বুলডোজার: মোদী-শাহ'র নয়া রথ
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
তখন স্কুলে পড়ি। চলছে জরুরি অবস্থা। সেটা খায় না মাথায় দেয়, তখনও বুঝে উঠিনি। বুলডোজার দিয়ে মানুষের বাসস্থান গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা তখনই প্রথম শুনলাম। নয়াদিল্লির আশেপাশে এই কুকীর্তিটির অধিনায়ক ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর 'নয়নের দুলাল' সঞ্জয় গান্ধী। হয়তো সেই বাসস্থান ছিল অবৈধ নির্মাণ, সরকারি জায়গার ওপর মানুষের সংসার। নগর পরিচ্ছন্নতার নামে চলেছিল বুলডোজার দিয়ে তাণ্ডব। তবে তখনই বুঝেছিলাম, শাসনের তরে বুলডোজার দরকার পড়ে।
তার অনেকদিন পর ১৯৯৬ সাল। এক রাতে হাতিবাগান-গড়িয়াহাটের ফুটপাথ সাফা হয়ে গেল। চলেছিল সেই বুলডোজার, পে-লোডার। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ফুটপাথের ধারের সব দোকানের কাঠামো। কলকাতার ইতিহাসে যা ‘অপারেশন সানশাইন’ নামে পরিচিত। আর এই অপারেশনের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জ্যোতি বসুর কমরেড-ইন-আর্মস সুভাষ চক্রবর্তী আর তাঁর ডেপুটি কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই রাতের পরে ফাঁকা ফুটপাথ দেখেছিল বটে শহরবাসী, একইসঙ্গে দেখেছিল বলের কী প্রচণ্ড কলরব। তবে তখনও বুলডোজারের গায়ে দলীয় রাজনীতির দাগ লাগেনি।
আমার বিবেচনায় প্রথম দলীয় রাজনীতির ছোপ লাগল ত্রিপুরাতে। মনে পড়ছে, ২০১৯ সালে যখন আমাদের রাজ্যে সিপিআইএম শিবির ও গেরুয়া শিবির মিলে হুইসপারিং ক্যাম্পেন শুরু করেছিল, 'উনিশে রাম, একুশে বাম', তখন এই রাজ্যে ভোট প্রচারে এসে ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিআইএম পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকার বলেছিলেন, 'তৃণমূল বাংলায় বুলডোজার দিয়ে পার্টি অফিস ভাঙেনি'। ত্রিপুরায় ক্ষমতাসীন বিজেপির অত্যাচারের ছবি তুলে ধরতে গিয়েই মানিক সরকার এই তুলনা করেছিলেন। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, শুধু বামপন্থীদের দলীয় অফিসই নয়, বিজেপি সরকারের বুলডোজারের আঘাত থেকে রেহাই পায়নি লেনিনের মূর্তিও।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে জাহাঙ্গিরপুরী। ষষ্ঠ বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে দেশ-বিদেশের উদ্যোগপতিদের সামনে ঐক্যের বার্তা তুলে ধরতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'আমরা বুলডোজ করতে চাই না। আমরা মানুষে মানুষে বিভেদ চাই না। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আমাদের বৈশিষ্ট্য। আমি চাই সবাই এক সঙ্গে থাকুক। ঐক্যবদ্ধ পরিবারই সফল পরিবার।' পাঠক খেয়াল করুন, মমতা এখানে 'বুলডোজ করতে চাই না' বাক্যটি ব্যবহার করলেন। করলেন ঠিক সেদিন, যার আগের দিন দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীর বুলডোজার তাণ্ডব সারা পৃথিবী দেখেছে। দেখেছে, সেই বুলডোজারের সামনে শীর্ষ আদালতের স্থগিতাদেশের কথা রীতিমতো জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করছেন সিপিআইএম নেত্রী বৃন্দা কারাত ও সিপিআইএমএল লিবারেশনের নেতা রবি রাই'রা।
আপাতত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পিছু হঠেছে বুলডোজার। দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া বিজেপি শাসিত নর্থ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ও শাহ'র দিল্লি পুলিশের এই উচ্ছেদ অভিযানকে 'বিজেপির বুলডোজার রাজনীতি' বলে তোপ দেগেছেন এবং আপ বিধায়কদের রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। পুর নিগমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অবৈধ নির্মাণ হঠাতেই উচ্ছেদ অভিযান। তা নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। গত শুক্রবার এই উচ্ছেদ অভিযান নিয়েই বিজেপির বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ আনল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। আপের অভিযোগ, শহরের বাসিন্দাদের থেকে ঘুষের টাকা চেয়েছিল বিজেপি কাউন্সিলররা, তারপরই দলের সভাপতি পুর নিগমগুলোকে বুলডোজার নিয়ে অবৈধ নির্মাণ উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। টুইটে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, 'গোটা দিল্লি থেকে এই ধরনের অভিযোগ আসছে। দিল্লির মানুষ এই ধরনের তোলাবাজি ও গুণ্ডাগিরি বরদাস্ত করবে না। এই কারণেই কি পুর নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে?'
এ নিয়ে আরও কথা বলার আগে 'বুলডোজার রাজনীতি' নিয়ে কিছু কথা বলি। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তথাকথিত সমাজবিরোধী দমনের নামে প্রথম বুলডোজার ব্যবহার করেন। উদ্দেশ্য মূলত, রাজ্যের মুসলমানদের শিক্ষা দেওয়া। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এই নীতি বিশেষ জনপ্রিয় হয়। যোগী আদিত্যনাথের নামকরণ হয় 'বুলডোজার বাবা'। সম্প্রতি রামনবমীতে সহিংসতার পর মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানও বুলডোজার ব্যবহার করেন।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীও বুলডোজার-নীতি আঁকড়ে ধরার কথা বলেছেন। এরপরই দিল্লির হিংসাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে আমরা বুলডোজার নামতে দেখলাম। হনুমান জয়ন্তীর শোভাযাত্রার নামে হিংসার ঘটনার পরে পরেই। রামনবমীর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রা দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীর মসজিদের সামনে আসতেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। সংঘর্ষের ঘটনায় বেশ কয়েকজন পুলিশকর্মী ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দারা আহত হয়েছিলেন। এই সংঘর্ষের রেশ কাটতে না কাটতেই চারদিনের মাথায় বুধবার বিজেপির দখলে থাকা নর্থ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের তরফে বুলডোজার দিয়ে এই এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। অতএব, বলাই বাহুল্য, এই বুলডোজার বা পে-লোডার কোনও কাঠামো ভাঙার যন্ত্র নয়, বিজেপির উৎপীড়নের হাতিয়ার। এটাই বুলডোজার রাজনীতি। সংখ্যালঘু পীড়নের রাজনীতি।
জাহাঙ্গিরপুরীতে বুলডোজার অভিযানকে বেআইনি আখ্যা দিয়ে আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভে বলেন, বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নামে আসলে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে টার্গেট করা হচ্ছে। বুলডোজারকে একটি রাষ্ট্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে আদালতে সওয়াল করেন তিনি। দুষ্মন্ত দাভে সুপ্রিম কোর্টে আরও বলেন, শুধুমাত্র জাহাঙ্গিরপুরীই নয়, দেশের যে কোনও জায়গাতেই কোনওরকম হিংসাত্মক ঘটনার পর বুলডোজার ব্যবহার করে সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে টার্গেট করা হচ্ছে। রাষ্ট্র এভাবে কাজ করতে পারে না বলে শীর্ষ আদালতে সওয়াল করেন তিনি।
একটা সময় এই বাংলায় স্লোগান ছিল: 'মানুষ যখনই চায় বস্ত্র ও খাদ্য/ সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য'। এখন দেখা যায়, যখনই দুয়ারে ভোট কড়া নাড়ে বিজেপি তখনই হিংসা নামিয়ে আনে। গেরুয়া শিবিরের এই রাজনীতিটা নতুন নয়। গত ৪০ বছর বিজেপির রাজনীতির হালহকিকত যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন ভোট এলেই বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে তৎপর হয়ে ওঠে। বাজপেয়ী-আদবানির জমানায়ও তাই। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার কলঙ্কিত ইতিহাসেরও তো আমরা সাক্ষী। এখনও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাওয়ায় বিজেপি তাদের ভোটের রোটি সেঁকা আজও চালিয়ে যাচ্ছে। এখন বুলডোজার হয়েছে হরধনু।নরেন্দ্র মোদী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যতই উন্নয়নের কথা, ডিজিটাল ভারতের কথা বলুন না কেন, তিনিও মনে মনে জানেন, ভোটের জন্য দরকার সেই জয় শ্রীরাম। এটাকেই রাজনীতির কারবারিরা বলেন, ব্যাক-টু-বেসিক, বাবা গোড়ায় ফিরে এসো। অর্থাৎ, বিজেপি প্রযুক্তি, স্বনির্ভর, উন্নয়ন এমন সব যতই যা বলুক, ভোটের সময় গোড়ায় ফিরে আসে। সীমান্তের এপারে সংখ্যালঘু পীড়ন আর ওপারে 'পুলওয়ামা'। হিন্দু মনে সুড়সুড়ি। তাই তো দুষ্মন্ত দাভে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করতে গিযে বলেন, 'দিল্লিতে ৭৩১টি অবৈধ নির্মাণের কলোনি আছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ লোক বাস করেন, আর পুর নিগম বেছে নিল একটা কলোনি! যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তুমি নির্দিষ্টভাবে একটা সম্প্রদায়কে টার্গেট করেছ।' আদালতকে দাভে বলেন, 'পুলিশ ও পুর প্রশাসন সংবিধান দ্বারা চালিত হতে দায়বদ্ধ, বিজেপি নেতাদের কথায় চলতে নয়।' দাভে তো আইনের কথা বলছেন কিন্তু বুলডোজার রাজনীতি চলে নিজের তরিকা মেনে। মানে না সে আদালতের নির্দেশও। তাই তো বিধ্বস্ত জাহাঙ্গিরপুরীকে দিল্লি পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে মুড়ে রেখেছে, সেখানে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। সেখানকার বীভৎসা যাতে বাইরের পৃথিবীতে পৌঁছতে না পারে।
রমজান মাসে এই ঘটনায় আবারও এক সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক মেরুকরণ আমরা দেখতে পেলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে। ঘটনার জন্য কে দায়ী কে দায়ী নয়, সে সব গবেষণা চলছে। দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে কেস-ডায়েরি হিসেব কষেই তৈরি করা হবে। তবে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে, জাহাঙ্গিরপুরীর ঘটনার ফলে বিজেপির রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার প্রচেষ্টা কিন্তু এখন ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা। দিল্লির সাতটি লোকসভা আসন বিজেপির দখলে থাকলেও সরকার হাতে নেই। পঞ্জাব বিধানসভা ভোটে বিপুল জয় পাওয়ার ফলে কেজরিওয়াল এখন অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। তিনি তাঁর ওয়েলফেয়ার ইমেজ দিয়ে দিল্লির মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজধানী শহরে তিন-তিনটে পুর নিগম কব্জায় আনতে চান। নির্বাচন আসন্ন। এই তিনটে নিগমেই কিন্তু ক্ষমতাশীল বিজেপিকে পাঙ্গা নিতে হবে আপের সঙ্গে। উলটোদিকে কেজরিওয়ালও মরিয়া, তাঁর সরকার ব্যাপক জনকল্যাণমুখি কর্মসূচি নিয়েছে। বিদ্যুতের দাম থেকে শুরু করে অবৈতনিক স্কুল চালু করা এবং জলের কর না নেওয়া- এই সবই কিন্তু কেজরিওয়ালের বিশেষ ওয়েলফেয়ার-ইমেজ। তার সুফল কেজরিওয়াল হাতেনাতে পেয়েছেন। এখন পুর নিগমের ভোটেও সেই তাসই খেলতে চাইছে আপ। বিজেপির হাতে তাই সেই পুরনো তাস। নাগপুরের তাস: সহিংসতা জারি রাখো, ভোট ঘরে তোলো।
সামনে ২০২৪। লোকসভা ভোট। বিরোধীদের দমনে দেশের সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ নেয়। কখনও মামলা দিয়ে বিরোধীদের চাপে রাখার উদ্যোগ নেয়, বিরোধী নেতাদের পিছনে এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়া হয়, কখনও বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নামানো হয় বিরোধীদের কণ্ঠরোধে। এবার বিজেপি নিয়েছে নতুন পন্থা: বুলডোজার পন্থা।
আমরা কি শুধুমাত্র সমালোচনা করবো? কোনো দিশায় হাঁটতে পারবো না?
ReplyDelete