যে কথাগুলি কেউ বলছেন না
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
পশ্চিমবঙ্গে গোদি মিডিয়ার টিভি চ্যানেলগুলি খুললেই এখন ‘হা রে রে রে’ রব। যেন সারা রাজ্য জুড়ে ডাকাত পড়েছে। ক্রম অগ্রসরমান নির্বাচনী রণাঙ্গণে দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী যেন একে অপরকে মহাকলরবে পরস্পরের দিকে রে রে করে তেড়ে যাচ্ছে। কোথায় দিল্লির সীমান্তে লাখে লাখে কৃষক প্রায় ৪০ দিন ধর্না দিয়ে পড়ে আছেন, করোনা-বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে ‘হা-অন্ন হা অন্ন’ রব, ‘দেশিয়’ ভ্যাকসিনের রাজনীতি ও কেরামতিতে যখন আতঙ্কিত দেশবাসী, কর্মহীন মানুষের বিপুল স্রোতে এক আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থা- তখন এ রাজ্যের গোদি মিডিয়া ‘রাম রাম’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস সচকিত করছে। যেন, রামভক্তদের পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা আরোহন নিছক সময়ের অপেক্ষা। আর সেই অপেক্ষার তর গোদি মিডিয়ার মোটে সইছে না, তাই গেরুয়া শিবিরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ বিধৃত করে এদের আপাত জীবন-যাপন। বীতশ্রদ্ধ হয়ে বহুজনে এখন টিভি দেখা বন্ধ রেখেছেন, বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরের নানান রকমফের থেকে তবুও অনেক কিছু পাওয়া যাচ্ছে।
তাই, নেতাদের দলবদল ও আকচাআকচি থেকে মুখ ফিরিয়ে আমরা সাধারণজনেরা বরং অনেক বেশি কথা বলতে চাইব নিজেদের দাবিদাওয়া ও অভাব-অভিযোগ নিয়ে। দেশ ও রাজ্য কোনদিকে এগোচ্ছে, আমাদের সমস্যাগুলিই বা কোথায় আর কীভাবে নিজেদের আরও কার্যকরী ভাবে আগুয়ান করা যায়, সেই হতে পারে প্রকৃত কথা ও বার্তা।
যেমন ধরা যাক, দিল্লির সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকদের কথা। এই অবস্থান সারা দেশের জন্যই এক অভূতপূর্ব বার্তা বয়ে আনছে। একদিকে তা যেমন গোটা দেশের কৃষক সমাজকে রাজনৈতিক দলের উর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ করেছে, অন্যদিকে তা এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির আলোকবর্তিকা হিসেবেও উদিত হয়েছে; এই অর্থে যে, কৃষিকাজ ও কৃষক সমাজের সঙ্গে সমাজের ক্ষমতাশালী বৃত্ত (যেমন কর্পোরেটকুল বা শাসকশ্রেণি) এতদিন যে আধিপত্যের সম্পর্ক বজায় রেখেছে ও কৃষক সমাজকে প্রান্তিক করেই নিজেদের অতি-মুনাফা উশুল করেছে, তা আজ ঘোরতর প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে। কৃষকদের এই নবজাগরণ ও ক্ষমতায়নের প্রশ্নকে বাদ দিয়ে আগামী যে কোনও নির্বাচনে কোনও এজেন্ডাই তৈরি হতে পারে না। গোদি মিডিয়া এ নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক নীরবতা অবলম্বন করতে পারে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচনে কৃষক সমাজের পক্ষ থেকে কতকগুলি দাবির উত্থাপন এখন অনিবার্য:
ক) সমস্ত শস্যের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করতে হবে;
খ) চাষবাসের এলাকা থেকে দু-তিন কিলোমিটার অন্তর সরকারি মান্ডি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে;
গ) প্রান্তিক ও ছোট চাষীদের শস্য কেনার ব্যাপারে সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে;
ঘ) বেসরকারি সংস্থাকেও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা তার উপরে দাম দিয়েই শস্য কিনতে হবে।
আমরা জানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে ও ভার্চুয়াল জগতের বিপুল প্রসারে এমন এক আর্থিক ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে যেখানে কাজ ও কাজের জগতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। নিত্য নতুন কাজের এলাকা ও পরিসর যেমন তৈরি হচ্ছে, আবার পুরনো কাজের জগৎ ও এলাকা হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন যে কাজের পরিসর উঠে আসছে, তাও খুব দ্রুত বদলে বদলে যাচ্ছে। অল্প কথায় বললে, শ্রম ও শ্রম বাজারে যেমন বহু কাজ বিদায় নিয়েছে, নতুন কাজেরও প্রসার হয়েছে। কিন্তু নতুন এই কাজগুলি সব সময় স্থায়ী বা চিরকালীন নয়। এক কথায়, এমন এক নমনীয় কাজের ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠছে যেখানে কাজের স্ফীতির সঙ্গে অপ্রতুলতাও একযোগে বিরাজ করছে। কেউ কেউ এই নতুন ব্যবস্থাপনাকে ‘গিগ’ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করেন যেখানে আদত কথাটা হল: কাজ আছে চাকরি নেই। অর্থাৎ, প্রায় সমস্ত কাজগুলি অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক, স্বল্প সময়ের বা অনিশ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা, কাজের নির্ঘন্ট ও নির্দিষ্ট সময় বলে আর কিছু থাকছে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঠিক করে দিচ্ছে, কার কখন কতটা কাজ ও মজুরি। এই অবস্থা কাজের জগতে এক ভয়ঙ্কর বিপন্নতা ও আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি করেছে। উনিশ শতকের শ্রমিকদের ১২-১৪ ঘন্টা কাজের যে রীতি ও সার্বিক দুরবস্থা ছিল, তাই যেন আবার নতুন করে ফিরে এসেছে। কাজের এই পরিবেশ ও সম্পর্ক পালটে যাওয়ার ফলে বহু ক্ষেত্রেই শ্রমদানকারীরা শ্রমিকের মর্যাদাও পাচ্ছেন না। তাদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে না দেখিয়ে ‘পার্টনার’ হিসেবে দেখানোর রেওয়াজ চালু হয়েছে, যা শ্রম-উৎসারিত আয়ের বন্টনের ক্ষেত্রে ‘মজুরি’ হিসেবে না দেখিয়ে ‘শেয়ার’ হিসেবে এখন দেখানোর চল। ‘প্ল্যাটফর্ম’ অর্থনীতির নাম করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চালনায় ‘শেয়ার’এর ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োজনের এই নতুন আয়োজন এখন সুবিদিত ও প্রচলিত। যেমন, ‘আর্বান ক্ল্যাপ’, ‘উবের’এর তথাকথিত পার্টনার কর্মী বা ড্রাইভাররা বা বিভিন্ন অনলাইন সংস্থায় যারা ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থার কথা সকলেই জানেন। ফলে, শ্রমিক হিসেবে যে ন্যূনতম বিধিব্যবস্থা চালু থাকার কথা, যেমন, ন্যূনতম মজুরি, পিএফ, ইএসআই, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি, তা এইসব ‘শেয়ার’ ভিত্তিক ক্রিয়াকর্মে নাকি প্রযোজ্য নয়। অতএব, তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা বলতে কিছুই নেই। উপরন্তু, কাজেরও কোনও নিরাপত্তা নেই। কাজ এই আছে তো এই নেই।
উল্লেখ্য, এই বিপুল নতুন শ্রমবাহিনীর জন্য কেউই কিছু বলছেন না। এদের জন্য কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও এজেন্ডা বা আওয়াজও নেই। তাই এই মূল দাবিগুলি ওঠা উচিত:
ক) অনলাইন ব্যবস্থায় কর্মরত কর্মীদের কাজের মর্যাদা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে;
খ) যে যেখানে কর্মরত তাঁদের সেই সমস্ত অনলাইন সংস্থার ‘কর্মী’ হিসেবে গণ্য করতে হবে;
গ) এই কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করতে হবে।
এর পাশাপাশি এ রাজ্যে রয়েছেন এক বিশাল ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং উদ্যোগপতি যারা নিজ শ্রমে নিজ বিনিয়োগে দিনাতিপাত পরিশ্রম করে দিন গুজরান করেন। দীর্ঘ লকডাউনের কারণে এঁদের কাজকর্মে প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, ই-কমার্স ও হোম-ডেলিভারির বাড়বাড়ন্তে এদের পেশাগত জগতেই বিশাল বিপর্যয় নেমে এসেছে। পাড়ায় পাড়ায় বহু মুদি-স্টেশনারি বা খাবারের দোকান বিপন্ন, ফুটপাতে হকারদের কেনাবেচাও বহু গুণে অধোগামী, টুকিটাকি গৃহস্থালী শিল্পের বাজারও ধুঁকছে। নিজেদের উদ্যোগ চালাতে পরিশ্রান্ত এইসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সামনে এখন ঘোর অন্ধকার। এঁরা সমাজের এক বিশাল অংশ। এঁদের কথাও নির্বাচনের ম্যানিফেস্টোতে আসতে হবে:
ক) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতিদের জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প তৈরি করতে হবে;
খ) হস্তশিল্প ও অন্যান্য ক্ষুদ্র উদ্যোগের গৃহস্থালী পণ্যগুলিকে সরকারি তরফে ক্রয়-বিক্রয়ের আয়োজন করা হোক;
গ) এঁদের উদ্যোগের স্বার্থে অত্যাল্প সুদে সহজ ঋণের সর্বজনীন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা উচিত।
ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, জাতি নয়, জাতপাত নয়- সমাজের বৃহত্তর মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক মুদ্দাগুলিকে সংহত করেই আগামী নির্বাচনের এজেন্ডা তৈরি হবে। বহু দাবি ও এজেন্ডা এখনও অনাদায়ী, তা নিয়ে প্রচার ও আন্দোলনও চলবে। আমি এখানে চেষ্টা করলাম, সমাজের বিপুল এক অংশের কথা বলতে, যাদের দাবিদাওয়া সেভাবে আলাদা করে কেউ ভেবে দেখেন না। বিশেষত, নব-উত্থিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রাঙ্গণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত নতুন যে ‘গিগ’ শ্রমবাহিনীর আত্মপ্রকাশ, তাঁদের কথা কোনও রাজনৈতিক দলই এখনও সেভাবে বলছেন না। কারণ, তাঁদের ব্যাপক অস্তিত্ব এইসব রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিগোচরেই আসেনি।
দিল্লির সীমান্তে কৃষকেরা যে দীর্ঘস্থায়ী ও অবিশ্বাস্য এক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন তা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক-অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে বলে আমার বিশ্বাস। সমাজ-ভাবনার সব উপাদান তো আর সাহেবদের মাথা থেকে আসে না (যেমন এ দেশে অনেকে তাকিয়ে থাকেন), এই মাটিতেও যে তা নির্মিত হয়, তা আরও একবার পণ্ডিতদের বিনয়ের সঙ্গে মেনে নেওয়া যথাযথ হবে। একইভাবে, দেশ জুড়ে ও এ রাজ্যেও প্রযুক্তির অভিঘাতে যে নতুন অর্থনীতির জন্ম হয়েছে, তার আধারেই আজকের মেহনতি শ্রমবাহিনীকে নির্দিষ্ট করে এবং তাঁদের দাবিদাওয়াগুলিকে সংহত করেই প্রকৃত এজেন্ডা গড়ে উঠবে। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষকে হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-বিহারী, ঘটি-বাঙাল, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণে বিভাজন করে যে বিভেদকামী রাজনীতি এ দেশের মাটিতে আপাত সাফল্য পেয়েছে (যদিও তা এখন নিম্নমুখি), তার বিপ্রতীপে কৃষক সমাজ সহ সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে তাঁদের রুটি-রুজি-মর্যাদা-স্বাধীনতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করেই এক প্রকৃত গণপ্রজাতান্ত্রিক ভারত গড়ে উঠতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচন এই ক্ষেত্রে অবশ্যই পথ দেখাবে।
সাম্প্রতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির সঠিক বিশ্লেষণ ও অত্যন্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী দাবী রেখেছেন এই সামাজিক দায়িত্ববান লেখক যা বঙ্গবাসীর জীবন ও জীবিকাকে অনেকটা সুরক্ষিত করতে পারে।
ReplyDeleteউন্নততর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনীয় কিছু সময়োচিত পদক্ষেপের উল্লেখও দরকার আসন্ন নির্বাচনী দাবী সনদে।
খুব পরিস্কার এবং নির্দিষ্ট হয়েছে এই লেখাটি। চলমান কৃষক আন্দোলন কিভাবে গোটা কৃষক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে এক সুস্পষ্ট মৌলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবীকে সামনে এনেছে,অন লাইন ক্ষেত্রের অসংগঠিত কর্মীদের সেক্টরভিত্তিক কিভাবে এক স্বাধীন বর্গ হিসেবে উঠে আসার ঐতিহাসিক অনিবার্যতা দেখা দিয়ছে এবং ক্রমশ সংকটাগ্রস্ত আরেকটি, কার্যত মেহনতী ও পরিশ্রমী সমুদায়-- ছোট মাঝারী ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোগী সমাজ, তাকেও যেভাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ যে কোনো দল ও সংগঠনের কাছে এই প্রবন্ধ বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য বলে মনে করি।
ReplyDeleteVery constructive suggestions.
ReplyDeleteঠিক বিষয়গুলিকে সামনে আনা হল। ভাল লেখা ।
ReplyDelete