করোনা ও ‘নিউ নর্মাল’
সোমনাথ গুহ
এখন একটা নতুন কথা শোনা যাচ্ছে ‘নিউ নর্মাল’। অর্থাৎ, আজ থেকে ছয় মাস আগে আমরা যেটা স্বাভাবিক ভাবতাম, সেটা ২০২১'এর মে মাসে আর স্বাভাবিক নয়, সেকেলে হয়ে যেতে পারে এবং তার পরিবর্তে একটা নতুন ‘স্বাভাবিক’ গড়ে উঠতে পারে। ধরা যাক নতুন শতাব্দীর শুরুতে আইটি শিল্পে যখন একটা উল্লম্ফন ঘটে তখন ক্ষুদ্র কক্ষ বা কিউবিকল ধরনের প্ল্যান বাতিল করে ‘ওপেন ফ্লোর’ অফিসের নকশা চালু হয়েছিল। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের খোলামেলা জায়গায় সারি সারি ডেস্কে প্রযুক্তি কর্মীরা নিজেদের কম্পিউটারে কাজ করত। এতে কর্মীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার সুযোগ থাকত যার ফলে পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে উঠত যা তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করত। অনেককে একটা বড় জায়গায় স্থান করে দেওয়ার ফলে মালিকেরও এতে পয়সার সাশ্রয় হত। করোনার কারণে অফিসের এই নকশা এখন অকেজো। এখন আর কনুইয়ে কনুই ঠেকিয়ে বসা যাবে না, কাজের ফাঁকে খুনসুটি করা যাবে না, অফিস ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে কোনও জটিল প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। এখন পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে হবে, সংঘবদ্ধতার জায়গায় আসবে বিচ্ছিন্নতা। এর জন্য প্রয়োজন দুজনের মধ্যে একটা ঢাল- কাশি, হাঁচি, সংক্রমণ আটকানোর জন্য একটা স্বচ্ছ সুরক্ষার দেয়াল। অনেক দোকানে এখন দেখা যাচ্ছে কাউন্টার থেকে ফুট খানেক তফাতে লম্বা করে একটা টেপ বা নিদেনপক্ষে একটা দড়ি লাগিয়ে দিচ্ছে যাতে ক্রেতা আর বেশি অগ্রসর না হতে পারে। কর্পোরেট অফিসে যারা আসবাবপত্র সরবরাহ করে তারা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যায় এই ধরনের নতুন অফিস-নকশা কী হবে তা নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছে।
যেটা নিশ্চিত যে করোনা-সংক্রান্ত সুরক্ষা বিধির কারণে একই জায়গায় এত কর্মীর আর সঙ্কুলান করা যাবে না। আইটি শিল্পে বাড়ি থেকে কাজ করার রীতি আগেই সীমিত ভাবে চালু ছিল, কোভিড-১৯ সেটাকে আরও ত্বরান্বিত করল। টিসিএস ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে ২০২২'এর মধ্যে তাদের ৭৫ শতাংশ কর্মী বাড়ি থেকে কাজ করবে। অফিস পুনর্গঠনের কারণে আরও একটি কোম্পানি বহু কর্মীকে বাড়ি থেকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছে।
এই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ একটি ধূর্ত চাল যা বহু কর্মী সানন্দে মেনে নেয়। এর কিছু যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। আইটি শিল্প মূলত কিছু বড় শহর ব্যাঙ্গালোর, পুনে, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই, মুম্বাইয়ে সীমাবদ্ধ। অন্যান্য ছোট, বড় শহর থেকে যুবক, যুবতীরা এখানে কাজ করতে আসে। বাড়ি ভাড়া করে, নিজেরা রান্নাবান্না করে তাদের থাকতে হয়। এছাড়া অফিস দূরে হলে যানবাহনের খরচা আছে, বছরে দু' তিনবার বাড়ি যাওয়ার খরচা আছে। নিজের বাড়িতে থাকলে তাদের খাওয়া, যানবাহনের খরচা বেচে যায় এবং তারা নিজের পরিবারের সাথে থাকতে পারে (মূল দফতর যে শহরে সেখানে একটা বাড়ি ভাড়া রাখতেই হয় কারণ যে কোনও সময়ে যেতে হতে পারে)। মহিলারা এটা পছন্দ করে কারণ এতে তারা অফিসের কাজের সঙ্গে গেরস্থালির কাজও দেখাশোনা করতে পারে। উলটো দিকে এই ব্যবস্থায় কর্মচারীর স্বার্থ-বিরোধী কিছু বিপদজনক দিক আছে। এতে বাড়ি অফিস একাকার হয়ে যাচ্ছে, প্রাইভেসি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। বাড়িতেই অফিসের মতো পরিবেশ গড়ে তোলার পুরো দায় কর্মীর। তার নিজের একটা ঘর চাই। সেই ঘর কোলাহল মুক্ত করতে হবে যাতে সে কাজে মনোনিবেশ করতে পারে। ফ্যান, লাইট, এসি, ল্যাপটপ সব খরচ কর্মীর, মালিকের এক পয়সা খরচা নেই, অফিসে যে মাঝেমাঝে চা, কফি দেওয়া হয় সেই দায়িত্বটাও আর তার রইল না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কর্মীবাহিনী ছত্রাকার হয়ে গেল। আইটি শিল্পে কোনওদিনই সে ভাবে ইউনিয়ন ছিল না কিন্তু এক ফ্লোরে বহু কর্মী একসাথে কাজ করার ফলে একটা ঐক্য, সংহতি গড়ে উঠত। ম্যানেজমেন্টের কোনও পদক্ষেপ মনঃপূত না হলে তারা একসাথে গিয়ে তা কোনও আধিকারিককে জানাতে পারত। কিন্তু কর্মী এখন একা। কোনও সমস্যা হলে সে ম্যানেজারের শরাণপন্ন হতে বাধ্য, কোনও অন্যায় হলে তার প্রতিবাদ করার কোনও উপায় নেই।
ধরা যাক তার অফিস ব্যাঙ্গালোরে, সে শিলিগুড়িতে তার বাড়ি থেকে কাজ করছে। হঠাৎ যদি তাকে ‘পিঙ্ক স্লিপ’ ধরিয়ে দেওয়া হয় সে কোথায়, কার কাছে প্রতিবাদ জানাবে? আর তাকে সাথ দেবে কে, সে তো একা! এছাড়া ব্যাঙ্গালোরের মতো জায়গায় বসবাস করার অনেক সুবিধা আছে। সেখানে বহু ভালো কোম্পানি আছে, তাদের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠে, সপ্তাহান্তে দেখা হয়। সেই কারণে এক জায়গায় পছন্দ না হলে অন্যত্র চলে যাওয়া যায়, যেটা কলকাতায় বসে অত সহজ নাও হতে পারে। তাই কেরিয়ারের উন্নতির জন্য মূল অফিসে থাকা বেশি লাভজনক। এছাড়া অফিস শুধু কাজের জায়গা নয়, সেটা একটা মেলামেশারও পরিসর। কর্মজীবনে মানুষ বাড়ির থেকে অফিসে বেশি সময় কাটায়। সেখানে ঝগড়াঝাঁটি যেমন হয়, মজা, স্ফূর্তি, ফষ্টিনষ্টি এই সব আরও বেশি হয়। অফিসের পরে আড্ডা, একসাথে সিনেমা যাওয়া, নানা সম্পর্ক গড়ে ওঠা, জীবনকে রঙিন করে। বাড়ি থেকে কাজ করার ফলে একজন কর্মী এই অফিস লাইফ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তার সামাজিক পরিসর সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, ভ্যাকসিন বেরিয়ে গেলে জীবন আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। কিন্তু আরও অনেক ক্ষেত্রের মতো আইটিতে এটা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ, আপাতত এতে উভয় পক্ষই খুশি। এটাই হবে ‘নিউ নর্মাল’।
এই ঢালের ব্যবহার জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই এখন অপরিহার্য হয়ে উঠছে। কর্পোরেট হাসপাতালে ডাক্তার আর রুগির মাঝে তৈরি হচ্ছে স্বচ্ছ কাঁচ বা অন্য কোনও পদার্থের একটা স্ক্রিন। আপাতত, একান্ত প্রয়োজন না হলে, পালস মাপা, বুকে স্টেথো বসিয়ে রুগিকে পরীক্ষা করা হচ্ছে না। ভিডিও কনফারেন্স করে বা ফোনে রুগিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। লকডাউনে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরাও ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করছে। তাদের তো ওষুধ বেচার কাজ, বাড়িতে বসে কী করবে? দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কিছু প্রশিক্ষণ হয়েছে আর তথ্য বিশ্লেষণ, ডেটা আন্যালাইসিস। চিকিৎসকদের চেম্বারে রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাদের পেটমোটা ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছে এই চিত্র দেখতে আমরা সবাই অভ্যস্ত। রাজ্য সরকার এখন গ্রিন এবং অরেঞ্জ জোনে ওষুধ বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছে। কিছুদিন আগে এক নামকরা বহুজাতিক সংস্থার ওয়েবিনারে এইসব জোনে রিপ্রেজেন্টেটিভদের অবিলম্বে কাজে নামতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন তো তারা এক ঝাঁক মিলে চেম্বারে ঢুকে যেতে পারবে না, অনেক ডাক্তার ইতিমধ্যেই পুরনো ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের আপত্তি জানিয়ে দিয়েছে। তাহলে নতুন ব্যবস্থা কী হবে? ওয়েবিনারে কর্তারা জানিয়ে দিয়েছে, ডাক্তার যে ভাবে বলবে ঠিক সেটাই অনুসরণ করতে। সুতরাং এখানে একটা নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে যেটা হবে আগামী দিনের ‘নিউ নর্মাল’।
No comments:
Post a Comment