Tuesday, 30 June 2020

দিন যাপন!

আড়ালের প্রতিবেশীরা
সোমনাথ গুহ

বড় রাস্তার মোড়ে বহুতলের নিচে একটা নতুন লোক সবজি বিক্রি করছে। তখন লকডাউনের প্রথম দফা পেরিয়ে দ্বিতীয় দফা চলছে। ব্যাধির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের সদিচ্ছা ফিকে হতে শুরু করেছে। সংক্রমণ বাড়ছে। প্রতিদিন বহু মানুষ কর্মচ্যুত হচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ পথে নেমেছে। এরই মধ্যে ওই মানুষটির আগমন। কথায় একটা টান থাকলেও বাংলা ভালোই বলেন, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। দেখা গেল, সবজি বেশ টাটকা, দামও কম। নতুন তো তাই খরিদ্দার তৈরি করছে, সবাই ভাবল। তিনি বাদামতলায় থাকেন, কাঠের মিস্ত্রি ছিলেন, কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বহুতলের এক দারোয়ানের প্রতিবেশী। তারই সুপারিশে এখানে এসে বসা। ফ্ল্যাটবাড়ির লোকেরাও খুশি, তারা হাতের কাছে সবজি পেয়ে যাচ্ছে। পাড়ায় হঠাৎ সবজিওয়ালা বেড়ে গেছে, কিছু মাছওয়ালা। মিনিবাসের ড্রাইভার মাছ বিক্রি করছে, হেল্পার আলু, পেঁয়াজ নিয়ে ফুটপাতে বসে গেছে। 

রামনাথ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে আমাদের পাড়ায় আছে। সে জামাকাপড় ইস্তিরি করে এবং সেই সুবাদে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তার আসাযাওয়া। মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা হয় কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। রামনাথের বাড়ি উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলায়। এর আগে ওর দাদুদের নেতাজিনগর গাছতলায় দোকান ছিল, এখনও ওর চাচেরা ভাইদের আছে। পাড়ায় আসার পর তার আবাস একটা নড়বড়ে ছোট গুমটি, যেটার চেহারায় ক্ষণস্থায়িত্ব অনিবার্য ভাবে লেপটে আছে। থাকবারই তো কথা, সেটা যে কতবার স্থানান্তরিত হয়েছে তা তো কহতব্য নয়! পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট উঁচু একটা টেবিল যেটার ওপর সে ইস্তিরি করে, যেটার ওপর সে শোয়, যেটার ওপর বাবু হয়ে বসে সে আহার করে আর ওটারই পেটের ভিতর পাট করা জামাকাপড় রাখা থাকে। এই গুমটির ওপর অ্যাজবেস্টাসের চাল, একপাশে একটা মাটির উনুন। পাশেই একটা বাতিস্তম্ভ যেটার দোসর বহু পুরনো একটা কদম গাছ। আমপানের রাতে গাছটা শিকড় ছিঁড়ে পুরনো বন্ধুকে জড়িয়ে ভূপতিত হয়, খুঁটিটার হ্যালোজেন বাতিটা কোনও দৈব আদেশে রামনাথের ঘরের চালের মাত্র এক ফুট ওপরে ঝুলতে থাকে।

এই রামনাথকে সবার প্রয়োজন কিন্তু কোনও সামাজিক দরকারে জায়গা অকুলান হলে তার গুমটি সরানোর কথাই সবার মনে আসে। নতুন টিউবওয়েল বসবে রামনাথকে সরাও, প্যান্ডেলে ঢোকার জায়গা অপ্রশস্ত রামনাথকে সরাও, গাড়ি ঘোরানোর জায়গা কম রামনাথকে সরাও। লকডাউনের কারণে তার ব্যবসায় তালা, ছোটখাটো ইস্তিরির ব্যবসাও বন্ধ। বেশির ভাগ লোকই এই মারির সময়ে বাইরে থেকে ইস্তিরি করার পক্ষপাতী নয়। কয়েক জন বেপরোয়া, ওকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করে, তোমার তো গলির মধ্যে ওইটুকু ঘর, কে দেখতে আসবে। আরে না দাদা, ক্লাবের ওখান থেকে একজনকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ, কে রিস্ক নেবে? মাসখানেক নিজের পয়সায় কোনওরকমে চালানোর পর তার অবস্থা সঙ্গীন। অগত্যা এ বাড়ি ও বাড়ি যায় সাহায্য চাইতে। একটা মানুষ যে খেটে খেয়ে অভ্যস্ত, তার পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া একটা মানসিক নির্যাতন। সে কুন্ঠিত হয়ে পড়ে, তার বিবেক কুঁকড়ে যায় অবমাননার জ্বালায়। আমাদের সুব্যবস্থিত জীবনে আমরা ভাবতেও পারি না স্বাভাবিক জীবনের শৃঙ্খল যখন ভেঙে পড়ে নিতান্ত ছোটখাটো ব্যাপারেও, নিম্নবিত্ত মানুষ কী সমস্যায় পড়তে পারে। পাড়ার মোড়েই পেট্রল পাম্পে একটা বাথরুম আছে যেটা মিনিবাসের স্টাফ, পাম্পের কর্মচারীরা, আশেপাশের দোকানদারেরা এবং রামনাথের মতো মানুষেরা ব্যবহার করে। তালাবন্দির কারণে সেই বাথরুমেও তালা পড়ে গেছে। শৌচকর্ম করতে তাকে এখন রথতলা বাজারের পাশে সুলভে যেতে হয়। সেখানে পয়সা লাগে, তাতেই রামনাথের দিনে দশ পনেরো টাকা বেরিয়ে যায়। কাজ বন্ধ, ওই টাকাই বা সে পাবে কোথায়? তাই রোজই এর তার কাছে হাত পাতে। 

বাদামতলায় বাড়ি বলে মানুষটার নাম হয়ে গেছে বাদল। রোজ কেনাকাটার ফলে তার সাথে ভালোই পরিচয় হয়ে গেছে। একদিন বলে, আর বলো না দাদা, লোকে এত দরাদরি করে আমার আর কী থাকবে বলো তো? না দিলে আবার রেগে যায়, গালাগালি করে। কাঠের কাজ করে পাঁচশো টাকা রোজ থাকত, এখন তার আধাও হয় না। বাদল বিহারের মানুষ, বেগুসরাই জেলা। পঁয়ত্রিশ বছর আগে এসেছিলাম  বিহার থেকে তখন ব্রহ্মপুরে একটা মান্ডি ছিল, তারপর থেকে যত ফ্ল্যাট হয়েছে তত মান্ডি বেড়েছে, সে গড়গড় করে বলে। বাড়ি যাও না? ঐ ছঠের সময় আর সাদীটাদি হলে। হঠাৎ এখানে চলে এলে? পিতাজী ছিল তো, কাঠের কাজ করত, তখন আর আমার কত বয়স! আমিও বড় হয়ে একই কাজে লেগে গেলাম। এই কাজ ভালো লাগে না দাদা। এই ভ্যানের জন্য পঞ্চাশ টাকা, পাল্লা দশ টাকা, তার ওপর লোকের গালি! 

সনাতন বাড়ি বাড়ি জল দেয়, ভারি, পুরনো কলকাতায় বলা হত ভিস্তিওয়ালা। ভিস্তি অর্থে জল বয়ে নিয়ে যাওয়ার চামড়ার থলি। অল্প বয়সে দেখেছি বড় ডালডার টিনে জল ভরে বাঁকে করে কাঁধে বয়ে নিয়ে যেত। এখন এসেছে ঘিয়ের জার যা তাঁরা সাইকেলে ঝুলিয়ে দূরদূরান্তে চলে যেতে পারে। সনাতনরা পাঁচজন একসাথে দুটো ছোট ঘরে ভাড়া থাকে। তিনজন সময় থাকতে উড়িষ্যায় চলে গেছে, সনাতন এবং আর একজন আটকা পড়েছে। জল দেওয়ার কাজ তালাবন্দির আওতায় নেই, লোকে নিচ্ছেও জল। সুতরাং পয়সা সনাতনের চিন্তা নয়, তার চিন্তা দেশে তার পরিবার কেমন আছে। এমনিতে কম কথা বলে, কোনও প্রশ্ন করলে শুধু ঘাড় নাড়ে। হঠাৎ একদিন শুনি সে সাইকেলে করে ভদ্রক জেলায় তার গ্রামে রওনা হয়ে গেছে। তার ভাই খবর দিল। তখন রটে গেছে বাংলা থেকে যারা যাচ্ছে তারা উড়িষ্যায় সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তাই অনেককে সীমান্তে আটকে দিচ্ছে। কী হবে যদি পুলিশ ধরে? বাড়ি পৌঁছলেও তো পনেরো দিন আলাদা থাকতে হবে, খারাপ কিছু হলে ভুবনেশ্বর নিয়ে যাবে! তার ভাইয়ের গলায় অসহায়তা। 

সেদিন দুপুর বারোটা নাগাদ দেখলাম বাদল গোছগাছ করে বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
- কি,তোমার কাঠের কাজ কবে শুরু হবে? 
- কি জানি দাদা, কোনও খবর নেই।
আজকে তার মুড বেশ ভালো।
- তোমাদের আশীর্বাদে বিক্রি বেশ হচ্ছে।
গামছা দিয়ে গলা মুছতে মুছতে বলল। বাদলের চার মেয়ে, এক ছেলে। এটা বলতে গিয়ে সে একটু লজ্জিত হল, যার অর্থ ও হয়তো বোঝে যে এটা ঠিক নয়। রেশন ওর বড় ভরসা। পরিবারের সাতটা কার্ড আছে। দু' টাকা দরে মাথাপিছু দু কিলো চাল এবং তিন কিলো গম পায়। 
- চাল খাওয়া যায় না দাদা, গলা দিয়ে নামে না।
বাদল  বুকের ওপর নিম্নগামী আঙুল দিয়ে বোঝাল।
- ওটা চোদ্দ টাকায় বিক্রি করে দি। 
- দু টাকার চাল চোদ্দ টাকায়! 
- ভ্যান ভাড়াটা ধরে। রেশন দোকান থেকে মাল নিয়ে যেতে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া পড়ে যায়। 

তাতেও ওর ভালোই লাভ থাকে। আর এর অর্থ, এইরকম মানুষও আছে যে ওই চাল যা গলা দিয়ে নামে না তা চোদ্দ টাকায় কিনে নেয়। হতে পারে সে আরও গরিব, কিংবা তার রেশন কার্ড নেই আবার বাজার থেকে এর থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনবে সেই সঙ্গতিও নেই। গরিবের কত স্তর, তলানি খুঁজে পাওয়া ভার! 

১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরের দিন সাগর ফোন করে বলে, দাদা, একটা সুযোগ পেয়েছি, বাড়ি পালাচ্ছি, অবস্থা সুবিধার মনে হচ্ছে না। ব্যাটার দূরদৃষ্টি আছে বলতে হবে, সেই যে গেছে এখনও ফিরতে পারেনি। সাগর ক্ষৌরকার, দেশ বিহার, মজঃফরপুর জেলা। চুল কাটার সময় তার সাথে রানার নানা কথা হয়। সন্ধ্যাবেলায় সে একটা মণিহারী দোকানে কাজ করে, মাসকাবারি মাল খদ্দেরের বাড়ি পৌঁছে দেয়। এতে তার প্রায় হাজার তিনেক টাকা ইনকাম আছে। দেশে গেলে সে আর ফিরতে চায় না তাই দোকানের মালিক তাকে মাঝেমধ্যেই ছাড়িয়ে দেয়, তখন সে ঠিক অন্য কোনও কাজ জুটিয়ে নেয়। বয়স্ক মানুষকে রাস্তায় হাঁটায়, কিংবা সন্ধ্যাবেলায় টিভি দেখায় তাঁকে সঙ্গ দেয়। এর জন্য সে পঞ্চাশ টাকা রোজ পায়।

বাদল আবার রেশন পেয়েছে। এটা হয়তো কেন্দ্রীয় সরকারের: পঞ্চাশ কিলো চাল, একুশ কিলো গম। পঞ্চাশ কিলো মানে একেক জন পিছু কত করে দিয়েছে, গম না হয় বোঝা গেল জনপ্রতি তিন কিলো!
- হিসাব করে দেখ না দাদা কত হয়?
হিসাবের মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা গেল না, পাঁচ করে সাত জনের হয় পঁয়ত্রিশ কিলো, দশ করে সত্তর কিলো... কিছু একটা গরমিল মনে হয়!

- চাল কেমন?
- ওই দাদা, নরম, আঠার মতো।
- যাই হোক, তোমার তো এখন খাবারের অভাব নেই?
- না দাদা মিথ্যা কথা বলব না, কোনও অভাব নেই।

আনলক শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তার আর পুরনো কাজে ফিরে যাওয়ার উৎসাহ নেই।
- মিথ্যা কথা বলব না দাদা, খারাপ বিক্রি হচ্ছে না, কিন্তু দুবেলা বসতে পারলে ভালো হয়। দেখ, ছিল ছুতোর মিস্ত্রি, হয়ে গেল সবজিওয়ালা! 

No comments:

Post a Comment