Friday, 11 March 2022

পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন

পথেই হচ্ছে এ পথ চেনা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কি কিছুটা অভাবিত ফল হল? অর্থাৎ, অনেকেই ভেবে রেখেছিলেন, এবারে বিজেপি’র পরাজয় সুনিশ্চিত। এমনকি আমিও। এই ভাবার পেছনে যে মানদণ্ডগুলি কাজ করেছিল, বাস্তব তথ্য আহরণের যে পদ্ধতিগুলি ইস্তেমাল করা হয়েছিল, যা আগের কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনেও প্রয়োগ করে আমাদের আন্দাজ মিলে গিয়েছিল, তা এবারে মিলল না! কেন? কারণ, নিত্য পরিবর্তিত সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির দৈনন্দিন হালহদিশ না রাখতে পারলে, মানুষের ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে সম্যক পরিচয় না থাকলে, পিছিয়েই পড়তে হয়। অতএব, আরও নতুন কিছু জানার ও শেখার আছে।

প্রথমেই আমরা সহজ-সরল একটা সমীকরণ করে ফেলেছিলাম যে, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে যেহেতু দীর্ঘকালীন এক ব্যাপক কৃষক আন্দোলন হয়েছে, ফলে, জাত-ধর্মের উর্ধ্বে উঠে কৃষক সমাজ বিপুল ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে এসপি-আরএলডি জোটকে ভোট দেবে। তা মোটে হয়নি। এ প্রসঙ্গে কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত ফলাফল ঘোষণার পরদিন এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন যে, আন্দোলন আর নির্বাচন- এই দুটিকে আলাদা করে দেখতে হবে। তিনি নিজেও জানেন না, তাঁর পরিবারের সদস্যরা কাকে কোথায় ভোট দিয়েছেন। আন্দোলনে কৃষকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, তার মানে এই নয় যে নির্বাচনেও সকলে একইভাবে ভোট দেবেন; ভোট দেওয়ার সময় নানা ধরনের মাত্রা ও বিষয় মানুষের মধ্যে কাজ করে বলে তাঁর অভিমত। কথাগুলির মধ্যে যৌক্তিকতা আছে। যে কারণে, বিজেপি’র নেতারা নির্বাচনী প্রচারের সময় নানান জায়গায় বলে বেড়িয়েছেন, কৃষকেরা আন্দোলনের কথা ভুলে গিয়েছে।

এইখানে একটি প্রশ্ন উঠবে। প্রায় সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে, বিজেপিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে কংগ্রেস সার্বিক ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলি বহু ক্ষেত্রে বিজেপিকে পর্যদুস্ত করতে সক্ষম। এর কারণ কী? সোজা উত্তর হল, রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস ও তার নেতৃত্ব একেবারেই অপদার্থের চূড়ান্ত, রাজনীতিকে তাঁরা দায়িত্বপূর্ণ উপায়ে নিতে অপারগ, তাদের শীর্ষ নেতা দুদিন পর পরই (এমনকি টগবগে নির্বাচনী প্রচারপর্বেও) বেশ কয়েক সপ্তাহের জন্য বিদেশে বেপাত্তা হয়ে যান, অন্তর্দলীয় কোন্দলে তাঁরা দীর্ণ, নির্বাচন পর্ব ছাড়া এই দলের কর্মী ও নেতাদের কোনও কাজে দেখা যায় না এবং অধিকাংশ সময়ে জনপরিসরে তাঁরা অদৃশ্য থাকেন। কিন্তু কতকটা এমন ধরনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তো অখিলেশ যাদব সম্পর্কেও  উঠেছিল। নির্বাচন ঘোষণার দু-তিন মাস আগ অবধি তিনি এই নির্বাচনকে খুব যে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন, তা নয়। ফলে, প্রধান প্রতিপক্ষ খেলা শুরুর আগে এমন একটা গা-ছাড়া ভাব নিয়ে আসরে নামল যে পরে নিজেদের পোক্ত হতে হতে বিজেপি বহু দূর অবধি খেলাটাকে এগিয়ে নিয়ে চলে গেছে।

এ তো গেল নিজেদের দুর্বলতার কথা। কিন্তু কিছু ধারণাগত ভুলও যে সমান তালে বহমান তার হদিশ কে রাখছে! যে রাজ্যের আদ্যোপান্ত মানসিকতায় বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিকতা মহিলাদের স্বাধীন সত্তা হিসেবে দেখতে নারাজ, সেই তালেই তাল রেখে এমনকি প্রগতিবাদীরাও ধরে নিলেন যে, যেহেতু মুসলমানেরা বিজেপির কাছে ব্রাত্য, অতএব, গোটা মুসলমান সমাজের ভোট, এমনকি মুসলমান মহিলাদের ভোটও বিরোধীদের ঝুলিতেই পড়বে। ২০১৭ সালের ভোট দেখেও বিরোধীরা শিক্ষা নেননি। ওই নির্বাচনের পর সাবা নাকভি একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন যে, বহু জায়গায় দলে দলে মুসলমান মহিলারা বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। এবারেও দেখা গেল, মুসলমানদের একটা অংশ (মূলত মহিলারা) বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। এর পেছনে অন্যতম কারণ হল, মোদি কর্তৃক তিন তালাক প্রথার অবসানের পদক্ষেপ এবং মহিলাদের অধিকার বিষয়ে বিজেপির নানাবিধ প্রতিশ্রুতি। সবচেয়ে বড় কথা, জাতপাত-ধর্ম নির্বিশেষে উত্তরপ্রদেশের মহিলাদের একটা অংশের বিশ্বাস হয়েছে যে আগের তুলনায় তাঁদের সুরক্ষা বেড়েছে। যদিও হাথরস, উন্নাওয়ের মতো ঘটনা ঘটেছে কিন্তু হয়তো তাঁরা সেগুলিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে অথবা আগের তুলনায় সংখ্যায় কম বলে আস্বস্ত বোধ করেছেন। এছাড়াও, বিনামূল্যে দুয়ারে রেশন প্রকল্প মহিলাদের ভরসা জুগিয়েছে। আর এইসব ধারণা গড়ে তোলার জন্য আরএসএস বাহিনী তৃণমূল স্তরে লাগাতার প্রচারকাজ চালিয়ে গেছে।

এখন কেউ কেউ আছেন, যারা মনে করেন, জনগণ তাঁদের ‘ঠিক’ (পলিটিকালি কারেক্ট) কথাগুলি শুনে চলবে। না শুনলে, না মিললে, ‘মর গে যা’ বলে তাঁরা হাঁটা দেবেন উলটো পথে। এঁরা যাই হোক, রাজনীতি করা মানুষ নন। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয়ে তাজ্জব বনে কিছু উলুখাগড়াকে দেখছি, এটা সেটা বলে, আসলে উত্তরপ্রদেশের মানুষ ‘মনুষ্য পদবাচ্য নয়’ বলেই তাঁরা দেগে দিচ্ছেন। তাঁরা মনে করেন, একটা নির্বাচন দিয়েই সব সমাধা করে ফেলবেন। কারণ, তাঁদের সারা বচ্ছর কোনও কাজ নেই। তাই, তাঁদের মুখে ঝাঁটা মেরে রাজনীতি যেদিকে বওয়ার সেদিকেই বইছে। বরং, ক্ষীণদৃষ্টি না হলে দেখা যাবে, সম্ভাবনার একেকটি আগলকে তা খুলে দিচ্ছে।

বুঝতে হবে, সংগঠিত, অর্থবান ও তৃণমূল স্তরে বিস্তৃত শাসক দলের (বিজেপি) বিরুদ্ধে অগোছালো এক দুর্বল প্রতিপক্ষ (এসপি) যখন মাঠে নামল তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তবুও মানুষ সাড়া দিয়েছেন। ফলাফল থেকে দুটি স্পষ্ট বার্তা উঠে এসেছে: এক) ২০১৭ সালের তুলনায় বিজেপি জোটের আসন এবারে প্রায় ৫০+ নেমে গেছে এবং দুই) সমাজবাদী পার্টি প্রধান বিরোধী পক্ষ হিসেবে নিজেদের আসন সংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশি বাড়িয়ে (২০১৭ সালের নির্বাচনের তুলনায়) আগামী নির্বাচনে ভোট বিভাজনের সম্ভাবনাকে প্রায় নির্মূল করে দিয়েছে। এই দ্বিতীয় মাত্রাটিই হল এবারের নির্বাচনে বিরোধীদের আসল প্রাপ্তি যেখানে আগামী দিনে সারা বছর ধরে সমাজবাদী দলকে মানুষের যাপনে ও আন্দোলনে সবাক ও সক্রিয় থাকতে হবে। যদি আবারও তারা হেলায় ঘুরে বেড়ায়, তাহলে অশেষ দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।

সেই সঙ্গে পঞ্জাবে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে। অনেকেই ভেবেছিলেন, আপ এবারে জিতবে। কিন্তু ১১৭টি আসনের মধ্যে ৯২টি আসন পেয়ে তারা এইভাবে বিপুল জয়লাভ করবে, তা কেউই প্রত্যাশা করেননি। কীভাবে এটা সম্ভব হল? সারা বচ্ছরকার কাজ দিয়ে। প্রথমত, আমরা জানি, দিল্লি ও পঞ্জাবের মধ্যে এক নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে- তা শুধু নিত্য চলাচলের নিরিখেই নয়, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিত্তিতেও। তাই, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার দিল্লিতে যে উল্লেখযোগ্য জনকল্যাণের কাজগুলি করেছেন তার বিশাল প্রভাব পঞ্জাবের মানুষের ওপর পড়েছে। দ্বিতীয়ত, দিল্লির সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকদের (যাদের এক সুবৃহৎ অংশ পঞ্জাব থেকে এসেছিলেন) আপ ও দিল্লি সরকারের পক্ষ থেকে নীরবে নানা ধরনের দৈনন্দিন সহায়তা ও সমর্থন প্রদান করা হয়েছে যা কৃষকদের আন্দোলনকে বহু গুনে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করেছে। এই সহমর্মিতা ও মানবিকতাকে পঞ্জাবের মানুষ স্বীকৃতি দিয়েছেন। অথচ, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলনের পাশে কিন্তু আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি ছাড়া সমাজবাদী দলের নেতা-কর্মীদের সে ভাবে পাওয়া যায়নি। যদিও তাদের জোটসঙ্গী আরএলডি হয়তো বা কিছুটা বেশি সক্রিয় ছিল।

সবটা মিলিয়ে উত্তরপ্রদেশ ও পঞ্জাবের ২০২২’এর বিধানসভা নির্বাচন আগামী দিনে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা হতে চলেছে। বিজেপি উত্তরপ্রদেশে খর্বিত জয় পেলেও এই ফলাফল যে তারা ২০২৪’এও অটুট রাখতে পারবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। একক বিরোধী দল হিসেবে সে রাজ্যে সমাজবাদী দলের উত্থান একটি বিশেষ ঘটনা যা সময়ের ব্যবধানে তাদের আরও রাজনৈতিক প্রস্তুতি ও কার্যক্রম গ্রহণের দিকে প্ররোচিত করবে, আরও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে আসতে।

বলাই বাহুল্য, সারা দেশ জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় আধারে আঞ্চলিক বিরোধী দলগুলির এক ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে ওঠার বস্তুগত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেই আলোকেই আগামী রাজনীতির ঘুর্ণাবর্ত নির্মিত হবে। আপ ইতিমধ্যেই মিশন গুজরাত ও মিশন হিমাচল প্রদেশ’এর কার্যসূচি গ্রহণ করেছে। ২০২২’এর শেষে এই দুটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সেদিকে আমাদের সকলের চোখ থাকবে। বিভাজনের রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে দেশ জুড়ে যে চরম স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির দাপট চলেছে, তার বিরুদ্ধে যখন বামেরা অত্যন্ত দুর্বল তাঁদের ক্ষীণদৃষ্টির কারণে, তখন ভগৎ সিং, আম্বেদকর, নেতাজী ও ইনকিলাবি সমাজবাদী ধারা নিশ্চয়ই একটা আপাত পথ দেখাবে। পঞ্জাবের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে তিনি ভগৎ সিং’এর গ্রামে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্বের শপথ নেবেন। আপ’ও জানিয়েছে, ভগৎ সিং ও আম্বেদকরের চেতনার ওপর দাঁড়িয়েই তারা তাদের সরকার ও দলের কার্যকলাপ পালন করবে। বলাই যায়, এক নতুন যাত্রাপথের দিকে উন্মীলিত হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতি। যারা হতাশাগ্রস্ত, ক্ষীণদৃষ্টি, তাঁরা বরং শোকে কাতর থাকুন।  

      

1 comment:

  1. বামেদের আরো আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি আর কতদিন? ফ‍্যাসিবাদ বিরোধিতার নামে মুড়ি মুড়কির এক দর করা আর কতদিন?

    ReplyDelete