Thursday 20 August 2020

বদলে যাওয়া দুনিয়া

 উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দিন কি শেষ!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 
 
 

এই ভয়ঙ্কর অতিমারি সময়েও রাজনৈতিক সংঘর্ষে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে বাংলার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল ও শহরতলি। যখন এ লেখা লিখতে বসেছি, ভারতে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ২৯ লক্ষ ছুঁইছুঁই। আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারত – এই তিনটি দেশ যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন তিন অতি রক্ষণশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি – কোভিড আক্রান্তে বিশ্বে শীর্ষে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, এই তিন রাষ্ট্রপ্রধানই কোভিড নিয়ে হয় তুকতাক, নয়তো তুচ্ছতাচ্ছিল্য অথবা মাস্তানি দেখিয়ে এ মহামারিকে নিজ নিজ দেশে ভয়ঙ্কর অবস্থায় নিয়ে গেছেন। এমতাবস্থায়, এ রাজ্যে দুই আপাত প্রধান দল তৃণমূল ও বিজেপি এলাকা দখলে ‘মারি ও মরি’ হুঙ্কারে খুনোখুনিতে মেতে উঠেছে। এর সঙ্গে রয়েছে অন্তর্দলীয় গোষ্ঠী লড়াইও। আসন্ন ২০২১’এর বিধানসভা লড়াইয়ের মহড়া অতএব শুরু হয়ে গিয়েছে। আর সংসদীয় নির্বাচনে এই রক্তপাতের অভিশাপ দীর্ঘদিন শুধু এ রাজ্যেরই অভিশপ্ত ভূষণ। এতে নতুন-পুরনো সব দলেরই হাত পাকানো আছে।

 

এ কথা সুবিদিত, এ রাজ্যকে বিজেপি এবারে পাখির চোখ করেছে। গত বছর লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন প্রাপ্তি তাদের সে আশাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে। যদি ধরেও নেওয়া যায়, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিত ও চয়ন সম্পূর্ণতই আলাদা, তৎসত্ত্বেও এবারের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী যে তৃণমূল ও বিজেপি, তা নিয়ে সম্ভবত বেশি তর্ক-বিতর্ক উঠছে না। কিন্তু প্রশ্নটা ঈষৎ অন্যত্র। তা হল, পশ্চিমবঙ্গকে বিজেপি কেন পাখির চোখ করল? তারা এ রাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য কেন এত মরীয়া? যদিওবা ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর মহারাষ্ট্র, দিল্লি ও ঝাড়খণ্ড বিধানসভায়, বিশেষত দিল্লি ও ঝাড়খণ্ডে বিজেপি বিপুল ভোটে হেরেছে! আগামী নিকটে বিহারেও হারার সম্ভাবনা প্রচুর। সে অর্থে তো পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আশা আরও দূরবর্তী। কিন্তু তবুও, বিহারে যদি বা হেরেও যায়, পশ্চিমবঙ্গে তাদের যে করে হোক জিততেই হবে। আর এই বেপরোয়া ও একমুখি মনোভাবের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই হয়ে উঠেছে রক্তাক্ত বধ্যভূমি। আগামী দিন যে আরও ভয়ঙ্কর তা সহজেই অনুমেয়।

 

কিন্তু কেন? কীসের তাড়নায় এক অযাচিত অসম্ভবকে সম্ভব করতে বিজেপি গোটা দেশের সাংগঠনিক শক্তিকে এ রাজ্যে নামাতে চলেছে, যথেচ্ছ অর্থ খরচ করছে ও পেশীশক্তি ব্যবহারেও অকপট? এর পেছনের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভীষ্টকে তাই বুঝতে হবে।

 

পশ্চিমবঙ্গ হল এমন এক রাজ্য যার আলো-বাতাস-হাওয়ায় সজীব সজল মুক্ত বাতায়ন। যে রাজ্য এ দেশে শুধু বামপন্থার সার্বিক উত্থানকে সম্ভব করেনি, ধর্মাচরণ ও ধর্মমতেও এক উদার ও সহনশীল বাতাবরণ নির্মাণ করেছে ও তাকে নিয়ত রক্ষার প্রয়াস রেখেছে, পশ্চিমি ভাবধারার বহু ইতিবাচক ও সদর্থক ভাবনাচিন্তাকে ধারণ করেছে, জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্যতম নেতৃত্বকারী ভূমিকা রেখেছে ও গত দুশো বছরে আরও বহু কৃতি সন্তানের জন্ম দিয়েছে যারা এ দেশ ও বিদেশে যুগান্তকারী কাজ ও চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছেন। এ এক বিরল কৃতিত্ব। আর এই কৃতিত্বের মধ্যেই সুপ্ত হয়ে আছে এক উদার, ব্যাপ্ত, বিশ্ব-ভাবনা যা রবীন্দ্রনাথ, চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণদেব, বিদ্যাসাগর, সুভাষচন্দ্র বসু, নজরুল, লালন, বাউল ও সুফি সাধকেরা এবং আরও নানান ধারা ও ব্যক্তিত্বের পরম্পরায় এ বাংলার মাটিতে গভীর শিকড়ে প্রোথিত হয়ে আছে। এই গোটা বুননটি বাংলার মাটিকে এমন এক ঔদার্য ও মুক্ত চিন্তার রসদ জুগিয়েছে যে তাকে মুছে ফেলা বা বিস্মৃত হওয়া অতীব কষ্টকর। সংঘ পরিবার ও বিজেপি এই পরমতম ঐতিহ্যের বিস্মৃতির প্রায়-অসাধ্য কাজটিকে সম্পন্ন করার ভয়ঙ্কর উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ, তারা জানে, বাংলার এই প্রাণবায়ু ও মুক্ত সজীবতাকে যদি কিয়ৎকালের জন্যও ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাদের প্রাচীনপন্থী, অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে মতাদর্শগত ভাবে মোকাবিলা করার মতো আর তেমন জোরালো আয়ুধ হয়তো সারা দেশেই আর থাকবে না। তাই এ এক তীব্র মতাদর্শগত যুদ্ধ: অন্ধত্ব বনাম ঔদার্য, কুসংস্কার বনাম অনুসন্ধিৎসা, উগ্র জাতীয়তাবাদ বনাম বিশ্ব মানবিকতা এবং ধর্মীয় মৌলবাদ বনাম যত মত তত পথ।

 

কিন্তু এখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লড়াইয়েরও কতকগুলি দিক আছে। যেমন, বর্তমান রাজ্য সরকার ও শাসক দলের কার্যকলাপে স্বৈরাচারী প্রবণতা যথেষ্ট কার্যকরী ও দৃশ্যমান যা বহু সাধারণ মানুষের মধ্যে নানাবিধ ক্ষোভ-বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। আমফান ও কোভিড বিপর্যয়ে তার গণ বহিঃপ্রকাশ রাজ্য জুড়ে বহু অঞ্চলে দেখাও গেল। তাই, শাসক দলের বিরুদ্ধে যে অভাব-অভিযোগ তার সুযোগ বিরোধী পক্ষের দিকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এই অসন্তোষকে বিজেপি যে হাতিয়ার করবে তা বলাই বাহুল্য। সে দিক থেকে নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনে বিজেপি কিছু ফসল ঘরে তুলবে। কিন্তু এই বঞ্চনার অভিযোগ রাজ্য জুড়ে সার্বিক প্রবণতা কিনা, সে হদিশের পরীক্ষাও ২১’এর ভোটে নির্ধারিত হবে। আর এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশিয়েই বিজেপি আশায় বুক বাঁধার চেষ্টা করে চলেছে। আর তাই এই শঙ্কাও অমূলক নয় যে, উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মিশেলে আবার বহু কিছু ঘেঁটেও যেতে পারে। অর্থাৎ, শাসক দল ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলি, হয়তো দেখা গেল, আপাত ভাবে খানিক চাপা পড়ে গেল, বরং উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিপ্রতীপে শান্তি ও উদার পরিবেশে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাটাই বড় হয়ে ধরা দিল।

 

২০০৮-০৯ সালের সাব-প্রাইম সংকট ও বিশ্বের আর্থিক মন্দায় সামগ্রিক ভাবে উদারবাদী ও বিশ্বায়ন-প্রসূত রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে এক সামগ্রিক ধাক্কা অনুভূত হয়। সেই ছন্নছাড়া বিপন্ন পরিবেশে অনেকেই মনে করতে থাকেন, বিশ্বায়নের ফলেই এই সংকট। অতএব, রক্ষণশীলতা, জাতীয়তাবাদ, ‘দেশিয়’ পণ্যের বাসনা, সীমান্ত প্রাচীর – এইসব অনুষঙ্গগুলি বর্ণবাদী, ধর্মবাদী, জাতিবাদী বিভিন্ন ধরনের শক্তিগুলির হাতিয়ার হয়ে ওঠে ও উত্থিত সংকটের সুযোগে বিশ্বের বহু দেশে এরা ক্ষমতায় আরোহন করে। আমেরিকা, ব্রাজিল, ইউকে, ফ্রান্স, তুরস্ক ও ভারত সহ আরও বহু দেশে অনুরূপ ঘটনা দেখা যায়। বর্তমান এই দশকটা তাই সে অর্থে ছিল একইসাথে রক্ষণশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ও পতনের যুগলবন্দী; যদি প্রথম অর্ধ হয়ে থাকে পটভূমি নির্মাণ সহ তার উত্থানকাল, তাহলে দ্বিতীয় অর্ধ হল তার অধোগামিতার আরেক পটভূমি রচনার পর্যায়কাল, ফলত, পতনপর্বের শুরু। সে বাদে এই সময়কে বলা যায় এক যুগ সন্ধিক্ষণ, এক উত্তরণকাল পর্ব: যখন উদারবাদীদের সাময়িক পতন ও রক্ষণশীলদের আপাত উত্থানে তথ্য প্রযুক্তি তার বিকাশের প্রায় সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে চালকের আসনে অধিষ্ঠিত করছে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে রাজনীতিকদের ভাষা ও নীতির তেমন কোনও গুরুত্ব নেই। কারণ, রাজনৈতিক-অর্থনীতির হাল যেহেতু ক্রমেই চলে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই হাতে, তাই রাজনীতিকদের গরম গরম কথায় তার কিছু যায় আসে না; সে নিশ্চিত, তার অ্যালগরিদমের আঙ্গিকেই বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির পরিসর চলতে থাকবে। দেশ, ব্র্যান্ড, নেতা, নীতিকথার সে পরোয়া করে না। তার মধ্যে পোরা সূত্রাবলী ও তার আঙ্কিক সমাক্রান্তেই তার অক্লান্ত গতি।

 

এ হেন বিশ্ব পরিস্থিতিতে তাই কারও নিস্তার নেই। জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় উগ্রতা, বর্ণবাদ – এসবের আজ কোনও মূল্যই নেই আর। কতিপয় নেতা ও কিছু সাধারণ মানুষের মননে, মস্তিষ্কে এমন কিছু ধারণা থেকে যাবে মাত্র, তা নিয়ে বাকবিতণ্ডা ও কিছু কিছু রক্তপাতও হয়তো হবে কিন্তু অচিরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত নব-নির্মিত অপার ভুবনের যে বাধ্যবাধকতা, সেই নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতির পাদপ্রদীপেই আত্মবলিদান দেওয়া ছাড়া উগ্রপন্থীদের আর কোনও উপায়ও থাকবে না। কারণ, তারাও তো চায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে আর তা সময়ের প্রাসঙ্গিকতাকে অনুধাবন করেই। সেটা ট্রাম্প, বোলসোনারো, মোদি প্রমুখেরা অবশ্যই বুঝে গেছেন।

 

এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে, আমাদের দেশে ও রাজ্যেও, তাই এক নতুন উত্তরণের সম্ভাবনা প্রবল। সেই উত্তরণের সঙ্গে প্রাচীনপন্থী, উগ্র ধর্মীয় ভাবাবেগ ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই কোভিডের ভয়াবহতা ও নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে ধর্মীয় অনাচার ব্যতীত আর আছেটাই বা কী!        

3 comments:

  1. পশ্চিমবঙ্গে যে লড়াই চলছে সেখানে ধর্মের ভূমিকা কম।মূলত কায়েমী স্বার্থের লড়াই ।তাছাড়া আজ যারা বি জে পি কিছুদিন আগে অনেকেই তৃণমূল ছিল।এরা দল পাল্টেছে মাত্র।ফারাক তেমন নেই

    ReplyDelete
  2. আজকের সমস্যার আলোচনা অনেক দিক হতে করা হয়েছে। এটা আকর্ষণীয়। তবে তোমার লেখা আরো ধারালো হয়।এই অন্ধকার এর মুক্তি এখনো আশাপ্রদ অবস্থায় নেই। আরো নৈরাজ্য ও হিংসার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। সকলে ভালো থেকো। শুভেচ্ছা জেনো।

    ReplyDelete
  3. আপনার বক্তব্যকে সমর্থন করেই কয়েকটি কথা বলছি। বিজেপি ভারতবর্ষ ব্যাপী জাতপাতের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলকে দেখতে চায়। কিন্তু বাংলার ইতিহাসকে ওরা জানে না। এখানে জাতপাতের রাজনীতি দিয়ে জনমনকে প্রভাবিত করা একটু শক্ত। বাংলায় প্রাচীন যুগ থেকেই বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মাথা তুলতে পারে নি, এবং মাঝে মাঝেই বাঙলার বাইরে থেকে শাসকবর্গ বাঙলায় প্রবেশ করে এক অব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে বাঙলায় একটি পাকা আসন করে দেওয়ার জন্যেই অষ্টম শতাব্দীতে আদিশূর কান্যকুব্জ থেকে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আর পঞ্চকায়স্থ বাংলায় নিয়ে আসেন। অবস্য এর মানে এই নয় যে বাংলায় আগে পঞ্চ কায়স্থ ছিল না। কিন্তু এ সত্ত্বেও বাংলায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম যে প্রবল হতে পারে নি এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব যথেষ্ট ছিল, তারই প্রমাণ হল মহীপালের রাজত্বে, ১০৪০ খ্রিষ্টাব্দে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য অতীশ দীপংকরের তিব্বত যাত্রা। আর এই কাজের ও সংস্কৃতির পরিণত রূপ দিলেন রামমোহন ও বিদ্যাসাগর। তাই বাংলার রাজনীতির ধরন বুঝতে গেলে ইতিহাসকেও ভাল ভাবে অনুধাবন করতে হবে। এত গেল একটা দিক, অন্যদিকে মানুষের মনের অন্দরে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রতি করোনা ও আমফান পরবর্তীকালে নানা কারণে ক্ষোভ জমা হয়েছে। এই ক্ষোভ নিরাময় করতে গেলে যা করা দরকার তা করবে কি না জানা নেই। এখন দেখা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।

    ReplyDelete