প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীই পথ
বিধান চন্দ্র পাল
ক্রেটাসিয়াস যুগের কথা আমরা অনেকেই জানি। সময়টা ৬৫০ থেকে ১৩৬০
লাখ বছর আগে। সেই যুগে পৃথিবীতে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম
ছিল পৃথিবীর সর্বকালের বৃহত্তম প্রাণী ডাইনোসর। যদিও এই বিলুপ্তির নির্ভরযোগ্য কারণ
এখনও মানুষের অজানা। তবে বিজ্ঞানীরা অন্তত নিশ্চিত করেছেন যে, পরিবেশ প্রতিকূলতার কারণেই
আসলে ডাইনোসর পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। পরিবেশের বিপর্যয় মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণী সবাইকেই
বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। তাহলে দীর্ঘকাল ধরে একটু একটু করে পরিবেশ বিপন্ন করে তোলার ফলই
কি করোনা ভাইরাস?
‘পরিবেশ’ বিষয়টির আসলে ব্যাপকতা রয়েছে। পৃথিবীর সব কিছুই প্রকৃত
অর্থে পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে ভূপৃষ্ঠ থেকে ওজোন স্তর পর্যন্ত উঁচুতে
থাকা আলো, বাতাস, পানি, শব্দ, মাটি, বন, পাহাড়, নদ-নদী, সমুদ্র, মানুষের তৈরি করা বৈচিত্র্যময়
সব অবকাঠামো এবং সম্পূর্ণ উদ্ভিদ ও জীবজগৎ। সব কিছু মিলেই আসলে প্রাকৃতিক পরিবেশ। পানি, বাতাস, মাটি ইত্যাদি জড় পরিবেশের আওতায় পড়ে; আর জীবজন্তু,
কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদ এগুলো স্বাভাবিকভাবেই জীব পরিবেশের আওতাধীন। পরিবেশের অবশ্য অরেকটি
রূপও আছে। সেটি হল সামাজিক। সামাজিক পরিবেশের আওতায় পড়ে পারস্পরিক সম্পর্ক। মানুষের
সাথে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কও পরিবেশকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেমন: কৃষিক্ষেত্রে
সবুজ বিপ্লবের সূচনা, যার মাধ্যমে ষাটের দশকে বিশ্বে প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
করে উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়াস চালানো হয়েছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি, অদক্ষতা সহ নানা
কারণে এই বিপ্লবের ফলে সামাজিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়েছিল।
পরিবেশ ও প্রকৃতিকে এমনভাবে কখনই জয় করা ঠিক নয় যাতে তা ভারসাম্যহীন
হয়ে পড়ে। কেননা মানুষ কিন্তু একদিকে সামাজিক জীব, অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও গুরুত্বপূর্ণ
অংশ। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, সৃষ্টির শুরু থেকেই আসলে মানুষ পরিবেশকে জয় করেছে, উৎপাদনের
বিভিন্ন উপকরণ তৈরি ও ব্যবহার করতে শিখেছে। মানুষ প্রতিনিয়ত স্ব স্ব অবস্থার পরিবর্তনের
মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে প্রয়াসী। কিন্তু উন্নয়ন এবং প্রকৃতিকে জয় করার এই
কাজটি যদি প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে না করা হয়, তাহলে
মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বাধ্য।
প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছরে সার্স, মার্স, নিপাহ, ইবোলা, সোয়াইন
ফ্লু, বার্ড ফ্লু, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো কত নতুন রোগ-ই তো আমরা দেখেছি। আর সাম্প্রতিক
সময়ে আমরা সবাই ভুক্তভোগী করোনা ভাইরাস বা কভিড-১৯ নিয়ে। একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়
যে, এই ভাইরাসগুলির অধিকাংশই কিন্তু পশু-পাখির দেহ থেকে মানুষের দেহে ছড়িয়েছে। জাতিসংঘের
পরিবেশ ও গবাদিপশু সংক্রান্ত গবেষণা ইন্সটিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে সম্প্রতি এও
বলা হয়েছে, এসব ভাইরাস মানবদেহে আসে প্রাকৃতিক পরিবেশে হস্তক্ষেপের কারণে। এসব হস্তক্ষেপের
মধ্যে রয়েছে জমির ক্ষতিসাধন, বন্যপ্রাণীর ব্যবহার, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং জলবায়ুর
পরিবর্তন। (সূত্র: বিবিসি ৭ জুলাই, ২০২০)।
প্রসঙ্গত আমরা জানি, সার্স, সিভেট, নিপাহ ভাইরাস বাদুড় থেকে
মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। মার্স ভাইরাস উট থেকে, সোয়াইন ফ্লু শূকর থেকে এবং বার্ড
ফ্লু মুরগি বা পাখির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে। ফলে, পরিবেশবাদী বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানও এটা জোর দিয়েই বলেছেন যে, প্রকৃতি হরণ ও হননের ফলে যে পরিবেশ বিপর্যস্ততা তার ফলে বন্যপ্রাণী মানুষের সংস্পর্শে আসায় এসব বিপত্তি হয়েছে। সর্বশেষ কভিড-১৯'ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাত্রারই
প্রভাব। পরিবেশের প্রতি এই ধ্বংসাত্মক মনোভাব আমাদের অস্তিত্বকেই আজ বিপন্ন করে তুলছে।
প্রসঙ্গত, আমরা সবাই জানি যে, কভিড-১৯ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে কাঁচা মাংসের
বাজারের কর্মীর মাধ্যমে প্রথম ছড়ায়। যেখানে প্রচুর বন্যপ্রাণীর কাঁচা মাংস বিক্রি হত।
ফলে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, যখন মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশকে যথেচ্ছভাবে লুণ্ঠন
ও ধ্বংস করে তখনই এসব প্রাণী মানুষের সংস্পর্শে আসে, আর তখনই অন্যান্য অনেক সমস্যার
পাশাপাশি নানা রকমের রোগেরও সৃষ্টি হয়। কভিড-১৯ যার মধ্যে অন্যতম।
প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করা বেসরকারি সংস্থা 'ওয়ার্ল্ড
ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার'এর এক সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির
প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে, প্রকৃতিতে
এখন কত প্রজাতির প্রাণী বেঁচে আছে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই মানুষের। যে কারণে
ঠিক কত প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট হিসাবে দেওয়া কঠিন (সূত্র: বিবিসি
২৮ নভেম্বর, ২০১৯)। এছাড়া জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বিশ্বে বিলুপ্ত
হয়েছে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনাঞ্চল। পৃথিবী থেকে যদি এভাবে দ্রুত বনাঞ্চল ধ্বংস
হতে থাকে তাহলে তার পরিণাম সত্যিই ভয়াবহ হতে বাধ্য। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশের মোট আয়তনের
তুলনায় যেটুকু বনভূমি রয়েছে তা অনেক কম। প্রতি বছর বন্যা ও খরার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে।
দখল, দূষণ সহ বিভিন্ন কারণে নদীপ্রবাহের গতি স্বাভাবিক না থাকায় কৃষি কাজ সহ নানা ক্ষেত্রে
সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, বন্যায় ভেসে যাচ্ছে অনেক সাধ আর স্বপ্ন। এর সাথে এখন ব্যাপকভাবে
যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের এবং নতুন নতুন রোগব্যাধি। আর এ সব কিছুর ফলে উন্নয়ন বিঘ্নিত
হচ্ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে। সে কারণে পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন হওয়া সবার জন্যে
অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই দেশের পরিবেশগত সমস্যা
এবং এসব সমস্যার প্রকৃত কারণ জানা প্রয়োজন। একই সাথে সেগুলো আমাদের অনুভূতি ও উপলব্ধিতেও
আনা দরকার। তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে মানুষের কাজে লাগানোর পরেও পরিবেশের
ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হতে পারে।
পরিশেষে বলতে হয়, দারিদ্র্য, উন্নয়ন ও পরিবেশ এত বেশি অঙ্গাঙ্গীভাবে
সম্পর্কিত যে, দারিদ্র্য দূরীকরণ, উন্নয়ন সংগঠন ও পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি আসলে
একইসঙ্গে চিন্তা করা দরকার। যদি আমরা সেভাবে চিন্তা না করি কিংবা এড়িয়ে যাই তাহলে একের
পর এক পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা এবং জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণীর
মতো ‘জুনটিক রোগ’ (সূত্র: বিবিসি ৭ জুলাই, ২০২০) থেকে আমরা কখনই মুক্ত হতে পারব না।
প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য কি দেয়নি আমাদের? বেঁচে থাকার উপাদান,
ভালো লাগা ও ভালো থাকার উপাদান। সব কিছু যেন উজাড় করে দিয়েছে আমাদের। তাই প্রকৃতি ও
জীববৈচিত্র্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করাটা এখন সময়ের
দাবি। আর এই আঙ্গিকটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রেখে দেশব্যাপী নতুন একটি জাতীয় শিক্ষা
ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করে সবাই মিলে একযোগে সে লক্ষ্যে এখনই কাজ শুরু উচিত
বলেও আমি মনে করি।
আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস
(গত ২৯ এপ্রিল, ২০২০) বিশ্বনেতাদের প্রতি একটি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'করোনা পরিস্থিতি
থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।' সেদিকটিতে গুরুত্ব দেবার সময়
এখনই। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে 'রিভেঞ্জ অফ নেচার'। প্রকৃতি কখনই
প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় না, নেতিবাচক হয় না। তাহলে এই প্রবাদটা কেন ব্যবহৃত হয়? কারণ, প্রকৃতিও
মানুষের মতো প্রাণের দাবি রাখে। সহনশীলতা ও সম্প্রীতিবোধের মাত্রা হয়তো তারও আছে। তাই
সময়ের প্রয়োজনে কিংবা তাগিদে তাকেও কখনও কখনও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে হয়। দেড়শো বছর আগে বলা ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস কিংবা একশো বছর
আগে রবীন্দ্রনাথের বলা প্রকৃতির প্রতিশোধের কথাটা ইতিহাসে যেন বারবারই সত্যি হয়েছে।
আর সেই সত্যি আমরা চাই না। আসুন, এবার আমরা কভিড-১৯ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রাকৃতিক
পরিবেশের সাথে প্রকৃত অর্থেই সুন্দর এক মৈত্রীর বন্ধন রচনা করি।
No comments:
Post a Comment