আমার জীবনের ধ্রুবতারা
আনসারউদ্দিন
সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার পরিচয় নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে। তখন সবেমাত্র আমি লিখতে এসেছি। বয়সের তুলনায় লেখালেখি শুরু করেছি অনেক দেরিতে। বেথুয়াডহরি থেকে প্রকাশিত 'বনামি' পত্রিকায় 'আবাদ' নামে আমার একটি গল্প প্রকাশ পায়। এটিই আমার প্রথম গল্প। গল্পটি পড়ে কবি কনক ঠাকুর আমাকে একটি হাতচিঠি লিখে দেন কৃষ্ণনগরের গল্পকার সুবোধ দাসের উদ্দেশ্যে। সুবোধ দাস থাকতেন হাতার পাড়ায়। ওখানে দেখেছিলাম সুধীর চক্রবর্তীকে। প্রতি রবিবার সুবোধ দাসের বাড়িতে সাহিত্যের আড্ডা বসত। আমিও গিয়ে পড়েছিলাম ওইদিনেই। তখন বেলা ১১'টা মতো হবে। জমে ওঠা আড্ডার মাঝে আমি এক আগন্তুক। চাষি মানুষ। মাথায় উস্কোখুসকো চুল। বোশেখ মাস। মলিন পোশাক। ধূলি ধূসরিত হয়ে চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে। আমি যাঁকে গল্পকার সুবোধ দাস ভাবছি তিনি বলে উঠলেন- আমি সুবোধ নই, আমি সুধীর চক্রবর্তী। ওই যে সুবোধ।
সুধীরবাবুর নামটার সঙ্গে তেমনভাবে পরিচিত ছিলাম না। যদিও আমি কৃষ্ণনগর কলেজে পড়াশুনা করেছি। এ আমার দুর্ভাগ্য। সবই সময়ের ফের। সময়ের ফের বলছি এ কারণেই, আমি যে বছর কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হই তার আগের বছর তিনি চন্দননগর কলেজে চলে যান। আবার যে বছর স্নাতক হয়ে চলে আসি ঠিক তার পরের বছর উনি কৃষ্ণনগর কলেজে বহাল হন। সুধীরবাবুর সঙ্গে এরকম একটা কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে গিয়েছে ছাত্র জীবনে। এখনও অনেকে বলেন, কৃষ্ণনগর কলেজে পড়েছ অথচ সুধীরবাবুর ছাত্র ছিলে না, বিশ্বাস হয় না। মানুষ যখন আশ্চর্য চোখে আমার দিকে তাকায় তখন আমার কষ্ট হয়। আমি তো আর জনে জনে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে পারি না।
অন্যদের দেখাদেখি আমিও তাঁকে স্যার বলতাম। কৃষ্ণনগরের স্যার বলতে ঐ একজনই। তা সে হোক, আলু-পটলের খুচরো বিক্রেতা থেকে বড় গদির ব্যবসাদার কিংবা কোনও সরকারি আমলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। পরে জেনেছি এঁদের অনেকেই ওঁর ছাত্র ছিলেন না। সুবোধ দাসের হাতার পাড়ার বাড়িতে কনক ঠাকুরের হাতচিঠির দৌলতে সুধীরবাবুর ছাত্র হয়ে গেলাম। সেদিনের রবিবাসরীয় সাহিত্যের আড্ডায় পেয়েছিলাম আনন্দবাজারের সংবাদকর্মী অধীর বিশ্বাস, শৈবাল সরকার, কুন্তল মিত্র ও কবি সঞ্জীব প্রামাণিককে। এদের মধ্যে শৈবাল সরকার ছিলেন 'প্রজ্ঞা' প্রকাশনার অন্যতম প্রকাশক। প্রজ্ঞা থেকেই সুধীর চক্রবর্তীর 'সদর-মফস্বল' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। আমি ওইদিন 'বনামি' পত্রিকাটি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কবি সঞ্জীব প্রামাণিক সর্বসমক্ষে তা পাঠ করে শোনালেন। ঐ একটা গল্প লিখে সবার মন জয় করে নিলাম। সুধীরবাবু বললেন- আনসার তুমি লেখ। ভবিষ্যতে তুমি বড় মাপের লেখক হবে, সে গুণ তোমার মধ্যে আছে।
যেদিন তিনি আমাকে এ কথা বললেন সেদিন তিনি আমার মধ্যে বীজমন্ত্র বপন করে দিলেন। এটা আমার কাছে যেমন চাপের তেমনি আবার শপথেরও। তবে শুধু চাপ আর শপথ নিয়ে তো লেখক হওয়া যায় না। আশীর্বাদেও না। আশীর্বাদ থেকে কারও আয়ু বা পরমায়ু হয়তো বাড়ানো যেতে পারে, কাউকে রোগ ব্যাধি থেকে সাময়িক মুক্তি বা স্বস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লেখক হওয়া? নৈব নৈব চ।
সাংসারিক বা পারিবারিক কাজে কৃষ্ণনগর গেলেই স্যারের সঙ্গে দেখা হত কখনও সখনও। জিজ্ঞাসা করতেন- কী লিখলে? তখনও হয়তো কিছুই লেখা হয়নি। তবুও স্যারকে খুশি করার জন্য বলতাম, একটা গল্প লিখছি স্যার।
'লেখা হলে গল্পটা আমাকে দিয়ে যেও।'
হ্যাঁ স্যার, সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতাম। এই চাপটা না নিলে আমার লেখা এগোয় না। স্যারকে দিতে হবে, যে কারণে লেখার প্রতি আরও যত্নবান হওয়া। এভাবে বেশ কিছু লেখা প্রকাশ পেয়েছে। লেখা বলতে গল্প। আমি নিজে থেকে ওঁকে কখনও লেখা বা গল্প প্রকাশের অনুরোধ করিনি। আসলে অতি লিখিয়ে নই আমি। যা লিখতাম ভাবতাম অনেক বেশি। ভাবতে ভাবতে আগের লেখার বিষয় আশয় মাথার মধ্যে থেকে ফৌত হয়ে যেত। কমবেশি যাই-ই লিখেছি পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছি। পাঠকের ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সুধীরবাবু অনুঘটকের কাজ করেছেন। আমার বিভিন্ন বইপত্র যোগ্য পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। যাঁদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেননি তাঁদের কাছে আমার লেখালিখির ব্যাপারে আলোচনা করতেন। উনি কোথায় কী বলতেন আমি জানতাম না। জানার কথাও নয়। চন্দননগর, কলকাতা, বহরমপুর, মালদা যেখানেই সাহিত্যানুষ্ঠানে গিয়েছি কেউ না কেউ বলে উঠত- আপনার কথা সুধীরবাবু আমায় বলেছেন।
কী বলেছেন না বলেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে চাইনি। তিনি আমার কথা অন্যদের বলেছেন এটাই অনেক। কখনও সখনও মনে হয়েছে স্যার আমার কথা জনে জনে এত বলেন কেন? উনি না বললে আমি কি লেখক হতে পারতাম না। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনা করিনি। আমি জানি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আমার পেশাকে সম্মান করেন। আর আমার গল্পের অনুরাগী। তিনিই আমার মূল অনুপ্রেরণা। আমার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের সদাসর্বদা খোঁজখবর নিতেন। বদলে যাওয়া গ্রাম নিয়ে তাঁর কৌতূহলের সীমা পরিসীমা ছিল না। এক সময় মাইলের পর মাইল হেঁটে গ্রাম পরিক্রমা করেছেন। বর্ষার কর্দমাক্ত আর চোত বোশেখের ধূলিধূসর পথ। পথেরও নানান অলিগলি। সে সব পেরিয়ে প্রান্তিক মানুষের সন্ধানে ফিরেছেন। রাত কাটিয়েছেন আউল বাউল দরবেশ সাঁই ফকিরদের কুটিরে আশ্রমে। সংগ্রহ করেছেন লোকগান আর লোকসংস্কৃতির নানান বিষয়। একজন শহুরে ভদ্রজন, অধ্যাপক মানুষ কীসের টানে দশকের পর দশক শীত গ্রীষ্ম বর্ষা উপেক্ষা করে ব্রাত্য মানুষের জীবনযাপন ও লোকায়ত ধর্মের হালহদিস করেছেন এটাও একটা গবেষণার বিষয়।মূলত গানের টানে বিভিন্ন গ্রাম পরিক্রমা করেছেন। লালন সাঁই কুবির গোঁসাইয়ের গান যেমন তিনি সংগ্রহ করেছেন তেমনি আরও অনেক বাউল ও মুর্শিদি গানকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। অন্তজনের রচনা হলেও এই গানের মধ্যেই বিশ্বমানবের কথা তুলে ধরা হয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যাপী গ্রাম গ্রামান্তরের নানান মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে তিনি একটি আশ্চর্য জগৎ খুঁজে পেয়েছেন।
সুধীরবাবুর সবচেয়ে বড় গুণ, যে কোনও ধরনের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবার ক্ষমতা। যত সহজে প্রান্ত ধর্মের মানুষের সাধন ভজনের গূঢ় কথা টেনে বের করতে পারেন তা তাঁর বইগুলো পড়লেই সচেতন পাঠক বুঝে নিতে পারেন। স্যারের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর পরই পড়ে ফেলি 'প্রজ্ঞা' প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত 'সদর-মফস্বল' বইটি। গ্রামে বসবাস করা সত্ত্বেও চরিত্রগুলোকে একেবারেই অচেনা লাগে। আসলে তারিফ করতে হয় তাঁর দেখার চোখকে আর মানুষ সম্পর্কে গভীর জীবনবোধকে। অধিকাংশ রচনাতে লেখক হিসাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ রচনাগুলোকে জীবন্ত করে রেখেছে। যখন তাঁর বই পড়ি তখন মনে হয় আমরাও গ্রাম পরিক্রমার সাক্ষী হয়ে যাচ্ছি। পাঠকের মানসভ্রমণ কোনও রচনার ক্ষেত্রে একটা ডকুমেন্টারি ভ্যালুর মর্যাদা পেয়ে যায়। আর সব চাইতে বড় গুণ হল অসম্ভব রকমের রসবোধ। সেই রসবোধ তাঁর প্রতিটি লেখাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে।
একটা বিষয়ে ভিন্নমত লক্ষ করি তাঁর লেখালেখি নিয়ে। আজও সঠিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করা গেল না তাঁর লেখনীর কুল-গোত্র, জাত-ধর্ম। তাঁর রচনাগুলোকে গল্প, উপন্যাসে আখ্যায়িত করা যায় না। প্রবন্ধ বলতে অনেকের কুণ্ঠা রয়েছে। কেউ বলেন রচনা, কেউ বলেন বিশেষ রচনা, কেউ বলেন আখ্যান-কথন। তিনিও নির্দিষ্ট করে আমাদের বলে যাননি। আমার মনে হয় তাঁর রচনাকে সবরকম ভাবে আখ্যায়িত করা যায়। এক একটি কথনে বা রচনায় অসম্ভব রকমের গল্পের সুখ তৈরি হয়। পূর্ণাঙ্গ গল্পও উঠে আসে। যে গল্পের জন্য আমাদের মতো গল্পকাররা হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকে। আমাদের স্যার কত সহজে সে সব পদদলিত করে বৃহত্তর আখ্যানের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন।
সুধীরবাবুর লেখা যত পড়েছি তত বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছি। আমাদের চেনাজানা বৃত্তের বাইরেও যে একটা জীবন আছে, একটা আলাদা জগৎ আছে, সেই অচেনা অজানা জগৎ'কে আবিষ্কার করেছেন তিনি। সেখানে ফুটে উঠেছে সম্প্রীতির পরম্পরা, সহজিয়ার ধারাভাষ্য। সেই ধারাভাষ্য রচিত হয়েছে গানে ও পদে। গানের প্রতি তাঁর আলাদা রকমের ঝোঁক আছে তা ধরা পড়ে বিভিন্ন আখ্যান-কথনে। গান বিষয়ক অনেক গ্রন্থের তালিকা এই মুহূর্তে দেওয়া যেতে পারে। যেমন, সাহেবধনী সম্প্রদায় ও তাহাদের গান, গানের লীলার সেই কিনারে, বলাহাড়ি সম্প্রদায় ও তাহাদের গান, বাংলা গানের সন্ধানে, নির্জন এককের গান, বাংলা গানের চার দিগন্ত, বাংলা ফিল্মের গান ও সত্যজিৎ রায়। আরও অনেক গান বিষয়ক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়।
সুধীরবাবুর 'সদর-মফস্বল' বইটি পড়ার পর আরও অনেক বই পড়েছি পর্যায়ক্রমে। নতুন বই প্রকাশ পেলেই আমি তা সংগ্রহ করতাম। তাঁর 'গভীর নির্জন পথে' বইটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৯ সালে। আমি পাঠ করি ১৯৯২-তে। বইটি পড়ে নিজের মধ্যে একটা ঘোর তৈরি হয়েছিল। একটি কঠিন বিষয় কত সহজে গল্পে ও কথায় ছবির মতো তুলে ধরা যায়, তা পাঠের মাধ্যমে বোঝা যায়। 'ব্রাত্য ও লোকায়ত লালন' বইটির জন্য ১৯৯৩ সালে পেয়েছেন 'শিরোমণি' পুরস্কার। 'পঞ্চ গ্রামের কড়চা' গ্রন্থের জন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে পেয়েছেন 'নরসিংহ দাস' পুরস্কার। 'বাউল ফকির কথা' বইটির জন্য দু-দুটি 'কুলীন' পুরস্কার পেয়েছেন। একটি আনন্দ পুরস্কার ২০০২ সালে অন্যটি সর্বভারতীয় সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৪ সালে। সারা জীবনের সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত 'বিদ্যাসাগর' পুরস্কার লাভ করেছেন ২০১৮ সালে। এছাড়া আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় তাঁর প্রাপ্তির ঝোলা পূর্ণতা পেয়েছে।
সুধীরবাবু সম্পর্কে আর যে কথাগুলো না বললে আলোচনা অপূর্ণ থেকে যায় তা হল সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মনিষ্ঠা। এর সঙ্গে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব, এসো কুটুম বসো কুটুম তো আছেই। আর আছে আমাদের মতো বেশ কিছু গুণগ্রাহী। অধিকাংশ সময় তার বাড়ির দরজা হাট করে খোলা থাকত। প্রতিদিন নিয়ম করে লেখা, সকালে নিজ হাতে থলে ঝুলিয়ে বাজার করা। বাজার করতে করতে বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ জমানো। আলু, কপি, ফুলকপি, বেগুন, টম্যাটোর মধ্যে ভেসে উঠত কৃষক খেতমজুরদের মুখ। স্যার আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে তাঁর রামচন্দ্র মুখার্জী লেনের বাড়ি ডেকে নিতেন। আসলে তিনি গ্রামীণ ধারাভাষ্য আমার কাছ থেকে জানতে চাইতেন। গ্রামীণ রাজনীতি, পঞ্চায়েত ভোট, একশো দিনের কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প, ধর্মীয় জলসা থেকে বার্ড ফ্লু রোগ। গ্রামের কত হাঁস মুরগি পাখ পাখালি মারা গিয়েছে সে খবরও জানাতে হত তাঁকে। আমার কথা শোনার জন্য স্যারের স্ত্রী নিবেদিতা চক্রবর্তী এসে বসতেন। অন্যদের দেখাদেখি বউদি বললেও তাঁকে মা ডাকতে ইচ্ছে করত। তিনিও ভীষণ ভালোবাসতেন আমাকে। সত্যি বলতে কি আমার প্রতি তাঁদের ছিল অপত্য স্নেহ। আমার সাহিত্যের সাধনায় তাঁদের অটুট বিশ্বাস ছিল। কোনও পত্র-পত্রিকায় লেখা পেলেই সর্বাগ্রে পড়ে নিতেন ওঁরা। আমার নতুন কোনও বই বেরলে আমি নিজ হাতে দিয়ে আসতাম। পাঠক হিসাবেও তুলনাহীন। এরকম নিষ্ঠাবান পাঠক কখনও দেখিনি। সীমিত সময়ের মধ্যে পাঠ শেষ করে আমাকে জানাতেন। আলোচনা করতেন পঠিত গল্প বা উপন্যাস নিয়ে। আমার ‘জনমুনিষ’ উপন্যাস প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৮ সালে। দিয়ে এসেছি দিনের ভাগে। শীতকাল, তখনও লেপ ছেড়ে উঠতে পারিনি। হঠাৎ স্যারের ফোন, আনসার তোমার বই পড়লাম। আমার অবাক হওয়ার পালা। কখন পড়লেন! নাতিদীর্ঘ উপন্যাস হলেও বুঝতে পারলাম স্যার বাকি রাত না ঘুমিয়ে আমার বইটি পড়ে ফেলেছেন। আর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানিয়ে দিলেন। এই তো গতবার ‘অভিযান’ থেকে আমার প্রকাশিত উপন্যাস ‘হেঁসেল জীবন’ তাঁর হাতে পৌঁছে দেওয়ামাত্র তেমনই বিনিদ্র শীতের রাতে পড়ে ফেললেন। আমি আগের বছরের মতো লেপ-কম্বলের ওম নিচ্ছি। ওম নিতে নিতে পঁচাশি বছরের গলা ভেসে এল মোবাইলে- ‘আনসার তোমার হেঁসেল জীবন শেষ করলাম।'
আমি বই পড়ার জন্য অনেককেই দিয়েছি। মতামতের জন্য প্রহর গুনেছি। কেউ কেউ ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা করেছেন। কারও কারও মতামতের আশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন তো সাতবার ভাবতে হয় কাকে বই দেব আর কাকে দেব না। দেখেছি, যাঁরা পয়সা খরচ করে কিনে পড়েন তেমন অচেনা অজানা পাঠকেরা হঠাৎ হঠাৎ ফোন করে জানান। বুঝি এটাই লেখক জীবনের প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিযোগ সুধীরবাবুই তৈরি করে দিয়েছেন। আমার প্রথম গল্পের বই তাঁর ধ্রুবপদ প্রকাশনী থেকেই প্রকাশ করেছিলেন ১৯৯৪ সালে। বইয়ের নাম ‘আনসারউদ্দিনের গল্প’। দ্বিতীয় বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি উদ্যোগী হয়ে 'প্রতিক্ষণ' থেকে 'আনসারউদ্দিনের ছোটগল্প' প্রকাশে সহযোগিতা করেছিলেন। তখন ছোট গল্পকারদের গল্প সংকলনের সিরিজ চলছিল। সেই সিরিজে এই অধম লেখকের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ হল। স্যারের সক্রিয় উদ্যোগে আমার আরও দুটি বই প্রকাশ পেল। প্রকাশক হলেন স্যারের প্রিয় ছাত্র ও অনুগামী শিবনাথ ভদ্র। বই দুটির নাম যথাক্রমে ‘আনসারউদ্দিনের গল্প সংগ্রহ’ (২০০৩) এবং অন্যটি ‘শোকতাপের কথামালা’।
সুধীরবাবুর কাছে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিযোগ হল তাঁর পত্রিকা ‘ধ্রুবপদ'এ লেখার আমন্ত্রণ। দু-দুটো সংখ্যায় উনি আমাকে দিয়ে লিখিয়েছেন। শুধু লিখিয়েছেন বললে ভুল হবে, উনি আমাকে ওঁর পত্রিকায় গদ্য লেখা শিখিয়েছেন। তার আগে আমি কখনও গদ্য লিখিনি। স্যার বললেন, সরল গদ্যে লিখবে, প্রথমে বুঝতে দেরি হলেও পরে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন সরল গদ্য কাকে বলে, মুক্ত গদ্য কাকে বলে। 'অভিজ্ঞতা' সংখ্যায় লেখার পরপরই ‘নারীবিশ্ব’ সংখ্যায় আবার সুযোগ দিলেন। লিখলাম ‘গ্রামীণ নারীজীবন’ নামক আখ্যান। পত্রিকায় অনেক অনেক জ্ঞানীগুণী লেখকদের মধ্যে আমার লেখাটি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছিলেন। স্যারকে আড়ষ্ট গলায় বলেছিলাম- স্যার আমার লেখাটি প্রথমেই জায়গা পেল দেখছি।
স্যার বললেন, আমি গ্রামকেই প্রাধান্য দিই।
স্যার শুধু গ্রামকেই প্রাধান্য দেননি। আমার মতো একজন গ্রামীণ মেঠো ছেলেকে সাহিত্যের পাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁকে শতকোটি প্রণাম।
No comments:
Post a Comment