অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
শ্রীলঙ্কায় তুমুল অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাপক গণবিক্ষোভের প্রেক্ষিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আমাদের দেশেও কি এমনতর সংকট আসন্ন? কারণ, গত কয়েক দিনে পেট্রোল, ডিজেল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে উর্ধ্বগামী হয়ে চলেছে, তাতে এক প্রবল অর্থনৈতিক বিপন্নতার সম্ভাবনা যে একেবারে অমূলক তা বলা যাচ্ছে না। উপরন্তু, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারেও টান পড়েছে (এ বছরের এপ্রিলের গোড়ায় তা ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমে গিয়ে ৫৪০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে)। সাধারণ মানুষের গড় আয় পড়তির দিকে, ছোট ব্যবসা ও লেনদেন তীব্র সংকটে। এই মার্চে মূল্যবৃদ্ধির হার গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ (৬.৯৫ শতাংশ)- যেখানে আনাজপাতির মূল্যের উর্ধ্বগতির হার ১১.৬৪ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে, আমরা এক সর্বগ্রাসী সংকটের মুখে। তদুপরি, শিল্প বৃদ্ধির হারও তলানিতে এসে ঠেকেছে (এই ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ১.৭ শতাংশ)।
তবুও, এখুনি ভারতবর্ষের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো একেবারে হুড়ুমুড় করে রাস্তায় নেমে পড়ছে না, দেশ জুড়ে এক উত্তাল গণরোষের সম্ভাবনাও তেমন ভাবে প্রকট নয়। কিন্তু অন্য অর্থে ও ব্যঞ্জনায় তা যে দিনে দিনে আরও ভয়ানক ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর নির্দিষ্ট কারণসমূহ আমাদের দেশের কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈততা ও মিশ্র অর্থনীতির আবহের মধ্যেই অন্তঃস্থ।
দেশে একটি শক্তিশালী ও আধিপত্যকামী কেন্দ্রীয় সরকার বিরাজমান থাকলেও, খাতায়-কলমে ও সংবিধানে আমরা নিজেদের ‘Union of States’ বলে বর্ণিত করেছি। সেই অর্থে, এখনও কিছু আপেক্ষিক ক্ষমতা রাজ্য সরকারগুলির হাতে ন্যস্ত আছে। উপরন্তু, বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রে যেহেতু নানা ধরনের পরস্পর বিরোধী দল ও সরকার ক্ষমতায় আসীন, তাই সবটা মিলিয়ে এমন এক অর্থনৈতিক বাতাবরণের চল হয়েছে যেখানে আক্রমণের বর্শামুখটা কোনদিকে থাকবে তা নিয়ে সাধারণ্যের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বেরও যথেষ্ট অবকাশ থেকে গেছে। তাই দেখা যায়, পেট্রোপণ্যের বর্ধিত মূল্যের দিকে যখন কেন্দ্র বিরোধী দলগুলি সরব হয়, তখন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বলে, রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে তেলের ওপর আরোপিত কর কমিয়ে মূল্যহ্রাসে সহায়তা করুক। অথচ, কোনও দলই জিএসটি কাউন্সিলে তেলকে জিএসটি’র আওতায় নিয়ে আসার কথা উত্থাপন করতে চায় না; কারণ, সে ক্ষেত্রে তেলের ওপর সর্বোচ্চ কর ২৮ শতাংশের বেশি হবে না আর তাতে রাজ্য ও কেন্দ্র উভয়েরই কর থেকে আয় অনেকটা কমে যাবে, যদিচ সামগ্রিক ভাবে জনজীবনে মূল্যস্তর বেশ কিছুটা হ্রাস পাবে।
বলা যায়, এমনতর দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতি বরং আখেরে ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে আপাত অর্থে ইতিবাচকই সাব্যস্ত হয়েছে। কারণ, ক্ষমতার পৃষ্ঠে লেপ্টে থাকার অভিলাষে রাজনৈতিক দলগুলি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বাধ্যত অনুসরণ করার চেষ্টা করে যা দেশের অর্জিত সম্পদকে কিছুটা হলেও বিস্তৃত পরিধি জুড়ে বন্টিত হতে দেয়। তা পিএম কিষাণনিধি প্রকল্পই হোক কি কৃষক-বন্ধু প্রকল্প অথবা দুয়ারে রেশন কিংবা মহল্লা ক্লিনিক! এই অনুশীলন অবশ্যই দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সরকারি এইসব উদ্যোগ অন্তত দুর্ভিক্ষ জাতীয় পরিস্থিতি থেকে একটা নড়বড়ে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে নিঃসন্দেহে।
কিন্তু এর অপর পিঠে ভিন্নতর একটি গল্প আছে। সে গল্প এক অন্য ধরনের বিপন্নতা ও অসহায়তার কথা বলে। তা নিমেষে দেশ ও দশকে নিঃস্ব করে দেয় না বটে, কিন্তু তিলে তিলে নিয়ে চলে এক ভয়ানক আত্মহননের পথে। সে এক বিচিত্র ও ভয়ঙ্কর অভিসার। আমাদের দেশ এমনই এক অভিনব ধ্বংসাত্মক অভিমুখে দাঁড়িয়ে; যে লয় অতি ধীর, প্রগাঢ়, নিষ্ঠুরতম ও মর্মস্পর্শী।
গত শতকের পঞ্চাশ থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগসমূহের প্রবল উপস্থিতি এমন এক স্থিতিশীল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজের জন্ম দিয়েছিল যেখানে উপার্জনের একটা স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করে জনসমাজের কিছু অংশ এক আপেক্ষিক নিশ্চিতির মধ্যে জীবনযাপন অতিবাহিত করতে পেরেছিল। যদিও জনপরিসরের এক বড় অংশ ছিল এই আলোকবৃত্তের বাইরে ও তাদের দিনকাল ছিল অতীব দরিদ্র ও শতচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট-বিপ্লব, তথ্যপ্রযুক্তির আগ্রাসী উত্থান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্দাম আগমনে এই রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র নির্ভর জনসমাজের আপাত নিশ্চিন্ত জীবনে ক্রমেই এক বড়সড় অভিঘাত নেমে এল। বহু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে গেল অথবা বেচে দেওয়া হল, সরকারি চাকরির সংখ্যাগত প্রাবল্যও কমে এল, ভিআরএস নিয়ে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ স্থায়ী চাকরি থেকে বিদায় নিল এবং তারা অচিরেই ফুরিয়ে গেল। ফুরিয়ে গেল দুটি অর্থে: এক) সমাজ ও অর্থনীতিতে এদের যে প্রাবল্য ছিল (ট্রেড ইউনিয়নগত শক্তিতে, মাইনে বাড়িয়ে নেওয়ার ক্ষমতায় ও নিঃসন্দেহে সমাজ-রাজনীতির সক্রিয়তায়) তা একেবারে কমে গেল এবং দুই) যে সামাজিক ক্ষমতা ও মর্যাদা এদের করায়ত্ত ছিল, তাও গেল নিভে। যেমন, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে শেষ জীবন অবধি কাজ করে অবসরপ্রাপ্ত বড়বাবু কি কোনওদিনও ভাবতে পেরেছিলেন যে তাঁর ছেলে তেমন যুৎসই কাজ না পেয়ে একবিংশ শতকের প্রথম দশকে পৌঁছে শেষমেশ অটো চালাবে! অথচ, যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের সে সুদিন থাকত, তাহলে নিদেনপক্ষে ছেলেটির একটি পাকা চাকরি ও নিশ্চিত জীবন কি সেখানে বাঁধা ছিল না? এই অযাচিত স্খলন এক আচম্বিত বিপন্নতা। তারপর যখন ছেলেটি অটো না চালিয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে সামান্য চাকরি নিল এবং হঠাৎ করে সে সংস্থা একদিন বন্ধ হয়ে গেল, তখন ফুরিয়ে আসা অসহায় পিতার ছোট্ট ফ্ল্যাট ভেঙে কি পুলিশ তাদের সকলের অর্ধপচা লাশ উদ্ধার করল?
খবরে প্রকাশ, প্রায় সর্বত্র খুনের থেকে আত্মহত্যার সংখ্যা এখন অনেক বেশি। আমাদের দেশে একমাত্র বিহার বাদে প্রায় সব রাজ্যেই খুনের থেকে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি বেশি করে ঘটে চলেছে। মানব সূচকে উন্নত রাজ্য কেরালায় একটি খুনের ঘটনার তুলনায় প্রায় ২৭টি আত্মহত্যার ঘটনা পাওয়া যাচ্ছে। হতে পারে, কেরালায় অপরাধ প্রবণতা কম, কিন্তু এতগুলি আত্মহত্যার ঘটনা কীসের ইঙ্গিত দেয়? আত্মহত্যাও তো এক ধরনের হত্যাই- নিজেকে হত্যা। তেলেঙ্গানা এবং তামিলনাড়ুতেও দেখছি, খুনের থেকে আত্মহত্যার ঘটনা ১০ গুনেরও বেশি। আর এই প্রবণতা এখন প্রায় সারা বিশ্ব জুড়েই (কিছুটা ব্যতিক্রম লাতিন আমেরিকার দেশগুলি, যেখানে সংগঠিত অপরাধের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অধিক)। জাপানের মতো একটি উন্নত দেশে আত্মহত্যার ঘটনা খুনের ঘটনার থেকে প্রায় ৫৭ গুন বেশি। ভাবা যায়!
এখানেই তীব্র সংকটের মহাবীজ লুকিয়ে আছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির আবহে (যন্ত্র চালিত গিগ অর্থনীতির উত্থান) এবং সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক বাতাবরণে মানুষ হয়ে পড়ছে অসহায়, বিপন্ন, দরিদ্র ও ছিন্নমূল। তার তাৎক্ষণিক ক্ষুধার নিবারণ হয়তো রাষ্ট্র করছে, কিন্তু তার যে সার্বিক অধঃপতন- অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক- তা তাকে নিয়ে চলেছে এক অচিন্তনীয় অন্ধকারের করালগ্রাসে। তার সারা অঙ্গে এক মসৃণ শৃঙ্খলের জাল, যে জাল কেটে বেরতে গিয়ে সে আরও ঘোরতর ভাবে জড়িয়ে পড়ছে তার নাগপাশে। তার যাপনের প্রতিটি মুহুর্তে তাকে সজাগ থাকতে হচ্ছে জীবিকা-অর্জনের নানাবিধ পথ খুঁজে নিতে; যে কর্মে সে নিয়োজিত, সেখানেও তার প্রতিনিয়ত আসুরিক লড়াই নিজেকে প্রমাণ দেওয়ার, নয়তো ছিটকে পড়তে হবে বৃত্তের বাইরে। এটা শাসকেরা বুঝেছে- তাই অন্তত পেটে ভাত জুগিয়ে যদি প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তবে সংকটের প্রকাশ দৃশ্যত অত তীব্র হয় না; কাজের জগতে যেমন তেমন চরে বেড়ানোও যায়! গিগ অর্থনীতির এই হল জমানা- এই কাজ আছে তো, আবার এই কাজ নেই!
শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষের পারিবারিক গোয়ার্তুমি শাসন ও একচেটিয়া ভুলভাল অর্থনৈতিক নীতি দেশটাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমাদের দেশেও বিমুদ্রাকরণ ও আচম্বিত লকডাউন ঘোষণায় যে তুমুল সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল- যার প্রভাব এখনও বিরাজমান- তার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশ জুড়ে পথে নেমে মানুষ যে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়নি তার কারণ, রাজ্যে রাজ্যে জনকল্যাণমূলক রাজনৈতিক-অর্থনীতির অনুশীলন ও প্রসার। কিন্তু এতে করে তো বিপন্নতা ও দারিদ্র্য ঘুচছে না। সেই অসহনীয় জ্বালা থেকে মুক্তি পেতেই কি তবে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত মানুষ সন্ধান করছে আত্মহননের পথ? কারণ, তার চোখে রাষ্ট্র বেপাত্তা, দুয়ারে খাদ্যসামগ্রী জুগিয়ে তার আপাত কাজ শেষ। এরপর যা কিছু অপ্রাপ্তি ও ‘ব্যর্থতা’, তার দায় ব্যক্তির নিজের- যুক্তি হল, আজকের গিগ অর্থনীতিতে কাজের যে অযূত লভ্যতা, সেখানে যদি সফল না হওয়া যায় তার দায় কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরই নয়? সকলেই তাই উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে! কে রইল, কে পড়ে গেল- তা দেখার সময় ও বাসনা কারও নেই। কারণ, তুমি পিছিয়ে পড়লে মানে তুমি হেরে গেলে। এ এক অবিশ্বাস্য ও ভয়ঙ্কর যুক্তিবদ্ধ সংকট।
এক সময় কর্মজীবী মানুষ ট্রেড ইউনিয়নে জোটবদ্ধ হয়ে আশা ও আদায়ের পথ পেয়েছিল। এখন নতুনতর রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিন্যাসে সেই ট্রেড ইউনিয়নের সম্ভাবনাও ক্রমেই সুদূরপরাহত। শত যুদ্ধ, হাজারও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন করেও যে মনুষ্য-সমাজকে সম্পূর্ণত নিয়ন্ত্রণাধীন করা যায়নি, তা কি অবশেষে আত্মহননের পথকে (পঙ্গপালের আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো) উন্মুক্ত করে যন্ত্রের অ্যালগরিদমেই সমাধা হবে? কারণ স্পষ্ট বার্তা হল, হয় অ্যালগরিদমের নিয়মে চলো, নয়তো ম’রো।
একটি মর্মস্পর্শী ও ভাল লেখা।
ReplyDeleteসত্যের অন্দরে প্রবেশ করে এক অসাধারণ লেখা।
ReplyDelete