বৈষম্যের শিকড় ইতিহাসের গভীরে
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
২০০৮'এর সাব-প্রাইম সংকট ও তৎপ্রসূত উদার অর্থনীতি ও রাজনীতির দৈউলিয়াপনায় বিশ্বের বহু দেশে রক্ষণশীল ও বর্ণবাদী, জাতিবাদী, ধর্মবাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। কারণ, এর আগে তথাকথিত বিশ্বায়ন ও উন্নয়নের নামে গত দু' দশকে জল-জঙ্গল-জমি লুঠ ও উচ্ছেদের যে মোচ্ছব দেশে দেশে শুরু হয়েছিল তার একটা প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোনও কোনও দেশে সেই সুযোগে, অতএব, রক্ষণশীল ধরনের শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলি কমবেশি ক্ষমতায় আরোহন করে; যেমন, ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেন, ব্রাজিল, ফ্রান্স, রাশিয়া সহ আরও এমন বহু দেশে। কারণ, এদের তুরূপের তাস ছিল বর্ণ, ধর্ম, জাতি ও অনুরূপ ভিত্তিক বিবিধ চিরায়ত সামাজিক বৈচিত্র্যসমূহ, যাকে কেন্দ্র করে বৈচিত্র্যের মধ্যে অনৈক্য ও বিভাজন নির্মাণ করা যায়, যা খুব সহজেই এক কাল্পনিক শত্রু নির্মাণ করে বিষাদগ্রস্ত মানুষের মনে ক্ষণিকের প্রতিহিংসার আগুন জ্বালাতে পারে। ফলত, সে অভিঘাতে স্বভাবতই বিশ্ব জুড়ে নানাবিধ প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে থেকেছে। চকিতে কোভিড এসে গোটা অভিসারটিকে আরও মর্মন্তুদ করে তুলেছে।
কিন্তু, এতসব মর্মান্তিকতার মাঝেও কোথাও কোথাও মানুষের চেতনায় যে ঐক্যবদ্ধ সুর ও লড়াইয়ের মেজাজ প্রাণবন্ত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে স্বস্তির। রক্ষণশীল ও উগ্র বর্ণবাদী নিষ্ঠুরতায় যখন আফ্রিকান-আমেরিকান মধ্যবয়সী জর্জ ফ্লয়েডকে আমেরিকার মিনিয়োপলিসের পুলিশ গলায় হাঁটু চেপে নৃশংস ভাবে খুন করে তখন তার প্রতিক্রিয়ায় সারা বিশ্ব জুড়ে যে অভূতপূর্ব আলোড়ন উঠতে পারে তা হয়তো অনেকেই আন্দাজ করে উঠতে পারেননি। ইতিহাসের নির্মম গতিপথে যেন এই একটি স্ফুলিঙ্গই দাবানল জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। আর এই দাবানল ইতিহাসের শিকড়েও আগুন লাগিয়েছে- যেখান থেকে উদ্ভূত সমস্ত বিভাজন, অত্যাচার ও শোষণের সাংস্কৃতিক-সামাজিক অবয়ব তৈরি হয়। তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড ও তার প্রতিবাদে ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে যে নতুন পর্বান্তর অভিযান শুরু হয়েছে তার তাৎপর্য অসীম ও সুদূরপ্রসারী।
জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকারীকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়াই শুধু নয়, পুলিশি ব্যবস্থাকে আমূল সংস্কার করা, মিনিয়াপোলিস পুলিশকে defund ও disband করা, পুলিশি ট্রেনিং'এর খোলনলচে বদলে ফেলা, জনগণের স্বশাসিত এলাকা নির্মাণ করা- শুধমাত্র এটুকুও নয়, ইতিহাসের নাড়া ধরেও টান পড়েছে। শুরু হয়েছে ইতিহাসের অনুসন্ধান এবং মূর্তি ভাঙ্গা বা সরিয়ে ফেলারও এক সুতীব্র আন্দোলন। লন্ডন ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের কুখ্যাত দাস ব্যবসায়ীদের মূর্তি। এমনকি আমেরিকায় রিচমন্ডে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে কলম্বাসের মূর্তিও। এই কলম্বাসকেই এতদিন দেখানো হয়েছে আমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে। অথচ আমেরিকা আগে থেকেই ছিল এক উন্নত সভ্যতা রূপে যেখানে ইউরোপ থেকে কলম্বাসের বাহিনী গিয়ে লুঠপাট ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে নেটিভ আমেরিকানদের নিকেশ করে গোটা ভূখণ্ডের দখল নেয়। বর্তমান এই আন্দোলনের অভিমুখ দেখে মনে হবে, আজকের নতুন প্রজন্ম সমস্ত উপনিবেশবাদী, বর্ণবাদী ও দাসবাদীদের নিজ দেশের মাটি থেকে শিকড় সহ উপড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর। তারা বাংলার মন্বন্তরের কারিগর দাম্ভিক চার্চিলের মূর্তিকেও রেহাই দিতে নারাজ। এমনকি বৃটেনের ভারতীয়রা ভারত দখলকারী রবার্ট ক্লাইভের মূর্তিও অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। নিউজিল্যান্ড'এর হ্যামিল্টন শহরে ১৮৬০ সালে মাওরি জনজাতি নিধনে অভিযুক্ত জন হ্যামিল্টনের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় দাস-মালিক ও প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিসের মূর্তি। ব্রিস্টলে সপ্তদশ শতকের দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলস্টোন'এর মূর্তি ভেঙ্গে আন্দোলনকারীরা শহরের নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। মূর্তি ভাঙ্গা ও ইতিহাসের পুনর্বিচারের দাবি ছড়িয়ে পড়েছে বস্টন, নিউ ইয়র্ক, ব্রাসেলস, অক্সফোর্ড সহ ইউরোপ, আমেরিকা ও বিভিন্ন দেশের নানান প্রান্তরে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে, ৬০-৭০'এর দশকের মূর্তিভাঙ্গা আন্দোলনের কথা যেখানে মূল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাঠ নতুন ভাবে উঠে এসেছিল। কোনও আন্দোলন যখন অত্যাচারের শিকড় ধরে টান দেয় তখন তার ঘাত-প্রতিঘাত এইভাবেই সর্বব্যাপ্ত হয়।
বুঝতে হবে, আমেরিকার বর্ণ বৈষম্য এবং ভারতের ধর্মীয়, জাতিগত ও জাতপাতের নিপীড়ণ একই মানসিকতার সুতোয় বাঁধা। এ দেশেও খুব সহজেই একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে যে কোনও অপরাধ ও সমস্যার মূল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। পাশাপাশি, উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ, হিন্দু ধর্মের নিম্ন জাতি ও আদিবাসীদের একইভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির অধিবাসী বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা চলে। আর সে অজুহাতে তাঁদের ওপর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিপীড়ণ বহুকালের এক পরিচিত অনুশীলন। রক্ষণশীল শক্তির ক্ষমতায় আরোহনে এ নিপীড়ণ আরও তীব্রতর হয়েছে। তবে, কোভিড আজ সকলকে এক সারিতে দাঁড় করিয়েছে।
ইউরোপ-আমেরিকায় বর্ণ বৈষম্য বিরোধী এই তীব্র সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন কি নতুন দিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে? মনে হয়। ফলত, যে নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতির অবয়ব ও আঙ্গিক নির্মিত হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে তার গতিপথে লক্ষ রাখাই সকলের অভীষ্ট। উদ্দেশ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতির কতটা গণতান্ত্রিকীকরণ সম্ভবপর হল তার খতিয়ান রাখা। সে কাজ বহুধা বিস্তৃত ও অবশ্যই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন সাপেক্ষ। তরুণ প্রজন্মই একে সাদরে লালন করতে পারে। আমাদের দেশে অন্ধকার শক্তির সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার প্রসঙ্গ তাই আজ এতটাই জ্বলজ্যান্ত।
ভারতে বর্ণবৈষম্যের ইতিহাস আমেরিকার থেকে ঢের বেশি পুরনো, এবং এক অচলায়তন সদৃশ প্রতিষ্ঠান, যার পরিচয় রামায়ন থেকে শুরু করে ধর্মীয় রীতির মোড়কে হাজার হাজার বছর ধরে বহমান।আর্য-অনার্যের ভেদ, জাতিভেদ, বর্ণভেদ তথাকথিত ধর্মের আধারে আমাদের অস্থিমজ্জাকে পর্যন্ত বিষিয়ে দিয়েছে। আজ যে ধর্মীয় বিভেদের উৎকট প্রকাশে আমরা লজ্জা বোধ করতেও ভুলেগেছি, আর আত্মধিক্কারে জর্জরিত হই না, তার মূলও রয়ে গেছে আমাদের চেতনার শিকড়ে। আর শুধু বর্ণবৈষম্যের কথা ভাবলে আমাদের মতো বর্ণবিদ্বেশী জাতি পৃথিবীতে দ্বিতীয় মিলবে কিনা সন্দেহ। শুধু গায়ের রঙের কারণে আদিবাসীদের আমরা হেয় করি, আমাদের বাড়ির কালো মেয়েকে আমরাই অবলীলায় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করি। সুতরাং অন্যদের দিকে বাঁকা চোখে না তাকিয়ে আসুন আমরা আয়নার দিকে তাকানো অভ্যেস করি, যদি তাতে ক্ষীণতম পরিবর্তনও ঘটে।
ReplyDelete