‘পুড়ছে পুড়ছে ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে...’
সোমনাথ গুহ
সকালবেলায় সংবাদপত্রে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি দেখে প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালকের বিখ্যাত ছবির সেই হাহাকার মনে পড়ে যাচ্ছিল। বগটুই গ্রামের দগ্ধ হয়ে যাওয়া লাশগুলো মধ্যরাতে বিভীষিকা হয়ে নিদ্রায় হানা দেয়। নারী পুরুষের কান্না দিনরাত কানের কাছে একটা ঘ্যানঘ্যানে রিংটোনের মতো বেজে চলে। ভ্যান ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে মানুষের প্রস্থান দেখে মনে হয় এ যেন এশিয়ার ইউক্রেন- যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা থেকে মানুষ পলায়ন করছে। আলুথালু বেশে শোকে বিহ্বল নারীর কাতর অনুযোগ বারবার স্মৃতিতে ফিরে আসে- এ কোন রাজ্যে বাস করছি আমরা? কাকে মানুষ উপুড় করে ভোট দিয়ে তৃতীয় বার মসনদে বসাল?
সাফল্য তৃণমূল কংগ্রেসের মাথায় চড়ে গেছে। নির্বাচনে ড্যাং ড্যাং করে জিতে যাবার পর তারা এখন হাতির পাঁচ পা দেখছে। তারা যেন বাংলার নবাব আর পুরো রাজ্যটা তাদের জায়গির। বিরোধীদের ঠুসে দিয়ে তারা এখন নিজেদের মধ্যে রক্তের হোলি খেলায় মেতেছে। দলের মধ্যে যার যত জোর তার তত কামাই। মধ্যযুগের মতো বিভিন্ন এলাকা ওয়ারলর্ডদের মধ্যে ভাগ করা- তাদের অধীনে অসংখ্য তোলাবাজ যারা ঐ প্রভুদের নিয়মিত নজরানা দেয়। সম্পদ তো সীমিত, তা নিয়ে কামড়াকামড়ি চলে। উপঢৌকনে ঘাটা পড়লে প্রভু একজনকে হটিয়ে আরেকজনকে তুলে আনে; নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। যে তাদের কথা শুনবে না, বিরোধিতা করবে, তারা খালাস! তারপর বলবে, চোপ সরকার চলছে! পার্টি এর সঙ্গে যুক্ত নয়, ওসব পারিবারিক বিবাদ, আত্মহত্যা, গভীর ষড়যন্ত্র, বাংলার বদনাম করছে! কার্টুনের চরিত্রের মতো নেতারা টিভির সামনে হাজির হয়, মুখ দেখে মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। মানুষকে তারা বোকা ভাবে; ভাবে ভেড়ার দল, যা বোঝাব তাই বুঝবে। যে নেতার নিজের মস্তিষ্কে অক্সিজেন কম, সে বড় নেতার পাশে বুড়ো খোকার মতো মাথা নাড়ায় আর টিভি-বিস্ফোরণের তত্ত্ব দেয়। তারা জানে না মানুষ সব দেখছে, বুঝছে, যখন রাজনৈতিক প্রত্যাঘাত করবে পালিয়ে কুল পাবে না। সে অভিজ্ঞতা এ রাজ্যে কংগ্রেস ও সিপিএমের যথেষ্ট হয়েছে।
ভেবে দেখুন, আনিশ খানের মৃত্যু হয়েছে ১৯ ফেব্রুয়ারি; মাত্র দু' সপ্তাহ বাদে পূর্ব বর্ধমান জেলার বাবুবাগ এলাকার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে সতের বছরের কিশোরী তুহিনা খাতুনকে দিনের পর দিন সর্বসমক্ষে লাঞ্ছনা ও যৌন হেনস্থা করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করল ওই এলাকার কাউন্সিলার বশির আহমেদ। তুহিনার কাহিনি কোনও অংশে হাথরসের থেকে কম নৃশংস? তুহিনা তাঁর দুই দিদি ঝর্ণা বিবি ও কুহেলি বিবির সাথে থাকতেন। দিদিদের স্বামীরা কাজের সূত্রে অধিকাংশ সময় বাইরে থাকতেন। তুহিনার মা নেই, বাবা ধনাই শেখ দ্বিতীয় বিবাহ করে খাগরাগড়ে থাকেন; তিনি নিয়মিত মেয়েদের খোঁজখবর রাখেন। ধনাই বশিরের বিরোধী গোষ্ঠীর লোক। বশির পৌর নির্বাচনের টিকিট পাওয়ার পর শুরু হয় ওই তিন বোনের ওপর অত্যাচার। বাড়ির সামনের দেওয়ালে তিন বোনের ছবি আঁকা হয়। ঐ ছবির ওপর বশিরের ছেলেরা হাত বোলায়, চুমু খায়, সোহাগ করে, যৌন ইঙ্গিত করে, কুৎসার বন্যা ছোটায়। বশিরের বিজয় মিছিল থেকে তুহিনাদের বাড়ির সামনে বোমা মারা হয়। লোহার গেট ভেঙে তিন বোনকে চুলের মুটি ধরে ঘর থেকে বার করে আনে। ‘খেলা হবে’র তালে তালে তাঁদের নিগৃহীত করা হয়। তার ঘণ্টা খানেক বাদে তুহিনা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে। চোদ্দো জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, মাত্র পাঁচ জন ধরা পড়েছে। বশির পুলিশের খাতায় ফেরার; অথচ সে কাউন্সিলার হিসাবে শপথ নিয়েছে! সেটাই তো হবে, তার মাথার ওপর তো নাকি মন্ত্রীর হাত রয়েছে! এরপরেও বলা হবে এ রাজ্যে মহিলারা নিরাপদ, ওসব শুধু ইউপিতে হয়!
অবশ্য কে নিরাপদ এখানে? সদ্য নির্বাচিত কাউন্সিলার যাঁরা জনতার ভোটে সদ্য নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরাই নিরাপদ নন! ১৩ মার্চ একই দিনে রাজ্যের দুই এলাকায় দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হল। পানিহাটিতে অনুপম দত্তের হত্যা তো হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্য। ভর সন্ধ্যাবেলায় সিসিটিভি দ্বারা সুরক্ষিত এলাকায় আততায়ী সটান হেঁটে এসে স্কুটারের ওপর বসে থাকা এলাকার জনপ্রিয় প্রতিনিধিকে পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। যতদূর জানা যায়, অনুপম দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন। অবৈধ কারবার, প্রমোটারি এসব বরদাস্ত করতেন না। কিন্তু দলটাতে তো এখন এইসব লোকেরই রমরমা। যত বেআইনি কাজে সঙ্গত দেবে তত তোমার পিছনে লোক বাড়বে, পার্টি মুখে হরির নাম গাইবে কিন্তু তলায় তলায় তোমাকেই মদত দেবে। অনুপমরা লাশ হয়ে যাবে, নেতারা নাকিকান্না গাইবে।
অনুপম দত্তের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ঝালদা পৌরসভার দু' নম্বর ওয়ার্ডের বিজয়ী কাউন্সিলর কংগ্রেসের তপন কান্দুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযোগ, কংগ্রেসের এই নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছিল তৃণমূলে জয়েন করার জন্য। এই ব্যাপারে স্থানীয় থানার আইসি'র বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, তিনি নাকি তপনবাবুকে লাগাতার চাপ দিয়েছেন দল বদলানোর জন্য। এই আইসির বিরুদ্ধে এখনও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নেতাদের তোতাপাখির বুলি: এটা পারিবারিক বিবাদ।
তারপর রামপুরহাটের এই ভয়ানক ঘটনা। কজন মারা গেছেন? সরকার বলছে আট, অন্য সূত্রে দশ। তাহলে দাঁড়াল, দু' মাসের মধ্যে পাঁচটি ভয়ঙ্কর ঘটনা, প্রতিটি রাজনৈতিক। আর বলা হচ্ছে, গত দু' সপ্তাহে ১৬ জন খুন হয়েছেন রাজ্যে, যার মধ্যে ১২-১৩টি রাজনৈতিক খুন। সরকারের ধরাবাঁধা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে:
(১) সিট গঠন করো এবং সেটা এমন একজন কুখ্যাত অফিসারের নেতৃত্বে যিনি রিজওয়ানুর কাণ্ডে অন্যতম মূল অভিযুক্ত ছিলেন;
(২) কিছু পুলিশ কর্মীকে, মূলত নিচু তোলার, ক্লোজড করো;
(৩) ওসি, আইসি'কে ছুটিতে পাঠিয়ে দাও, স্থানান্তরিত করো আর না হয় তাঁদের উড়ে বেড়াতে দাও;
(৪) সিবিআই'এর দাবির প্রবল ভাবে বিরোধিত করো;
(৫) ষড়যন্ত্র, পারিবারিক বিবাদ ইত্যাদি বলে প্রথম থেকেই তদন্তকে প্রভাবিত করো, ভুল পথে পরিচালিত করো।
এই জমানায় পুলিশ কর্তারা ক্যারিকেচার মাত্র, সব ‘হার মিস্ট্রেস ভয়েস’। এঁদের দেখে করুণা হয়! দুঁদে সব আইপিএস, কত পরিশ্রম করে সেই জায়গায় গেছেন, এখন প্রতি মুহুর্তে শেখানো বুলি আউড়ে ঢোক গিলতে হয়। এঁরা করবেন ঘটনার তদন্ত! সিট তো একটা জোক! রাতের অন্ধকারে আনিশের লাশ আনতে গিয়েছিল, তাঁদের পরিবারকে কোনও খবর না দিয়ে। নেহাৎ পাড়ার লোক সজাগ ছিলেন বলে আটকে দিয়েছেন। কী উদ্দেশ্যে গিয়েছিল তারা? কোনও উত্তর নেই। এক মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। ফরেনসিক রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। কোথায় কী? সব ঢুঁ ঢুঁ! আদালত আরও এক মাস সময় দিয়েছে। কিন্তু কোনও আশা আছে কি? প্রতিনিয়ত যে হারে খুনখারাপি হচ্ছে, তাতে আনিশ হারিয়ে যাবেন। বিচার পাবেন না। এক বলিষ্ঠ, প্রতিবাদী যুবক দালালদের কাছে মাথা নোয়ালেন না, তাঁর জানটা চলে গেল। কোনও প্রতিকার নেই। বিরোধী দলগুলোও ঠুঁটো জগন্নাথ।
তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূলের স্বৈরাচারী রূপ নগ্ন হয়ে গেছে। দলের বাইরে বিরোধীরা যত হীনবল হবে, দলের মধ্যে বখরা নিয়ে তত খুনোখুনি হবে। এ যেন অমোঘ নিয়তি! যত দিন যাচ্ছে, বিজেপির সাথে এই দলটার পার্থক্য ক্ষীণ হয়ে আসছে। এখন তারা একইরকম ভাবে অসহিষ্ণু, কোনও রকম প্রতিবাদকে বরদাস্ত করে না। বাংলার মানুষের ভোগান্তি আছে। আইনশৃঙ্খলার আরও অবনতি হবে। পরের বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা ভাবলে শিউড়ে উঠতে হয়। রক্তগঙ্গা বইবে বাংলায়?
পুনশ্চ: খুনখারাপি জারি আছে। এরই মধ্যে (বুধবার রাতে) নদীয়ার হাঁসখালিতে তৃণমূল নেতা সহদেব মণ্ডলকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর স্ত্রী পঞ্চায়েত সদস্যা। যে হারে চলছে, দলটা ঝাড়ে বংশে উজাড় না হয়ে যায়। ওদিকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটায় তৃণমূলের এক প্রতিনিধি দল অমিত শাহ'র সাথে দেখা করছে।
হচ্ছেটা কী? কোনও নতুন সমীকরণ?
জনগণ তার রাস্তা খুঁজে নেবে। পতন আসন্ন।
ReplyDeleteযে বিরোধী শূন্য রাজনীতি করতে চায় তাকে অবশ্যই একেবারে নীচুতলা থেকে এক লুম্পেন, খুনী, হিঙ্স্র ও লুটেরা বাহিনীর উপর নির্ভর করতে হবে। এই দৈত্য কে একবার বাজারে ছেড়ে দিলে সে নিজের নিয়মেই চলবে। তাকে বোতল বন্দী করা প্রায় অসম্ভব। এই রাজনীতি র প্রতিফলন আমরা এরাজ্য আগেও দেখেছি এখনও দেখছি। ক্যাডার নির্ভর পার্টি হলে এই দৈত্য কে খানিকটা পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করা যায়। যেটা বিজেপি করছে অন্য রাজ্যে। আর তৃণমূল এর মত ব্যাক্তি কেন্দ্রিক দল এই রাজনৈতিক অনুশীলনে এক চরম নৈরাজ্য অবিলম্বে ডেকে আনবে।
ReplyDeleteনৃশংস ও অমানবিক এক পিশাচ মুখ এ পরিণত একটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এখন দন্ডমুন্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
ReplyDeleteআবার নতুন করে বাংলার মানুষকে সব ভাবতে হবে।