Sunday, 20 March 2022

অর্থনীতির ভোলবদল

বেকারত্ব কি সত্যি বাড়ছে 
নাকি কর্মজীবীর আয় কমছে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

বহু বিজ্ঞ ও পণ্ডিতজনদের দেখছি, তাঁরা বড় ব্যাকুল হয়ে আতসকাঁচের নিচে নানাবিধ তথ্য সমবেত করে ভারতীয় অর্থনীতির নানারকম অবস্থা (ভাল বা মন্দ) বর্ণনা করে চলেছেন। তাঁদের বলা ও বিশ্লেষণে বাস্তবতার ছবিটি বেশ ভালরকমের অধরা। আসলে এইসব প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে কেন্দ্র করে যে এক বহুবিধ সম্ভাবনা ও মাত্রা নির্মিত হয়ে চলেছে, সংক্ষেপে, রাজনৈতিক-অর্থনীতির এক নবজন্ম সূচিত হচ্ছে, সে দিকে বিশেষ কারও দৃকপাত নেই। যেমন ধরা যাক, সদ্য প্রকাশিত CMIE-এর তথ্যে প্রকাশ, ভারতে ফেব্রুয়ারি ২০২২’এ বেকারত্বের হার ৮.১ শতাংশ। গত জুন ২০২১’এ এই হার ছিল ৯.১৭ শতাংশ, যা প্রতি মাসে ওঠানামা করতে করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এসে ৮.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্বের এই হার দেখে সরকার-বিরোধীরা রে রে করে উঠছেন, ধ্বস্ত অর্থনীতি! আর সরকারপন্থীরা বলছেন, আমরা ক্রমেই ভালোর দিকে যাচ্ছি। স্বীকার করে নেওয়া ভাল, আজ অর্থনীতির (ডিজিটাল নির্ভর গিগ অর্থনীতি) এমন হাজারও গতিমুখ তৈরি হয়েছে যে, কোনও এক মুহূর্তে সামগ্রিক ভাবে ভাল-মন্দের নিদান দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। দেখা যাবে, অর্থনীতির কোনও একটা ক্ষেত্র যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তখন অন্য একটি গতিমুখে সমৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাহলে যে ক্ষেত্রগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেখানে কর্মরত মানুষজনের অবস্থার বিচার আমরা কীভাবে করব? এখানেই এসে পড়ছে আধুনিক ভূষণে জনকল্যাণের রাজনীতি যা সামগ্রিক ভাবে বিপর্যস্ত মানুষজনকে অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা ঠেকা দিয়ে রাখতে সমর্থ বলে সাব্যস্ত হচ্ছে! বলাই বাহুল্য, এ দেশে সেই অনুশীলনের প্রাবল্য এখন উর্ধ্বমুখি।

আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। CMIE-এরই আরও একটি বিস্তৃত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ২০২১’এ পুরুষদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি: ৬৯.৭৫ শতাংশ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এই হার ৪২.১৪ শতাংশ। এরপর দেখা যাচ্ছে, ২৪-উর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ক্রমেই কমে আসছে। ৪০ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার সব থেকে কম: ০.১৬ শতাংশ। অর্থাৎ, পুরুষদের মধ্যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনও না কোনও কাজে তাদের এক বড় অংশ নিয়োজিত হয়ে পড়ছে, যদিচ, অত্যাল্প মজুরি ও অনিশ্চিত যাপনের ষোলআনাই সেখানে বিদ্যমান। এই হল আজকের গিগ অর্থনীতির উদার ক্ষেত্র যেখানে অফুরান কাজ কিন্তু চাকরির সুরক্ষা নেই। চাইলেই কোথাও না কোথাও একটা কাজ জুটে যাবে বটে কিন্তু সেখানে কতদিন অথবা কত মজুরির বিনিময়েই বা, এই প্রশ্নগুলি অতীব বাস্তব। উল্লেখ্য, এই তথ্যরাশিতে বয়স অনুসারে দু’ ধরনের বেকারদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: এক) যারা কর্মহীন এবং কাজ খুঁজছেন; দুই) যারা কর্মহীন ও কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজের সন্ধান করছেন না। অল্প বয়সের কারণে অনেক পরিবারেই পুরুষদের লেখাপড়া ও ‘ভাল চাকরি’ জোগাড়ের ওপর জোর দেওয়া হয়, যে কারণে, কাজ করতে ইচ্ছুক হলেও উপযুক্ত যোগ্যতা ব্যতীত অনেকেই তেমন ভাবে কাজের সন্ধান করে না।

মহিলা বেকারত্বের ছবিটিও তদুরূপ তবে খানিক ভিন্নধর্মী। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি: ৯৪.৮৬ শতাংশ। আর কর্মহীনতার হার সব থেকে কম ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে: ১.১২ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, উপরে উল্লিখিত দু’ ধরনের কর্মহীনদের মধ্যে ‘কর্মহীন ও কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজের সন্ধান করছেন না’ এমনতর জনসংখ্যা মহিলাদের মধ্যে বিপুল ভাবে বেশি। শুধু বেশি বললে কথাটা ফুরচ্ছে না, বাস্তবতা হল, মহিলারা ‘যারা কর্মহীন এবং কাজ খুঁজছেন’ তাঁদের থেকে ‘কাজের সন্ধান করছেন না’ মহিলারা সংখ্যায় বহু গুন বেশি। আমাদের দেশে মহিলাদের ঘরের বাইরে কর্মে নিয়োগের ব্যাপারে সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ এখনও প্রবল ভাবে বিদ্যমান।

মোদ্দা কথায়, কোভিড পরিস্থিতি ও লকডাউনের বিপন্ন সময় এবং তার অনুসারী অর্থনীতিগত বিপর্যয়ের কথা বাদ দিলে, সাধারণ ভাবে, বেকারত্বের সমস্যা আজ আর তেমন মারাত্মক কোনও সমস্যা নয় (এই কথাটি শুনলে অবশ্য অনেক বড় পণ্ডিতই আমার দিকে রে রে করে তেড়ে আসবেন)। এর কারণ, পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতি এবং গিগ অর্থনীতির উদয়, যেখানে প্রভূত কাজের সুযোগ বিদ্যমান; যদিও প্রখর বাস্তবতা হল, সেই সব কাজে প্রাপ্ত মজুরি বা সামাজিক সুরক্ষা যথেষ্ট নিম্নমানের এবং কাজের নির্ঘন্টেরও কোনও মা-বাপ নেই। এই প্রেক্ষাপটেই তাই, আমরা ‘গ্রেট রেজিগনেশন’এর মতো প্রবণতাকে কখনও কখনও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখছি যখন দলে দলে কর্মরত মানুষেরা তাদের নিজ নিজ কাজের দফতরে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসছেন। তাদের কেউ কেউ হয় নতুন কাজে যোগ দিচ্ছেন যেখানে মজুরির হার অপেক্ষাকৃত ভাল অথবা নিজেরাই ছোট ছোট উদ্যোগপতি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। বলার কথা এই, এমনতর এক রাজনৈতিক-অর্থনীতিগত পরিস্থিতির আজ উদয় হয়েছে যেখানে কাজ পাওয়া ও হারানোর সম্ভাব্যতা দুইই বেশ প্রকট। সাবেক অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদরা এই নবতর প্রবণতা ও বাঁকগুলিকে বুঝেই উঠতে পারছেন না। তাই, বরাবরের মতো গতানুগতিক কিছু বিশ্লেষণে নিজেদের আবদ্ধ রেখে দায় সারছেন।

অল্প কথায়, সবটা মিলিয়ে আমাদের দেশে ও অন্যত্র এমন এক রাজনৈতিক-অর্থনীতির বাতাবরণ তৈরি হয়ে চলেছে যেখানে গিগ অর্থনীতি ভিত্তিক বহু কাজের সুযোগ ও প্রাপ্তি অনায়াস হয়ে উঠছে কিন্তু আয়ের মান মোটেই আশাপ্রদ নয়। সে কারণে, নিরলস পরিশ্রম করে যে অর্থপ্রাপ্তি একজন শ্রমিক বা কর্মচারীর জুটছে, তাতে তাঁর দিনযাপন মোটে ভাল হচ্ছে না। ফলে, সরকারের তরফ থেকে নানা ধরনের জনকল্যাণ প্রকল্পের আজ এত চাহিদা ও রমরমা যেখানে প্রাপ্তির কোটাটা আরও কিছুটা ভরিয়ে দেওয়া যায়। ফলত, জাতপাত-ধর্মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে জনকল্যাণের অর্থনীতি ও রাজনীতিই আজ প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে ব্লকচেইন প্রযুক্তির উত্থান অর্থনীতির লেনদেনকে রাষ্ট্রের গহ্বর থেকে মুক্ত করে এক নতুন পথে নিয়ে ফেলছে।

মোটের ওপর, এইসব কারণে রাজনৈতিক দল সমূহ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ এক সামগ্রিক চ্যালেঞ্জের মুখে। কোন দল ক্ষমতায় গিয়ে বাস্তবে কতটা জনকল্যাণমূলক কার্যসূচিকে বাস্তবায়ন করতে পারছে- তার ওপরেই তাদের জনপ্রিয়তা এবং আরোহন-অবরোহনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সেই রাজনৈতিক দলই আজ গ্রাহ্যতা পাবে যারা শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ মানুষের মৌলিক সামাজিক-অর্থনৈতিক চাহিদাগুলি (খাদ্য, বিজলি, পানি, আবাস) অনেকাংশে পূরণ করতে সক্ষম। যে কারণে, আপ’এর মতো একটি নতুন দল নিজস্ব কোনও শাখা সংগঠনের (ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সংগঠন, ছাত্র-যুব ফ্রন্ট) অস্তিত্ব ছাড়াই বিস্তৃত উপায়ে প্রায় সারা দেশ জুড়েই জনতার আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়ে উঠছে এবং এক নতুন পথের দিশারী হয়ে দেখা দিচ্ছে। কারণ, তারা এমন এক ‘মডেল অফ গভর্নেন্স’এর রূপকল্প শুধু কথায় নয়, অনুশীলনেও করে দেখাতে সক্ষম হয়েছে যা আপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে এক আলোড়ন তুলেছে। বলাই বাহুল্য, পঞ্জাবে তাদের বিপুল জয়ের পিছনে দিল্লি সরকারের ‘মডেল অফ গভর্নেন্স’এর বিশাল প্রভাব কাজ করেছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য বহু দেশেও এমনতর নতুন নতুন দল ও নতুন নতুন নেতা এসে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনীতির পরিসরে জায়গা করে নিচ্ছে।

অর্থাৎ, উত্থিত পরিস্থিতি ক্রমেই এক নতুন চক্রের জন্ম দিচ্ছে। বাস্তবতা হল, একদিকে গিগ অর্থনীতি কাজের এক অপার ভুবন গড়ে তুলছে, অন্যদিকে আপামর জনসাধারণের কর্মক্ষেত্রে গড় আয় নিম্নমুখি হয়ে চলেছে। শ্রমজীবী মানুষের এই বিপর্যস্ততা ও অনিশ্চিতির মোকাবিলাতেই আজ জনকল্যাণ অর্থনীতির বাধ্যত উত্থান। যে কোনও রাজনৈতিক দলকেই আজ ক্ষমতায় আরোহন করতে হলে বা সেখানে টিকে থাকতে গেলে জনকল্যাণের সৃজনশীল ও প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডকে উশুল করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বহু কথিত, ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম প্রণয়নের দিকে এ এক যাত্রা বটে। অথবা হতে পারে: Universal Basic Income in kind and partially in cash

 

No comments:

Post a Comment