সংক্রমণের
ডায়রি
শ্রেয়া
ঘোষ
(১)
একটা বন্ধ ঘর। ঘরে একজন মানুষ। ডাঁই করে রাখা জিনিসপত্র কিছু। খাদ্য সামগ্রী বা নিত্য প্রয়োজনীয় । সে সব দিকে কিন্তু মন নাই মানুষটির। সকাল থেকে বারে বারে বন্ধ জানলার কাচের শার্সি দিয়ে আসা আলো মাপে। অন্ধকার হয়ে যায়। খিদে পায় যখন, বুঝতে পারে একটা দিন শেষ হল। তখনই একটা রঙিন চক খড়ি দিয়ে দেওয়ালে একটা দাগ কাটে। চার দিনে চারটে দাগ আর পাঁচ দিনের দিন চারটে দাগের ওপর দিয়ে একটা ঢ্যাড়া। এরকম ৬টা হওয়া মানে এক মাস। তখন পরের লাইনে চলে যেতে হয়। এত কিছুর দরকার হত না। ঘড়িটা বিগড়েছিল। ব্যাটারি লাগালেই হয়তো চলত অথবা কলকব্জায় কিছু মেরামতি। আর করা হল না। মোবাইলে সময় দেখা চলত কিন্তু কতদিন? মোবাইলের ব্যাটারিও তো মৃত্যুঞ্জয় নয়।
আর চকখড়ি? কটা আছে? গুনতে বসে মানুষটা। কাজ পায়। চারটে গোটাগুটি আর সাত আটটা ছোট ছোট। তারপর? হতে পারে সব কিছু আগের মতো। মোবাইল, ঘড়ি আবার সব চলতে শুরু করল। কিন্তু নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিকল্প কোনও উপায় তৈরি রাখতে হবে। পাশের ছোট ঘরটা গুদাম মতো। খুঁজলে ওখানে কয়লার টুকরো বা পুরনো মোম রঙের বাক্স পাওয়া যেতে পারে। তবে এখনই খুঁজতে শুরু করবে না। তার চেয়ে আশাটা জিইয়ে রাখা অধিক জরুরি। আর সেই আশাটুকু ধরে রেখে মানুষটা আজ থেকে আর একটা কাজ শুরু করে। এ যাবৎ কাটা দাগগুলো, যারা এখন ছয় সাতটা সমান্তরাল সারিতে বোকার মতো দাঁড়িয়ে, ন্যাড়া ন্যাড়া, তাদের পাশ দিয়ে ত্যারচা দাগ কেটে ডালপালা আঁকে। শুকনো ডালে পাতা সাজায়, কুঁড়ি, ফুল। তিরিশটা গাছকে ফুলে পাতায় ভরিয়ে বহুদিন পর ও যেন ক্লান্ত বোধ করে।
খেলাটাকে ধরে রাখে পরদিন, তার পর দিনও। গাছের তলার সারির দাগগুলোতে জুড়ে দেয় হাত পা। একা মানুষের পাশে ক্রমশ অনেক। পোশাক পরায় তাদের কোনওদিন। পোশাকের হেরফেরে নারী বা পুরুষ। মুখে মুখে মাস্ক। বাচ্চা, বুড়ো, মাঝবয়সি। সারি দিয়ে মানুষ বা সাজানো গাছপালা দেখে ওর মনে পড়ে কিছু। একটা ক্লাস ঘর। বেঞ্চ, বাচ্চা, ব্ল্যাক বোর্ড। চকের স্টিকগুলো কোথা থেকে এল সেই প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যায় অতঃপর। মনে পড়ে যায় সকালের ভাতে ভাত, প্রেসার কুকারের হুইশিল। স্নান-খাওয়া, তৈরি হয়ে রিক্সায় স্টেশন। ভীড়, ভীড়। স্কুলের প্রেয়ার লাইনে সারি দেওয়া ঘেঁষাঘেঁষি বাচ্চা। ঠেলাঠেলি, চিৎকার। মানুষটার আঙুলের ডগা শিরশির করে। শীত করে। কেন কে জানে চোখ উপচে নোনা জল গড়ায় গাল বেয়ে। পাগলের মতো ও গুনতে শুরু করে লাইনের সংখ্যা। গুনতে গিয়ে দেখে কতকগুলো মানুষ, ছবির মানুষ কেমন ঝাপসা। কাছাকাছি মানুষজনের মাঝে মাঝে ফাঁক। খাঁ খাঁ শূন্যতা।
(২)
অনেকদিন পর আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে ও। ন্যাপথালিনের গন্ধ কড়া হয়ে বসে গেছে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে। বাজারের ব্যাগ নেয় হাতে। টাকা-পয়সা। র্যাশন কার্ড, কী ভেবে আরেকটা পরিচয় পত্র। উঁচু হিলের চটিটায় পা ঢুকিয়েও সরিয়ে নেয়। পা-ঢাকা ওয়াকিং শু-টাই বেছে নেয়। আর একটা কিছু... ভুল হচ্ছে কোথাও। বেরিয়ে পড়ে ল্যাচ টেনে দরজা বন্ধ করেই দেখে আর একজন কেউ, ওরই মতো একটা ব্যাগ হাতে। মুখে মাস্ক। অভ্যেসটা তৈরি হয়নি। দোনামোনা করে শেষ অবধি আবার দরজা খুলে ঘরে ঢুকে, আলমারি খুলে এক গোছা মাস্ক থেকে একটা বেছে নেয়। হাল্কা নীলটা নিয়েও আবার রেখে দিয়ে কালো কুচকুচেটাই পরে নেয়। আয়নার সামনে একটুক্ষণ। কিন্তু আয়না তো ধরে রাখবে না ওর এই অদ্ভুত ছবি। মোবাইলে ক্যামেরা অন করে নিজেই নিজের ছবি তোলে। এই প্রথম। ছবিটা একেবারে পছন্দ হয় না ওর। এরকমই কি ও? নাকি হাত কেঁপে গেল? শুনশান রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় ও। পথে লোকজন নেই। বাড়ি ঘর স্পন্দনহীন। জানলা বন্ধ, দরজা বন্ধ। বাড়িগুলোও মানুষের মতো একলা আর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাঠ সম্পূর্ণ করেছে। গাছগুলো সবুজ। গত রাতের ঝড়ে গাছ থেকে খসে পড়া আমগুলো থেঁতলে পড়ে আছে মাটিতে। একলা শালিক খুঁটে খাচ্ছে কিছু। ওষুধের দোকানের সামনে গোল গোল গণ্ডির একটাতে দাঁড়িয়ে পড়ে ও। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে। একজন বেরিয়ে আসে দোকান থেকে। চোখাচোখি হয় ওর সঙ্গে। লোকটার চোখ কেমন উপোসি। ওকে দেখে যেন জ্বলে ওঠে। ফুটপাথের লাইনে ও তখন একা। লোকটা দু' পা এগিয়ে থ্যাক করে থুতু ফেলে রাস্তায়। ও ভয় পায়। বেশ কিছুদিন পর পুরনো ভয়টা ফিরে আসে। লোকটার মুখনিঃসৃত লালারস থেকে কোটি কোটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ও কিছু বলতে চায়। চিৎকার করে লোকটাকে সতর্ক করতে চায়। অথচ ওর স্বরযন্ত্র বরাবরের মতো অসহযোগিতা করে। ও তাড়াতাড়ি দোকানের মধ্যে ঢুকতে যায়। দোকানি হাতের ইশারায় নিষেধ করে। নিরুপায় অপেক্ষাকালে ও আক্রান্ত হয় অচেনা পুরুষের নিক্ষিপ্ত জীবাণু দ্বারা- কোভিড ১৯ বা ত্রাস ।
(৩)
ওর মন কেমন করছিল ঘরের জন্য। ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ছোট ঘরটা ছেড়ে যাবার কালে। ছোট্ট ঘরটা যে ওর নিজের ছিল না ভুলেই গিয়েছিল। সাতাশ বছর ধরে ঐ এক কামরায় যাপন। ছোট, ভীষণ ছোট ছিল ঘরখানা। একটা দেড়া চৌকি, ওপরে পুরনো সুজনি। দু' এক জায়গায় তাপ্পি মারা। হোটেলের ঘরের বাতিল চাদর। তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। সাতাশ বছর আগের সেই লাথি ঝাঁটার দিনগুলো আস্তে আস্তে নেই হয়ে গিয়েছিল এই ঘরটা পেয়ে। আস্ত ঘরও নয় কিছু। রান্নাঘরের এক দিকে দেওয়াল তুলে, স্লাইডিং দরজা লাগিয়ে আলাদা খুপরি একটা। তবু হোটেল শুদ্ধু লোক জানে ওটা মাসির ঘর। গাদাগাদি তক্তাপোশ, আলমারি, বাক্স, টেবিল পাখা, কুলুঙ্গিতে ঠাকুরের পট, ক্যালেন্ডার। দড়ির আলনায় ঝোলানো শাড়ি, ম্যাক্সি, পেটিকোট। আর কী লাগে একটা ঘরকে সম্পূর্ণ করতে?
মার্চের মাঝামাঝি থেকে হোটেল ফাঁকা হতে শুরু করল। কাকা, মানে ম্যানেজার বললেন ভালো বুঝছি না মাসি। স্বপন, আশিস তর্ক জুড়ে দিল। নতুন গেস্ট না এলেই বা নিউ লজের কি? এ তো আর ভুইঁফোড় উত্তরা কি মেজদির লজের মতো নয়। মাসকাবারি পার্মিন লোকেদের ভাড়ার টাকাতেই দু-তিন মাস চলে যাবে। গেল না। ১০৪, ১১৬, ৩১২, ২১০ সব এক এক করে খালি হতে লাগল। ট্রেন বন্ধ, ফ্লাইট বন্ধ। ওরা বোকার মতো ভেবেছিল আটকে পড়ে যাবে পার্মিন গেস্টগুলো। ২ জন, ৪ জন করে বারো হাজার-চোদ্দ হাজার টাকায় প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বাক্স গুছিয়ে চলে গেল। মালিকের ফোন এল। জ্যোতিষের টোটো ডেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে কাকাও শ্রীপুরে ভাগ্নের বাড়ি চলে গেল। মালিক এসে চাবি পত্র বুঝে নিয়ে যাবার আগে ওকে বলে গেল, মাসি তোমার ভাতিজির ঘর আছে না করিমগঞ্জ। ওখানেই না হয় একটু ব্যবস্থা করে নাও। এক পয়সা ইনকাম নেই, বেতনের টাকা কোথা থেকে দিই বল তো। তার ওপর তুমি একা মেয়েছেলে। সাবধানে কাটিয়ে দাও কটা দিন। কাঁচাকান্তি মা দয়া করলে ফের না হয়.... পরশু আমার কিছু মাল নিয়ে যাচ্ছে একটা গাড়ি ওদিকে। পারমিট করিয়েছি। ভাগ্নি জামাইকে বলে রেখ মেন বাস স্ট্যাণ্ড থেকে এসে তোমাকে নিয়ে যেতে।
দুটো রাত আর ঘুম আসেনি। তার মানে খবরের কাগজের ছবির ঐ পরিযায়ী শ্রমিক না কি, তাই ছিল ও? জানতো না তো।
স্বপন, আশিস, সিকিওরিটির গোবিন্দ- সকলের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল।
- আজ তোমারে জবাব দিল, কাল না হলে পরশু আমাদেরও তাড়াবে। ব্যাগ, বাক্স, প্লাস্টিকের থলি গুছিয়ে নিয়ে ভোর রাত্তিরে ওরা পথে নামল। কোথায় যাবে? করিমগঞ্জ, জিরিবাম… শেষ অবধি কোথাও পৌঁছবে না ওরা।
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে বন্দীদশা। আমাদের শ্বাস আটকে আসবে। বদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে আমাদের চোখে ছানি পড়বে। গায়ে ছত্রাকের বাসা। বাতাসশূন্য এক অন্ধ কুঠুরিতে শুধু ভয়টুকু জাপটে ধরে বেঁচে থাকা। ভয় থেকে অবিশ্বাস। অবিশ্বাস থেকে ঘৃণা। আলো আর সহ্য হবে না। আরশোলা বা চামচিকে যেমন। আলো থেকে পালিয়ে যাব অন্ধকারে। ভালোবাসা সহ্য হবে না। পালিয়ে যাব সন্দেহের অন্ধকূপে। সংক্রমণ চলে যাবে একদিন। কিন্তু থেকে যাবে সংক্রমণের ভয় বাকি জীবনের ওপর থাবা বসিয়ে। মুক্তি নেই আর।
Satti mukti nei aar .. khub sundar o samoyopojogi lekha
ReplyDeleteএ লেখায় বিমূর্ততা থেকে ক্রমশ মূর্ত ভয়ের অবয়ব। অথবা অবয়বহীন ভয়ের অনুভব। এখন যেমন।
ReplyDelete