Thursday, 28 April 2022

এক অত্যাশ্চর্য আত্মকথন

যে বই হাতে নিলে নিঃশব্দ রাত

ঝর্নার মতো মৌন প্রভাতে অবতরণ করে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

শ্রীমতী কৃষ্ণকামিনী দাসী। যদিও নামটা আসল নয়। ১৯০৩ সালে বাঁকুড়ার এক গ্রামে জন্ম, ২০০৩'এ দেহাবসান। ১৯১২ সালে মাত্র ন' বছর বয়সে বিয়ে। স্বামী ১৪ বছরের বালক। বিয়ের পর পরই স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন কলকাতায় তাঁর মামাশ্বশুরের বাড়িতে। ১৯১৯ সাল অবধি সে বাড়িতেই বসবাস। উত্তর কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে যে বাড়ির অদূরেই পান্তীর মাঠ। জানালার খড়খড়ি খুলে সেই মাঠের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণকামিনী আবিষ্কার করেন এক অভিনব জগৎ; আর তাঁর কলকাতা যাপনের সেই বাল্য-কৈশোরের আট বছরে, গ্রামের সরলমতি বালিকা থেকে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন এক প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বময়ী সত্তা। 

তাঁর বয়স যখন আশির কাছাকাছি, স্মৃতিতে সতত উজ্জ্বল কলকাতা যাপনের তাঁর সেই অলৌকিক গাথা তিনি কতকটা আত্মজীবনীর মতো নিজের খেরোর খাতায় লিখে ফেলেন-

‘কলিকাতা আমাকে মানুষ করিয়াছে, দেশ কী বস্তু শিখাইয়াছে, লক্ষ মানুষের প্রাণস্পন্দন শুনাইয়াছে, সেকালের কত বিচিত্র ঘটনায় সামিল করিয়াছে, আমার ভাগ্য লইয়া ছিনিমিনি খেলিয়াছে, হাসাইয়াছে, কাঁদাইয়াছে, আমায় লইয়া যা-ইচ্ছা করিয়াছে। আর সাক্ষীর ন্যায় চুপ করিয়া দেখিয়াছে পান্তীর মাঠ – যেন একটী আত্মা। কলিকাতা আমাকে কুহকের ন্যায় নিশিডাক দেয়, এই বার্দ্ধক্যের কালেও, তবুও আমি কিন্তু আর কখনো কলিকাতা যাই নাই।'

তারপর যতদিন বেঁচেছেন, পাতা উল্টে বারবার তাঁর আত্মকথনের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন সেই ফেলে আসা আট বছরের দিনলিপিতে। কী সেই আমোঘ টান, কী সেই অমূল্য প্রাপ্তি- যা তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের সমস্ত কিছুকে ম্লান করে শুধুমাত্র সেই কটি বছরের মায়ামোহতেই তাঁকে টেনে টেনে নিয়ে যায়?

এই অত্যুজ্জ্বল মননের অধিকারিণীর মৃত্যুর কিছুকাল পরে ২০০৭ সালে তাঁরই এক উত্তরপুরুষের হাতে নিরুদ্ধ সেই আত্মকথনের পাতাগুলি এসে পড়ে। তিনি সে কথামালা পড়ে মোহিত হয়ে যান; সযত্নে সেগুলিকে যথাযথ পরিচর্যা করে মনস্থির করেন যে তা প্রকাশ করবেন। যেহেতু কৃষ্ণকামিনী তাঁর কথাগুলি নিজের জন্যই লিখেছিলেন, কখনই জনসমক্ষে প্রকাশ করতে চাননি, তাই সে উত্তরপুরুষ (বিশ্বজিৎ মিত্র) তাঁর অভিপ্রায়কে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাঁর আসল নামটি অপ্রকাশ রেখে ‘পান্তীর মাঠ’ নামে আত্মজীবনীটি প্রকাশ করেন। ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘এই বিশিষ্ট মানুষটি আমার একান্ত আপনার জন। ২০০৭ সালে যখন এই রচনার পাণ্ডুলিপি হাতে পাই, তখনই আমার মধ্যে এটি বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছে জাগে। তার কারণ শুধু এই নয় যে, ভাষ্যটি একটি টালমাটাল সময়ের দলিল আর এর ভাষা সুললিত ও পুরনো ধাঁচের। আমাকে বেশী আকর্ষণ করেছিল এই নারীর উত্তরণের তাগিদ ও ঋজু অকপটতা, যার ব্যাপ্ত-কিন্তু-নিরুচ্চার অভিব্যক্তি সেই সেকালের রক্ষণশীল পরিবারের স্বাভাবিকভাবেই লজ্জাশীলা এক মহিলার পক্ষে অকল্পনীয় ঠেকেছে আমার কাছে। কিন্তু একই সঙ্গে আবার তিনি নিজের পরিবারের সম্মান নিয়েও চিন্তিত। জীবনীর মধ্যেই সেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। তাই সবদিক বিবেচনা করে লেখিকার নাম পরিবর্তন করাই সাব্যস্ত হল।’

তিনি তো ছিলেন কৃষ্ণ অনুরাগী, কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর, সম্ভবত তাই তাঁর উত্তরপুরুষেরা তাঁর কলম-নাম রাখলেন কৃষ্ণকামিনী দাসী।

‘পান্তীর মাঠ’ এক অত্যাশ্চর্য আত্মচরিত। শুধুমাত্র এই কারণে নয় যে, কস্মিনকালেও ইস্কুল বা বিদ্যায়তনের চৌকাঠ না পেরিয়ে কৃষ্ণকামিনী অক্ষর-ধ্বনি ও শব্দের ব্যঞ্জনায় এক অনাবিল ছন্দে গ্রথিত করেন তাঁর লেখনি, তদুপরি, মনের মাধুরী, অভিমান ও জীবনরসকে যে এইভাবে স্রোতস্বিনী নদীর মতো ‘সচলবচল’ (তাঁরই ব্যবহৃত শব্দ) করে তোলা যায়, তা এই গ্রন্থটি না পড়লে ঠাওর করার কোনও উপায় নেই। তাই, এ বই হাতে নিলে নিঃশব্দ রাত ঝর্নার মতো মৌন প্রভাতে অবতরণ করে, নিঃসঙ্গ দুপুর তার দহন তেজের দীপ্তি ফুরিয়ে টুপ করে সন্ধ্যা হয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়!

কৃষ্ণকামিনী শুরুতে দু-এক পাতা গৌরচন্দ্রিকা করেছেন। কেন লিখতে গেলেন তিনি এ আত্মকথন?

‘প্রথমেই বলি, আমার এ কাহিনী কেহ পড়িবে না। আমি ইহা লুকাইয়া রাখিব স্থির করিয়াছি সকলের চক্ষুর অন্তরালে। কারণ, পড়িলে অনর্থ হইবে। কেহ পড়িবে না জানিয়াও আমার লিখিবার কারণ কী?’

এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এই মুহূর্তে পাঠকের কৌতূহল নিবারণের ইচ্ছে আমার নেই। তা করলে, এই অসাধারণ সাহিত্যকর্মের অন্তর্লীন বাঁশির সুরটি থেকে রসিক পাঠক বঞ্চিত হবেন। প্রায় প্রতিটি বাক্যে যে নির্মেদ উচ্চারণ, যে অসীম বোধ ও ভালবাসার গভীর আকুলতা- তা পাঠককেই সিঞ্চন করে নিতে হবে যে! বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কলকাতার ধনী গৃহে অন্তঃপুরবাসিনী যে কিশোরী গৃহবধূ, যার নয়ন জুড়ে চারপাশে নানাবিধ রঙ ও মাধুর্য, শুধু কি তাই, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির টুকরো-টাকরাগুলিও যথাবিধ প্রখর, যেন মনে হবে তা আসলে ইতিহাসের এক নিবিড় ব্যাখ্যা ও পাঠও বটে। স্ত্রীর প্রতি অমনোযোগী কিন্তু সুগায়ক স্বামী, পনের কি ষোলো বছর বয়সে কোলে প্রথম সন্তান, দাস-দাসী পরিব্যাপ্ত ভরা সংসার, সুতীব্র আগ্রহে ঘরে বসেই অক্ষরশিক্ষা ও বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, হরিসাধন মুখোপাধ্যায় মায় যা হাতের কাছে মেলে তাইই পড়ে ফেলা, সচকিতে স্বদেশির ছোঁয়া- এতসব কি আর পল্লবিত হত কৃষ্ণকামিনীর মন ও মননে, যদি না, ‘তখন আমরা দুইজন কিশোরকিশোরী সেই সদ্য-আগত সন্ধ্যার আবছায়ায় পরস্পরের উপস্থিতি উপভোগ করিতে লাগিলাম।’

আর শব্দচয়ন? বাংলা ভাষায় যে কত সুরময়, লাবণ্যময় শব্দের বাস, তা আরও একবার এই বইটি থেকে বুঝতে পারি। অড্ডবড্ড, হটোঠ্যাং, ফৌৎ, থাকদমা, খুঞ্চেবোস, মুড়োয়-কাঁটা-হেঁটোয়-কাটা- এতসব শব্দের বিচিত্র রসভাব তো এই গ্রন্থ থেকেই সংগ্রহে পেলাম!

সব পেরিয়ে ‘পান্তীর মাঠ’ কি আসলে এক সুনিবিড় প্রেম-আখ্যান? যা বলতে গিয়ে চারপাশটাই লেখিকার কাছে হয়ে ওঠে অমৃতময়? যা লিখতে গিয়ে তিনি এঁকে ফেলেন এক নিগূঢ় দৃশ্যকল্প-

‘আমার আনন্দের রাজ্যে আমি এক অদ্ভুত ভাব লইয়া প্রবেশ করিলাম। উদ্ভাসিত সেই মনের রাজ্য। কত রঙের আনাগোনা সেস্থানে। কত কুসুম, কত কুমকুম, কত আবীর। কত গন্ধ-সুবাস। আর সকল কিছু কী কোমল। আমার শরীর বলিয়া সেস্থলে কিছু নাই। তাহা যেন কেবলই ক্রমশ গলিয়া পড়িয়া যাইতেছে। লজ্জা নাই, বেদনা নাই, পূর্ব্ব জীবন নাই, পিছুটান নাই, সঙ্কল্প নাই, পরিণাম নাই, আশা-আকাঙ্খা নাই, এমনকী কী বলিব সন্তানও নাই। কিছু নাই। শুধু এক আশ্চর্য্য আনন্দ ঘিরিয়া থাকে চারিদিক, আমার অন্তর – যেন সকলই অমৃতময়। খাইলেও হয়, না খাইলেও হয়। শুইলে হয়, না শুইলেও চলে। বেশবাস আছে কী নাই, কে জানে ছাই। স্নান করিলে সুখ, না করিলেও সুখের ঘাটতি তো দেখি না। শুধুমাত্র অবস্থাগতিক হইতে পরিত্রাণ পাইবার আশায় অনন্যোপায় হইয়াই হয়ত এই ভাবরাজ্যে আশ্রয় লইয়াছিলাম, কিন্তু তাহার ফলে যাহা মিলিল তাহা বিস্ময়কর। ইহা সত্যিই এক অভূতপূর্ব দশা।’

এ এক অনাস্বাদিত গদ্য। এক অবগাঢ় প্রবাহ। এই এক স্বল্প আত্মকথন ছাড়া তিনি আর কখনও কিছু লেখেননি। লিখবেনই বা কেন? তিনি কি লেখক হতে চেয়েছিলেন? প্রলোভনের শিখর বাইতে বাইতে, হা-হতোহস্মি, এ সমাজে যথাযথ গ্রন্থরস নেওয়ার পাঠকই বা কই? যারা ‘আধুনিক’, সমাজের কত কিছু নিয়ে কত কী বলেন, কখনও ভাববেন কি, অন্যতর যোগ্য হয়ে ‘পান্তীর মাঠ’ হাতে তুলে নিই!

প্রকাশক: অভেদ ফাউন্ডেশন।

(এই অমৃতসমান বইটি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন দীপঙ্কর কুণ্ডু, এক নিরলস বইওয়ালা। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।)     

8 comments:

  1. Pradyumna Bandyopadhyay28 April 2022 at 20:59

    আশ্চর্য এই ব ই য়ের হদিস দেওয়ার জন্য অনিন্দ্য কে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. পড়ার আগ্রহ হচ্ছে

    ReplyDelete
  3. দারুন

    ReplyDelete
  4. ছবির মতো সব লেখা।পুরোটা পড়তে তো হবেই।

    ReplyDelete
  5. পড়ার আগ্রহ তৈরি হল।

    ReplyDelete
  6. মনে হচ্ছে হাতে পেলে এক্ষুনি পড়ে ফেলি

    ReplyDelete
  7. একালে প্রকাশিত সেকালের একখানি অত্যাশ্চর্য আখ্যান আত্মকথার অবয়বে।

    ReplyDelete