কিছু দায় তো আমাদেরও
শতাব্দী দত্ত
এরই পাশাপাশি এমনও ঘটে- যে শ্রমিকরা কোনওমতে নিজের সর্বস্ব আর্থিক সম্বল একত্রিত করে নিজের রাজ্যে ফিরতে গাড়ি ভাড়া করেছিলেন, তাদের লকডাউনের নিয়মরক্ষার অজুহাতে নিঃস্ব অবস্থায় পরিবারসুদ্ধ গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। কোথাও বা শোনা যায়, শ্রমিকদের ঘরের ফেরার জন্য যে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়, সেই ব্যবস্থারই অঙ্গ হিসাবে শ্রমিকদের ইংরেজিতে ফর্ম ফিল-আপ করে আনতে বলা হয়। হয়তো সরকারের ধারণা হয়েছিল, ইংরেজি শিক্ষার দায় শ্রমিকদের নিজেদেরই। তেমনই বাড়ি ফেরার হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনার দায় তাঁদের নিজেদেরই বলে মনে করিয়ে দেয় আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা। এরই সাথে, অর্থনীতিকে 'চাঙ্গা' করতে অঙ্গীকারবদ্ধ কিছু রাজ্যের সরকার অস্থায়ীভাবে দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রম আইন রদ করার পথে হেঁটেছে। এতে এটাই মনে হয়েছে যে, সরকারের কাছে শ্রমিকদের সর্বোচ্চ শ্রম সময়ের সীমা, ন্যূনতম মজুরির সীমা এবং আরও কিছু মৌলিক অধিকার রক্ষা দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। বলাই বাহুল্য, এইসব ভিত্তিহীন সরকারি সিদ্ধান্ত মানুষ ও অর্থনীতির মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটিয়ে মানুষকেই হারিয়ে দেয়। ফলত, নাগরিক দ্বারা নির্বাচিত সরকারের দ্বারা নাগরিক তথা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলিও খর্ব হতে থাকে।
আরেকটু পিছিয়ে এসে কিছু চোখ সওয়া ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। লকডাউন ঘোষণা করার পর প্রথম দিকের কয়েক দিনে আমাদের অনেকেরই মোবাইল ফোনের পর্দায় অথবা খবরের চ্যানেলগুলোতে দেশের নানা প্রান্তের কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখতে পাচ্ছিলাম। কীভাবে নানা প্রান্তের পুলিশ লকডাউন নিয়মভঙ্গকারীদের অভিনব পদ্ধতিতে শাস্তি দিচ্ছে তা আমাদের স্তব্ধ মধ্যবিত্ত দিনযাপনে কৌতুক ও বিনোদনের সাময়িক উৎস হয়ে উঠেছিল। যেমন, কোথাও দেখা গেল কোনও নিয়মভঙ্গকারীকে পুলিশ জনসমক্ষে কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছে, কোথাও কোনও একজনকে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বলা হচ্ছে, আর লাঠিপেটা আজকাল আরও সাধারণ শাস্তির পর্যায় পড়ে। অসম্মানের দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্তরা খুব স্বাভাবিকভাবেই দর্শকদের হাসির খোরাক হয়েছিলেন। এখানে নিয়মভঙ্গকারীদের নিয়মের পথে ফেরানোর মহৎ উদ্দেশ্যের পাশাপাশি শাস্তিপ্রাপ্তদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিও প্রায় সব ক্ষেত্রেই চোখে পড়েছিল। আর তা হল, অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ব্যক্তিদেরই শাস্তির নিশানা করা। ভিডিও ক্লিপগুলিতে এই শাস্তিদানের সময়ই পাশ দিয়ে চার-চাকা বা দু-চাকায় অন্যান্য ব্যক্তিদেরও যেতে দেখা গেলেও তাঁদের এই অসম্মানের পরিণতি হতে হয়নি। আরও দেখা গেল, কোনও এক জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিকের দলকে জীবাণুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের উপর রাসায়নিক (সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট) স্প্রে করলেন। অথচ, এই তরল মানবদেহের সংস্পর্শে এলে শরীরে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার চরম সম্ভাবনা থাকে। অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে উচ্চশ্রেণিকে আর্থিক সৌভাগ্যের কারণে এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি। নাগরিক বা মানবাধিকার বারবার সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানের দ্বারা নির্ধারিত হতে দেখা গেছে, যা কোভিড-১৯ আরও বড় আকারে দৃশ্যমান করেছে।
শুধুমাত্র গত কয়েক সপ্তাহের লকডাউনের সময়ে 'পরিযায়ী শ্রমিক'দের অবস্থান দেখেই এই শ্রেণির আয়তন সম্বন্ধে আমরা ইতিমধ্যেই আংশিক ভাবে হলেও অবহিত হয়েছি। আবার এই শ্রমিকরা সমাজের বৃহত্তর অর্থনৈতিক অনগ্রসর মানুষের অন্যতম অংশ। সুষ্ঠু নাগরিক জীবনধারা বজায় রাখতে অর্থনীতির মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত এই সব মানুষের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। অথচ, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় ভূমিকার দিক থেকে এবং জনসংখ্যার গুরুভাগ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা জাতীয় আয়ের একটি অতি ক্ষুদ্রভাগের অধিকারী। তবু দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভোটদানের নিরিখে সমাজের এই অংশই সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তা মাথায় রেখে উপরোক্ত ঘটনাগুলি পরপর সাজালে সমাজের এই অংশের প্রতি সরকারি প্রতিনিধি বা সরকারের যে আচরণগত অসঙ্গতি ও বৈষম্যমূলক চরিত্র প্রকাশ পায় তা সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়।
এই সরকারি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অসংখ্য অসুখের সূত্রপাত হয়তো আরও গভীরে যার সংক্রমণ বহুদিন ধরে সমাজ বয়ে চলেছে। গণতান্ত্রিক সরকার কোথাও গিয়ে সমাজেরই প্রতিফলন, তাই, সামাজিক আচরণের প্রতিও সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এখানে কথ্য ভাষার একটা বড় ভূমিকা। দরিদ্র সমাজের প্রতি সম্বোধনের ভাষা তথাকথিত সম্মাননীয় সমাজের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় না। সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন ভাষায় ঘটে। আবার আশ্চর্য ভাবে, বহু 'শিক্ষিত', 'রুচিশীল' পরিবারে অর্থের বিনিময়ে শ্রম দিতে আসেন যারা তাঁদের খাবার বা জল দেওয়ার ক্ষেত্রে পৃথক পাত্র ব্যবহৃত হতে দেখা যায় অথবা বাড়ির শৌখিন বসার জায়গায় হয়তো তাঁদের বসার অধিকার অনেক সময়েই থাকে না বা তাঁরা নিজেরাও বসতে কুণ্ঠা বোধ করেন। আমরা হয়তো এই কুণ্ঠার কারণ ভেবে দেখি না সব সময়। এমন আরও হাজারও ছোট বড় অসঙ্গতি আমাদের রোজকার জীবনে ঘটে চলে। শ্রম, দক্ষতা বা কর্মের বিনিময়ে উপার্জনের জন্য ধার্য 'সম্মান'এর মাপকাঠি হয়ে ওঠে উপার্জনের পরিমাণ অথবা উপার্জনকারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান। আচরণগত বৈষম্য দেখা যায় 'উন্নত', 'শিক্ষিত' মানুষের মহানুভবতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও। প্রিয়জনকে উপহার দান, সংগঠনকে অর্থ সাহায্য এবং ভিখারিকে ভিক্ষা দানের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য প্রকটভাবে দেখা যায় প্রায়শই। অথচ, এই তিন ক্ষেত্রেই অর্থের প্রবাহ একতরফা এবং অর্থপ্রদানকারী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছায় হয়ে থাকে। দরিদ্র ব্যক্তিকে অর্থ বা দ্রব্য দানের সময় বহু ক্ষেত্রেই সহমর্মিতার চাইতেও দানের গর্ব, আত্মসন্তোষ এবং প্রদর্শনের মোহ বড় হয়ে ওঠে। বলাই বাহুল্য, ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতা তার সম্মানের মৌলিক অধিকার লাভ অথবা তার প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার নির্ধারক হতে পারে না।
তাই, এই কোভিড-পরবর্তী দুনিয়ায় আবারও আমাদের আত্মসমালোচনা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। আমাদের সামনে যে অস্বস্তিকর চিত্রগুলো বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রকট হয়ে উঠেছে, তার দায় সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজ ও ব্যক্তিরও।
No comments:
Post a Comment