নন-এলিট বনাম দুই হুজুরের যুদ্ধ কথা
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
আপনি থাকেন কোথায় – লাল পাড়ায় না গোলাপী পাড়ায়, নাকি সবুজ হয়ে গেছে আপনার পাড়া। কেমন আছেন? আপনার প্রধান শত্রু এখন কে? করোনা ভাইরাস নাকি এই লকডাউন?
জবাব দেবে কে? ঐ যারা চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, বাস্তবে যাদের হাতে ‘হ্যারিকেন’, যাদের হাতে আলো নেই, তারা কারা? এমন সঙ্কটকালে কে জবাব দেবে, কে বলবে– তারা না আমরা? নন-এলিটরা না এলিটরা?
সর্বোচ্চ আদালত বলে দিয়েছে, রেলপথ ধরে ওদের হাঁটা দেওয়া নিয়ে নজরদারি করা আদালতের কম্মো নয়। ওরা কেন হাঁটে রেললাইন ধরে বা সড়কপথে? তারা জানে, বাড়ি পৌঁছতে হবে, দেশের বাড়ি যেখানে তাদের অপেক্ষায় আছে তাদের আপনজনেরা, বাবা-মা। তাই তারা হাঁটে। এমন সরল উত্তর তো আদালত বোঝে না। নিজেরাও গুছিয়ে বলতে পারে না। তাই ওরা, প্রশ্ন উঠলে বলে খিদের কথা, মাথার ওপর আকাশ দেখায়, ফাঁকা পকেট দেখায়, ভঙ্গিতে বলে, ‘দাদা আমরা বাঁচতে চাই’। গরিব অসহায় মানুষও বাস্তবে স্বদেশে ফিরে আপনজনের মাঝে বাঁচতে চায়। আর যদি সেখানেও মরে তো, নাকি ‘সে মরণ স্বর্গসমান’! কী সব্বনেশে কথা।
- কোথায় তোমাদের দেশ? এই দেশ, ভারতবর্ষ, তোমাদের দেশ নয়?
না বলতে পারে না, হ্যাঁ'ও বলতে পারে না, ধারণায় গলদ! নন-এলিট যে! আমরা এলিটরা জানি। জানি, যখন ওরা কাজে যায়, রোজগারের ধান্দায় বা ধর্ম করতে তখন যে দেশ খোঁজে সে দেশ ভারতবর্ষ; সে এক মহাদেশ, আর ফিরতে চায় নিজের গ্রামে, তাই তাদের দেশ!
- এসব তো তাহাদের না-বলা কথা। তাহারা নন-এলিট, গরিব-গুর্বো। আমাদের কথা কী?
আমরা এলিটবর্গ। আমরা জানতে চাই কবে খুলবে শপিং মল, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বাজার-হাট, চায়ের আড্ডা? আগে আমরা এলিটরা জানতাম সরকার এক ও অভিন্ন। এখন বুঝেছি তা নয়। আমাদের বাঁচতে হয় দুটো সরকার নিয়ে। দুই হুজুর। দুটো সরকারই এলিট ও নন-এলিটদের বাঁচাতে চায়। এ যদি ডাল দেয় তো ও দেয় তেল। অথচ, আমরা সবাই ফিরি শূন্য হাতে। ম্যাজিক!
একজন বলে আমার পুলিস, আমার প্রশাসন, পরিবহন, আমার ডাক্তার-হাসপাতাল আছে তোমার সেবায়। চিন্তা কী?
- কোথায় তোমার পুলিস? পুলিসের বদলে তো পথে পথে সিভিক পুলিস! দুধের বদলে ঘোল? তাও তো পর্যাপ্ত নয়। সব মিলিয়ে সংখ্যাতেও তারা কাঙ্ক্ষিত (আন্তর্জাতিক) স্তরের ধারেকাছে নয়। আর মান? পুলিস আজ ডান্ডা উঁচিয়ে এলেও, ‘সোস্যাল ডিসট্যান্সিং’এর কানুন থাকলেও আমরা মানি না। কেন মানব? এই তো সেদিনও দেখেছি তাদের নাকের ডগায় বসেছিল জুয়ার ঠেক, নাচ-গান বা মদের আসর। তাদের হাত মুচড়ে অপরাধীদের ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওরা, ওদের চিনেও চেনে না তোমার পুলিস। আর তোমার সব-জান্তা প্রশাসন? তারা তো জম্ম থেকেই আমাদের সামাজিক মেলামেশা, সহানুভূতি, সহযোগিতা পছন্দ করে না, তারা চায় বুঝি মানুষে মানুষে দূরত্ব, চিরস্থায়ী সোস্যাল ডিস্ট্যান্সিং। তারা কেউ তাইরে নাইরে না গান গায়, কেউ তোমাকে এন্টি-সেপ্টিক তেল দেবে বলে ব্যস্ত। কেউ তথ্য নিয়ে খেলে। আর ডাক্তার-হাসপাতাল? কী বা বলব সে সব দুঃখের কথা। ক্যান্সার রোগী, আসন্নপ্রসবাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে হাসপাতাল! ডায়ালিসিসের সমস্যা।
এদিকে শোনা যাচ্ছে ভিন রাজ্যের নার্সরা সব দলে দলে নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে ব্যস্ত হয়েছে। চক্রান্ত নয়? বেসরকারি হাসপাতাল কর্তারা মানুষের কাছে, সরকারের কাছে আরও সাহায্য, সুবিধা চাইছেন। অথচ, তারা কোনওদিন পকেটে টাকা না থাকা মানুষগুলোকে পাত্তাই দেয়নি। আর সরকার, প্রশাসন? তাদের দাবায়ে রাখার কৌশল শিখেই ওরা এ ব্যবসায় নেমেছে। কোনওদিন তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়নি, তোমরা কেন নিজ বাহিনি তৈরিতে মন দাওনি এতকাল? বেসরকারি ক্ষেত্রকে বড় আসন দেওয়া হয়েছে– তারা কী করল? কেউ কিছু করেনি, এমন নয়। করেছে, কেউ কেউ। নিম্নমানের ট্রেনিং দিয়ে তারা নিজেদের হাত ধুয়েছে। উদাহরণ: WBUT- এর অধীন একটি হাসপাতালে (পিয়ারলেসে) যে নার্স তৈরির কারখানা তার মান যে বেশ খারাপ তার রিপোর্ট দিয়েছি, কাজ হয়নি। আরও উদাহরণ আছে, থাক। কে বলবে, কোন মুখে? তুমি, হে বাহাদুর সরকার, তুমি নিজেও তা করনি কেন! গুচ্ছ গুচ্ছ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করেছ, অথচ, নিজের প্রয়োজন মতো নার্স বা ডাক্তার বানাওনি দেশি-বিদেশি ঋণ বা সাহায্য পেয়েও।
অবশ্য এসবের দায় প্রায় পুরোটাই বাম সরকারের! কিন্ত, এখন পারস্পরিক দোষারোপ কে শোনে? কেনই বা শুনবে, সবাই জানে, ‘অপরাধী কৌন’। আজ দেশে ও রাজ্যে মাথাপিছু ডাক্তার অত্যন্ত কম। প্রশিক্ষিত নার্স আরও কম। আর হাসপাতাল? বেড সংখ্যা? নিরাপত্তা? ‘ভুলি কেমনে’ আমরি হাসপাতালের সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। সরকার তো শিক্ষা নেয়নি, উল্টে বেসরকারি ক্ষেত্রকে তোষণ করে গেছে।
মাথার ওপর একটা সরকার আছে নিয়ন্ত্রণে, পরামর্শদানে। তারাই বা কী করেছে? মিত্রোঁ/ ভাইয়োঁ- বইনোঁ তাদের কাছে কী পেল? কী শেখাল করোনা তাঁদের? সংসদে দাঁড়িয়ে এক মন্ত্রী করোনাকে গুরুত্ব দিতে না করেছেন, অমিতজি ব্যস্ত থেকেছেন নানা অস্ত্র প্রয়োগে এনআরসি/ক্যা বিরোধী তথা বহুস্বর গণতন্ত্রকামী নানা ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘টাইট’ দিতে আর মধ্যপ্রদেশে বিজেপি শাসন নিশ্চিত করতে। আর আমাদের ‘জনপ্রিয়’ প্রধানমন্ত্রীজি? তিনি তাঁর নিজের ঢাক পেটাতে করোনা আবহতেই মহামান্য ট্রাম্পকে এনেছেন, অপ্রস্তুত দেশবাসীকে বলেছেন লকডাউন করে দিলাম, বন্ধুরা ঘরে থাকো। কখনও বলেছেন আরএসএস'এর কথা শোনো, গোচোনা খাও; ‘সবার জন্য গৃহ’ প্রকল্প রূপায়ন না করেই বলেছেন ঘরে ঘরে, বারান্দায় বারান্দায় ‘দিয়া জ্বালাও’। বলেছেন, নাও দিলাম তোমাদের ত্রাণে কুড়ি লক্ষ কোটি টাকা যা নাকি জিডিপি-র দশ শতাংশ।
মহা ফাঁপরে পড়লেন বিত্তমন্ত্রীজি। টাকা কোথায়? এ তো আর প্রধানমন্ত্রীজি বা তাঁর পেয়ারের আম্বানিজির ভাণ্ডার নয়! তবু, তাঁকে চাকরি বাঁচাতে হবে যে, তাই তিনি শোনাতে থাকেন প্রতিশ্রুতির গল্প। শুরু করলেন বাজেট বক্তৃতার অপঠিত অংশ। ঘোমটার আড়ালে খেমটা নাচ! সব প্রস্তাবই তো সেই অনাগত ‘অচ্ছে দিন’এর জন্য। ত্রাণ কই? এতে কী হবে কাজ হারানো আমাদের? এলিট-ননএলিট সবাই প্রশ্ন করে। আমার সন্তানরা কী খাবে, তাদের লেখাপড়া? কী হবে নগরে-বন্দরে কাজ করা পরিযায়ী শ্রমিকদের? তাদের পেটে খিদে, তাদের হাতে কাজ নেই, মাথার ওপর থাকা ছাদ কেড়ে নিয়েছে নিয়োগকর্তা-মালিক। যাদের জমানো টাকাও নেই, অন্য সম্বল নেই তারা হাঁটছে। তারা ভগবান-আল্লা তথা ধর্ম ভুলে, জাতপাত ভুলে, আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে হাঁটছে। তাদের কথা কে ভাববে? আদালত?
‘বন্দোবস্ত’ হয়ে গেছে, আদালত ভাববে না। আর খাদ্য? কবেই বা ওরা পেটপুরে খেতে পেত? তবে ভবিষ্যতে যাতে কিছু খেতে পায় তারই জন্য প্রকল্প বানাচ্ছে কেন্দ্রের জনদরদী সরকার। আর আশ্রয়, দেশে ফেরা? মহাকাশে যাবে? তাও হবে। যারা চায় এখনই নিজ গ্রামে, নিজ দেশে ফিরতে তাদের জন্য আছে সড়কপথ। তারা কেউ কেউ হাজার হাজার টাকা দিয়ে, পুঁজি নিঃশেষ করে ট্রাকে চেপে আসছে, প্রাণ হারালে পাচ্ছে কিছু সহানুভূতির বার্তা আর ক্ষতিপূরণের নামে কিছু অর্থ। কিন্তু এভাবে ব্যস্ত হয়ে তারা চলেছে যে, এতে কি থমকে যাবে না উন্নয়নের চাকা, এতে কি সরকারের ইজ্জত যাবে না?
সরকারের ইজ্জত বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে ভারতীয় রেল। এগিয়ে এসেছে (কৌশলে, রেলের মতো) রাজ্যে রাজ্যে কিছু দায়িত্বশীল সরকার (সব সরকারই তো দায়িত্বশীল নয়, কেউ কেউ কেবল এলিটদের মতো সমালোচনাই করে নির্মলাজি, অমিতজি বা মোদিজির) শুধু। ঝমাঝম চলছে রেলের গাড়ি ‘শ্রমিক স্পেশ্যাল’। পকেট থেকে শেষ কপর্দক কেড়ে নিয়ে। বড় স্টেশন থেকে গ্রামের বাড়ি পৌঁছে দেবে, চিকিৎসা দেবে রাজ্য সরকারগুলো। পরে নাকি খরচ মেটাবে কেন্দ্র! বকেয়া অর্থই তো অনেক রাজ্য পায়নি। জানেই না কবে টাকা পাবে, আদৌ পাবে কিনা। পায়নি প্রয়োজনমতো চাল-গম। অথবা যা পেয়েছে তা মানুষের খাবার যোগ্য নয়। এফসিআই'এর পুরনো খেলা। তবে, এফসিআইকে দোষ দেবেন কেন? তারা তো যন্ত্র, তারা তথ্যের কারচুপিও করে মন্ত্রী তথা যন্ত্রীর নির্দেশে। মন্ত্রীও ব্যস্ত ‘বন্দোবস্ত’এ। ‘অনলাইন’ লেখাপড়া হল, এরপর করতে হবে ‘অনলাইন’ স্বাস্থ্য পরিষেবার আয়োজন। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ‘আরোগ্য সেতু’ অ্যাপ। আমরা তো সবই মানি, মানব– ওরা, নন-এলিটরা মানবে তো? নাকি ইহজীবনেই দেখে যেতে পারব তাদের বিদ্রোহ!
No comments:
Post a Comment