Wednesday 5 August 2020

লেখককে খোলা চিঠি

আগামী ভুবনের অন্তর্বাস উন্মোচন করেছেন উপন্যাসের ঢঙে

প্রিয় অনিন্দ্য,

আজই আপনার বই পড়া শেষ করলাম (আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি)। হয়তো বলবেন, এতদিনে? না, একটু রয়ে সয়েই পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সময়ের অন্দরে কত নিখুঁত ও সন্তর্পণে প্রবেশ করেছেন। অর্থনীতি ও আগামী ভুবনের অন্তর্বাস উন্মোচন করেছেন। পরিবেশন করেছেন উপন্যাসের ঢঙে, যেখানে পাঠকের চলনে কোনও ক্লান্তি নেই। কোথাও কোনও অতিকথন নেই, ঠিক যেখানে যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই। না কোনও স্তুতি নয়, আপনার স্তুতি করে আমার আখেরে কোনও লাভ নেই। তাই, পড়ে যে ভাল লাগা তাকেই সরাসরি বলে ফেললাম।

আগামী দিনে প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগমনকে আপনি আপনার বোধ, মেধা ও অধীত বিদ্যা দিয়ে যে ভাবে নিরীক্ষণ করেছেন, তাকে শুধু প্রশংসা করে শেষ করা যায় না, বরং নিজেকে ওই চিন্তা ও মননে বোধহয় ঋদ্ধ করতে হয়। সত্যিই তো, কখনও ভুবনায়নের এই চলন ও ফলাফলকে এইভাবে তো ভাবিনি! একদম পুরনো ঢঙ, চিন্তা ও চেতনায় বস্তাপচা মার্কসবাদীদের মতো এটাই বলেছি, সব গেল সব গেল। দেশ বেকারত্বে ছেয়ে যাবে, যে কোনও সময় এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু এই নব উত্থিত রাজনৈতিক অর্থনীতির যে সদর্থক দিক তাকে তো আমরা চিনতে বা জানতে চাইছি না। আমি সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, বাম ডান কোনওদিক থেকেই এই অর্থনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ে কোনও নির্মোহ আলোচনা নেই, পাচ্ছিও না। সবটাই নেতিবাচক। তা তো হতে পারে না। এতদিন আমরা বাম রাজনীতির প্রতি মোহাচ্ছন্ন ছিলাম, তার কোনও মন্দ দিক দেখতে পেতাম না। অযূত সংকটের মধ্যেও পুঁজিবাদ তার পথ খুঁজে নিল, কিন্তু সমাজতন্ত্র পারল না। এই না পারাটাও পুঁজিবাদী চক্রান্ত বলে ব্যাখ্যা করলাম। অনেকটা, নবম শতকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও রণকৌশলে উন্নত ইসলামের গতিকে রুদ্ধ করতে না পেরে ইসলামকে আক্রমণকারী, রক্তলোলুপ বলে নিন্দা করে শ্লাঘা বোধ করতে লাগলাম। এটাই তো আমাদের ধারাবাহিকতা। 

যাই হোক, নজরদারি নিয়ে আপনার কাছ থেকে আরও একটু আলোচনা আশা করেছিলাম। যে আলোচনা কিছুটা তত্ত্ব ধর্মী। এ কথা তো ঠিকই যে নতুন এই অর্থনৈতিক পরিবেশে আমি আপনি সবাই নানা ভাবে নজরবন্দী। বেন্থাম ও ফুকোর চিন্তার আলোকে আগামী দিনের পরিবেশ পরিস্থিতি কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, সেই আলোচনা আরও কিছুটা হলে ভাল হত।

কয়েকটা প্রশ্ন রইল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই আস্ফালন সমাজ কী ভাবে গ্রহণ করছে? আর রাষ্ট্রই বা কেন তার সব দায় এড়িয়ে যাচ্ছে? এটাই কি প্রগতিশীল পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য? আর এই এগিয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে কিছুটা সমর্থন করেই কি অভিজিৎ বিনায়ক নোবেল পেলেন? অর্থাৎ, কর্পোরেট ও রাষ্ট্র নতুন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতেই কি অভিজিৎ'দের মতো মানুষকে সামনে হাজির করা, যাতে মানুষ, আপনার কথায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে প্রবেশ করে বিভ্রান্ত না হয়?

তবে আপনার শেষ অধ্যায় 'ভবিষ্যতের অতিকথা ও বাস্তবতা' পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। কেন জানেন? গান্ধীকে অদ্ভূত সুন্দর মূল্যায়ন করেছেন। আপনার লেখা পড়তে পড়তে বুদ্ধদেব বসুর 'উত্তর তিরিশ' মনে পড়ছিল। তাঁর সেই ঈর্ষনীয়  বাক্য বিন্যাস, 'দিল্লী তাঁকে দলে পেলো না, ওয়ার্ধা তাঁকে বেঁধে রাখলও না... পথের মানুষ আবার পথে নামলেন। ভেঙ্গে দিলেন আশ্রম, ছেড়ে দিলেন সঙ্গীদের.... একলা হলেন, শুদ্ধ হলেন, মুক্ত হলেন। এই তাঁর পূর্ণতা, তাঁর প্রায়শ্চিত্ত, যুধিষ্ঠিরের মতো কঠিন শোকাচ্ছন্ন-নিঃসঙ্গ স্বর্গারোহণ। কোন স্বর্গে? যেখানে আশ্রয় নেই, তবু নিশ্চয়তা আছে। যেখানে বিফলতা নিশ্চিত, তবু আশা অন্তহীন।...'

ঠিকই তো, যন্ত্র সভ্যতার যে প্রতিস্পর্ধী  বাচন গান্ধী নির্মাণ করেছিলেন তাঁর 'হিন্দ স্বরাজ' গ্রন্থে, তা সত্যিই তুলনাহীন। আমি গান্ধীবাদী নই, কিন্তু গান্ধী চিন্তার সঙ্গে কেন জানি না বিরোধ করতে পারি না। তাই তো মনে করি যে, ওঁর  ‘জ্ঞানতত্ত্ব’ পশ্চিমের বিকল্প নির্মাণ। ‘পশ্চিমী জ্ঞানতত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য-ই হল প্রভুত্ববাদ (কান্টীয় ভাষ্যে Savage কে  Civil  করার দায়িত্ব)। সে তার যাবতীয় অপকর্ম বিজ্ঞান ও যুক্তি (Reason) দিয়ে চালাতে চায়, প্রভুত্ব-বাদ পশ্চিমের এই অহংকার ও মৌলিকতার দাবি  নিয়ে বিজ্ঞানকে দিয়ে হিংসার বৈধতার বাচন নির্মাণ করে।' গান্ধী এই জ্ঞানতত্ত্বকে মানতে চাননি। আমাদের স্মরণে রাখা উচিত, সাম্প্রতিক কালে এডওয়ার্ড সইদ ও মিশেল ফুকো পশ্চিমের যে জ্ঞান-তাত্ত্বিক বাচনের কথা বলেছেন (উপনিবেশ বিস্তার ও  নির্মাণের সপক্ষে), গান্ধী তা অনেক আগেই বলতে পেরেছেন। আপনিও তেমনি শুদ্ধ বাক্যে ওঁর উপাসনা করেছেন যন্ত্র সভ্যতার আলোচনা করতে গিয়ে। সব শেষে দেখি, যে এত কিছুর পরেও মানুষের উপর বিশ্বাস হারাননি। একদিন হয়তো মানুষই তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় নিজেই পথে নামবে। আপনার কথা মতোই একদিন হয়তো দেখা যাবে, '...পথে নেমে লক্ষ লক্ষ মানুষ যন্ত্রের দানবীয় যুক্তি ও আধিপত্যকে অস্বীকার করতে চাইছে। এর যে নিদর্শন নেই, তা বলি কি করে!'

প্রসঙ্গত বলি, এই বিষয় নিয়ে আমার ছাত্রদের সঙ্গে যদি একটা অনলাইন-এ আলোচনার বন্দোবস্ত করি তাহলে কি আপনি কিছু বলতে রাজী হবেন? জানাবেন।

ভালো থাকবেন।

শুভেচ্ছা সহ

পার্থসারথি চৌধুরী। জলপাইগুড়ি।

পুনশ্চ: আপনার বই পড়ে আমার বন্ধু প্রদ্যুম্ন বন্দ্যোপাধ্যায় (আপনি চেনেন), খুব ভাল পাঠক, ওকে  বইটা উপহার দিলাম। আজই অর্ডার করেছি।

2 comments:

  1. এ বিষয়ে অনলাইনে কোনও আলোচনা হলে অবশ্যই উপস্থিত থাকব।
    অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

    ReplyDelete
  2. National Level Webinar
    On
    EPIDEMIC AND SOCIETY
    Organized jointly by Department History & Sociology
    Kalimpong College, Kalimpong, West Bengal
    Date – 7th of August, 2020



    Link for joining on Google Meet :
    https://meet.google.com/jsw-woqw-hpe

    You Tube Live Stream Link :
    http://www.youtube.com/channel/UCRe6rjNhek48pUB6MhFIw5g

    Link for Live Stream on Google Meet:
    https://stream.meet.google.com/stream/6f238ccb-3fe4-45fc-a61d-e532b94b5d4f

    ReplyDelete