Tuesday 4 August 2020

আত্মনির্ভরতার অশ্বডিম্ব?

‘বঙ্গ-ঐতিহ্যের’ একটি আত্মসমীক্ষাও
অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

গলায় শাড়ির আঁচলখানি, তুলসীমঞ্চে প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলার গৃহলক্ষ্মীর মুখাবয়বে যে ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’খানি ছিল, অতিমারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে আজ সবই ম্লান। এক দুর্বিষহ বিপন্নতা ও অন্তরবেদনার জলযান অশ্রুর অন্তহীন সমুদ্রের জোয়ারে ভেসে চলেছে। যেন ধ্বংসের শেষ খড়কুটোটাও গা-ঢাকা দিতে চায়, বুক কেঁপে ওঠে তারও। মানুষ দেবতা ভেবে যে কার পা জড়িয়ে ধরবে – সে প্রশ্নের যেন কোনও উত্তর হয় না, শুধু এক নির্লজ্জ বিতর্ক চলে। তবুও যেন মানুষ তেত্রিশ মিনিটে প্রায় বিশবার উচ্চারিত হওয়া শব্দটিকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে প্রাণপণ। এই শব্দ যদিও বাংলার জনমানসে অপরিচিত নয়।

আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগেও উচ্চারিত হয়েছিল এমনই এক অঙ্গীকার। রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছিলেন, ‘মৈমনসিংহ জেলার মুচিরা একত্র হইয়া ঘোষণা করিল যে অতঃপর তাহারা বিলাতি জুতা মেরামত করিবে না। বরিশাল জেলার ঠাকুর-চাকরেরা সভা ডাকিয়া স্থির করিল যে যাহারা বিলাতি দ্রব্য কিনিবে তাহাদের বাড়িতে কাজ করিবে না। কালীঘাটের ধোপারা সভায় মিলিত হইয়া স্থির করিল যে তাহারা বিলাতি কাপড় কাচিবে না। ছয় বছরের একটি বালিকা গুরুতর অসুখের সময়ও বিলাতি ওষুধ খাইতে অস্বীকার করিল। ব্রাহ্মণেরা স্থির করিলেন, বিলাতি কাপড় ব্যবহার করিলে বিবাহে পৌরোহিত্য করিবেন না। পরীক্ষার উত্তর লিখিবার খাতা বিলাতি কাগজের বলিয়া ছাত্ররা পরীক্ষা দিতে অস্বীকার করিল।’

দৃঢ়তায় এবং সংকল্পের নজিরে শুধু নয়, বাস্তবায়নের ঢেউয়ে সেদিন সম্রাটের মতো বুক ঠুকেছিল বাঙালি - বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল, ভারতহিতৈষী স্পিনিং অ্যান্ড ওয়েভিং মিলিস লিমিটেড, ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস, লোটাস সোপ ফ্যাকটরি, বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকলস, বেঙ্গল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি, গ্লোব সিগারেট, বেঙ্গল পেন্সিল ফ্যাকটরি, জবাকুসুম, ডাকব্যাক, কুন্তলীন, বোরোলিন, সুলেখা ইংক, দে’জ মেডিকেল, গ্রেট ইস্টার্ন মোটর কোম্পানি, মার্টিন বার্ন ইত্যাদি সহস্র-অযুত আয়োজনে বাংলা স্বনির্ভর হয়ে উঠেছিল এক কালে। ‘বনেদি বড়লোক’ বলে একটা কথা আছে। বাংলা কিছুটা তাই-ই। মঙ্গলকাব্য থেকে আজ অবধি এর ব্যতিক্রম হয়নি। সূতিবস্ত্র, রেশম, মসলিন, চিনি, সুপারি, পাট, চাল, হলুদ প্রভৃতির ব্যবসায় শুধুমাত্র অন্তর্দেশিয় বিস্তার নয়, মোকা ও বাসরা শহরাঞ্চলের মধ্য দিয়ে আরব থেকে শুরু করে সুমাত্রা, সিঙ্ঘল, মালাক্কা হয়ে লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, কেনিয়া এমনকি আফ্রিকাতেও বাণিজ্য বিস্তার করেছিলেন বাংলার ধনপতিরা। বাংলার বস্ত্র সম্পর্কে আমির খসরু লিখেছিলেন, ‘এই বস্ত্র এত বেশি সূক্ষ্ম ছিল যে ১০০ গজ কাপড় মাথায় জড়ানোর পরেও তার ভেতর দিয়ে মাথার চুল দেখা যেত।'

জগৎ শেঠ সম্পর্কে প্রচলিত ছিল, তিনি নাকি টাঁকশালকেও টাকা ধার দেবার ক্ষমতা রাখতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম শিল্পপতি। কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি শুধু নয়, ক্যালকাটা স্টিম স্টাগ এসোসিয়েশন, ফ্লোটিং ব্রিজ প্রোজেক্ট, ক্যালকাটা ডকিং কোম্পানি, বেঙ্গল কোল কোম্পানি ইত্যাদি কীর্তি বাংলার ধমনিতে প্রবাহিত। এমনকি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, বৈষ্ণবদাস শেঠ, লক্ষ্মীকান্ত ধর, হীরালাল শীল, কৃষ্ণদাস মল্লিক থেকে আজকের দিনে অমরগোপাল বোস, চন্দ্রশেখর ঘোষ, সাধন দত্ত, প্রণয় রায়, প্রীতিশ নন্দী, পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জী, সুমিত মজুমদার, অঞ্জন চ্যাটার্জী, সঞ্জয় কুমার ঘোষ, সুব্রত বাগচী, বিক্রম দাশগুপ্ত সকলেই সেই লোহিত কণিকা বহন করে নিয়ে চলেছেন। ব্রিটানিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম পাওয়া যায় ভুতো বোসের, নলিনচন্দ্র গুপ্তের।  বিস্ক ফার্ম কোম্পানির কৃষ্ণদাস পালের নাম আজ আর অপরিচিত নয় ভূ-ভারতে। সুতরাং, বিশবার কেন বিশ হাজার বার বললেও মায়ের কাছে মাসির গল্প নিতান্তই বৃথা আস্ফালনের মতো। তবুও, এসব সেদিনের কথা। আমাদের পরম্পরাগত ঐতিহ্যের অতীত ঘৃতঘ্রাণে মগ্ন থাকলেই হবে না, বর্তমানের বাস্তবকেও উপলব্ধি করতে হবে পরম ঔদার্যেই । 

সালটা ১৯৯১। আইএমএফ দ্বারা ঘোষিত হয়েছে ভারতবর্ষ একটি দেউলিয়া রাষ্ট্র। নরসিংহ রাও ও মনমোহন সিং'এর মতো কারিগরের অনন্যোপায়ের রং-তুলির ব্যবহারে ফুটে উঠতে শুরু করেছিল উদার অর্থনীতিবাদের সৌকর্যচিত্র। ২০০৭ সালের ৯ শতাংশ জিডিপির মৌতাতে কাহিল এই দেশ বুঝতেই চাইল না দূরে ঈশান কোণে মেঘ জমেছিল কিছু। উদার অর্থনীতিবাদের প্রভাব সব চাইতে বেশি দেখা যাচ্ছে যে তিনটি ক্ষেত্রে, তা হল দেশিয় দ্রব্যের মান ও মূল্য, দেশের কৃষি অর্থনীতি এবং ইলেকট্রনিক শিল্প ও চিকিৎসা দ্রব্য। আমদানির মাল্টিপ্লেক্সে বেখেয়ালে ক্রমশ ক্ষুদ্রতর হতে শুরু করেছিল রফতানির পাড়াতুতো সম্পর্কগুলো। আর আজকের দিনে যেখানে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি নয়, সার্ভিসেস'এর পাটকঞ্চিতে দণ্ডায়মান ভারতের জিডিপি, সেখানে প্রযুক্তিনির্ভর খোলা-বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে গবেষণা ও উদ্ভাবনী প্রয়াসের ব্যাপারে কতটা ফাঁপা কলজের জোর খাটবে, তা ভাবতেই হয়। 

‘আত্মনির্ভরতা’ অর্থাৎ দেশের মানুষের চাহিদাপণ্যের জোগান দেশিয় উৎপাদনের মাধ্যমেই মেটানোর সংকল্প। মনে পড়ে যায় একটি প্রবাদ: ‘করছে কিসের জাঁক, ময়না টিয়ে উড়িয়ে দিয়ে খাঁচায় পোষে কাক’। বর্তমানে ‘আত্মনির্ভরতা’র গল্প কিছুটা সেরকমই। ‘ছিল নেই – মাত্র এই’ ছাড়া একে আর কিছুই বলা যায় না। ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ দেশিয় দ্রব্য বলে বাস্তবে কিছু হয় না, বাড়ির গরুর দুধটাও নয়। ফলে বলতেই হয়, পুরাতনী ধারার বয়কট আন্দোলন ও স্বদেশি উৎপাদন বাস্তবোচিত কোনও প্রয়াস নয়। একুশ শতকে অন্য দেশের বাজার দখল করার নামই হল বাজিমাত, প্রকৃত দেশপ্রেমের আপ্তবাক্য। কিন্তু এই পথ তো নির্দিষ্ট কোনও সময়-বিন্দুর পরিকল্পনা বা উচ্চাভিলাষ নয়। ‘আত্মনির্ভরতা’র পুনর্সাফল্য নির্ভর করছে একটি দীর্ঘমেয়াদি সময়-অন্তরালে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে আপামর ভারতবাসীর সততা, নিবিষ্ট ও অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অভাবনীয় আত্মত্যাগে। বাঙালির কামব্যাকের অভিজ্ঞতা আছে, ভারতবর্ষ পারবে তো নয়া ক্যাম্পা কোলার বদহজমি বটিকা ঔষধি সামলাতে ।  

2 comments:

  1. মিহির সেন6 August 2020 at 09:57

    আত্মনির্ভরতার স্বরূপ ও তার সাথে বঙ্গ-ঐতিহ্যের সদর্থক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে যথার্থই একটা সুস্থ অর্থনীতির দিগদর্শন রয়েছে লেখাটিতে।‘অশ্ব-ডিম্বের’ ওমলেটের দুরাশা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হলে শক্তভিত গড়তে হবে বাস্তবের মাটিতে – শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রয়োগে। অচিরেই আমাদের অধিকাংশের এই বোধদয় একটা পরিনতি পাবে বলে আমার বিশ্বাস।

    ReplyDelete
  2. অর্ধেন্দু8 August 2020 at 11:05

    ধন্যবাদ। 'আ পরিতোষাদ-বিদুষাং ন সাধুমন্যে প্রয়োগবিজ্ঞানম
    বলবদ-অপি শিক্ষিতানাম-আত্মন্যপ্রত্যয়ং চেতঃ’ - কালিদাস - এই শান্তিটুকু পেয়ে খুশি হলাম, এই যা।

    ReplyDelete