স্কুল-পোশাকই কি শেষ পরিচয়?
প্রবুদ্ধ বাগচী
মূলধারার সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের একটা বড় সীমাবদ্ধতা হল, তারা সরকারের সমালোচনা করে বিবিধ খবর ছাপায় কিন্তু নানা ধরনের সরকারি প্রকল্প বা তার খুঁটিনাটি বিষয়ে সাধারণত খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। অথচ, সরকারের সমালোচনার চেহারায় যে সব সংবাদ প্রকাশ পায়, তার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি প্রকল্প বিষয়ে আরেকটু বিশদ তথ্য দেওয়ার দরকার পড়ে। তাই, রাজ্যের বহুল ও সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকেও এমন সব খবর মাঝে মাঝে বেরয় যাতে প্রকট হয়, সরকারি দফতরের সবটুকু সংবাদ প্রতিবেদক নিজেও জানেন না। কিন্তু সরকার-বিরোধী খবরের নিজস্ব একটা বাজার আছে, প্রধানত সেগুলিই আদপে ‘খবর’- কোথায় কোন সরকার কী প্রকল্প ঘোষণা করল, সাংবাদিক মহলের বিবেচনায় সেগুলো নাকি সচরাচর খবর নয়। ওগুলো নাকি পাঠক পড়তে চান না। সংবাদপত্রের পাতায় পাঠকের নাকি দাবি, সরকারের ভুল ত্রুটি ও সমালোচনা ধরনের সংবাদ।
সদ্য এই রাজ্যের পাবলিক ডোমেনে এমন একটা সংবাদ ঘুরপাক খাচ্ছে: রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দফতর সব সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলের ইউনিফর্ম নিজেরাই তৈরি করে সরবরাহ করবে বলে নির্দেশ দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রথমত পোশাকের রং হবে নীল-সাদা ও দ্বিতীয়ত তাতে সরকারের লোগো লাগানো থাকবে। যাবতীয় বিতর্ক এই দুই বিষয়কে ঘিরে। প্রথম প্রশ্ন, কেন নীল-সাদা? পরের প্রশ্ন, কেন লোগো? বলে রাখা প্রয়োজন, এই নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এতদিন ইউনিফর্ম তৈরির অর্থ সরকারের ওই দফতরই বরাদ্দ করত, যা সমগ্র শিক্ষা মিশন (পূর্বতন সর্বশিক্ষা মিশন) মারফত স্কুলের কাছে আসত। স্কুল তা তৈরি করিয়ে পড়ুয়াদের দিত বিনামূল্যে। পরিবর্তিত ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয়ভাবে এই তৈরির প্রক্রিয়াটা চলবে। যদিও বাস্তবে এত বড় রাজ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে এটা পরিচালনা করা অসুবিধে, তার একটা বিকল্প ব্যবস্থাও ভাবা হয়েছে- যদিও নিয়ন্ত্রণটা নির্দিষ্ট স্কুলের বদলে স্কুল শিক্ষা দফতরের হাতে থাকবে।
এই বদল কেন করা হল, তা নিয়ে নানা রকম মন্তব্য ভেসে বেড়াচ্ছে সংবাদপত্রে। অধিকাংশের মত, এটা নাকি কেন্দ্রীকরণের চেষ্টা। কথাটা হল, রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাটা তো একটা কেন্দ্রীয় কাঠামোর ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে- প্রতিটি ক্লাসের সিলেবাস এক, পাঠ্যবই এক- কেন্দ্রীয়ভাবে একই প্রশ্নপত্রে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাহলে পোশাক একরকম হলে মূল আপত্তি কোথায়? নীল-সাদা রংজুটি গত কয়েক বছরে রাজ্যের সরকারি রং হিসেবে একরকম স্বীকৃতি পেয়েছে, তাই পোশাকের রং নীল-সাদা হলে সমস্যা ঠিক কোথায়? নীল-সাদার বদলে যদি সবুজ-সাদা হয় তাতেও বিতর্ক বাঁধতে পারে; বস্তুত কোনও রঙের নির্বাচনই বিরোধ বা বিতর্কমুক্ত হবে, এমন ভাবা যায় না। আর, সরকার পোশাক তৈরি করে দিলে তাতে সরকারি লোগো থাকলেই বা অসুবিধে কোথায়? পুলিশের সরকারি ইউনিফর্মে অশোকস্তম্ভের ব্যাচ লাগানো থাকে, সেনাবাহিনীর প্রতিটি শাখার পোশাকে সেই বিভাগের লোগো লাগানো থাকে, এটাই রীতি। এই রাজ্যেও সবুজসাথীর সাইকেল বা কন্যাশ্রীর শংসাপত্রে ওই প্রকল্পগুলির লোগো ছাপানো থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি প্রকল্পেও উপভোক্তাদের জন্য প্রকল্পের সরকারি লোগো ব্যবহার করা হয়। রাজ্যের বিধায়ক বা কেন্দ্রের সাংসদ তাদের উন্নয়ন তহবিল থেকে কোনও প্রকল্প তৈরি করলে- রাস্তা, কালভার্ট, স্কুলের লাইব্রেরি, ক্লাসরুম, শৌচাগার ইত্যাদি- সেখানে সরকারি ফলক বসিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি কোভিডের টিকা নিলেও তার শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবি মুফতে পাওয়া যায়। তাহলে সরকারের অর্থে তৈরি পোশাকে সরকারি লোগো থাকলে তা নিয়ে এমন শোরগোল কেন, বোঝা মুশকিল।
অন্য আরও একটা কথা বলা হচ্ছে। রাজ্যের সরকারি ও সরকার পোষিত প্রায় সাড়ে আট হাজার স্কুলের নানা রকম ইউনিফর্ম আছে, সবার জন্য একরকম সরকারি রঙের পোশাক হলে স্কুলগুলি মনে করছে তাদের স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন লোপ পাবে। ইউনিফর্ম নিশ্চয়ই স্কুলের এক ধরনের পরিচয়, মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু ইউনিফর্মের ওপরেও অনেক স্কুল তাদের ছাপানো ব্যাজ বা পোশাকের ওপর স্কুলের লোগো ব্যবহার করে, এগুলোও একভাবে স্কুলের পড়ুয়াদের চিহ্নিত করে। সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি পোশাকে সরকারি লোগো থাকলেও, সেটা ছাড়া স্কুলের আলাদা লোগো বা ব্যাজ ব্যবহারে কোনও নিষেধ নেই। সরকারি পোশাকের ওপরেও স্কুল তাদের নিজস্ব লোগো লাগিয়ে নিতে পারে, নির্দিষ্ট ব্যাজ ব্যবহার করতে পারে- তারপরেও এই ব্যবস্থা কি স্কুলের স্বাতন্ত্র্যের ওপর খুব বড় ধরনের আঘাত বলে বিবেচিত হবে?
আসলে এই পর্যন্ত যা বলা হল তা গোটা বিষয়টার উপরিতলের কথা। এই ভাবনার পেছনে একটা অন্য বিবেচনা আছে। রাজ্যের স্কুলগুলির মোট পড়ুয়া সংখ্যা প্রায় এক কোটি পনের লক্ষ, এদের পোশাক পিছু বরাদ্দ বছরে ছশো টাকা হিসেবে স্কুলের পোশাক বাবদ সরকারকে ৬৯০ কোটি টাকা বছরে খরচ করতে হয়। শিক্ষা দফতরের ভাবনাটা হল, এই বিপুল বাজারের পুরোটাই সরকারি উদ্যোগে ব্যবহার করা। ১.১৫ কোটি পোশাক তৈরি করতে প্রয়োজন হয় প্রচুর কারিগর ও সেলাই জানা কর্মী। রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের যদি এই প্রকল্পে যুক্ত করা যায়, তাহলে এই বিপুল সরকারি অর্থের পুরোটাই তাঁরা তাঁদের উৎপন্ন পোশাকের একটা নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত বাজারের মাধ্যমে নিজেদের কাছে ফেরত আনতে পারেন। এতে নতুন কাজের সুযোগ যেমন আছে, তেমনি স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি মুনাফা করলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার একটা ইতিবাচক ছাপ পড়া অসম্ভব নয়। বিশেষ করে, গত দু’ বছরের কোভিড পরিস্থিতি যেভাবে প্রান্তীয় মানুষদের জীবনযাত্রায় বিপদ ডেকে এনেছে, এই সিদ্ধান্ত তাতে কিছুটা সুরাহার পথ দেখাতে পারে- বছরে প্রায় সাতশো কোটি টাকা খুব একটা কম অর্থ নয়, সরকার এই নিশ্চিত বাজারের রাস্তা তাঁদের সামনে খুলে দিলে সেটা তাঁদের একটা বড় সহায়।
আরেকটা তথ্য, হয়তো সর্বজ্ঞ সাংবাদিকরা জানেন না যে বেশ কিছু বছর ধরে সরকারি দফতরের বরাদ্দ অর্থ সরকারি সংস্থাগুলির মাধ্যমে খরচ করার একটা নীতি চালু আছে। স্কুল শিক্ষায় মিড-ডে-মিল পরিচালনার ভার অনেক ক্ষেত্রে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাতে। আইসিডিএস’এর পুষ্টি প্রকল্পে খাদ্যশস্য সরকারি অত্যাবশকীয় পণ্য নিগম বা বড়-মাঝারি-ছোট সরকারি সমবায়ের মাধ্যমে কেনা হয়। স্বাস্থ্য এবং নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের অধীন আশা ও অঙ্গনওয়ারী কর্মীদের পোশাক, অ্যাপ্রন সরবরাহ করে তন্তুজ ও মঞ্জুষা- দুটিই রাজ্য সরকারি সংস্থা। প্রসঙ্গত বলা দরকার, এক সময় বাম আমলে গ্রামীণ তন্তুবায়দের সামনে বৃহত্তর বাজারের সুযোগ খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে তন্তুজ বা মঞ্জুষা প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে পরিচালন ব্যবস্থার ত্রুটিতে প্রতিষ্ঠানগুলি কার্যত সাদা হাতিতে পরিণত হয়, বামফ্রন্টের শেষ পর্যায়ে তন্তুজ ও মঞ্জুষা ক্ষতিতে চলত। গত কয়েক বছরে তন্তুজ বা মঞ্জুষার মতো প্রতিষ্ঠানগুলি ঘুরে দাঁড়িয়ে লাভের মুখ দেখছে। কোভিড পরিস্থিতিতে গ্রামের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে দিয়ে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করিয়ে বহু সরকারি দফতর, হাসপাতাল তাদের পণ্য কিনে গোষ্ঠীগুলির কাজের আর্থিক বুনিয়াদকে কিছুটা পোক্ত করার চেষ্টা করেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে কলকাতায় ‘সরস মেলা’ আয়োজন করে এদের বিভিন্ন পণ্যকে বড় ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কার্যত স্কুল পোশাকের সঙ্গে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংযুক্তি এই নীতিরই একটা অঙ্গ।
এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, রাজ্যে জীবিকার সংকট ও শিল্পের আকাল নিয়ে যে সব প্রশ্ন জনপরিসরে ভেসে বেড়ায় তার মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি আছে। আজ আমাদের অর্থনীতি যেভাবে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে খুব বড় মাপের শিল্প এসে প্রচুর জীবিকার সুযোগ খুলে দেবে এ প্রায় একটা মরীচিকা। গিগ-অর্থনীতির নিজের নিয়মে বড় ও নিশ্চিত রোজগারের জায়গা প্রবলভাবে সংকুচিত। ফলে, এর বিকল্প একমাত্র ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের শিল্প যাতে জীবিকা ও রোজগারের সুযোগ বেশি। রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি সেদিক দিয়ে কিছুটা আশার আলো দেখাতে পারে, যাদের রোজগার বৃদ্ধির সঙ্গে গ্রামীণ মহিলাদের আর্থিক ক্ষমতায়নের বিষয়টাও জড়িত। বাম আমলে যখন বড় শিল্পের জয়গান গাওয়া হচ্ছিল তখনও কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে সব থেকে বেশি। গত এক দশকে বর্তমান রাজ্য সরকারও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। সব মিলিয়ে যে বিষয়টা নিয়ে একটা একমুখি ভ্রান্ত বিতর্ক উস্কে দেওয়া হচ্ছে, এটা বেশ স্পষ্ট।
যে সব স্কুল পুরোটাই সরকারি অনুদানে পরিচালিত, তারা শুধুমাত্র নিজেদের বিশেষ রঙের পোশাক দিয়েই নিজেদের স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন আঁকড়ে রাখতে চান- ব্যাপারটা বেশ কৌতুকের! স্কুল মানে কি কেবল তাদের বিশেষ পোশাক? আর কিছু নয়? বৃহত্তর অর্থনীতির স্বার্থে তারা না হয় তাদের এই আবদার কিছুকাল মুলতুবিই রাখল। শিক্ষার কি খুব বড় মাপের ক্ষতি হয়ে যাবে তবে?
No comments:
Post a Comment