এলিজিয়মের চুনসুরকি ও কিছু সাদৃশ্যের মঞ্চনিনাদ
অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
“নাকি এ শরীরে পাপের বীজাণুতে
কোন প্রাণ নেই ভবিষ্যতের
আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে
মৃত্যুকে ডেকে আনি নিজের ঘরে।”
২০১৩ সাল। একটি মার্কিন কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে উন্মোচিত হয়েছিল। নাম ‘এলিজিয়ম’। বাস্তবতার সঙ্গে সমান্তরাল ভবিষ্যতের যাপনচিত্র ও বিপ্লবীয়ানার ভাষ্যে উদ্ভাসিত এক ক্যানভাস- কখনও যেন মিশে যায় পরাবাস্তবতায়, কখনও আবার হারিয়ে যায় চেতনার অতলস্পর্শী বিষন্নতায়। আজ কোভিড-১৯ অতিমারী যখন একদিকে মানবজীবনে থাবা বসিয়েছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রনেতাদের ভিন্নতর মনোভাব নানাপ্রকারের শাসনযন্ত্রগত প্রকরণের মধ্যে দিয়ে রোজ নিজের দানবীয় চেহারা প্রকাশ করছে, তখন কোথাও না কোথাও অকিঞ্চিৎকর সঙ্গোপনে ‘এলিজিয়ম’ ছবিটির কথা বারেবারে স্মৃতিকে নাড়া দিচ্ছে। ছবিটিতে ২১৫৪ সালের কল্পনা করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে এক অন্য পৃথিবীর গল্প। এই পৃথিবী ডিস্টোপিয়ান। চারিদিকে অভিবাসনজনিত মারদাঙ্গা, অতিরিক্ত জনসংখ্যার দুর্বৃত্তপ্রবণ নোংরা জীবন, ট্রান্সহিউম্যানিজমের প্রতিস্পর্ধা, পঙ্গু স্বাস্থ্য-পরিষেবা, শ্রমিক শোষণ ও অত্যাচার, লাচার বিচার ব্যবস্থা এবং মুখেচোখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি নিয়ে ইতস্তত ভ্রাম্যমান মানুষের মুখগুলি। দেখলেই মন বলবে, এর চেয়ে মৃত্যু ঢের ভাল।
কিন্তু, এটা সার্বিক অবস্থা নয়। এমন নরকের পাশেই আছে স্বর্গের অবস্থান। পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থিত মানুষের তৈরি কৃত্রিম দুনিয়া– স্বপ্নের দুনিয়া– এলিজিয়ম। এখানে চারিদিক সবুজ গাছে ঘেরা, পরিষ্কার নীল জল, সুগন্ধময় পরিবেশ, নির্ঝঞ্ঝাট প্রাতিজনিক জীবন, বঞ্চনা-অভাব-অভিযোগহীন বিনোদনময়তা এবং সর্বোপরি ‘মেড-বেইজ’ নামক একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যা মানুষের যাবতীয় রোগ-যন্ত্রণা নিমেষে নির্মূল করে, বয়স কমিয়ে দেয় ও কোষের পুনর্নিমাণ করে মৃতদেহেও প্রাণের সঞ্চার করে। অর্থাৎ, একেবারে ইউটোপিয়ান। জন কার্লাইল নামের একজন মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত এই নতুন পৃথিবী। এই পৃথিবী সৃষ্টিতে অর্থব্যয় করেছেন একচেটিয়া বড়োলোকরা। ফলে এখানে কেবল তাদেরই অধিকার– প্রবেশের ও বসবাসের। এ যেন একইসঙ্গে একদিকে ডিস্টোপিয়া, অন্যদিকে ইউটোপিয়া।
চলচ্চিত্রে এই দুয়ের মধ্যে অভিঘাতের মূল বীক্ষা হল অর্থবান বনাম দরিদ্রের সামাজিক অবস্থান। অন্য কথায়, পুঁজিবাদ বনাম সাধারণ্যের কিংবা শাসক বনাম শোষিতের। পৃথিবীর মানুষকে জীবনযাপনের নিমিত্ত কিছু অর্থপ্রদান করে এরা, বদলে রোজনামচার অধিকারগুলিকে সম্পূর্ণ দমন করে রাখে এলিজিয়ম। এই কাজে সহায়তা করেছে আর্মাডাইনের অস্ত্র কারখানা। এখানে অত্যাধুনিক রোবট প্রস্তুত করা হয় যা পৃথিবীর মানুষের ওপরে নজরদারি চালায়, একটুও টুঁ-শব্দ বা বেচাল দেখলেই: গুলি। চলচ্চিত্রের প্রটাগনিস্ট চরিত্র ম্যাক্স ডি কোস্টা একসময় আর্মাডাইনে কাজ করত। কিন্তু একদিন তেজস্ক্রিয় বিকিরণের একটা দুর্ঘটনার ফলে যখন ম্যাক্সের জীবন বিপন্ন, মাত্র কয়েক দিন আর আয়ু, তখন কারখানার মালিক জন কার্লাইল ম্যাক্সকে ‘মেড-বেইজ’-এ পাঠিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে অস্বীকার করে। এতদিন ম্যাক্সের মধ্যে দুই-পৃথিবীর বৈরিতা নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না। এবার সে বেসামাল হয়ে পড়ে। স্পাইডার নামের একটি চরিত্র যে নানা রকমের কায়দায় এলিজিয়মে বেআইনিভাবে লোকজন পাঠানোর কৌশল আবিষ্কার করে থাকে। এলিজিয়ম এই কাজকে হিউম্যান স্মাগলিং বলে অপরাধী ঘোষণা করেছে। কিন্তু, এটাই স্পাইডারের পেশা কিংবা অন্য চোখে গেরিলাযুদ্ধ। অনন্যোপায় ম্যাক্স স্পাইডারের শরণাপন্ন হলে স্পাইডার না করে দেয়। কেননা কদিন আগেই সে তিনটি জাহাজ উড়িয়েছিল এলিজিয়মের উদ্দেশ্যে, লক্ষ্য ছিল রোগাক্রান্ত মানুষগুলোর চিকিৎসা করানো। কিন্তু এলিজিয়মের নিরাপত্তা বিষয়ক কর্তৃপক্ষ গুলি-বোমা মেরে সেগুলিকে মহাকাশেই ধ্বংস করে ফেলে। ফলে, স্পাইডার এখন ঝুঁকি নিতে নারাজ। পক্ষান্তরে এলিজিয়মের মধ্যে ক্ষমতা দখলের একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালু হয়েছে, এ খবর স্পাইডার জানত। সেখানেও যে কোনওদিন যা খুশি তাই হয়ে যেতে পারে। এদিকে ম্যাক্স নাছোড়বান্দা। স্পাইডার ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করে। উপায়টা কী, না, কার্লাইলের মস্তিষ্কে যান্ত্রিকভাবে এলিজিয়মের প্রোগামের একটা কার্বন কপি স্টোর করে রাখা আছে, যদি কোনওভাবে সেটাকে হাতানো যায়- যদিও সেটা নিতে গেলে কার্লাইলের মৃত্যু ঘটবে- তবেই কেল্লাফতে। সেই কোডিং পালটে দিয়ে, পৃথিবীর সব নাগরিককে এলিজিয়মের মেম্বার করে দিতে পারলেই এই পৃথিবীতেও ‘মেড-বেইজ’ চলে আসবে, পৃথিবীর মানুষ পুনর্জন্ম লাভ করবে, ক্ষমতার সমস্ত আঙ্গিক বদলে যাবে এক লহমায়– যেন এক নিভৃত বিপ্লব রচিত হবে। এরপরে ঘটনার টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রের শেষে বিপ্লব সফল হবার আশাপ্রদ অঙ্গীকার দেখানো হয়েছে। পৃথিবী আবার নতুন রূপে নিজের মহিমা ফিরে পাবে, এমনই প্রত্যাশায় অবগাহন করেছেন পরিচালক নীল ব্লমক্যাম্প ।
২০২০ সালের পৃথিবীতেও নেমে আসছে ডিস্টোপিয়ার কালো ছায়া। অতিমারী, দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন-বিশ্বউষ্ণায়ন, দুর্ভিক্ষ ও সামাজিক বৈষম্যের সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রত্যেকটি স্তম্ভ আজ বিপন্ন। সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকারগুলি রোজ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে শুধু তাই-ই নয়, সাবলীল বেঁচে থাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলিও ক্রমাগত বেহাত হয়ে পড়ছে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার রেখাগুলি স্থূল থেকে স্থূলতর হচ্ছে। মানুষ রোজ একটু একটু করে নরক যন্ত্রণার অভিঘাতে দীর্ণ হচ্ছে। অনুসন্ধিৎসু বক্ষালয় শান্তি চাইছে দু' দণ্ড। খুঁজছে, এলিজিয়ম। ‘এলিজিয়ম’ কথাটা আজকের নয়। মহাকবি হোমার, তাঁর ‘ওডিসি’-তে লিখেছেন, “But for thyself, Menelaus, fostered of Zeus, it is not ordained that thou shouldst die and meet thy fate in horse-pasturing Argos, but to the Elysian plain and the bounds of the earth will the immortals convey thee, where dwells fair-haired Rhadamanthus, and where life is easiest for men. No snow is there, nor heavy storm, nor ever rain, but ever does Ocean send up blasts of the shrill-blowing West Wind that they may give cooling to men; for thou hast Helen to wife, and art in their eyes the husband of the daughter of Zeus”। অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে, ‘এলিজিয়ান’ কথাটির অর্থ হল, A place or state of perfect happiness অর্থাৎ, পরমতম সুখযাপনের আবাসভূমি। সেখান থেকেই এসেছে ‘Elysium’ কথাটা। পরবর্তীকালে ভার্জিল লিখেছিলেন, “Night speeds by, And we, Aeneas, lose it in lamenting. Here comes the place where cleaves our way in twain. Thy road, the right, toward Pluto's dwelling goes, and leads us to Elysium. But the left Speeds sinful souls to doom, and is their path To Tartarus th' accurst”। আর দান্তে বিখ্যাত ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’-তে লিখেছিলেন, “With such affection did Anchises' shade reach out, if our greatest muse is owed belief, when in Elysium he knew his son”। কিন্তু বর্তমানের অভিধা বদলে যাচ্ছে, কিংবা গেছে অর্থনীতির বৈভবের একচোখা বন্টনে।
বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় ঔদার্যে, ন্যানোটেকনোলজি, মলিকুলার এসেম্বলস,
রোবটিক্স ও আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের অভাবনীয় উন্নতিতে দ্রুত বদলে যাচ্ছে চারপাশ। মোটা দাগে এখনও তা ধরা পড়ছে না ঠিকই কিন্তু যারা দেখার ঠিক দেখতে পাচ্ছেন। এ
বছরে মঙ্গল গ্রহে তিনটি যাত্রার কথা বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও ইউএই– এই লড়াইয়ে এগিয়ে। প্রাণের সন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে অন্য গবেষণাও চলছে লাগাতার। ভারতও
এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। বেঙ্গালুরুর
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এবং ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, চাঁদের মাটিতে ইট তৈরি করার পদ্ধতি তাঁরা আবিষ্কার
করতে সক্ষম হয়েছেন। চাঁদের মাটির সঙ্গে ইউরিয়া মিশিয়ে তৈরি হবে এই ইট জাতীয়
উপাদান আর সিমেন্টের বদলে ‘গুয়ার গাম’ নামক বিশেষ আঠা ব্যবহৃত হবে এই প্রযুক্তিতে।
প্রকৃতপ্রস্তাবে, চাঁদের জমিতে বসবাসোপযোগি ঘরবাড়ির স্বপ্ন আর অধরা থাকবে না
কিছুদিন পরে।
অন্যদিকে, আর্কটিক অঞ্চলে দ্য সভালবার্ড গ্লোবাল সীড ভল্ট-এ রাখা হয়েছে দুনিয়ার
অত্যাবশ্যকীয় শস্যের বীজগুলিকে। দ্য গিটহাব আর্কাইভ প্রোগ্রাম ২১ টিবির ফিল্মে
সঞ্চিত করেছে সারা দুনিয়ার যাবতীয় বুদ্ধিমত্তার ডিজিটাল ভার্সন। আর্কটিক অঞ্চলে
গভীর মাটির তলায় এগুলো জমানো শুরু হয়েছে। পরমাণু বোমা ফেটে গেলেও এগুলি সংরক্ষিত
হবে আগামি ১০০০ বছরের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হল, একদিকে মঙ্গল-চাঁদ, অন্যদিকে
আর্কটিক অঞ্চলের অতন্দ্র প্রহরিত সংগ্রহশালা– অদ্ভুতদর্শন এইসব হুড়োহুড়িতে
‘এলিজিয়ম’-এর সন্দেহজনক গন্ধ কোথাও নেই তো? কেননা বাড়ি বানানোর উপকরণ জোগাড় হলেও,
কারা কিনবে বা বানাবে সেই বাড়ি? খাদ্য-সংস্থানের উৎস থেকে উন্নত প্রযুক্তিগুলিকে
আবার নতুন করে রূপায়িত করার চাইতে, উপলব্ধ সম্ভারকে বহন করার অধিকার কাদের? আজকের
পৃথিবীতে কী পরিচয় তাদের, পদবিগুলি কি আমাদের খুবই পরিচিত, নাকি অন্য কিছু? অনুমানের
ভিত্তিতেই ঝাঁপাতে হয় পরীক্ষার অন্দরমহলে। আজ যদি এই অনুমানগুলি নিয়েই
বাস্তবতায় শতরঞ্চি পাতি, তবে কি আমরা অপেক্ষা করব কোনও ম্যাক্স ডি কোস্টার নাকি
প্রশান্ত ভূষণের কথাগুলিকে ভেবে দেখব, সাহায্যপ্রার্থী হব স্পাইডারের নাকি নিজেদের
মধ্যে থেকেই থুনবার্গের সমর্থনে ঐক্যবোধ জাগ্রত করার কাজে নিয়োজিত করব বিবেকবোধকে– এসব নানা প্রশ্ন আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনন্ত অভিসন্ধির নির্নিমেষ
পরাকাষ্ঠায় উন্মীলিত নয়নে খুঁজে নিতে হবে উত্তর, নিজেকেই– নইলে থালা-বাটির বাদ্যি
আর মোমবাতির চিতায় ধীরে ধীরে ব্যর্থ প্রার্থনা মিহি হয়ে যাবে, ফিসফিসানিগুলো এসে বলবে,
আজ বসন্তের শূন্য হাত
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”
তথ্যসূত্র:
No comments:
Post a Comment