লক্ষ লক্ষ মানুষ হাঁটছেন। রেল লাইন ধরে, হাইওয়ে পেরিয়ে, বাচ্চা কোলে, পিঠে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে, সাইকেলে, ট্রেনে, বাসে, যে যেখানে যেভাবে পারছেন, সে ভাবে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে। জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে। মরছেনও। পথে ঘাটে দুর্ঘটনায় অনাহারে অপুষ্টিতে অসুস্থতায় কোভিডে আক্রান্ত হয়ে। তবুও তাঁরা হাঁটছেন, বা ফিরে চলেছেন ‘শ্রমিক স্পেশাল’এ তাঁদের অলীক শিকড়ের টানে। সেখানে যে নিশ্চিদ্র নিশ্চয়তা আছে, তা তো নয়। তবুও তারা জীবন বাজী রেখে ফিরে চলেছেন। সকলে বলছেন, এঁরা পরিযায়ী শ্রমিক, এঁরা মরীয়া হয়ে ঘরে ফিরছেন। কীসের এত তাগিদ? কোথায় এত ভয়? নাকি কাজ হারানো, অভুক্ত দশায় তাদের আর কোনও উপায়ন্তর নেই? এঁরা কারা? এঁদের নিয়ে তো আগে সেভাবে কখনও আলোচনা হয়নি। বরং, এই ধরনের মানুষজনদের খুব সহজেই দাগিয়ে দেওয়ার এক খেয়াল আছে- এঁরা কামচোর, সর্বনাশা, ঝামেলাবাজ, নেশাড়ু। দেখা যাচ্ছে, এঁদের সংখ্যা কোটি কোটি। হঠাৎ যেন অদৃশ্য কোনও গর্ত থেকে পিলপিল করে সহস্র পিঁপড়েদের মতো বেরিয়ে আসা। কোথায় ছিলেন এঁরা?
চকিতে এমন দেখে আপনি ভয় পেলেও, এঁরা ছিলেন। এঁরা ছিলেন আপনার দৃষ্টির অগোচরে আপনার বাড়িতে, নানাবিধ অফিসে, চলার পথে দৃশ্যমান অট্টালিকা বা হাইওয়ে নির্মাণে, রাস্তা-ফুটপাত জুড়ে পসরা নিয়ে বসে, কারখানার যন্ত্রের সামনে, রাস্তা সাফাইয়ে অথবা এমন কিছু কাজে যেখানে এঁদের ছাড়া চলত না। কায়িক, পরিশ্রমসাধ্য, গায়ে গতরে কাজগুলি করার জন্যই এদের ডাক। যে কাজের মজুরি যেখানে আপেক্ষিক ভাবে বেশি সেখানেই তাদের জড়ো হওয়া। খুব কষ্টেসৃষ্টে থেকে, যতটা সম্ভব কাজ তুলে, প্রাপ্ত মজুরির কিছুটা নিজের জন্য রেখে বাকীটা দেশের সংসারে পাঠিয়ে খানিক হিল্লে ফেরানোই এঁদের অন্যতম প্রেরণা। প্রবহমান থাকলেও এতদিন কেউ পরোয়া করেনি- এই দৈনন্দিন যাপনে কতটা অসহায়ত্ব, কতটা পিষ্ট হওয়া ছিল। কোভিড১৯’এর তাণ্ডবে যখন কাজকর্ম শিকেয় উঠল তখনই বোঝা গেল উপরের আপাত শান্ত জীবন প্রবাহের গভীর তলদেশে কী নিদারুণ আগ্নেয়গিরি সুপ্ত হয়ে আছে। তা যেন নিমেষে বিস্ফোরণের তালে উদ্গীরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল দেশের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। আর রেখে গেল কিছু অমূল্য প্রশ্নাবলী ও নতুন দিকনির্দেশ। আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম, তাঁরা হাঁটতে শুরু করেছেন। কাঁখে শিশু, হাতে লোটাকম্বল নিয়ে।
এ হাঁটা বা এখন কাতারে কাতারে ট্রেনে ফেরা তাঁদের পশ্চাদপসরণ নয়। তাঁরা মুক্ত হয়ে ফিরে চলেছেন নিজ বাসভূমে। বহুকাল আর ফিরবেন না বলে। অনেকটা অগস্ত্য মুনির যাত্রার মতো। বলা ভালো, ধসে পড়া অর্থনীতির সম্ভাব্য ‘পুনর্জাগরণ’কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তাঁরা ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় নির্মাণ করতে ফিরে চলেছেন। এ তাঁদের মিলিত চেতনা। এই চৈতন্য তাঁদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে বহু কাল ধরে। শুধু অপেক্ষা ছিল উপযুক্ত সময়ের। রাজনৈতিক অর্থনীতির সেই কাল সমাগত। সে কালকে তাঁরা পড়ে ফেলেছেন। তাই দুটি বাড়তি মজুরির আশায় গ্রাম ও সংসার ছেড়ে তাঁদের পরভূমে পরাধীন হয়ে নিকৃষ্টতর ভাবে বেঁচে থাকার খোয়াবের মিথ্যাচারকে তাঁরা অবশেষে পরিত্যাগ করেছেন। এই মিথ্যাচারের পিছনে দৌড়নোর জন্য তাঁদের যে জমে ওঠা ক্ষতি ও ক্ষতের পরিমাণ, তার আঘাত তাঁদের সচকিত করেছে। কোভিড১৯ ছিল এই ক্ষতি ও ক্ষতের এক উপচার মাত্র। বলা ভাল, এক অনুঘটক।
কিন্তু যে পানে তাঁরা চলেছেন সেখানে কি নিশ্চিতি আছে? দুটি কাজ ও দু’ মুঠো কি তাঁদের আয়াসসাধ্য? এঁদের অধিকাংশই তো কৃষি পরিবার থেকে ছিটকে আসা তরুণের স্বপ্ন। তাহলে কি আবার প্রত্যাবর্তন সেই কৃষির বলয়েই? পরিবর্তিত দুনিয়া ও কোভিড-উত্তর সময় এই প্রশ্নকেই নতুন করে অনুধাবন করতে চাইছে। কারণ, অন্তত আমাদের দেশে কোভিডের এই ভয়ঙ্করতম তাণ্ডবেও যে ক্ষেত্রটি এখনও নির্মল দাঁড়িয়ে আছে তা কৃষি। কৃষিকে কোভিড ততটা ঘায়েল করতে পারেনি। কারণ, কৃষিকাজে মনুষ্য শরীরের ঘনিষ্টতা তত নিবিড় নয় এবং স্থানীয় পর্যায়েই তার কার্যনির্বাহ।
ইতিমধ্যে প্রকাশিত সরকারি তথ্য থেকেও দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে ২০১৮-১৯ সালে ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিষেবা শিল্পে যেখানে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫.৭ ও ৬.১ শতাংশ তা ২০১৯-২০ সালে এসে নেমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে .০৩ ও ১.৩ শতাংশে, উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ সালের জানুয়ারি-মার্চ’এর শেষ ত্রৈমাসিকে ম্যানুফ্যাকচারিং’এর ক্ষেত্রে তা -১.৪ শতাংশে। অথচ, কৃষির ক্ষেত্রে ছবিটি অন্যরকম। ২০১৮-১৯ সালে যেখানে কৃষির বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল ২.৪ শতাংশ, তা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ শতাংশে ও জানুয়ারি-মার্চের শেষ ত্রৈমাসিকে ৫.৯ শতাংশে। খবরে এও প্রকাশ, এবারের রবিশস্যও যথেষ্ট ভাল হয়েছে। অতএব, যারা দূর-দূরান্ত থেকে ঘরে ফিরে আসছেন, কৃষি ক্ষেত্র অন্তত তাদের একটা বড় অংশকে যে সামাল দিতে সক্ষম, তা তার আর্থিক সবলতা থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু এই চাপকে ধরে রাখা ও তার ভবিষ্যৎ বিকাশের পথটিই আসল পরীক্ষা।
এ কথা বারবার অনেকে বলেছেন, আমাদের দেশে কৃষিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং, শিল্প বিকাশের স্বার্থে কৃষিপণ্যের মূল্যকে সব সময়েই অতিরিক্ত নিম্নমুখি করে রাখা ও কৃষি উৎপাদকদের (বিশেষত ছোট ও প্রান্তিক যারা) মোটবাহী পশু হিসেবে দেখা হয়েছে যাদের কাজ হল অতি স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্যের জোগান দেওয়া যাতে শিল্পে অতি মুনাফার তাগিদে মজুরি খরচকে যতটা সম্ভব কম রাখা যায়। গত ৭০ বছর আমাদের দেশে কৃষি ক্ষেত্র নিজেকে অভুক্ত রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে পুষ্টি জুগিয়ে গেছে। অথচ, কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষি ক্ষেত্র থেকেই যথেষ্ট আয় ও কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিশেষ করে, কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্পের যে বিপুল সম্ভাবনা ও রসদ ছিল তাকে প্রকারান্তরে অবহেলা করে শুকিয়ে মারা হয়েছে।
কালের অবগাহনে আজ কোভিড পরিস্থিতিতে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির দুরবস্থায় কৃষির সামনে আবারও নতুন করে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন কৃষকের আত্মসম্মান পুনরুদ্ধার। কৃষি কাজ কোনও পরিত্যক্ত, ‘চাষাড়ে’, মোটা বুদ্ধির হেয় কর্ম নয়- তা অত্যন্ত উন্নত, শিল্পগুণসম্পন্ন, সৃজনশীল এক ক্রমউন্নত আত্মনির্ভর কর্মধারা। কৃষককে সম্মান ও তাঁর কাজের স্বীকৃতির মধ্যেই অর্থনীতির আগামী দিন, অন্তত আমাদের দেশে, বহু সম্ভাবনার আকর নিয়ে সুপ্ত হয়ে আছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের যে বেপরোয়া ঘরে ফেরার তাগিদ তা এই পুনঃঅবলোকন থেকে যে দুটি বাড়তি পয়সার জন্য পরবাসে যে নিকৃষ্টতম দীর্ঘস্থায়ী যাপন, তাকে পরিত্যাগ করে নিজ পরিসরে নিজ শক্তিকে পুনঃআবিষ্কার করা। হয়তো নিকট ভবিষ্যতে এই শ্রমিকদের জন্য হাহাকারে শিল্পগুলি ছটফট করবে। ইতিমধ্যেই গুজরাতে কচ ও অন্যান্য এলাকায় লবণ কারখানাগুলিতে সোরগোল পড়ে গেছে ও মালিকেরা জোড় হস্তে চলে যাওয়া শ্রমিকদের কাছে প্রার্থনা করে বলছে যে ফিরে এলে তারা দ্বিগুন মজুরি দেবে ও থাকাখাওয়ার বন্দোবস্তও করা হবে। কথায় আছে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান- বেঁচে থাকার
এই তিন ন্যূনতম প্রয়োজনে অন্ন হল এমন এক উপাদান যা ছাড়া মানুষ কোনওভাবেই বেঁচে
থাকতে পারে না। তাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডাটা অ্যানালিটিকস’এর যতই দাপট সারা
বিশ্বকে এক নতুন আঙ্গিক ও যাপন অভিমুখে নিয়ে চলুক না কেন, কৃষিকে কখনই সে বাতিল করতে
পারে না। কিন্তু কৃষি আজকের নতুন পরিসরে কীভাবে যুঝবে তা নিজেকেই আত্মমূল্যায়ন করে
জাহির করতে হবে। প্রশ্নটা সব সময়েই ছিল, কৃষি ও কৃষক কতটা নিজ মূল্যকে বুঝে ও যুঝে
উঠতে পারে। কোভিড১৯ পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাকে বাধ্যত বাস্তবায়িত করে এ দেশে এই ক্ষেত্রে এক
নতুন বাঁক নির্মাণ করেছে। সেই সুযোগকে ঠিকঠাক উশুল করতে কৃষি ও কৃষক সমাজ কতটা
প্রস্তুত, তাই এখন দেখার।
‘মন রে কৃষি কাজ জান না। এমন মানব-জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।’ এ আসলে চৈতন্যের আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
No comments:
Post a Comment