এতটা ক্ষোভ জমা ছিল
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
আমার যখন কৈশোর তখন আমাদের বাড়িতে এক ভদ্রলোক আসতেন নানা ধরনের বই বিক্রি করতে। আমার পিতৃদেব তাঁর কাছ থেকে মাসিক কিস্তিতে আর্থার মি সম্পাদিত দশ খন্ডের 'চিলড্রেন্স এনসাইক্লোপিডিয়া' কিনে দিয়েছিলেন। সেই ১০টি খণ্ড চোখের সামনে দুনিয়াকে প্রসারিত করেছিল। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, নাটক, চলচ্চিত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, খেলাধুলো, নানা দেশের ছবি, ফুল, ফল, পাখি, কীটপতঙ্গ কি না বিষয় ছিল তা তে। আমার কৈশোরের অনেকগুলি দুপুর ওই এনসাইক্লোপিডিয়া'তে কেটে গেছে।
পরে যখন আর একটু বড় হয়েছি তখনও ওই বই থেকে এটা ওটা জোগাড় করে লেখালেখি করেছি। দেওয়াল ম্যাগাজিন সাজিয়েছি। কিন্তু এই পর্বেই আমার মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন দেখা দিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, এই বই যথেষ্ট যত্ন নিয়ে বিশ্বের শিশুদের জন্য তৈরি করা হলেও বইটির মধ্যে আমরা সাহেব তোমরা নেটিভ, আমরা তোমাদের সভ্য করে তুলেছি- এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন আছে। সেখানে কোনও এক জাতি বা কোনও এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণার কথা ছিল না বটে কিন্ত শ্বেতাঙ্গ মানুষ উন্নত, এটা খুব সূক্ষ্মভাবে বুঝিয়ে দেবার ব্যাপার ছিল। বাবাকে যখন এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি, তিনি বললেন, হ্যাঁ এই বইটার মধ্যে এই পুরনো রোগ রয়ে গিয়েছে। এই তো সেদিন পর্যন্ত ওরা দুনিয়াটাকে শাসন করত। সেটা ভুলতে পারছে না। আরও ধাক্কা খাবে ওরা।
সেদিন বাবা হাতে করে বুঝিয়েছিলেন বর্ণবিদ্বেষ কাকে বলে। তিনি বলেছিলেন, সব জাতি সব ধর্ম সব বর্ণের মানুষের মধ্যেই ভালো মন্দ মিশিয়ে আছে। সুতরাং, জাত-ধর্ম-বর্ণ তুলে সবাইকে গাল পারা এবং তাদের প্রতি বঞ্চনা করা ঘোরতর অন্যায়। মার্টিন লুথার কিং'এর হত্যার ঘটনায় বাবা সাংঘাতিক কষ্ট পেয়েছিলেন।
বাবা চলে গেছেন অনেকদিন। তারপর আমরাও তো কম দেখলাম না। বিশ্বের মানচিত্রে যে সব প্রাণ-উদ্দীপক ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে অবশ্যই একটি হল দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষী শাসনের অবসান এবং নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তি। আমরা যারা খেলাধুলোর জগতের খবর রাখতাম তারা দেখেছি এই জগতে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে কি লড়াইটাই না হয়েছে। কি ক্রিকেট কি ফুটবল কি বক্সিং কি অলিম্পিকের আসর, বারে বারে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বর্ণবিদ্বেষের আবহে। সব মিলিয়ে বর্ণবিদ্বেষ পিছু হটেছে সন্দেহ নেই।
সংবাদমাধ্যম বিবিসির কথাই ধরুন। ভিতরের খবর জানি না, কিন্তু বাহ্যত বিবিসি বর্ণবিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেয় না। কোনও ঘোষক বা কোনও আলোচক বর্ণবিদ্বেষের প্রসঙ্গ এনে বিবিসি'র চাকরি খুইয়েছেন এমন ঘটনা আছে। লক্ষ করে দেখবেন, ওদের সংবাদ পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে সমস্ত ধর্ম বর্ণ জাতির মানুষ আছেন। বিবিসি ব্রিটিশ কোম্পানি বলে শুধুমাত্র সাদা চামড়ার মানুষরা খবর পড়ছে ব্যাপারটা আজ আর তেমন নেই। তবে ব্রিটিশ সমাজে বর্ণবিদ্বেষ মুছে যায়নি। সাম্প্রতিক বিক্ষোভ তার প্রমাণ দিচ্ছে।
এত কথার অবতারণা সম্প্রতি আমেরিকা জুড়ে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যে ঝড় চলছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা গত প্রায় চার দশক ধরে অজস্র লেখা পড়েছি এবং নিজেরাও লিখেছি আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ প্রসঙ্গে। আমেরিকার ইতিহাসে কালো মানুষদের প্রসঙ্গ ও তাদের লড়াই বারে বারে উঠে এসেছে বিভিন্ন লেখায়। আমেরিকার দাস ব্যবসা, দাস ব্যবস্থা- তার বিরুদ্ধে লড়াই, আব্রাহাম লিঙ্কন, মার্টিন লুথার কিং এসব নিয়ে চর্চাও তো কম হল না। ওয়াকিবহাল মানুষ জানেন, আজও আমেরিকার বুকে সে দেশের সব থেকে শোষিত বঞ্চিত মানুষ কৃষ্ণাঙ্গরা। এই আফ্রিকান-আমেরিকানরাই দরিদ্রের সিংহভাগ। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আশ্রয় ইত্যাদি সব কটি নিরিখেই এরা পিছিয়ে। ভোটাধিকার থেকে ওরা বহুলাংশে বঞ্চিত। রাষ্ট্রযন্ত্রের ডাণ্ডাতন্ত্রের প্রধান শিকার সমাজের এই অংশ। জেলখানায় এদেরই ভিড় বেশি। আসলে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থেই আমেরিকার মুষ্টিমেয় শাসকশ্রেণি এই বর্ণবিদ্বেষী চিন্তাধারাকে টিকিয়ে রেখেছে। কিছু শিশু বড় হয়ে ওঠে কৃষ্ণাঙ্গদের ঘৃণা করতে করতে।
তবে অন্তত আমার কাছে এইসব কথা নতুন কিছু ছিল না। বরং একরকম হতাশা গ্রাস করেছিল এই ভেবে যে আর যাই হোক আমেরিকার বুকে কখনও কোনও বড় রকমের প্রতিবাদ আর হবে না। অবস্থার পরিবর্তন হবে না। কালো মানুষের দুর্দশা চলতেই থাকবে। আসলে মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়েছিলাম। ইতিহাসের উজান স্রোতের স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমেরিকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী যেন আমাকে ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিল। তাকিয়ে দেখতে বাধ্য করল প্রতিবাদ করার মানুষ আছে। মানুষ মরে যায়নি। আমেরিকা জুড়ে হাজারে হাজারে লাখে লাখে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। তাদের মধ্যে তরুণ-তরুণী বেশি। সংখ্যায় একটা বড় অংশ শ্বেতাঙ্গ। পুলিশের বেয়নটের সামনের সারিতে তারা। পিছনে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ।
আজ বুঝতে পারছি, আমেরিকান সমাজের ভিতর কত ক্ষোভ জমা হয়েছিল। বেশি অতীতে গিয়ে লাভ নেই। ২০০৮ সাল থেকে যে অর্থনৈতিক মন্দা মার্কিন সমাজকে গ্রাস করেছে তার ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যহীনতা ভয়ানক জায়গায় পৌঁছে গেছে। ধনী-দরিদ্রের আসমান জমিন ফারাক যখন প্রকট ঠিক তখনই দেখা দিল করোনা ভাইরাস। আমেরিকান রাষ্ট্র আজ চাইলে কাল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারে কিন্তু করোনা'র আক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচাতে চিকিৎসার ব্যবস্থাটাই তার নেই। এদিকে লকডাউনের কারণে অর্থনীতির অবস্থা ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছেছে। তার প্রধান শিকার তো সমাজের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, মিশ্র বর্ণের মানুষ। এই সব কিছুই প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে। শ্বেতাঙ্গ পুলিশের বুটের তলায় জর্জ ফ্লয়েড'এর শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা মার্কিন সমাজের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। আলোড়িত হয়েছে দুনিয়ার নানা প্রান্তও।
ব্যর্থতা আমার। এত ক্ষোভ জমা হয়েছিল বুঝতে পারিনি। আবার বলছি মানুষের উপর আস্থা রাখতে পারিনি।
লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteলেখাটি বড়ই ছুঁয়ে গেল। অসংখ্য ধন্যবাদ এমন লেখার জন্য।
ReplyDeleteA view, that carries that prolong question - the conflict of colours, how long, how far?
ReplyDeleteBBC world news er পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে সমস্ত ধর্ম বর্ণ জাতির মানুষ আছেন, কিন্তু বিবিসি১ ও অন্য চ্যানেল যেগুলি UK er দর্শকদের জন্য তৈরি হয়....সে গুলি....
ReplyDeleteLoved the lucid style of the write-up. The author covered racism from all possible perspectives but at the same time maintained the story telling style till the end. Obviously that not at all easy for a serious subject like racism.
ReplyDeleteI am also hopeful, just like the author, that the anti-racism protests around the world will bring racial justice very soon.
খুব জরুরি লেখা।
ReplyDeleteলড়াই তো শুরু. এই সময় এই লেখাটা ছাড়িয়ে দেওয়া জরুরি.
ReplyDelete