লকডাউনে শিল্পচর্চা
তন্ময় সাঁতরা
লকডাউন। প্যানডেমিক। আশঙ্কা, সাবধানবাণী আর বিধিনিষেধে ঘেরা এ এক ভিন্ন সময়। এক ভিন্ন যাপন। এক প্রবল সংকটকাল। ভয়, দুর্ভাবনা ও উদ্বেগের কালো মেঘ যেন হঠাৎ এসে ছেয়ে ফেলেছে সারা আকাশটা। উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা হয়ে উঠেছে এই বিপন্ন সময়ের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
দীর্ঘায়িত এই গৃহবন্দিদশা ও এর অভিঘাত মানুষের জীবন, জীবিকা ও টিকে থাকার লড়াইকে এক অন্য খাতে বইয়ে দিল। মানবজীবনের সব কিছুই এখন এক অচেনা পরিস্থিতির মুখোমুখি। রাতারাতি যেন আমূল বদলে গেল তার যাপন ও ভাবনা। বলা বাহুল্য, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাটকের মতো চাক্ষুষ শিল্প-মাধ্যমও এর বাইরে থাকল না।
সঙ্গীতের অনুষ্ঠান, সাহিত্যের আড্ডা ও নাটকের মঞ্চায়নের মতো ছবি-মূর্তি-ইনস্টলেশনের প্রদর্শনীও জনসমাগম দাবি করে বলে এখন বন্ধ। শিল্পকলার কর্মশালা, ডেমনস্ট্রেশন, আর্টিস্ট টকেরও একই অবস্থা। আর্ট কলেজের স্টুডিওগুলি তালা-বন্ধ। শিল্পকলার শিক্ষায়তন, আর্ট গ্যালারি ও আর্টিস্ট রেসিডেন্সিগুলির নতুন কর্মপন্থা ও কর্মসূচি কি হবে সে-নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে। এ হেন অবস্থায় দেশ-বিদেশের বেশির ভাগ গ্যালারি ও মিউজিয়ম তাদের প্রস্তাবিত প্রদর্শনী স্থগিত রেখে অনলাইন বা আন্তর্জালিক প্রদর্শনীর পরিকল্পনা নিচ্ছে। শিল্পকলা প্রদর্শনের এই বিকল্প মাধ্যমটি এখন একটি নির্ভরযোগ্য ও অত্যাবশ্যক উপায় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার করে লাইভ টক ও ইন্টার-অ্যাকটিভ আলোচনার আয়োজন করা হচ্ছে যেখানে দর্শকরাও সহজে অংশগ্রহণ করতে পারছে। দূরে থেকেও দূরত্বকে অস্বীকার করার প্রয়াস করছে।
দৃশ্যকলা সামনে থেকে দেখে দর্শকের মনে যে অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির সঞ্চার হয়, তার অনেকটা অংশই বোধকরি অধরা থেকে যায় ইলেকট্রনিক মাধ্যমের দেখায়। শিল্পকলার প্রতিলিপি দেখার মতোই এ একপ্রকার আংশিক দেখারই সামিল। তবু শিল্পী, শিল্পের পৃষ্ঠপোষক, কিউরেটর ও আয়োজকদের কাছে আর কী-বা উপায় আছে! হয়তো ভবিষ্যতে প্রযুক্তির আরও উন্নতি এই ঘাটতিটুকুরও অনেকাংশ পূরণ করতে সক্ষম হবে।
লকডাউনে চর্চা থেমে নেই। ভাবনার আদান-প্রদান ও সৃজনের কমতি নেই। দেখা গেল, এই বদ্ধ জীবন ও সংকটে প্রহর যাপন মানুষকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে আর একবার যেন সচেতন করিয়ে দিল। নিজেকে বা নিজের জীবনকে উল্টে-পাল্টে বা ফিরে দেখার অবকাশ দিল। ফেলে রাখা প্রিয় কাজটির প্রতি যত্নশীল হবার প্রেরণা দিল। দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ থেকে রেহাই পেতে তাই কেউ হাতে তুলে নিল খাতা-কলম, ডায়েরি। অন্তরের তাগিদ থেকে টান দিল কেউ সেতারের তারে। এই লকডাউন পর্বেই কারও লেখা হয়ে গেল আস্ত এক উপন্যাস। এ যেন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ধারার এক আত্মসমীক্ষার অবকাশ। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত সময় ও আলোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্য যে এমনভাবে বদলে যায়, আর তা নিজেরই বাড়ির জানলা থেকে এভাবে দেখা যায়, সে ব্যাপারটি যেন এর আগে অনেকেরই চোখে পড়েনি। কেউ খুঁজে পেল আশেপাশের অতি সাধারণ খুঁটিনাটির মধ্যে তার নিজেরই মনের অনন্য প্রতিবিম্ব। কেউ সে সব ক্যামেরাবন্দি করল, কেউ বসে গেল রং-তুলি নিয়ে।
এ-সময়ে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-ইনস্টাগ্রামেও দেখা যাচ্ছে অসংখ্য সমৃদ্ধ পোস্ট। গৃহবন্দি থেকেও দেখে নেওয়া যাচ্ছে অসংখ্য শিল্পীবন্ধুর কর্মমুখর স্টুডিওর আনাচকানাচ কিংবা সমৃদ্ধ সৃজনসম্ভার। এই ভার্চুয়াল পরিদর্শন ও কথা বিনিময় বোধকরি ভিন্ন একপ্রকার ওয়ার্ক কালচারের আমদানি করবে। প্রত্যক্ষ এবং ভার্চুয়াল, দু-ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে এখানে নব-রচিত কিছু শিল্প-কর্মের উদাহরণ আনব। এই সময়ের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা শিল্পকলার মধ্যে দুটি বিশেষ ধারার কথা এখানে বলব। এক, যাদের কাজে ‘লকডাউন’ ও এই বিশেষ সময়ের প্রতিফলন পরোক্ষভাবে দেখা গেল। দুই, যাদের কাজে দেখা গেল এই করোনা-কালের প্রত্যক্ষ প্রভাব।
নিজের কাজ দিয়ে শুরু করি। সাধারণভাবে আমার ছবি চারপাশের জগতে ঘটে চলা ব্যাপার-স্যাপার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। রচনার অনেকটা রসদ আমার সংগ্রহ হয় সারাদিনের চলাফেরা থেকে। এই গৃহবন্দি-জীবন তাই, প্রথমে এক সজোর ধাক্কা হিসেবে এল। তবু চর্চা বাদ দিয়ে তো প্রহর যাপন সম্ভব নয়। লকডাউনের প্রথম পর্বে শুরু হল ড্রয়িং ও জলরং-এ ল্যান্ডস্কেপধর্মী কিছু কাজ। এমনিতেই আমার ছবির নীরব আখ্যানগুলিতে থাকে একপ্রকার অস্তিত্বের সংকট ও পরিব্যাপ্ত নির্জনতা। এই পর্বে বিচ্ছিন্নতা ও নিভৃতিকে যেন আরও বেশি করে উপলব্ধি করলাম। আমার একগুচ্ছ ড্রয়িং ও জলরং-এর কাজে তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ল। পাশাপাশি চলছে লিখিত শব্দ বা লিপিকে ড্রয়িং-এ ব্যবহার করার কিছু অনুশীলন। এই পর্বের ড্রয়িং-এ কিছু নতুন শব্দ ব্যবহার করেছি। যেমন ‘দূরত্ব’। সঙ্গীতের শব্দ (sound), সুর (melody), ছন্দ (rhythm) ও নোটেশন নিয়েও কিছু ড্রয়িং-এর চর্চা চলছে। এই আবদ্ধ ও সন্ত্রস্ত জীবনের সমস্যার কথা ভুলতে দীর্ঘসময় ধরে শুনছি রাগ সঙ্গীত। কিছু সময় তবলার রিয়াজ। তাই ছন্দতাল অনুপ্রাণিত কিছু মাটির কাজ করারও বাসনা হল।
একই গৃহপরিসরের আরও তিনজনের শিল্প-সৃজন সম্পর্কে কিছু কথা এখানে বলব। আমার স্ত্রী তাপসী (নাথ) শিল্পী। দুই মেয়ে তনয়া ও তিয়াসা ছোট বলে অবহেলা করে অ-শিল্পী বলার সাহসও আমার নেই। তিনজনের কাজেই গেরস্ত-জীবনকে দেখার প্রতিফলন। কাপড়ের উপর স্টিচ ও অ্যাপ্লিক মাধ্যমে করা তাপসীর কয়েকটি কাজে দেখা গেল ঘরের কিছু খুঁটিনাটি, সেলাইয়ের সরঞ্জাম আর জানলা দিয়ে দেখা বাইরের জিনিস। যেমন, মেঘ ও বৃষ্টি। বারো বছরের মেয়ে (দু’জনেই) তনয়া ও তিয়াসার ছবিরও মূল উপজীব্য ‘হোম’ বা গৃহকোণ। রান্নাঘরের তাকে রাখা কয়েকটি সাধারণ রান্নার সরঞ্জামই তনয়ার ‘কিচেন-শেল্ফ’ ছবিটির অনুপ্রেরণা। হলুদ বাদামি কমলা কালোর ছন্দোময় বিন্যাস ছবিটির ভাবব্যঞ্জনাকে গভীর করেছে। তিয়াসার ‘বুক-শেল্ফ’ ছবিটির অনাড়ম্বর রূপবন্ধে বইপত্র, ফুলদানি ও কয়েকটি জিনিসের উপস্থাপনা।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের (হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়) শিল্পকলা বিভাগের স্টুডিওগুলি এই লকডাউন পর্বে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগই যে-যার বাড়ি ফিরে গেছে। তেমনই কয়েকজন নবীন শিল্পীর এই পর্বে করা কয়েকটি শিল্পকর্মের প্রসঙ্গ এখানে আনব। সুরেশ কুমার সিংহ তার কাটোয়ার বাড়িতে বসে এ-সময় যে-সমস্ত ছবি রচনা করে চলেছে, তাতে ঘরে ফেরার আর্তি ও বন্দিজীবনের কথা স্পন্দিত। তার অনেকগুলি ছোট চিত্রপট জুড়ে রচিত একটি কাজে এই পীড়িত জীবনের ভাবব্যঞ্জনার অনবদ্য প্রকাশ দেখা গেল। এখানে পাখি ও বাড়ির রূপবন্ধ এসেছে পরিযান ও নিরাপদ আশ্রয়ের রূপক হিসেবে। আরতি আন্নামারিয়া কোচির বাড়িতে বসে আঁকছে গৃহপরিসরের ছবি। ‘কনফাইনমেন্ট’ শিরোনামে তার যে সিরিজটি চলছে তার একটিতে দেখা যাচ্ছে, রান্নাঘরের জানলার পাশে রাখা কাপ-গ্লাস-হাতা-খুন্তি। আর জানলার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের বাইরের এক টুকরো সবুজ। নারীজীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত এই রান্নাঘরেই। এছাড়া বার্ধক্য ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য কত মানুষকে দীর্ঘ সময় গৃহবন্দি থাকতে হয়। আর এখন প্রায় সব মানুষেরই সেই হাল। এই ছবিগুলি প্রকারান্তরে সে-কথা বলারই প্রয়াস করে।
দীপিকা রায় এখন রয়েছে তার ক্ষীরপাইয়ের বাড়িতে। আবদ্ধ জীবনের খণ্ড-মুহূর্তগুলিকে প্রাণবন্ত করে তোলার কাজে সে বেছে নিয়েছে ‘বুক আর্ট’। ছোট বাঁধাই করা খাতার পাতার কোথাও এঁকে, কোথাও কাগজ কেটে এই বই তৈরি করছে সে। অনির্বাণ মিশ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর পর্বের পাঠ এক বছর আগে শেষ করেছে। সে তার তমলুকের বাড়িতে বসে এ-সময়ে এঁকে চলেছে অসংখ্য ছবি। ছবিগুলিতে এই বিপন্ন সময়ের অসহায়তা, আর্তি ও নিরাপত্তাহীনতার প্রতিফলন।
এই অবস্থায় শিল্পীদের সৃজন অব্যাহত থাকলেও অসম্ভব এক অনিশ্চিয়তার মধ্যে তাদের দিন কাটছে। অতিবাহিত হচ্ছে এক বিপর্যস্ত জীবন। তাদের উপার্জনের পথগুলি বোধহয় কঠিনতর হল। তবু চর্চা থেমে নেই, সৃষ্টি থেমে নেই। কবি সাহিত্যিক সঙ্গীতশিল্পীদের মতো চাক্ষুষ মাধ্যমের শিল্পীরাও কাজ করে চলেছে। অনেক অনেক কাজ। তাদের কাজের মধ্যেই ধরা থাকবে এই সময়ের আখ্যান। নাড়ির অনুরণন। তবে জানি না, কোভিড-পরবর্তী দিনগুলিতে শিল্পকলার চর্চা ও পেশার দিকটি কতখানি বদলে যাবে।
খুবই প্রসংশনীয় কাজ আপনার
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
DeleteBhha besh valo o prasongik lekha Tanmoy 🌻
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ, বন্ধু!
DeleteTomar shilpo karjo aar lekhon dutoi sunder bhabe birajito..boye chaluk ei dhara aar jukto hok onek matra.
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!☺
Deleteপ্রায় একই অভিজ্ঞতা সবার৷ ভালো লাগল৷
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ জানাই। ভালো থাকবেন।
DeleteAnek diner pare jeno bristi elo....khub khub bhalo laglo....
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ, বড়দি! ভালো থেকো।
DeleteInnovative. Lovely
ReplyDeleteThank you, for this inspiring feedback! Regards.
Deleteলকডাউনে নানান বিষয়েই লেখা পড়েছি। কিন্তু এমন লেখা এই প্রথম পড়লাম। শিল্পী গৃহবন্দী হলেও শিল্প কেন থেমে থাকবে। নতুন আঙ্গিকে নতুন প্রকরণ সহকারে শিল্পচর্চা এগিয়ে চলুক মহামারিকে জয় করে।তন্ময়দাকে অজস্র ধন্যবাদ এই বার্তাকে প্রচারিত করার জন্য।
ReplyDeleteঅরণাভ, তোমার এই মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ! ভালো থেকো।
Deleteএই সময়ের এক সুন্দর উপস্থাপনা হিসাবে মূল্যায়িত হবে।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলুম।
Deleteআপনার লেখাটা পড়ে মনে হলো আপনি সমস্ত শিল্পীদের মনের কথাটা যেন খুব সহজেই বললেন, আপনার লেখাটা পড়ে আমিও আমার মনের আড়ালে থাকা অনেক ভাবনাকে খাতায় লেখার সাহস হয়তো করে উঠতে পারব, অনেক ধন্যবাদ স্যার।
ReplyDeleteধন্যবাদ, মোনালি, তোমার ফিডব্যাকের জন্য! লেখো, লেখার অভ্যেস তোমার শিল্পচর্চার পরিপূরক হোক।
DeleteKhubh Bhalo laglo aapnar lekha pore.. Bhalo thakun Tanmoyda
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ, পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য। ভালো থেকো তোমরাও।
Deleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete