Friday, 29 May 2020

বড়াই!

হংস মধ্যে বক
অমৃতা ঘোষাল

বৃষ্টি। আহঃ। আরাম। আহঃ। ঘুম। আহঃ। মসৃণ নরম বিছানা। আহঃ। ঘরে বসে বেতন। আহঃ। আবাসনের সিকিউরিটি গার্ডের কাশির শব্দ। ঘুম ভেঙ্গে গেল। লোকে কাশে কেন এত রোমান্টিক ঝড়বৃষ্টির রাতে! খোলা জানলার থেকে এক ঝলক বৃষ্টির দমক পায়ে ঠাণ্ডার উষ্ণ স্রোত বইয়ে দিল। বিছানা থেকে উঠে এক পেগ হুইস্কি বানিয়ে জানলায় দাঁড়িয়ে ঝড়-বৃষ্টির চাঞ্চল্য দেখে ভাবলেন, কাল একটা কিছু করতেই হবে। বেশ কিছু দগদগে ফেসবুক পোস্ট করে ইতিমধ্যেই বেশ পপুলার হচ্ছেন। এবার একটু বড় রকমের কিছু চাই। গত দু' মাসের স্যালারি ভালোই জমেছে। ঝড়বৃষ্টি কমলে এবার একটা কিছু করবেনই। হোয়াটস্যাপ খুলেই জাস্ট প্ল্যানিং হয়ে গেল। বান্ধবী আর পাড়ার দুটো গায়ে হাওয়া লাগানো বেকার ছেলে। পরশুই নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন একটু গরিব গরিব এলাকায়। ঝড়ের ঝাপটা বাড়ছে, জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন।

পরশু চাল, ডাল, সয়াবিন, তেল, আলু, বিস্কুট, মাস্ক আর সাবান ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সকাল সকাল। আর সঙ্গে তো সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান অর্থাৎ আপনার ডিএসএলআর ক্যামেরা রয়েছেই। সঙ্গে মুখে মাস্ক হাতে গ্লাভস পরিহিতা সুন্দরী বান্ধবী, আর ওই পাড়ার লাল্টু পল্টু। স্টিয়ারিং আপনার হাতে। গন্তব্য আপনার ঘরের পরিচারিকা যে জলমগ্ন এলাকায় এখন আছেন, তারই কেন্দ্রে। সেখানে একটু শুকনো জায়গায় থামলেন, কারণ খিচুড়ি রেঁধে দেওয়ারও একটা প্ল্যান আছে। প্যান্ট গুটিয়ে জল পেরিয়ে পরিচারিকার ঘর খুঁজে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে এদিক ওদিক ছবি তুলতে শুরু করলেন। খিচুড়ি রাঁধবে লাল্টুরা। বান্ধবী ব্যস্ত মাস্ক সরিয়ে সেলফি তুলতে। একটু উদাস ভঙ্গিতে দেখলেন একটা কচি বউ খামোকাই আপনাকে দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নাক মুখ ঢাকল। এরা মাস্ক ফাস্কের ধার ধারে না। কচি তাই আঁটোসাঁটো বাঁধন। খিচুড়ির গন্ধে মিশেল ঘটল অন্য ধোঁয়ার। দেখলেন অদূরেই বান্ধবী মাস্ক সরিয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। তার ঠোঁটের ওপর হালকা রোম বুঝিয়ে দিচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার শপিং মলের অভিজাত সালোঁ এখনও খোলেনি। মিশ্র গন্ধ উপভোগ করতে করতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন আজ রাতটা বান্ধবীর রাজারহাটের ফ্ল্যাটেই কাটাবেন।

লাল্টু খিচুড়ি প্যাক করে বিলিয়ে দিচ্ছে। পল্টু অনেককে চাল, ডাল, তেল, আলু আর সয়াবিনের প্যাকেট ধরিয়ে দিচ্ছে। তবে মাস্ক, সাবান সকলের জন্যে। ছবিগুলো তুললেন অনেক এঙ্গেল থেকে। একটু কায়দা করে তুলতে হবে পঙ্গু বৃদ্ধ আর রোগা শিশুদের ছবি। ভাবলেন ছবিগুলোয় ধূসর রংটাকে একটু ঘষে বেশ একটা সুররিয়াল গন্ধ ছড়িয়ে দেবেন। গ্রে স্কেল পিকচার আপলোড=স্কোপ অফ সফিস্টিকেশনও অর্জন। প্রায় এক লাখি স্যালারি থেকে আপনার খসল আড়াই হাজার, বান্ধবী একটু কম স্যালারি পেলেও পাঁচ হাজার খসিয়েছে। ফেরার সময় ব্ল্যাকে একটা ভদকা কিনলেন। ওটাকে অনেকে দেশি মালের ক্যাটাগরিতেই রাখে। তাই একটু শ্রেণিচ্যুত হলেন। মধ্যরাতে নেশাতুর হয়ে বান্ধবীর নাভির রিংটায় জিভ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ আতঙ্কিত হলেন। ধাতুতেও তো করোনার ভাইরাস জেগে থাকে! ব্যাস, বাকিটুকু রূপকথা!

গল্পটার মোদ্দা কথা হল- আত্মরতি। যেভাবেই হোক, নিজেকে মহৎ প্রমাণ করতে হবে। ছবির দৌড়ে নিজেকে সেরা দেখাতেই হবে। তাই কাউকে সাহায্য করারও কিছু একটা ডকুমেন্ট সযত্নে মেলে ধরতে হবে। ছবির সঙ্গে কখনও বা সেঁটে দিতে হবে কোনও বিখ্যাত কবির জ্বালাময়ী পংক্তি। দুটো রসকে একসঙ্গে মেশাতে হবে-- করুণ আর বীভৎস। অন্যের মনে যত 'চুক চুক' আর 'ওরে বাবা' জাগিয়ে তুলতে পারবেন, ততই আপনার সন্তুষ্টি বাড়বে। আবার আপনার কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বীও জুটে যাবে। আয়নার গোলকধাঁধায় ঢুকলে ঠিক যেমন হয়, তেমনটাই ঘটতে থাকবে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে। তবে এই গোলকধাঁধার দুটো মুখই আটকানো। তাই নিজেকে আপাতত নার্সিসাস ভাবুন। নেমেসিস ঠিক আপনাকে খুঁজে নেবে।

No comments:

Post a Comment