Friday, 19 June 2020

এক কাল যাপন

ভাইরাল কলিং বেল এবং জুজু
উৎস রায়চৌধুরী

শুকনো নিকেলের চাবুক ক্যানেস্তেরা পেটাচ্ছে। ঘুরপথে আরোগ্যের ইন্দ্রপতন হয়েছে। কেউ  কিছু বলেনি বলে রোবটের ধ্রুবক নিজেকে ভাইরাস বলছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেদের প্রেম, আর আমাদের ভেতর উউউউ সীমান্ত ছুঁয়ে উদগ্র, তার জামিন নেই। এখন পরীক্ষা হল সুতানুটি, না মাথাভাঙা— কোথায় একটু চার দেয়াল, কোথায় ক্ষণপল বা কল না পাওয়া কেওড়া গাছ যেখানে উঠলে আর ভয় থাকবে না। এসব বলতে বলতে পুঁচু হাত মালিশ করছিল। আমি কী বলতেই সব ইজাকুলেশনগুলি একটা অদ্ভুত কাঁটা কাঁটা গোলক বের করে আমাকে চূড়ান্ত ধাওয়া করল।

আমি দৌড়চ্ছি। হাওয়া সরে যাচ্ছে, শাঁখ বেজে যাচ্ছে, অদেখা নক্ষত্রগুলির ফাঁকে সেই কাঁটা কাঁটা গোলকটি লুকিয়েছে নিজেকে। আমরা তাকে না বশ করতে পেরে পাণ্ডিত্য খুইয়েছি। আর কী করা! এখন বদ্ধ বিকেল। আসলে ধরার কোনও স্কোপও নেই। রক্ত এখন চিরতা সুরে গান শোনাচ্ছে বলে রাঙিয়ে দিচ্ছে না মন।

অভাবের তিনটে স্তর আছে। একটি হুঁকোর ভেতরে অর্ধেক জলের মতো প্রবেশ করার সাধ্য না পেয়ে সারা জীবন ঘড় ঘড় শব্দ করে। দ্বিতীয়টি বলা হয়, চেষ্টা করা হয়, ইচ্ছাও আছে কিন্তু অমোঘ শক্তি বলে হয় না। শেষেরটিতে বুকের এ পাশটা হাত দিলে ও পাশটা খাঁ খাঁ মনে হয়। চাইলেও এর সমাধান হয় না। বেরতে না পারাটা এখন করতে না পারার অভাব। আর করার যা কিছু আছে তার অনেকটাই বা বেশ কিছু হল ফুজুল ঘুরঘুরে বাতিক যাতে কেউ প্রতিষেধক মাখায়নি বলেই মুখের সোয়াবে আজ ঘরবন্দী এক সিনেমা।

এই সিনেমাতে পাহাড় খেলা করছে। তবু যা একটি অপ্রবেশ্য দরাজ কাঠ সেটাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকলে সূর্য, নেই কিন্তু একটি বাঁচা আছে। এই বাঁচা আমাদের মাল্টি ভিটামিন খাওয়ায়, কিন্তু আমরা বুঝিনি। এসবের কালো অক্ষরে যে সিম্বলিক ট্রেন্ড তা আসলে যে কোন‌ও রকম দৌড়ের সদাচরণ। ফুলে ওঠে শাঁস মকুবের দরখাস্তে। সেটা কোন দরখাস্ত এবং কীসের, কোত্থেকে পাওয়া দরখাস্ত?

একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে চাঁদ আসে না, সেখানেও ছড়িয়ে আছে ভয়। কেন? ভয় কেন? এ‌ই কারণেই তো কাঁটা লিখিত গোলকের ভ্রমণের বারণ নেই। অবারিত ভ্রমণে তার প্রেমেরও শেষ নেই। চিবুকের ঘনত্বে যত মেঘলা শিশির তত গোলকের অন্ত নিক্ষেপ, আর ওয়েট করে দণ্ডায়মান সিসিইউ। আমাদের শেলবিদ্ধ সমাজ কা কা করে যখন ডেকে চলে যায় তখনই আমরণ ছিল্লিরা পুর ভাঙে। যদি প্রশ্ন হয়, আমাদের নিজেকে বাঁচাতে ঘরের মধ্যে কী আছে। কী করতে পারে একটি বল মাফিক সিবলিস? তখন ফাল্গুনের রং পাল্টে নেমে আসে অদ্ভুত মুখ মাখিত শ্রাবণ আর তা হল সহস্র বাঁচার এক তরফা মেশিন যা মিশে আছে এঘর, ওঘর, সে ঘরের রংয়ে। প্রতিটি মাখনাই এখন যে সবুজ রং ফেলছে ইদানিং ঘরে, ঘরের বাইরে তা আসলে হোম কার্পেন্টিং। এখানে মুক্তি নেই অথচ বেঁচে থাকার স্বপ্ন আছে। এসবের যত কিন্তু আছে তার একেকটি পথ ইউ টার্ন নেয় আরেকটিতে।

যা এখন সুহাগনি মেটিরিয়াল তা আসলে ময়দা মাখার একটি বিষয়। কোন‌ও কাজ নেই কিন্তু বেঁচে থাকার স্বরবর্ণ ময়দা কারুশিল্পের ইতিহাস আমাদের সামনে এখন দাঁড় করিয়েছে বাইরের কাঁটা গোলকের হাত থেকে বাঁচতে। বাঁচাই যখন পরম ধর্ম তখন নিজের দর্শনের ভেতর দরজা জানালা বন্ধ করে ডুবে থাকাই একটি অযৌন শিল্প। এই শিল্প কিন্তু নিজের আয়ুর তর্পণ। এই তর্পণে বিশেষ পুরস্কার আসে না তবে নতুন দিন দেখার এক কালকেতু সফর আছে। এভাবেই সায়মকালীন ঝিরঝিরে আলো যে গোলককে আজ মারণাস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেছে তার ঘুলঘুলি এখন হাঁচি হল কি না, গলায় গিলতে লাগল কি না, রানিং নোজের মেটিকিউলাস অবজেক্ট তৈরি হল কি না!

এসব দেখতে দেখতে আমার আলোচনায় পুঁচু পা হড়কে গেল। আমি ধরলাম, ও আমাকে ধরতেই দিল না। আর যে কে সেই, ধড়াম করে পড়ল। আসলে পড়ে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কেননা এখন অস্তাচলের সময়। এখানে কা কা করে সব ক্ষতিগুলো ঢুকে পড়ছে, এখান থেকে বাঁচার পথটি খুব সরু। এই ন্যারো স্পেস দিয়ে ঢুকতে গেলেই সাইডের ঢালটা নড়ে যায়, আর তখনই সিসিইউ বা আইসিইউ।

শ্বাসকষ্টটা এখন কমন প্রবলেম, তার মধ্যে যদি  ঢুকে পড়ে গোলকের নির্দেশিত খোঁচা তাহলেই গুবলেট। তবে মাননীয়া এখন ক্যা ক্যা থেকে মহিয়সী মাফিক, তাই আমরা এখন‌ও অ্যাঞ্জেলের হাতের মুঠোয় বা আজ পর্যন্ত বা সেই প্রদাহগুলিকে স্মরণ করি আজও। র মেটিরিয়াল হয়ে গেছি আমরা এখন। সবাই আর একটু তান্ত্রিকের তত্ত্বের কথা বললে আমরা বেশিরভাগই এখন রগড় করি নিজেদের নিয়ে।

আমরা নিজেদের বেঁচে থাকাটাও সাধারণ কাজের মধ্যে দিয়ে সুরক্ষিত রাখতে পারছি না। অ তে হস্তক্ষেপ করছি যার মানেই হল শেষ। ই তে হস্তক্ষেপ করছি আমাদের পেলভিস বড় ক্ষুধার্ত বলে। তাই কাঁটা গোলকের আক্রমণ খাওয়া পুঁচু আমাকে ধরে পিষলেও আমি বেঁচে যাই এই কারণে যে আমি এমন বর্ম পরেছিলাম যা আসলে বর্ম না, বরং নন-স্পেসিফিক লগারিদম যেখান থেকে আমাকে স্যানিটাইজ করা হয়েছিল উপর্যুপরি খাইয়ে।

আমি আর পুঁচু খুব দৌড়চ্ছি। পেছনে তাড়া করেছে সেই কাঁটা গোলক। এই এল বলে, এই চড়ল বলে, আর তক্ষুণি আমরা একটি ওয়াইন শপে ঢুকে পড়লাম। দোকানের বাইরেটা খোলা কিন্তু ভেতরে লেখা আছে খাওয়ার জন্য লকডাউন ফ্রি। বাইরে জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সেই কাঁটা গোলক খুব লাফাচ্ছে। ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দোকানদার চন্দ্রালোকিত গ্লাসে একটু ঢেলে দিতেই বাইরেটা আরবিয়ান ইডেন হয়ে গেল। আমি বললাম কেমন আলো! পুঁচুও। কিন্তু দোকানদার বলল এটা জেট বিমান তাই বাইরে থেকে কাঁটা গোলককে সরিয়ে ২০২০ সালের ইটি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। পুঁচু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

রাস্টিক নোব্‌লিটি। কেমন সাপ সাপ। বলা বলা ভাব। সরে আসা দিক। ক অক্ষরে পেয়ে বসেছে অনেক ভাবে। এসব পেয়ে বসা আসলে আমাদের সাধ না করেও ইজিয়ার করে তোলে। অফ সিজনে বৈঠক বসেছে এখন। তাই আমি লিখছি আর পুঁচু বলছে, অন হবে না? আসলে ও খুব অন হয়। আমি লিখে ফেললাম এক গিমিক। পুঁচু পড়তে গিয়ে ভয় পেল। আমি আবার লিখতে লাগলাম। আমি একটি খেলায় মেতে উঠলাম, কিছুটা কাচাকাচি, কিছুটা মোছামুছি, কিছুটা রাঁধারাঁধি। কিছুটা বকলমে আমি যেন ঘোষক, হোয়াটস্‌অ্যাপার, আবার কিছুটা গলায় কাঁটা গোলক ভর করল কিনা সেটা ভেবেচিন্তে দেখা!

রিয়েল গন্ধে মুখ সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা এখন নেই, কেননা আমরা সবাই এখন তো মুখোশ পরে আছি। কার কীরকম মুখের গন্ধ টের পাচ্ছি না। সবাই ভেতরে ভেতরে ক্যারিকেচার করছি, আর মুখোশটা ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে কাঁটা গোলক বুঝতে পারছে না বলে আমরা তাকে নিয়েও উপহাস করছি। সে হাসছে কিন্তু আমরা ঘরে আছি বলে কিছু করতে পারছি না। এসবের দাম দিতে হয়। নিজের ভেতর নিজে থাকাও একটি প্র‍্যাক্‌টিস। এই অভ্যাসে নীল হয় না মুখ, অথচ হালকা গোলাপি হয়ে যায়। হিন্দিতে দিল নখরবাজি বলে একটি কথা আছে, যেখানে মুখের সাধে মুখ বেফাঁস হয়, ঘরের বাইরের মুখ সেলোটেপ খুলে আস্ত প্রিন্স হতে চায়। আর তখনই যৌথ উদ্যোগ, অযৌথ নাড়ানাড়ি, সব ফসকে যায়, কাঁটা গোলক ঢুকে যায়। তখন সেটাই ইংরেজি সিনেমা। আর বাঁচার পথ নেই। কিন্তু বাঁচতে হবেই, তাই ঘরকে তাক লাগিয়ে গিটারের যমুনা ধুইয়ে দিয়ে জানলা একটু খুললে তাতে দেখবে বাইরের লাল রংটা আস্তে আস্তে সবুজ হচ্ছে। সব কাঁটা গোলকগুলো ছোট হয়ে আসছে। এই ছোট হ‌ওয়ার নামেও এক স্বপ্ন আছে। মহানুভবী স্বপ্ন যা ধীরে ধীরে নিজেকে চিনতে ও জানতে শেখায়।

চেনা জানা আমরা তো বাইরের লোকের ক্ষেত্রে অ্যাপ্লাই করি কিন্তু নিজেকে জানার এক প্রশ্নও খুব দারুণ ভাবে জড়িয়ে যায়। এখানে আমরা বদ্ধ অবস্থায় নিজেকে সংশোধন করতে চাই। এই সংশোধনও আমাদের চলে যাওয়ার কিছু আগে খুবই প্রয়োজন। পুঁচুও তাই বন্দী অবস্থায় নিজেকে চিনছে। নিজেকে বোধ করার সাথে সাথে স্বয়ং সারাৎসার আসলে মুখ্যত একটি হারমিটিয়াস বেনিফিট। এই বেনিফিটে অনেকদিন পর বের হলে নিজের রহস্য নিজেই উন্মোচিত হয়।

উলের মস্ত নম্রতায় যে গভীর তাক করে থাকা তার সেই তাকেই নজর ফেলে আছে এখন কাঁটা কাঁটা গোলক। যার প্রতিটি কাঁটার এক চূড়ান্ত কোণে সত্যের এক অবস্থান আছে। এই অবস্থানে নীলাভ চাঁদের সেই কোণটি এখন‌ও হা হুতাশ করে এইজন্যই যে আমরা এর ভালো মন্দে নিজের ভালোটা হারিয়ে ফেলেছি। সেইজন্য এই কাঁটা গোলকের বংশ এখন‌ও বিস্তৃত। এর ছড়ানো বাসায় গোল হয়ে পুড়ে যাচ্ছে কোন‌ও কোন‌ও মানুষের মুখ। সহন এখানে উত্তাপ বুঝছে না, উত্তাপ বুঝছে কেবল পলিগ্যামিস্টিক ডেমোক্র‍্যাসি যেখানে মানুষ নিজের ভুলেই নিজে একত্রিত হচ্ছে। নিজেই নিজের উল্লাসকে পকেটে মেরে ফেলে কাঁটা গোলকের কাছে সঁপে দিচ্ছে।

যদি কেউ প্রশ্ন করে ডার্ক এনিগ্‌মা কী? পুঁচুও এই একই প্রশ্ন আমাকে করল। আর আমি এনিগম্যাটিক পাওয়ারকে খুঁজতে থাকলাম। অবশেষে লাল একটি গুহার ভেতর দেখি শুয়ে আছে আমাদের সব সত্য ও সততাগুলো যেখান থেকে প্রায়ই আমরা সকলেই বিচ্যুত। গুহার কাছে আসতেই ম ম করে গন্ধ বেরোচ্ছে। কিসের গন্ধ? পুঁচু প্রশ্ন করল মুখোশ পরে। মুখোশ তো আমিও পরে আছি। কিন্তু পুঁচুর আর আমার মনে হচ্ছে আমরা মুখোশ পরে নেই। অদ্ভুত! আসলে সব অরিজিনালিটিগুলো শুকিয়ে পুড়ে কাঠ হয়ে গন্ধ ছড়াচ্ছে আর তার থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য কাঁটা গোলক। এই গোলক তাই আমাদের একেবারে বুঝে গিয়েছে, তাই আমাদের চারদিকে আক্রমণ করে আমরা এখন— ফিলসফি অফ্ লিভিং = অ্যান্থোলজি অফ্ রুইন।

এইভাবে এক অদ্ভুত মাত্রায় সব শব হয়ে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি নিজেরা নিজেদের দূরত্ব রেখে। এতে ভয় আছে বলে, ত্রাস আছে বলে, সবটাই আসলে এক ভৌতিক মিউজিক। আর আমাদের খুবলে খেয়ে চলবার পরিসর তুলে ধরেছে এক ভিনদেশি কাঁটা গোলক। আর তাই আমাদের ত্রাসপূর্ণ জীবন এখন এনিগ্‌ম্যাটিক। আমাদের সব র মেটিরিয়াল্‌সই এখন আমাদের গলে যাওয়া একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস, ভয়াল স্তবকের হেডলাইন যেখানে শুঁয়ো শব্দের অর্থও সেই কাঁটা গোলক।

পুঁচু হঠাৎ আঁৎকে উঠল। আমিও আঁৎকে উঠলাম, বললাম, কী রে! তখন ও দেখাল বাইরের স্নিগ্ধ আকাশের নিচে আমরা দাঁড়িয়ে আছি গুহার সামনে যেখানে সত্য ও সততাগুলো থেকে পচা গন্ধের এনিগ্‌মা স্পিরিটের স্রোত উঠছে, আর তার ওপরেই আকাশ থেকে ব‍্যালিস্টিক হয়ে ঝরে পড়ছে কাঁটা গোলক। এই গোলকের এক প্রান্তে আগ্রাসন আর আরেক প্রান্তে উল্লাস যেখানে সুইচ অন করে ঝুলে আছে অনেক অনেক অ্যাম্বুলেন্স। আর পারসেন্টেজ অফ এফেক্টেডরা খসা চামড়ার মুখড়া নিয়ে গলে গলে পড়ছে। পুঁচু বলল, চল আবার সেই ঘরেই ফিরে যাই যেখানে রয়ে গেছে বাঁচার তাগিদ আর আমাদের নতুন করে বানাবার মন্ত্র। এসব স্যালাইন ওয়াটারে মিশিয়ে আমি আর পুঁচু বলেছিলাম আমরা রাজা। আর তক্ষুণিই কাঁটা গোলক বলে উঠল না, এখন তা আমি, আর তোমরা রিউমেটিক বোনলেস গাইস এন্ড গার্লস। কারণ তোমরা ট্রুথ আর অনেস্টি হারিয়েছ।

আমি পুঁচুকে বললাম, চুপ। আমি নিজেও চুপ। আর দেখলাম কীভাবে কাঁটা গোলকের সমস্ত ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসছে আমাদের নিজেদের নষ্ট করার অণ্ডকোষ আর ডিম্বকোষ। আমি আর পুঁচু জানালা খুলে জোরে বলে উঠলাম — আমরা তো বাঁচতে চেয়েছিলাম।

No comments:

Post a Comment