অচলায়তনের ভাঙা জানালা দিয়ে
মধুময় পাল
খবর আসছিল ফোনে৷ এবং কিছুটা সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ কাগজ বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে করোনা আতঙ্কে৷ টিভি-র সামনে বসা যায় না৷ মাথা ঝিমঝিম করে, শরীর খারাপ লাগে৷ কোথাও বেরিয়ে খবর নেব এমন উপায় নেই৷ অদ্ভুত এক অচলাবস্থা তৈরি করা হয়েছে৷ আমরা যারা ট্রেন-বাসের ভরসায় বরাবর চলাচল করেছি, তাদের পক্ষে নিজের এলাকাটুকুর বাইরে যাবার সুযোগ নেই৷ এক ভয়াবহ আতঙ্কের বাতাস ঘিরে ফেলেছে আমাদের৷ বাড়ির বাইরে বেরোনো বিপদ৷ অহরহ কানের কাছে রাষ্ট্র বলছে৷ আত্মীয়ের কণ্ঠস্বরও ভয়ে কাঁপে, বেরোবেন না৷ এই বয়সের লোকজন সহজে আক্রান্ত হচ্ছে৷ গণ-পরিবহন বিপজ্জনক, সে কথাও রটানো হচ্ছে ফিসফাসে৷ উন্মাদের পাঠশালা খুলে বসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রায় প্রতিটি চ্যানেল৷ আজ বলা হচ্ছে, করোনা বাতাসে ওড়ে না৷ কাল বলা হচ্ছে, বাতাসে উড়ছে৷ আজ বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাস৷ কাল বলা হচ্ছে, ব্যাকটেরিয়া৷ একই সঙ্গে মারণ ও মস্তিষ্কের ব্যাধিতে আক্রান্ত এই সময়ে উদভ্রান্ত ও উপার্জনচ্যুত মানুষ কোন গভীর অবসাদে বিধ্বস্ত হতে পারে ভাবা যায় না৷ বলা হচ্ছে, করোনার চিকিৎসা নেই৷ অথচ বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচ-সাত লাখের প্যাকেজ৷ তাহলে অসমর্থ মানুষের অসহায় মৃত্যুই একমাত্র ভবিতব্য? এই আতঙ্ক, এই অচলাবস্থা কতটা স্বাভাবিক ও যথার্থ, এর পেছনে চক্রান্ত আছে কিনা, তা কিছুকাল পরেই পরিষ্কার হয়ে যাবে৷ এখনই অনেকে সন্দেহজনক গন্ধ পাচ্ছেন৷
যে খবর আসছিল, তার সবটাই করোনা সংক্রান্ত৷ এক, রাতের অন্ধকারে লাশ গায়েব৷ পুড়িয়ে দেওয়া বা পুঁতে ফেলা হচ্ছে৷ মৃত্যুর ঠিকঠাক হিসেব দিলে প্রশাসনের রামকোপে পড়তে হচ্ছে দায়িত্বশীল আধিকারিককে৷ দুই, মৃতের দেহের খোঁজ পাচ্ছেন না পরিবারের সদস্যরাও৷ তিন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা৷ চার, বেসরকারি হাসপাতালে বিল হচ্ছে লাখ লাখ টাকা৷ পাঁচ, টেস্টে বিভ্রান্তি৷ প্রথমে বলা হল, পজিটিভ৷ পরে বলা হল, নেগেটিভ৷ কিংবা উলটোটা৷ ছয়, পাড়ায় পাড়ায় ডাক্তারদের চেম্বার তথা গদি বন্ধ৷ ব্যতিক্রম আছে৷ সেলাম জানাই সেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যাঁরা ফ্রন্টলাইনে দাঁড়িয়ে সেবা করেছেন নিজেদের পরিবারের বিপন্নতার ভাবনা সরিয়ে রেখে৷ সাত, বিভিন্ন মহল্লায় রোগের খবর চাপা দেওয়া হচ্ছে৷ নেতৃত্বে শাসক দলের নেতারা৷ আট, কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নৈরাজ্য৷ চিকিৎসা নেই, খাবার নেই, সেই সঙ্গে পজিটিভ ও নেগেটিভ পাশাপাশি বিছানায় বা মেঝেয়৷ নয়, মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অমানবিক কুৎসিত কদর্য আচরণে৷ দশ, যথাযথ প্রতিরোধী পোশাকের অভাবে রোগাক্রান্ত হচ্ছেন সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীরা৷
ফোনে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁরা এসব জানাচ্ছেন, কোনও দলীয় বা ধর্মীয় প্ররোচনা তাঁদের নেই, হলফ করে বলতে পারি৷ কিছু চ্যানেল সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে কোনও কোনও দলের ভাড়া খাটছে, এটা ঘটনা, তাঁদের এড়িয়েই আমার প্রতিবেদন বা সন্ধান৷ করোনা বা লকডাউনের অচলায়তনের ভাঙা জানালায় বসে এটুকু স্পষ্ট দেখা গিয়েছে যে, রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে খান খান৷ সুপার স্পেশাল হাসপাতালের আওয়াজসর্বস্ব গল্প ভুস্ হয়ে গিয়েছে এক ঝটকায়৷ পরিত্রাণহীন দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত প্রতিটি গরিব রাজ্যবাসী৷ চলছে গোমূত্র থেকে যাগযজ্ঞ থেকে তালিয়া-থালিয়া থেকে কসমেটিকস বুজরুকি৷ যাদের সামর্থ্য আছে তারা কালোবাজারে কিনছে বিজ্ঞাপনের স্যানিটাইজার, অক্সিমিটার, যাবতীয় ভিটামিন, ঘরে মজুত করছে অক্সিজেন সিলিন্ডার৷ সরকারের অকর্মণ্যতা চাপা দিতেই মৃতদেহ গায়েব ও মৃত্যুর সংখ্যা গোপন৷ অদূরেই ভোট৷ মৃতদেহ নিয়ে খেলতে পারে বিরোধীরা! একটা কথা এখানে বলে রাখা দরকার, এই খান খান দশা বর্তমান সরকারের একক কৃতিত্ব নয়, পূর্বসূরিরা আছেন সগৌরবে!
এভাবে কি চাপা দেওয়া যায়? লুকোনো যায়?
১৯৪২-এর ১৬ ও ১৭ অক্টোবর মহাপ্রলয়ে বিধ্বস্ত হয় মেদিনীপুরের হাজার বর্গমাইলেরও বেশি এলাকা৷ ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসন খবর চেপে দেয়৷ সংবাদমাধ্যমকে সেনসর করে৷ দুর্গত এলাকায় বাইরের কাউকে বিনা অনুমতিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি৷ ঝড়-বন্যায় তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি বলে দায় সেরেছে সরকারি বিবৃতি৷ মেদিনীপুরের সর্বনাশের খবর প্রথম ছাপা হয় ৩ নভেম্বর৷ ঘটনার দু' সপ্তাহ পরে৷ এই সর্বনাশ পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি কারণ৷ সেদিনের বাংলার শাসকরা যদি একটু মানবিক হতে পারত, রার্ষ্ট্রের স্বাভাবিক মিথ্যাচার সরিয়ে রাখতে পারত, অনেক মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হত৷
মহাপ্রলয়ে বিধ্বস্ত মেদিনীপুরে বিস্তীর্ণ জনপদের ছবি আঁকেন চিত্তপ্রসাদ৷ পথে পথে ঘুরে৷ লেখেন ‘হাংরি বেঙ্গল’৷ পুস্তিকাকারে ছাপা হয় লেখা ও কিছু ছবি৷ ভিন রাজ্যগুলিও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকৃত অবস্থা যেন জানতে পারে, তাই ইংরেজিতে লেখা৷ ৫০০০ কপি ছাপা হয়েছিল৷ বহু মানুষকে জানানোর লক্ষ্য নিয়ে৷ খবর পেয়ে ব্রিটিশ পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে সব কপি৷ দু-চারটে রক্ষা পেয়েছিল কোনওক্রমে৷ বাজেয়াপ্ত করেও চাপা দেওয়া যায়নি মৃতদেহ আর বিপন্ন মানুষে সমাকীর্ণ মেদিনীপুরের খবর৷
পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক বিমল রায়৷ নিউ থিয়েটার্স-এর ব্যানারে৷ জানা যায়, বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সহ ছ-টি ভাষায় ডাবিং হয়৷ উদ্দেশ্য, অন্য রাজ্যের মানুষকে বিপন্ন বাংলার কথা জানিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করা৷ প্রশাসন জানতে পেরে ফিল্ম নষ্ট করে দেয়৷ তাদের যুক্তি হয়তো এরকম ছিল, এ ছবি দেখানো হলে দেশে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে৷ এত কিছু করেও চাপা দেওয়া যায়নি৷ লন্ডনের আর্কাইভ থেকে উদ্ধার হয়েছে সেই তথ্যচিত্রের ৫০টি স্থিরচিত্র৷ হিন্দিতে নাম ছিল ‘বঙ্গাল কো মদদ দো’৷ আজ থেকে সাতাত্তর বছর আগে যা সম্ভব হয়নি, এখন তা সম্ভব করার চেষ্টা ক্ষমতার অপচয় ছাড়া কিছু নয়৷ নেট-সংযোগ বন্ধ করেও সম্ভব নয়৷
পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় বাংলা এক সাংবাদিককে পেয়েছিল৷ “দি স্টেটসম্যান’-এর সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্স৷ সাহেব মানুষ৷ কাগজটিও সাহেবদের৷ তারা সাহেবদের স্বার্থ দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু তেমনটা হয়নি৷ ১৯৪৩-এর মার্চ মাস থেকে স্টেটসম্যান নিয়মিত দুর্ভিক্ষের খবর ছাপতে থাকে৷ তাতে লন্ডন বা দিল্লি বা কলকাতা বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করেনি৷ লন্ডনে ভারত সচিব আমেরি, দিল্লিতে গভর্নর জেনারেল লিনলিথগো এবং বাংলার গভর্নর জন হার্বার্ট ক্ষুধায় মৃত্যুর কথা ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে গিয়েছেন৷ ইয়ান স্টিফেন্স স্মৃতিকথায় লিখেছেন: People were now dying all around. The city's mortality figure had become appalling, as also reports from the surrounding countryside. (Monsoon Morning)। ১৩ আগস্ট ১৯৪৩ সাংবাদিক ওয়ার্ডসওয়ার্থ (পুরো নামটা বলেননি ইয়ান স্টিফেন্স) ‘…wrote a moving piece on this, stressing particularly the plight of lost or parentless children’, তাতেও হেলদোল নেই প্রশাসনের৷ অগত্যা ২২ ও ২৯ আগস্ট, পরপর দুটো রবিবার, কলকাতার পথে পথে পড়ে থাকা অনাহারে মৃত ও অর্ধমৃতদের পাতাজোড়া ছবি ছেপে দিলেন ইয়ান স্টিফেন্স৷ যুদ্ধ চলছে, ব্রিটেন লড়ছে৷ এই পরিস্থিতিতে যে কোনওরকম শাস্তি হতে পারত তাঁর৷ ভয় পাননি৷ একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিকের কাজ করেছিলেন তিনি৷ লন্ডনের টনক নড়েছিল ওই মর্মন্তুদ ছবির আঘাতে৷ ইয়ান স্টিফেন্স সম্পাদক ছিলেন দশ বছর (১৯৪২ থেকে ১৯৫১)।
এই মুহূর্তে স্টিফেন্সের কথা মনে পড়ে৷ সরকারের মুখপাত্র হতে দেননি তাঁর কাগজকে৷ আজ বাংলায় বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে ভাড়াটে মনে হয়৷ এতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা তো কমেছেই, প্রয়োজনীয়তাও কমেছে৷ সরকারের তথ্য গোপনের খেলায় সংবাদমাধ্যম যদি শাকরেদ হয়, বুঝতে হবে সময়টা খুব খুব খারাপ৷ জায়গাটা নিচ্ছে, নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম৷
মিডিয়ার এই অবস্থা অভূতপূর্ব।
ReplyDelete