Monday, 18 May 2020

থেকে যাবে সংক্রমণের ভয়!

সংক্রমণের ডায়রি
শ্রেয়া ঘোষ


(১)
একটা বন্ধ ঘর ঘরে একজন মানুষ ডাঁই করে রাখা জিনিসপত্র কিছু খাদ্য সামগ্রী বা নিত্য প্রয়োজনীয় সে সব দিকে কিন্তু মন নাই মানুষটির সকাল থেকে বারে বারে বন্ধ জানলার কাচের শার্সি দিয়ে আসা আলো মাপে অন্ধকার হয়ে যায় খিদে পায় যখন, বুঝতে পারে একটা দিন শেষ হল তখনই একটা রঙিন চক খড়ি দিয়ে দেওয়ালে একটা দাগ কাটে চার দিনে চারটে দাগ আর পাঁচ দিনের দিন চারটে দাগের ওপর দিয়ে একটা ঢ্যাড়া এরকম টা হওয়া মানে এক মাস তখন পরের লাইনে চলে যেতে হয় এত কিছুর দরকার হত না ঘড়িটা বিগড়েছিল ব্যাটারি লাগালেই হয়তো চলত অথবা কলকব্জায় কিছু মেরামতি আর করা হল না মোবাইলে সময় দেখা চলত কিন্তু কতদিন? মোবাইলের ব্যাটারিও তো মৃত্যুঞ্জয় নয়

আর চকখড়ি? কটা আছে? গুনতে বসে মানুষটা কাজ পায় চারটে গোটাগুটি আর সাত আটটা ছোট ছোট তারপর? হতে পারে সব কিছু আগের মতো মোবাইল, ঘড়ি আবার সব চলতে শুরু করল কিন্তু নাও হতে পারে সে ক্ষেত্রে বিকল্প কোনও উপায় তৈরি রাখতে হবে পাশের ছোট ঘরটা গুদাম মতো খুঁজলে ওখানে কয়লার টুকরো বা পুরনো মোম রঙের বাক্স পাওয়া যেতে পারে তবে এখনই খুঁজতে শুরু করবে না তার চেয়ে আশাটা জিইয়ে রাখা অধিক জরুরি আর সেই আশাটুকু ধরে রেখে মানুষটা আজ থেকে আর একটা কাজ শুরু করে যাবৎ কাটা দাগগুলো, যারা এখন ছয় সাতটা সমান্তরাল সারিতে বোকার মতো দাঁড়িয়ে, ন্যাড়া ন্যাড়া, তাদের পাশ দিয়ে ত্যারচা দাগ কেটে ডালপালা আঁকে শুকনো ডালে পাতা সাজায়, কুঁড়ি, ফুল তিরিশটা গাছকে ফুলে পাতায় ভরিয়ে বহুদিন পর যেন ক্লান্ত বোধ করে

খেলাটাকে ধরে রাখে পরদিন, তার পর দিনওগাছের তলার সারির দাগগুলোতে জুড়ে দেয় হাত পাএকা মানুষের পাশে ক্রমশ অনেকপোশাক পরায় তাদের কোনওদিনপোশাকের হেরফেরে নারী বা পুরুষমুখে মুখে মাস্কবাচ্চা, বুড়ো, মাঝবয়সিসারি দিয়ে মানুষ বা সাজানো গাছপালা দেখে ওর মনে পড়ে কিছুএকটা ক্লাস ঘরবেঞ্চ, বাচ্চা, ব্ল্যাক বোর্ডচকের স্টিকগুলো কোথা থেকে এল সেই প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যায় অতঃপরমনে পড়ে যায় সকালের ভাতে ভাত, প্রেসার কুকারের হুইশিলস্নান-খাওয়া, তৈরি হয়ে রিক্সায় স্টেশনভীড়, ভীড়স্কুলের প্রেয়ার লাইনে সারি দেওয়া ঘেঁষাঘেঁষি বাচ্চা ঠেলাঠেলি, চিৎকারমানুষটার আঙুলের ডগা শিরশির করেশীত করেকেন কে জানে চোখ উপচে নোনা জল গড়ায় গাল বেয়েপাগলের মতো গুনতে শুরু করে লাইনের সংখ্যাগুনতে গিয়ে দেখে কতকগুলো মানুষ, ছবির মানুষ কেমন ঝাপসাকাছাকাছি মানুষজনের মাঝে মাঝে ফাঁকখাঁ খাঁ শূন্যতা


()
অনেকদিন পর আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে ন্যাপথালিনের গন্ধ কড়া হয়ে বসে গেছে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজেবাজারের ব্যাগ নেয় হাতে টাকা-পয়সা র‌্যাশন কার্ড, কী ভেবে আরেকটা পরিচয় পত্র উঁচু হিলের চটিটায় পা ঢুকিয়েও সরিয়ে নেয় পা-ঢাকা ওয়াকিং শু-টাই বেছে নেয়আর একটা কিছু... ভুল হচ্ছে  কোথাওবেরিয়ে পড়ে ল্যাচ টেনে দরজা বন্ধ করেই দেখে আর একজন কেউ, ওরই মতো একটা ব্যাগ হাতেমুখে মাস্ক অভ্যেসটা তৈরি হয়নিদোনামোনা করে শেষ অবধি আবার দরজা খুলে ঘরে ঢুকে, আলমারি খুলে এক গোছা মাস্ক থেকে একটা বেছে নেয়হাল্কা নীলটা নিয়েও আবার রেখে দিয়ে কালো কুচকুচেটাই পরে নেয়আয়নার সামনে একটুক্ষণকিন্তু আয়না তো ধরে রাখবে না ওর এই অদ্ভুত ছবিমোবাইলে ক্যামেরা অন করে নিজেই নিজের ছবি তোলেএই প্রথমছবিটা একেবারে পছন্দ হয় না ওরএরকমই কি ? নাকি হাত কেঁপে গেল? শুনশান রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় পথে লোকজন নেইবাড়ি ঘর স্পন্দনহীনজানলা বন্ধ, দরজা বন্ধ বাড়িগুলোও মানুষের মতো একলা আর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাঠ সম্পূর্ণ করেছেগাছগুলো সবুজগত রাতের ঝড়ে গাছ থেকে খসে পড়া আমগুলো থেঁতলে পড়ে আছে মাটিতেএকলা শালিক খুঁটে  খাচ্ছে কিছুওষুধের দোকানের সামনে গোল গোল গণ্ডির একটাতে দাঁড়িয়ে পড়ে ।  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখেএকজন বেরিয়ে আসে দোকান থেকেচোখাচোখি হয় ওর সঙ্গেলোকটার চোখ কেমন উপোসিওকে দেখে যেন জ্বলে ওঠেফুটপাথের লাইনে তখন একালোকটা দু' পা এগিয়ে থ্যাক করে থুতু ফেলে রাস্তায় ভয় পায়বেশ কিছুদিন পর পুরনো ভয়টা ফিরে আসেলোকটার মুখনিঃসৃত লালারস থেকে কোটি কোটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে কিছু বলতে চায়চিৎকার করে লোকটাকে সতর্ক করতে চায়অথচ ওর স্বরযন্ত্র বরাবরের মতো অসহযোগিতা করে তাড়াতাড়ি দোকানের মধ্যে ঢুকতে যায়দোকানি হাতের ইশারায় নিষেধ করেনিরুপায় অপেক্ষাকালে আক্রান্ত হয় অচেনা পুরুষের নিক্ষিপ্ত জীবাণু দ্বারা- কোভিড ১৯ বা ত্রাস

()
ওর মন কেমন করছিল ঘরের জন্যওর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ছোট ঘরটা ছেড়ে যাবার কালেছোট্ট  ঘরটা যে ওর নিজের ছিল না ভুলেই গিয়েছিলসাতাশ বছর ধরে এক কামরায় যাপনছোট, ভীষণ ছোট ছিল ঘরখানাএকটা দেড়া চৌকি, ওপরে পুরনো সুজনিদু' এক জায়গায় তাপ্পি মারাহোটেলের ঘরের বাতিল চাদরতা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল নাসাতাশ বছর আগের সেই লাথি ঝাঁটার দিনগুলো আস্তে আস্তে নেই হয়ে গিয়েছিল এই ঘরটা পেয়েআস্ত ঘরও নয় কিছুরান্নাঘরের এক দিকে দেওয়াল তুলে, স্লাইডিং দরজা লাগিয়ে আলাদা খুপরি একটাতবু  হোটেল শুদ্ধু লোক জানে ওটা মাসির ঘরগাদাগাদি তক্তাপোশ, আলমারি, বাক্স, টেবিল পাখা, কুলুঙ্গিতে ঠাকুরের পট, ক্যালেন্ডারদড়ির আলনায় ঝোলানো শাড়ি, ম্যাক্সি, পেটিকোটআর কী লাগে একটা ঘরকে সম্পূর্ণ করতে?

মার্চের মাঝামাঝি থেকে হোটেল ফাঁকা হতে শুরু করলকাকা, মানে ম্যানেজার বললেন ভালো বুঝছি না মাসিস্বপন, আশিস তর্ক জুড়ে দিলনতুন গেস্ট না এলেই বা নিউ লজের কি? তো আর ভুইঁফোড় উত্তরা কি মেজদির লজের মতো নয়মাসকাবারি পার্মিন লোকেদের ভাড়ার টাকাতেই দু-তিন মাস চলে যাবেগেল না১০৪, ১১৬, ৩১২, ২১০ সব এক এক করে খালি হতে লাগলট্রেন বন্ধ, ফ্লাইট বন্ধওরা বোকার মতো ভেবেছিল আটকে পড়ে যাবে পার্মিন গেস্টগুলো জন, জন করে বারো হাজার-চোদ্দ হাজার টাকায় প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বাক্স গুছিয়ে চলে গেলমালিকের ফোন এলজ্যোতিষের টোটো ডেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে কাকাও শ্রীপুরে ভাগ্নের বাড়ি চলে গেলমালিক এসে চাবি পত্র বুঝে নিয়ে যাবার আগে ওকে বলে গেল, মাসি তোমার ভাতিজির ঘর আছে না করিমগঞ্জওখানেই না হয় একটু ব্যবস্থা করে নাওএক পয়সা ইনকাম নেই, বেতনের টাকা কোথা থেকে দিই বল তোতার ওপর তুমি একা মেয়েছেলেসাবধানে কাটিয়ে দাও কটা দিনকাঁচাকান্তি মা দয়া করলে ফের না হয়.... পরশু আমার কিছু মাল নিয়ে যাচ্ছে একটা গাড়ি ওদিকেপারমিট  করিয়েছিভাগ্নি জামাইকে বলে রেখ মেন বাস স্ট্যাণ্ড থেকে এসে তোমাকে নিয়ে যেতে

দুটো রাত আর ঘুম আসেনি। তার মানে খবরের কাগজের ছবির পরিযায়ী শ্রমিক না কি, তাই ছিল ও? জানতো না তো
স্বপন, আশিস, সিকিওরিটির গোবিন্দ- সকলের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। 

- আজ তোমারে জবাব দিল, কাল না হলে পরশু আমাদেরও তাড়াবেব্যাগ, বাক্স, প্লাস্টিকের থলি গুছিয়ে নিয়ে ভোর রাত্তিরে ওরা পথে নামলকোথায় যাবে? করিমগঞ্জ, জিরিবামশেষ অবধি কোথাও পৌঁছবে না ওরা
 
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে  বন্দীদশাআমাদের শ্বাস আটকে আসবেবদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে আমাদের চোখে ছানি পড়বেগায়ে ছত্রাকের বাসা বাতাসশূন্য এক অন্ধ কুঠুরিতে শুধু ভয়টুকু জাপটে ধরে বেঁচে থাকাভয় থেকে অবিশ্বাসঅবিশ্বাস থেকে ঘৃণাআলো আর সহ্য হবে নাআরশোলা বা চামচিকে যেমনআলো থেকে পালিয়ে যাব অন্ধকারেভালোবাসা সহ্য হবে নাপালিয়ে যাব সন্দেহের অন্ধকূপেসংক্রমণ চলে যাবে একদিন। কিন্তু থেকে যাবে সংক্রমণের ভয় বাকি জীবনের ওপর থাবা বসিয়েমুক্তি নেই আর

2 comments:

  1. Satti mukti nei aar .. khub sundar o samoyopojogi lekha

    ReplyDelete
  2. এ লেখায় বিমূর্ততা থেকে ক্রমশ মূর্ত ভয়ের অবয়ব। অথবা অবয়বহীন ভয়ের অনুভব। এখন যেমন।

    ReplyDelete