'বুঝিলাম আজি আর প্রাণ নাহি রয়...'
অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
হাঁসফাঁস গরম চারিদিকে। প্রাকৃতিক আবহাওয়াও যেমন উষ্ণ, তেমনই বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাও। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরেও। গত কয়েক মাসে ধর্ষণ, হত্যা সহ আরও বহু প্রকারের দুর্নীতি ও হিংসার ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই তর্জনী উঠেছে রাজ্যের সরকারের দিকে, সেই সরকার যাকে মাত্র কয়েক মাস আগেই মানুষ বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেছে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে যে, যখন মানুষের কাছে অন্যান্য দলগুলির চেয়ে সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দলটিই ভরসার প্রতীক ও প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু, তখন তাদের এ হেন আচরণের কারণ ও ব্যাখ্যা কী? এবং অবশ্যই এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তির উপায়ই বা কী?
‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’– বাংলার রাজনৈতিক ভাষ্যে ভারি গুরুত্বপূর্ণ এক শব্দবন্ধ। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটিও এই মুহূর্তে এরই ছায়াতলে দাঁড়িয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চাইছে। অবস্থা সামাল দিতে চাইছে। কিন্তু সবিশেষ সফল হচ্ছে না। আসলে একের-পর-এক ক্রমাগত যদি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ ঘটতেই থাকে তখন বোধহয় আর সেটাকে বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। তখন তা সমাজের এক বিশেষ অবস্থার পরিণতিকে ঘোষণা করে দেয়। আজ এখানে অন্যায়কারী, অন্যায়ের শিকার ও পরিত্রাতা এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছে। ফলে, অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। আর এখানেই বিরোধী দলগুলি নিজেদের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার প্রতিভূ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। অথচ আমজনতা জানে যে বিগত জমানায় দিনকাল কেমন ছিল আর বর্তমানে জাতীয় স্তরে অবস্থাটা কীরকম! ফলে, তাদেরও ডাল খুব কিছু গলছে না।
অনেক চিন্তাবিদই এখানে সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরে ঘটনাগুলিকে বিশ্লেষণ করতে চাইছেন, কিন্তু মনে হয় সেটা লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তাহলে কি এটা হাল ছেড়ে বসে থাকার সময়, নাকি অবস্থাটাকে আরেকটু গভীরে খতিয়ে দেখে হাল ধরার উপক্রম করাই জরুরি?
প্রকৃত প্রস্তাবে, বর্তমান অবস্থার ব্যাখ্যা লুক্কায়িত আছে সময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কলকাতা কেন্দ্রিক যে-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল সেটা এখানকার সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে আদি ছাঁচের (প্যারাডাইমের) একটা বদল ঘটিয়েছিল। সেটা কীরকম? ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অবধি দেশে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের দরুণ যে-ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা অথবা বৌদ্ধিক পরিবেশ বজায় ছিল তা আমূল বদলে গিয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি সর্বস্তরেই দেখা গিয়েছিল নানান পরিবর্তন। আর এইসব পরিবর্তনগুলি উত্থান ঘটিয়েছিল এক সংখ্যালঘু শ্রেণির (মূলত হিন্দু পুরুষ), যাদের মধ্যে ছিল আগামীর শাসক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা (মনে রাখতে হবে দুনিয়ার নিয়মই হল সংখ্যালঘু কর্তৃক সংখ্যাগুরুর ওপরে শাসন আরোপ)। আর এই শ্রেণির মধ্যে ছিল দুটি ভাগ– এক, উদারপন্থী যারা সমাজে পুরনো যা কিছু তার সরাসরি পরিবর্তনের পক্ষে আর দুই, রক্ষণশীল যারা সাবেক ব্যবস্থার মূল আদলের অন্দরে থেকেই পরিবর্তনের পক্ষে।
স্বভাবিকভাবেই ব্রিটিশ সরকার প্রভাবিত হয়েছিল উদারপন্থীদের দ্বারা, কেননা ইউরোপিয়ান রেনেসাঁসের মূল সুর গেয়েছিলেন তাঁরাই। আর তৎকালীন আমজনতার বৃহদাংশই ছিল রক্ষণশীলদের পক্ষে। উদাহরণ হিসাবে বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত সই-সংগ্রহের ঘটনাকে বিচার করাই যায়। উদারপন্থীরা সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সংখ্যালঘু হলেও, শাসক যেহেতু তাঁদের দ্বারাই বেশিরভাগ সময়ে প্রভাবিত হয়েছিল, তাই তাঁরাই ধীরে-ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে পৌঁছতে পেরেছিলেন। যে-কারণে গান্ধীর আগের ও পরের কংগ্রেসের মধ্যে দেখা যায় এক উদ্ভাসিত স্তর ভাগ। গান্ধীর আগে এই দল ছিল এলিট শ্রেণির, তাঁর আগমনের পরে এটা জনগণের দলে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরেই দেশভাগ, দাঙ্গা, গান্ধীর অবস্থান, হত্যা ও কংগ্রেসি এলিট উদার শ্রেণির রমরমা– এই নানাবিধ কারণগুলির জন্য দেশের ক্ষমতার রাশ থেকে যায় সেই সংখ্যালঘু উদারপন্থীদের হাতেই। ব্রিটিশও বোধহয় চেয়েছিল এদের হাতেই ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করতে।
সংখ্যালঘু রক্ষণশীলরা এখানে দীর্ঘদিনের জন্য চেপে গিয়েছিল, টুকটাক ব্যাপার ছাড়া খুব কিছু করে উঠতে পারেনি। এরই বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে ক্ষোভ জমা হয়। তাকেই পুঁজি করে অর্থনীতির স্তরে কিছুটা অন্য মার্গের কথা বলে উঠে এসেছিল বামফ্রন্ট। এরাই প্রচার করেছিল মেহনতি মানুষের হাতে ক্ষমতা প্রদানের কথা। মানুষ এদের বিশ্বাসও করেছিল। কিন্তু এখানেও দেখা গিয়েছিল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ক্ষমতার স্বাদ পেতেই এরাও কৃষক-শ্রমিকদের জন্য কিছু-কিছু ব্যবস্থা করে দিয়ে আরেক উদারপন্থী আকাডেমিক এলিটের জন্ম দিয়েছিল, যারা মুখে সাধারণ মানুষের কথা বললেও জীবনযাপনে অভিজাততন্ত্রের প্রতীক হয়েই সমাজে বসবাস করেছিল। দৃষ্টান্ত হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী থেকে শেষ বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী অবধি লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রায় সকলেই তথাকথিত উদারপন্থী এলিট শ্রেণিভুক্ত। আবার প্রধানমন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই ঘটনা– কংগ্রেসের ক্ষেত্রে যাঁরা উদার এলিট গোষ্ঠীর তাঁদের, আর যাঁরা তা নন তাঁদের রাজত্বকালের সময়সীমার পার্থক্য দেখলেও ব্যাপারটা বোঝা যায়। পক্ষান্তরে অন্যান্য দলের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কমবেশি একই।
কিন্তু এরপরেই, কী রাজ্যে কী দেশে, এক বিপরীত অবস্থা ঘটল। ২০১১ ও ২০১৪ সালে রাজ্য ও দেশের ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছলেন এতদিনের সংখ্যাগুরু কিন্তু ক্ষমতাহীনদের মনের মতো (এতদিন যেমন মনের মতো না হলেও নির্বাচনে উপায়ান্তর ছিল না) প্রতিনিধিরা অর্থাৎ রক্ষণশীল সংখ্যালঘুরা। তাঁরা চাইলেন রাজ্য ও দেশকে অন্যভাবে পরিচালনা করতে। সমস্ত হায়ারার্কিগুলিকে ভেঙে ফেলতে। ভাষা, ব্যবস্থা, পুলিশ, মিডিয়া, আদালত ইত্যাদি সর্বত্র মানুষের শাসন কায়েম করতে ইচ্ছা করলেন। কিন্তু কোন মানুষ? মোটের ওপর রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন যারা। কেউ কেউ ধর্ম (প্রাচীন হিন্দুত্ববাদ নিয়ে এদের মাথাব্যথা) নিয়ে সেই দিক ধরলেন আর কেউ কেউ অর্থ-সম্পত্তি (লোভী সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব কায়েম করা নিয়ে এরা বিচলিত) নিয়ে সে-পথে গেলেন। ফলে, প্রথমেই দেশের উদারপন্থী সংখ্যালঘু শ্রেণি সবচেয়ে বেশি বুকে ব্যথা অনুভব করল। চেঁচামেচি করতে লাগল। কেননা তাদের হাত থেকে সব কিছু বেরিয়ে যেতে থাকল। তারা লুম্পেন, হুলিগান ইত্যাদি নানান বোল কপচাতে শুরু করল। তবে এসব বিষয়কে এতদিনের রক্ষণশীল সংখ্যালঘুরা, যারা সমাজের বৃহদাংশের বলে বলীয়ান ও ক্ষমতাসীন, তারা পাত্তা দিল না। সম্প্রতি এরই প্রতিফলন দেখা গেল এক বিতর্কসভায় রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষনেতার ভাষণে। যেখানে তিনি উপস্থিত উদার এলিট শ্রেণিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'আপনাদের ভোটে কিছু এসে যায় না, সেইজন্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। আপনারা অধিকাংশ লোকই হয়তো ভোট দিতে যান না। আমি আপনাদের নিয়ে মাথা ঘামাই না।' আর এই মাথা না ঘামানোর ফলে যারা কিছুটা কট্টর রক্ষণশীল (তা ধর্মের বিষয়েই হোক কিংবা অর্থ-সম্পত্তির) তাদের আগ্রাসন বাড়তে লাগল। আর এখন এর প্রভাবের পরিসর বাড়তে বাড়তে সাধারণ মানুষকেও অর্থাৎ সংখ্যাগুরুকেও আক্রান্ত করতে শুরু করেছে। ফলে, এই মুহূর্তে আক্রমণকারী, আক্রান্ত ও বিচারক সকলেই অন্তর্গত হয়েছে একই শ্রেণিতে। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অবস্থায় এখন সকলে বেঁচেবর্তে আছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী?
এই অবস্থা থেকে এখন মানুষ স্বস্তি পেতে চাইছেন। কিন্তু তা তথাকথিত উদারপন্থী সংখ্যালঘুদের ফিরিয়ে এনে যে পাওয়া সম্ভব নয় তা সংখ্যাগুরু মানুষ যেমন একদিকে জানে, তেমনই মানুষের কাছে এমন উপায় নেই যা রক্ষণশীল সংখ্যালঘুদের শাসনাধীনে থেকেই এর থেকে মুক্তি অর্জন করার সুযোগ দেবে। মানুষের এই অবস্থার প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায় বৃন্দাবন দাসের সেই লাইনগুলির কথা, 'বুঝিলাম আজি আর প্রাণ নাহি রয়/ কূলে উঠিলে সে বাঘে লইয়া পালায়/ জলে পড়িলে সে বোল কুম্ভীরেই খায়/ নিরন্তর এই পানিতে ডাকাইত ফিরে/ পাইলেই ধন প্রাণ দুই নাশ করে।' সুতরাং, এক বিভ্রান্তির মধ্যে গোটা সমাজ এখন প্রবেশ করেছে।
এমতাবস্থায় আবার বিশ্বের আর্থনীতিক অবস্থান্তরও ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, সাবেক অর্থনীতি থেকে ডিজিটাল অর্থনীতিতে মানুষ ঢুকে গিয়েছে। এখানে শ্রমিক শ্রেণির স্তর বিন্যাস আর আগের মতো থাকছে না। এক থাকছে না যাপনের চিত্রও। সব মিলিয়ে কোন্ উপায়ে ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে সেটা এই মুহূর্তে কেউই জানেন না। বোধহয় সেটাই আসল সমস্যা। আর সেই সমস্যার সমাধানের উপায় অনুসন্ধানই আশু প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কি সেই পথে এগোচ্ছি, নাকি স্রেফ গোল-গোল কথা বলে আর একে-অন্যের সঙ্গে আকচা-আকচি করে এই বিভ্রান্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলছি – সম্ভবত ভাববার সময় এসেছে।
No comments:
Post a Comment