনেকটাই ট্রাম্প প্রশাসনের পরামর্শের পরিপন্থী। তবে সীমান্ত নিয়ে মতবিরোধের আবহে এর ভবিষ্যৎ কার্যক্রম অনিশ্চিত। মোদি ক্ষমতায় আসার পরে গেটওয়ে হাউসের হিসেব অনুযায়ী, চীনের প্রথম সারির টেক বহুজাতিক সংস্থাগুলি ভারতে স্টার্ট আপ'এর ক্ষেত্রে ৪ বিলিয়ান ডলার (৩০,০০০ কোটি টাকা) লগ্নি করেছে। মোদি শাসনের পাঁচ বছর পার করে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের মার্চে ভারতের ৩০টি ইউনিকর্ন কোম্পানির (ইউনিকর্ন কোম্পানি এমন একটি স্টার্ট আপ কোম্পানি যার মূল্য ১ বিলিয়ান ডলারের বেশি) মধ্যে ১৮টিই চীনের অর্থ সাহায্যে চলে। আরও ৯২টি কম বিনিয়োগের স্টার্ট আপ কোম্পানিকেও অর্থ সাহায্য করে চীন।
চীনের সফটওয়ার কোম্পানিগুলো যেমন, আলিবাবা, বাইটডান্স, টেনসেন্ট হুয়াওয়েই, জেডটিই; মোবাইল কোম্পানিগুলো যেমন, অপ্পো, ভিভো, ওয়ান প্লাস, কুলপ্যাড, মোটোরোলা, লইকো, লেনোভো, মিজু, অনার, জিওনি, জিফাইভ, হেয়ার, টিসিএল এবং অটোমোবাইল জায়ান্টগুলো যেমন, ভলভো, এসএআইসি, নিপ্পন, সাংহাই ইলেক্ট্রিক, বেইজিং অটোমোটিভ, ওইসকো, চায়না ডংফ্যাং, ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষে গভীর শিকড় বিস্তার করেছে। ডিডি, চান্ক্সিং, শানওয়েই ক্যাপিটাল, ফসান ক্যাপিটাল, চায়না ইউরেশিয়া ইকনমিক কর্পোরেশন ফান্ড হল চীনের কিছু বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানি যারা ইন্ডিয়ান স্টার্ট আপ কোম্পানিদের অর্থ সাহায্য করে থাকে। সেই সব ইন্ডিয়ান স্টার্ট আপ কোম্পানির উদাহরণ হিসেবে পেটিএম, ওলা, স্ন্যাপডিল, সুইগি, ফ্লিপকার্ট, মাই ডর্মাসি, হাইক মেসেঞ্জার, আইবিবো আর মেক মাই ট্রিপ, ড্রিম ১১, বাইজু’স অ্যাপ, বিগ বাস্কেট, ডেলহিভারি, ওয়ো, পলিসি বাজার, কুইক্র, রিভিগো, উড্ডান, জোমাটো ইত্যাদির কথা বলা যায়। চীনের ভিডিও অ্যাপ টিকটকের ২০০ মিলিয়ন ভারতীয় গ্রাহক আছে। ভারতে এই ভিডিও অ্যাপ ইউএস-ভিত্তিক ইউটিউবকে ছাড়িয়ে গেছে। আলিবাবা, টেনসেন্ট, বাইটড্যান্স, ভারতে ফেসবুক, অ্যামাজন, গুগ্লদের মতো ইউএস জায়ান্টকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। অপো আর জিয়াওমির মতো চীনের স্মার্টফোন ভারতের স্মার্টফোনের বাজার ৭২ শতাংশ দখল করে নিয়েছে, আর দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং এবং মার্কিন অ্যাপ্লের মতো ব্র্যান্ডকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। আর ভারতে ৫টি সেরা মোবাইল ফোন ব্র্যান্ডের মধ্যে চারটেই হল চীনের কোম্পানি। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সমতুল্য বিনিয়োগের ধারা না মেনে যেহেতু চীন দেশিয় বিনিয়োগ জটিল সংযোগ সহ দ্রুতগামী ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তির এলাকায় (ফাস্ট মুভিং ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি এরিয়া) হয়ে থাকে, সেই কারণেই তাদের প্রভাবকে এই ধরনের বিনিয়োগের আয়তনের তুলনায় সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করা হয়। এখন, এটা পাঠকরাই ভাল করে ভেবে দেখুক যে, চীনকে বয়কট করার সামর্থ্য আদৌ ভারতের আছে কিনা ।
এর সাথে সাথে শিল্প এবং কারিগরির বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের পুঁজির প্রবেশ ঘটছে। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সৌরশক্তি উৎপাদনকারী সরঞ্জাম, কেমিকাল, অ্যালুমিনিয়াম, পশুখাদ্য, অটোমোবাইল, ধাতুবিদ্যা, নির্মাণকার্য, রেল এবং বন্দরের নির্মাণ ইত্যাদির কথা। ব্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রেও পিপ্ল্স ব্যাঙ্ক অফ চায়না (পিবিওসি) ভারতে বিভিন্ন ঘুঁটি সাজিয়েছে। খুব সম্প্রতি পিবিওসি ভারতে হাউজিং ডেভেলপমেন্ট ফিনান্স কর্পোরেশন লিমিটেডের (এইচডিএফসি) ওপর অংশীদারিত্বের জন্য আরও টাকা লগ্নি করেছে। এমনকি এখানে প্যাটেলের ৬০০ ফিট উঁচু মূর্তির কথাও বলতে হয়, যা কিনা তাঁর প্রতি মোদির উঁচু মাপের শ্রদ্ধাঞ্জলী। ২৯৯০ কোটি টাকায় তৈরি সেই স্ট্যাচু অফ ইউনিটিও মেড ইন চায়নার শিলমোহর বিরহিত নয়। ২০১০ সালে মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই মূর্তির কথা ঘোষণা করা হলেও এই স্ট্যাচু অফ ইউনিটির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে। ১৭০০ মেট্রিক টন ওজনের ৬৫০০টি ব্রোঞ্জ প্যানেলের গোটাটাই জিয়াংক্সি টঙ্কিং মেটাল হ্যান্ডিক্রাফ্ট্স লিমিটেড কোম্পানিতে ঢালাই হয়েছিল, কারণ ভারতবর্ষে সেরকম সুযোগ-সুবিধা নেই।
ওদিকে ভারতের যে সব পিএসইউ'গুলো উন্নত সেমিকন্ডাক্টারে গবেষণাতে রাজি হয়েছিল, তাদের অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ভেঙে ফেলা বা দুর্বল করে দেওয়া হল। পাশাপাশি, ঝুঁকি সাপেক্ষ কর্পোরেটাইজেশনের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা ভারী শিল্প বা প্রযুক্তির উন্নয়নের ব্যপারে বড় একটা আগ্রহী নয়। ইতিমধ্যে, 'মেক ইন ইন্ডিয়া' এবং আত্মনির্ভর ভারতের পোস্ট ট্রুথ পূর্বাভাসের প্রভাবে ভারতের বেসরকারি কর্পোরেট সেক্টরকে বিদেশি সহযোগিতা বা যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রযুক্তি আমদানি করতে উৎসাহিত করা হচ্ছিল। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অন্যান্য দেশের সেই বহুজাতিক সংস্থাগুলো যারা কিনা আইটি, জৈব প্রযুক্তি (তবে ভারি শিল্পের ক্ষেত্রে নয়) আর অন্যান্য ক্ষেত্রে উদার আবহাওয়ার প্রভাবে ছুটে আসছে, তারা প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং উন্নতিকরণের জন্যে একেবারেই ইচ্ছুক নয়। কোভিড-১৯ এসে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ না হলে কোনও দেশই আত্মনির্ভরশীলতার দিকে যেতে পারে না। ভারতের মতো এক বিশাল এবং বৈচিত্রপূর্ণ দেশের কাছে বাইরের দেশ থেকে অনুকরণ করার মতো কোনও মডেল নেই। বেসরকারি কর্পোরেট ক্ষেত্রের ওপর নির্ভরশীলতা, বহিরাগত উৎস থেকে অর্থের যোগান এবং মানুষের যোগদান সহ পরিকল্পিত সরকারি হস্তক্ষেপের বিনিময়ে অফশোর ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ক্ষেত্র (স্বল্পমূল্যে শ্রম পাবার জন্য অন্য দেশে বাণিজ্য স্থানান্তরিতকরণ)- এসবই ভারতের পক্ষে আত্মঘাতী হয়ে উঠছে। চীনের সঙ্গে চলতে থাকা সীমান্ত নিয়ে বিরোধ ভারতের নিরাপত্তাহীনতাকে আরও বেশি করে প্রকট করে দিয়েছে। এখন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর জন্যে, এরকম খারাপ পরিস্থিতিতে সঠিক রাজনৈতিক বিকল্পের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবার চূড়ান্ত সময়।অনুবাদ: মঞ্জিস রায়
No comments:
Post a Comment