এসো, রক্ত মুছে গুলাল মাখি...
অমৃতা ঘোষাল
সব উৎসব নির্ভেজাল ক্ষীরের মতো হয় না। কিছু উৎসবের আওয়াজ হয় 'ঝপাৎ', 'চকাম', 'চকাস', 'ফটাস', 'ফুচৎ' কিংবা 'গ্লাব'! যেমন, হোলি। ওই দিন আমাদের পবিত্র(?) দেশের প্রান্তে প্রান্তে ওই আওয়াজগুলোর সঙ্গে ঘুরে-ফিরে আসে ধ্রুবপদের মতো একটা লাইন- 'বুরা না মানো, হোলি হ্যায়'। একটু মাথা ঘুরিয়ে দেখা যাক।
• ১৩ মার্চ ২০১৭, সোমবার। সেদিন ছিল হোলি। দিল্লির গোবিন্দপুরী এলাকার ছয় বছরের মেয়ে ধর্ষিতা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ধর্ষকের একটা নাম 'মন্ত্র' ছাড়া সেই শিশুটি আর কোনও কিছুই মনে করতে পারে না।
• ২ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার। হোলি। কাঠুয়া কাণ্ডের বীভৎসতার স্মৃতি যখন দগদগে, তখনই ঘটল। দেরাদুনে ডিএল রোডে দশ বছরের একটা মেয়ে এক তেইশ বছরের পুরুষ আত্মীয়ের কাছে ধর্ষিত হয়। সেই যুবক যথাসম্ভব ভয় দেখায় তাকে চুপ থাকার জন্যে, তবু সে তার বাড়িতে সমস্তটা জানায়।
• ২১ মার্চ ২০১৯, বৃহস্পতিবার। তেলেঙ্গানার তুর্কপল্লিতে ছয় বছরের শিশুকন্যা হোলি খেলার জন্যে বাইরে বেরয়। তারপর নিখোঁজ। ক্রমশ মেয়েটার ক্ষতবিক্ষত ধর্ষিত মৃতদেহ মেলে ঝোঁপের মধ্যে।
• ১০ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে হোলির দিন, নয় বছর বয়সী একটা মেয়ে গানের অনুষ্ঠান 'ফাগ'এ যায়। তারপর তাকে ধর্ষিত আর অচেতন অবস্থায় একটা ক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয়। ধর্ষণের পর মেয়েটাকে শ্বাস বন্ধ করে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল।
• ২৯ মার্চ ২০২১, সোমবার। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে এবার এক দলিত কিশোরীর গ্যাংরেপ ঘটে। মুখে ঘুমের ওষুধ দেওয়া কাপড় গুঁজে, অচেতন করে, সারা রাত তাকে ধর্ষণ করা হয়। পরদিন ভোরে গ্রামের বাইরে সেই প্রবল আহত মেয়েটাকে ধর্ষকরা ফেলে রেখে আসে।
হোলি সেই অনুষ্ঠান যেখানে রঙিন ছদ্মবেশে খুব সহজে দেহ স্পর্শের অনুমতি মেলে! তুলতুলে দেহ কিংবা আরও বেশি করে প্রতিবাদ করতে না পারা দেহ। তাই শিশুরাই প্রবলভাবে হোলির অন্ধকার দিকটার শিকার হয়। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বহু নারী এখন খোলাখুলি লেখেন যে, ওই উৎসবে ঘটে যাওয়া শৈশবের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা তাদেরকে হোলি-বিমুখ করে তুলেছে। অত্যাচারের একটা প্রারম্ভিক অধ্যায়ও থাকে। রঙ ভর্তি বেলুন নারীদেহের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ লক্ষ করে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। এরপর রঙ মাখানোর সময়ে চলে নারী-অঙ্গকে নিজের ইচ্ছা মতো ব্যবহার করার একটা উৎসব। আরও ব্যাপারটা জান্তব হয়ে ওঠে যখন রঙিন ছদ্মবেশে, প্রায় অচেনা হয়ে থেকে এগুলো ঘটানো যায়। প্রায় ছয় বছর আগে দিল্লির পুলিশ কন্ট্রোল রুমে হোলিকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩৫,০০০ অভিযোগ জমা পড়েছিল। তার মধ্যে বিশেষ করে ১১টা মৃত্যু, ২১টা ধর্ষণ, ২১১টা ইভটিজিং, ৪৬টা রাস্তার বিক্ষিপ্ত গোলযোগ, ৪০টা বন্দুক-বোমাবাজির ঘটনা আর ১৪২টা আঘাত করার ঘটনাও ছিল।
এবার ভাবা যাক, হোলির জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে। 'সিলসিলা' (১৯৮১) ছবির 'রং বরসে ভিগে চুনরওয়ালী' থেকে 'ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি' (২০১৩)-এর 'বলম পিচকারী'- এই 'হোলি-সং'গুলোর ভঙ্গিটুকু উল্টেপাল্টে দেখা যাক। প্রথম গানটায় স্পষ্ট করেই বলা হল- 'বেলা চামেলী কে সেজ বিছায়া/ সোয়ে গোরি কা ইয়ার/ বলম তরসে'। আর দ্বিতীয় গানটায় রয়েছে- 'তেরি কলাই হ্যায় হাতো মে আই হ্যায়/ ম্যায়নে মরোড়া তো লাগতি মালাই হ্যায়'। এই গানগুলোতেও প্রত্যক্ষভাবেই বলা হল হোলিতে উদ্দেশ্যপূর্ণ ভাবেই নারীসঙ্গম করার কথা l আবার গানের কথাগুলোর তালে অনুকূল তাল মিলিয়ে চলছে সেখানে নায়িকারাই। 'মহব্বতেন' (২০০০) ছবির 'সোনি সোনি আঁখিওয়ালি', 'ওয়াক্ত'(২০০৫)'এর 'ডু মি আ ফেভার/লেটস প্লে হোলি'- এই প্রত্যেকটাতেই যৌন উদ্দীপকের প্রয়োগ বেশ প্রবল। আর উপস্থাপনা খানিকটা এইরকম যে, হোলিকে কেন্দ্র করে একজন নাছোড়বান্দা পুরুষ নায়িকাকে মানিয়ে গুছিয়ে বেশ সম্ভোগের উপাদান বানাবে। এই গানগুলো যে ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় আর হোলিতে আমরা সবাই শুনি, তা বলাই বাহুল্য। এতটাই উঁচু ভলিউমে শুনি যে অত্যাচারের শিকার হওয়া শিশু-নারীদের আওয়াজ সেখানে চাপা পড়ে যায়।
অবশ্য আওয়াজ চেপে ধরার আরেকটা কৌশল আছে। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার এক লাফে ওই দিন অনেকটা বেড়ে যায়। ভাং-মিশ্রিত লস্যি কিংবা ঠাণ্ডাই তো হোলির অনিবার্য অঙ্গ। ভাং কিংবা মদ খেয়ে ও খাইয়ে টার্গেট করা শিশু কিংবা নারীটিকে ব্যবহার করার পদ্ধতিটা তো আরও সহজ। এছাড়াও ড্রাগ ব্যবহারের প্রবণতাও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে অনেকটাই বেড়ে যায়। অন্যদিকে জল কিংবা রং ভর্তি বেলুন ছাড়াও নারীদেহে নিক্ষেপ করার তালিকায় চলে আসে কাদা, গোবর কখনও বা ডিম। তাই নারী কিংবা শিশুর রক্ত হোলি খেলার উপাদানে যুক্ত হলে হয়তো উল্লাসের নেশা আরেকটু বেড়ে যায় !
একটা অন্য হোলির গল্প শুনি এবার। 'লাঠমার হোলি' এই উৎসবের নাম। মূলত উত্তরপ্রদেশের মথুরায় বরসনা আর নন্দগাঁও শহরে এই উৎসব হয়, মূল হোলির চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই। 'লাঠ' শব্দের অর্থ লাঠি আর 'মার' অর্থাৎ আঘাত। উৎসবের পেছনে থাকা মিথটা খানিকটা এইরকম- শ্রীকৃষ্ণ হোলির সময় নন্দগাঁও থেকে বরসনায় এসেছেন। প্রত্যেক গোপীর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ, কিন্তু শুধু শ্রীরাধার চন্দ্র-আননেই তিনি কৌশলে রঙ মাখান। এতে অন্যান্য গোপীরা রেগে যান ও বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করে অপরাধী শ্রীকৃষ্ণকে বরসনা থেকে বিতাড়িত করেন। সেই কাহিনির একটা বিনির্মাণ করার চেষ্টা করা হয় এখনও। পুরুষেরা সাধ্যমতো নারীর লাঠির আঘাত সহ্য করেন, সেটাই রীতি। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলে এই উৎসব। সহৃদয় যে কেউ অবশ্য বুঝতেই পারবেন যে, কোনও নির্লজ্জ আচরণের কারণে নারীর থেকে আত্মরক্ষার সন্দর্ভ রয়েছে এই উৎসবের পরতে পরতে।
তাই হোলি হয়ে উঠুক সম্ভ্রমসূচক এক উৎসব, যেখানে নারী আর শিশুরা থাকবে সুরক্ষিত। আর যদি তা না ঘটে, তবে বলতে হয়- 'বুরা মানো, হোলি হ্যায়'।
আমাদের সমাজে যেগুলোকে দেখার পরেও না দেখার ভান, শোনার পরেও না শোনার ভান করতে থাকে। কিন্তু ম্যাডাম, আজ আপনি সেই ছদ্মবেশী, রঙিন মুখোশ আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরলেন। খুব খুব ভালো লাগলো আমার। ধন্যবাদ ম্যাডাম
ReplyDeleteলেখাটা খুবই ভালো লাগলো এবং আমি মনে করি বর্তমান সময়ে আমাদের সকলকে সচেতন থাকতে হবে যাতে ভবিষ্যতে(বর্তমানেও) এরকম নোংরা-জঘন্য কাজ যাতে আর না ঘটে; শুধু তাই নয় দোষীদের চিহ্নিত করে এমন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত যাতে আর কেউ এরকম কাজ করতে সাহস না পায়।🌱
ReplyDelete