বিভাজনের রাজনীতির উর্ধ্বে
সিদ্ধার্থ বসু
আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় তাজমহল নিয়ে একটা পোষ্ট প্রায়ই দেখা যায়। তাতে অভিযোগ থাকে খানিকটা এরকম যে সবাই তাজমহলের প্রসংশা করে বটে কিন্তু হিন্দু মন্দিরের সৌন্দর্যের দিকে তাকায় না। আপাত নিরীহ এই পোস্টে এমন কিছু নেই যা নিযে কিছু বলা বা লেখা যায়। তবে একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, এর পিছনে একটা গভীর অভিসন্ধি আছে ও বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করছে, যা ভারতবর্ষের বর্তমান অবস্থার একটা ইঙ্গিত বহন করে। বিভাজন ও ধর্মীয় মেরুকরণের যে বিষবাষ্পের মধ্যে ভারতীয় জনগণকে শ্বাস নিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তারই প্রকাশ এই ধরনের পোস্টে পাওয়া যায়। ভাবটা যেন এমন, যে মানুষ ইলাহবাদে পূর্ণ কুম্ভে প্রয়াগে স্নান সারে, ভক্তিভরে বারাণসীতে বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করে, গঙ্গার ঘাটে বসে, সে হিন্দু মন্দিরের প্রশংসা করে না। অথচ আবার সেই মানুষই আদিনা মসজিদের সামনে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বা দিল্লীর মুঘল স্থাপত্যের বিস্ময়কর কাজ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়। এভাবেই বিষয়টাকে অস্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা। কখনও কি সৌন্দর্যের আস্বাদ নিতে গিয়ে দর্শনার্থীদের একবারের জন্যও মনে হয় কার থেকে কে বড় অথবা শিল্পস্থাপত্যে হিন্দুরা এগিয়ে না মুসলমানরা? না কখনই মনে হয় না। এই ভেদভাবের বিষ সুকৌশলে সাধারণ মানুষের মনে ঢোকানো হচ্ছে। কারণ একটাই- ধর্মের বিভাজন ঘটিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছনো। দেশব্যাপী আসল জ্বলন্ত সমস্যা- ভয়াবহ বেকারত্ব, অর্থনীতির বেহাল দশা, কৃষকরা ধুঁকছে- সর্বোপরি করোনা নিয়ে অপরিকল্পিত চিন্তা, যার ফলে দেশের মানুষের সীমাহীন দুর্গতি থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই এই হীন চক্রান্ত।
এই বিভাজনের সূক্ষ্ম রাজনীতির আবহাওয়ায় আসল সত্যিটা চাপা পড়ে যায়। তাই ইতিহাসের দিকে বারবার ফিরে তাকাতে হয়। অথচ, মূলত যাদের এই বিভাজনের বলি হতে হচ্ছে তাদের চোখে ভারতবর্ষ ও হিন্দু সমাজ কেমন ছিল তা একটু দেখা যাক।
আবু মা আশায় ফালাকী টানা দশ বছর ভারতবর্ষে থেকে সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। আবু রায় আল বেরুনি হিন্দুদের জ্যোতিষ ও দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করার জন্য টানা ষোল বছর ভারতে থেকে সংস্কৃত চর্চা করেন এবং তাঁর বিশ্বখ্যাত হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র ও দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ ‘কেতাবুল হিন্দ’ রচনা করেন। কাসেম ফেরেস্তা হিন্দু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এই অনূদিত গ্রন্থের নাম ‘একতিয়ারাতে কাসেমী’। এছাড়াও সুলতান ফিরোজ শাহ হিন্দু পুস্তক অনুবাদ করিয়েছেন। আজাদ বেলগ্রামী হিন্দু অলঙ্কারশাস্ত্র সম্বন্ধে একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। অনেকেই মনে করেন যে সম্রাট আকবরই প্রথম হিন্দু গ্রন্থ অনুবাদ ও হিন্দু পণ্ডিতদের তাঁর দরবারে সসম্মানে স্থান দেন। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হল, সম্রাট আকবরের প্রায় একশো বছর আগে কাশ্মীরাধিপতি সুলতান জায়েন-উল-আবেদিন প্রথম এই কাজ শুরু করেছিলেন। তিনিই প্রথম হিন্দুদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় বন্ধ করেন। হিন্দু দেবদবীর দেবালয়ের জন্য দেবোত্তর বা ওয়াকফ দান করেন। গো-হত্যা নিষিদ্ধ করেন। তাঁর আদেশে আরবি ও ফারসি ভাষার বহু গ্রন্থ হিন্দিতে অনুবাদ হয়। এছাড়া বহু হিন্দু গ্রন্থ ফারসি ভাষায় অনুবাদ হয়। তাঁর রাজত্বকালেই কাশ্মীর রাজাদের ইতিহাস ‘রাজতরঙ্গিনী’ লেখা হয়। তাঁর রাজকার্য পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন হিন্দুরা। শুধু তাই নয়, তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা ও বিভাগীয় মন্ত্রী ছিলেন হিন্দু। তাঁর নাম ছিল শ্রীয় ভট্ট। ভারতীয় রাগ সঙ্গীতে অসামান্য দক্ষতার জন্য তাঁকে গোয়ালিয়রের রাজা সঙ্গীতের দুর্লভ দুটি গ্রন্থ উপহার পাঠান। ফেরিস্তা কাশিম হিন্দ শা আস্তরাবাদী’র বই ‘তারিখ-ই ফেরেস্তা’তে এই রাজা ও তাঁর রাজত্ব সম্বন্ধে লেখা আছে।
আকবরেরও আগেএইরকম আরেক সম্রাট হিন্দুদের রাজকার্যে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি দাক্ষ্যিণাতের বাদশাহ এব্রাহিম আদেল শাহ। শুধুমাত্র হিন্দুদের রাজকার্যে নিয়োগই নয়, অফিস আদালতের ভাষা ফারসির পরিবর্তে হিন্দি ভাষা চালু করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণদের কর্মকর্তা করে তোলেন। ভারতবর্ষ বিষয়ে ‘মসালেকুল আবসার’ গ্রন্থে লেখা হয়, ‘ভারতভূমি এক মহিমান্বিত দেশ। তাহার বিস্তৃত সীমা, বিপুল ঐশ্বর্য, বিশাল বাহিনী এবং অতুলনীয় শাসন-প্রণালীর সহিত কোনও দেশের তুলনা হইতে পারে না।' এই একই স্বর শোনা যায় ভারত ভূমি সম্বন্ধে আজাদ বেলগ্রামীর রচনায়। ‘গেজলানুল হেন্দ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখছেন, 'স্বর্গাদপি গরীয়ান হিন্দুস্থানের বর্ণনা তফসীর ও হাদিসের গ্রন্থাবলীর সাহায্যে লিপিবদ্ধ করিতে হইবে।' ভারতবর্ষের হিন্দুদের শাস্ত্র ও বিদ্যা বিষয়ে তাদের কীরকম ধারণা ছিল তার প্রমাণ মেলে শায়েক আলী রুমী’র ‘মোহাজেরতুল আওয়ালে' গ্রন্থে। সেখানে তিনি লেখেন, 'সর্বপ্রথমে যে দেশে গ্রন্থাদি লিখিত হয় এবং যে স্থান হইতে জ্ঞানের উৎস সমূহ প্রবাহিত হয়, তাহা ভারতবর্ষ।' এই মনোভাবের প্রকাশ আরও অনেকের লেখাতেই পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে একজন দার্শনিক জামালউদীন্ন ফেকতী তাঁর ‘আখবারুল হোকামা' গ্রন্থে ভারত ভূমি সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষকে চিরকাল সকল জাতি জ্ঞানের খনি এবং ন্যায় ও রাজনীতির প্রস্রবণ বলিয়া স্বীকার করিয়াছে।' ভারতবাসী বিষয়ে আজাদ বেলগ্রামী তাঁর গ্রন্থ ‘গেজলানুল হেন্দ' এ লেখেন, ‘অঙ্ক ও সঙ্গীতশাস্ত্রে ভারতবাসীরাই অগ্রণী। তাঁহারা এই দুই বিষয়ে এরূপ উন্নতি করিয়াছেন যে, তাহার অধিক সম্ভব বলিয়া মনে হয় না। অন্য দেশবাসীগণ অঙ্কশাস্ত্রের অধিকাংশ নিয়ম ভারতীয়দের নিকটে শিক্ষা করিয়াছেন।' এ কথা বলেই তিনি থামেননি। এই বইয়েরই অন্য স্থানে তিনি লিখছেন, ‘ভারতীয় পণ্ডিতগণ অলঙ্কারশাস্ত্রের উদ্ভাবনায় আরবদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন নাই, পারসিকদের নিকটও কৃপা-ভিখারী হন নাই। ইহার কারণ এই যে, ভারতবর্ষে যে যুগে জ্ঞানচর্চা আরদ্ধ হইয়াছিল, ইতিহাস তাহা নির্ণয় করিতে অক্ষম।' এই প্রশংসায় ভারতীয় হিসেবে কি গর্ব অনুভব হয় না?
এ প্রসঙ্গে হিন্দু পণ্ডিতদের উদেশ্যে ভারত বিখ্যাত জ্ঞানতাপস মির্জা জানেজা বলেন, 'সর্বপ্রকার বিদ্যা, যোগ, ধ্যান এবং দার্শনিক জ্ঞান ও গবেষণায় হিন্দুদের বিশেষ কৃতিত্ব আছে।' সুলতান ফিরোজ শাহ (হিজরী ৭৭৫ সন)'এর আমলে হিন্দু সাহিত্য এবং শাস্ত্রের চর্চা করলে মুসলমানরা রাজ অনুগ্রহ, সম্মান, অর্থ এবং ভূসম্পত্তি লাভ করতেন, ধর্ম্মদ্রোহি(কাফের) বলে লাঞ্ছিত হতেন না। তাই আজ সারা দেশে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে সুকৌশলে যে বিভাজনের বিষ ছড়ানো হচ্ছে তা যে আসল সত্যকে আড়ালে রেখেই তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
ক্ষিতিমোহন সেন এই বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন । তার উল্লেখ থাকলে ভালো হত ।
ReplyDelete