Friday, 29 May 2020

এক যুদ্ধক্ষেত্র

চলচ্চিত্রে বিচ্ছিন্নতা
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়

সিনেমা এক যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। প্রেম, সংঘাত, ঘৃণা, বন্ধুত্ব, হিংস্রতা, মৃত্যু... এক কথায় আবেগ। আর এই আবেগ থেকেই বিচ্ছিন্নতা। ফেদেরিকো ফেলিনি, আন্তোনিওনি, আ্যালা রেঁনে এইসব পরিচালকদের ছবিতে প্রেমের পরাজয় সন্ধান করা যায়। তিনজনই বুর্জোয়া সমাজে আবেগের মূল্য ধসে যাওয়া ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন। ফেলিনির 'লা দোলছে ভিটা'য় বুর্জোয়া অধঃপতনের সাধারণ একটি দৃষ্টিই আমরা লক্ষ করি। আন্তোনিওনির 'লা স্ত্রাদা' ছবিতে দরদি প্রেম, সংযোগের ব্যর্থতা বিষয়ে এক ভিন্ন রূপ। আন্তনিওনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেন বুর্জোয়া সমাজের শূন্যতা, 'ইল গ্রীডো' ছবিতে শ্রমিকশ্রেণির পারিপার্শ্বিকতা। একজন কাজের লোক মরীয়া হয়ে মানবিক সম্পর্ক সন্ধান করছেন। আলডো-র আত্মহত্যা ও ইরমার কান্না, যখন সে দেখছে আলডো ঝাঁপ দিচ্ছে- এই দৃশ্য আধুনিক চলচ্চিত্রে বিচ্ছিন্নতা বিষয়ক একটি শক্তিশালী ইমেজ। আলডো-র মৃত্যু খুব সহজভাবেই ছিল একটা প্রয়োজন। এটাই অনিবার্য উপসংহার, বোধের বাইরে চলে যাওয়া। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ইরমাকে যখন সে বিদায় জানাচ্ছে তা শুধু ইরমাকে নয়, জানাচ্ছে নিজেকেও; সে নিজের কাছ থেকে, পরিবেশ-গোষ্ঠী-গ্রাম- গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে । 

পরের তিনটি ছবিতে বিচ্ছিন্নতার বিষয় আরও পরিমার্জিত সূক্ষ্ম এবং আরও বিশদ ও গভীর। মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার গুরুত্ব ব্যক্তিগত পরাজয়ের চেয়ে বেশি। বোধে শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে যায় আরও। 'লাভেন্তুরা' শূন্য দ্বীপের নির্জনতায় মানবিক একাকীত্বের নাটক, শহর আমাদের চারপাশে যে স্থাপত্যের কারাগার তৈরি করে তারই পটভূমিতে 'লা নত্তে' নিজেরই কারাগারে বদ্ধ মানুষের নাটক। আন্তোনিওনি একবার চিত্রকর মার্ক রোথকো-র স্টুডিওতে গিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, আপনার আঁকা ছবি আমার ক্যামেরায় তোলা ছবির মতো,  about nothing। আপনার মনে পড়ে, apart from the experiences of subjects there is nothing, nothing, nothing and nothingness। অপরাহ্ণ থেকে নির্ঘুম রাত্রি, নির্ঘুম রাত থেকে ধূসর ভোরের দিকে চলে যায় 'লা নত্তে'। যন্ত্রণা, দ্বন্দ্ব, পীড়নের এক দীর্ঘ প্রতিকৃতি।

এরকম প্রচুর ছবি নিয়ে বিচ্ছিন্নতার আলোচনা করা যায়।  

আন্তোনিওনির আরেকটি ছবি 'প্যাসেঞ্জার'। Passenger is a film within a film-এর অন্তর্গত প্রতিবিম্ব । অপরিচিত সব উদ্দেশ্যের সন্ধানে চলেছে লক। একজন মৃত মানুষকে তার নিজের নামটা দিয়ে দেয় লক। যেন সে নিজের সম্পর্কে একটা মৃত-সত্যকে আবিষ্কার করেছে। এক জীবনে নিজেকে দুবার আবিষ্কার করা যায় না‌, প্রথম অস্তিত্ব থেকে নিতে হয় নির্বাসন। দ্বিতীয় অস্তিত্ব খুঁজে বার করা যায়, কিন্তু সেখানেও মুক্তি নেই। কী আর করা যাবে, তাই বিচ্ছিন্ন হতেই হবে। লক যদি রবার্টসন হয়ে যায়, রবার্টসনও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হতেই হবে, লক রবার্টসন হয়েও বাঁচতে পারে না, বিচ্ছিন্নতা এই-ই। আসলে বুর্জোয়া সভ্যতার অন্যতম প্রধান নান্দনিক উপাদান বিচ্ছিন্নতা, বিমূর্তায়ন ও মায়া। ফলে, চলচ্চিত্রে বিচ্ছিন্নতার শুধু মাত্রাগত নয় ঘাতগত গুরুত্বও আছে।

No comments:

Post a Comment