Saturday, 31 July 2021

বিগ মিডিয়ায় বামপন্থীদের টিউটোরিয়াল!

নিছক সেবা নয়, শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে নীতির লড়াই

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের আসন শূন্যে নেমে আসায়, দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিক ভাবে বামশক্তিকে কেউই ছেড়ে কথা বলছেন না। সে তুলনায় কংগ্রেসের দুরবস্থা নিয়ে তেমন সোরগোল খুব একটা কিছু নেই। বিশেষ করে বিগ মিডিয়ায় তো বামেদের প্রতি নানারকম টোটকা ও পরামর্শের ছড়াছড়ি। যেন টিউটোরিয়ালের আসর বসেছে। ‘আনন্দবাজার’ বা ‘এই সময়’এ এ বিষয়ক ঘন ঘন উত্তর-সম্পাদকীয়গুলি পড়লে মনে হবে বামেদের এই ভরাডুবির কারণে তারা যারপরনাই চিন্তিত এবং কী উপায়ে আবারও বাম-উত্থান হতে পারে তার জন্য নানাবিধ পরামর্শ ও উপদেশ দিতে তারা কসুর করছে না। অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে প্রণব বর্ধনের মতো বিদ্দ্বজ্জনেরা বহু শব্দ ব্যয় করে লিখছেন বা বলছেন। মোদ্দা কথায়, সকলেই বাম বিধ্বস্ততায় কাতর। আর তাঁদের এই যাতনায় প্রধানত একটি অভিমুখই খুব স্পষ্ট করে পাচ্ছি- তা এই যে, বামেরা মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন, কারণ, তাঁরা মানুষের কথা শুনতে অনাগ্রহী এবং পরিস্থিতির বিচারে রণকৌশলগত ভাবে নানারকম ভুলভ্রান্তি করে চলেছেন।

আমি অবশ্য জানি না, এ দেশে কোন দল মানুষের কথা শুনে কাজ করে! ভোটের আগে তারা কথা শোনার ভান করে, কিছু কিছু জনমুখি উদ্যোগ নেয় এবং এমন একটা হাওয়া তৈরির চেষ্টা করে যে ক্ষমতায় এলে তারা মানুষের নানাবিধ উপকারে লাগবে ও তাদের সরকার আপেক্ষিক বিচারে মানুষের পক্ষে কাজ করবে। মানুষও সময়ের নিরিখে ভোটের মুখে একটা অদৃশ্য যূথবদ্ধতা গড়ে তোলে- সমর্থন ও বিরোধিতার একটা ম্যাট্রিক্স তৈরি হয় এবং সেই সুবাদেই খুব নিকৃষ্ট ধরনের সরকার চালানো দলটির পরাজয় ঘটে। কখনও কখনও সরকার ততটা নিকৃষ্ট না হলেও, বিরোধী দল এমন একটা সম্ভাবনাময় পরিবেশ-পরিস্থিতির রূপকল্প হাজির করে যে মানুষ তাতে বিশ্বাস করে নতুন সরকারের অভিষেক ঘটায়। তবে হ্যাঁ, মানুষের কথা শোনার একটা আলতো প্রক্রিয়া থাকে, তা এই অর্থে যে, কোন কোন বিষয় নিয়ে জনতা ক্ষুব্ধ ও তাদের সমস্যার মুল জায়গাগুলিকে তারা কীভাবে দেখছে- সেই সব বুঝে নির্বাচনী রণকৌশলকে সাজাতে হয়। তবে এইসব সমস্যার উপাদানগুলিকে বোঝার জন্য নানাবিধ সমীক্ষারও প্রচলন আছে এবং পেশাদার সংস্থার সাহায্যেও তার আঁচ পাওয়া যেতে পারে। যেমন, এবারের ভোটে জনমতকে বুঝতে তৃণমূল দল আই-প্যাক’এর সাহায্য নিয়েছিল।

উপরন্তু, নির্বাচনী রণাঙ্গণে ‘কোর্স কারেকশন’ বলে একটি কথা আছে। যে কোনও দলই একগুঁয়েমি ছেড়ে যদি জনতার রোষের কারণগুলিকে অনুধাবন করতে পারে এবং সেই মোতাবেক নিজেদের পরিমার্জন করে নিতে সক্ষম হয়, তাহলে নির্বাচনী বিপর্যয়কে হয়তো এড়ানো যায়। এর জন্যও পেশাদার সংস্থার সাহায্য নেওয়ার চল শুরু হয়েছে। কারণ, দলের নিচুতলা থেকে আসা ফিডব্যাকগুলি সব সময় নির্ভরযোগ্য হয় না।

পেশাদার সংস্থার সাহায্যেই হোক অথবা নিজ দলের কর্মীদের ফিডব্যাকের ভিত্তিতে- আসল জায়গাটা হল বাস্তবতাকে অনুধাবন করা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে প্রতিফলিত করতে পারা। এক বড় সংখ্যক মানুষ যদি মনে করতে শুরু করে যে অমুক দলটির ওপর নির্ভর করলে তাদের দাবি-দাওয়া কিছুটা পাত্তা পেতে পারে, তবে সেই দল লড়াইয়ের ময়দানে কার্যকরী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে। জেতা-হারা তো পরের প্রশ্ন। এবারের রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট কোনও প্রতিপক্ষই ছিল না- সেটি বোঝার জন্য নির্বাচনী ফলাফল অবধি অপেক্ষা করার দরকার পড়েনি। তা খালি চোখে গত কয়েক বছরেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এর কারণ আর কিছুই নয়, বামপন্থার নীতিগত অবস্থান থেকে তাদের বিচ্যুতি ও কৌশলগত দান ফেলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার অলীক (কু) বাসনা। একে ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ বললে অত্যুক্তি হয় না। মনে হয় না, বাম বিপর্যয়ের এই মৌলিক দিকটি (নীতিগত বিচ্যুতি) নিয়ে বিগ মিডিয়া বেশি অগ্রসর হতে চাইবে। তাদের বেদনাবোধের একটা বড় কারণ সম্ভবত বিজেপি’র মতো একটি ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট শক্তির এ রাজ্যে প্রায় শূন্য থেকে প্রধান বিরোধী পক্ষ রূপে উত্তরণ। সেই বেদনার যাথার্থ্য আছে এবং বামপন্থীদেরও উচিত এই ধরনের ফ্যাসি-বিরোধী সরব রাজনৈতিক উদারবাদীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, বামপন্থীদের বিপর্যয়ের কারণগুলিকে বিগ মিডিয়ার উত্তর-সম্পাদকীয়র প্রান্তরে বেঁধে রাখা। তাহলে আরও বড় বিপর্যয় বামপন্থীদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিগ মিডিয়ার বিশ্লেষণকে অতিক্রম করে বামপন্থীদের বুঝতে হবে তাদের নীতিগত অবস্থান থেকে স্খলনের তাৎপর্যকে। এক কথায়, শ্রমজীবী শ্রেণির পক্ষে থাকার যে রাজনীতি দিয়ে বামপন্থার পরিচয়, তার থেকে শত যোজন দূরে সরে যাওয়ার তাদের যে বিচ্যুতি আর সে বিচ্যুতির কারণে তাদের ফেলে যাওয়া পরিসর-হরণের কাহিনিকেও বুঝতে হবে।

অতএব, অল্প কথায়, বামপন্থীদের (বামফ্রন্টকে গণ্য করে) গৌরব হারানোর পেছনে দুটি বড় কারণকে গভীর চর্চায় নিয়ে আসা উচিত। এক, একুশ শতকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিসরে শ্রমজীবী মানুষের বিবর্তনকে অনুধাবন না করার চেষ্টা করে উদারবাদী পুঁজিবাদের পক্ষে জোরালো ভাবে দাঁড়িয়ে পড়া এবং দুই, ফলত শ্রমজীবী মানুষের পরিসরটি অন্যের দ্বারা দখলিকৃত হওয়া।

প্রথম কারণটির ক্ষেত্রে বলতেই হয়, আজও বামফ্রন্ট সম্যক ভাবে বুঝে উঠতে পারেনি, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জোরপূর্বক কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও কর্পোরেট কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত সমাজকে চাকুরি জোগানের যে খোয়াব তারা দেখেছিল তা এক অলীক কুনাট্য ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। কারণ, এ সত্য প্রায় সর্বজন স্বীকৃত যে আধুনিক কর্পোরেট শিল্পে চাকরি হয় খুব স্বল্পজনের। বরং, দখলিকৃত কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল শ্রমজীবী মানুষের যে কর্মচ্যুতি হয় তা ওই সামান্য কর্মসংস্থানের থেকে অতি বহুল পরিমাণে বেশি। এই কথা শীর্ষ আদালত তাদের রায়েও পরিষ্কার ভাবে বলেছিল। সিপিএম’এর তাত্ত্বিক নেতা প্রভাত পট্টনায়ক এবং বামফ্রন্টের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র মহাশয়ও এই কথাগুলি স্পষ্ট ভাবে লিখেছিলেন। কিন্তু কর্পোরেট বিগ মিডিয়া দ্বারা প্রশংসিত ও উদারবাদী পুঁজিবাদে আচ্ছন্ন বামফ্রন্ট তখন কর্পোরেট শিল্প স্থাপনার লক্ষ্যে আন্দোলনরত কৃষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারপরের পরিণতি আমরা জানি। আর সেই পতন থেকে বামফ্রন্ট তো উঠে দাঁড়াতে পারলই না বরং আরও ক্ষয়প্রাপ্ত হল নিজেদের সেই পুরনো অবস্থানকে আঁকড়ে ধরে থাকায়; এবং গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল এবারের নির্বাচনে সিঙ্গুরে গিয়ে সিপিএম প্রার্থীর প্রতীকী শিলান্যাস করে সেই পুরনো খোয়াব দেখানোয়। সবটা মিলিয়ে তাদের নীতিগত অবস্থান প্রকারান্তরে দাঁড়িয়ে গেল শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে। তাই প্রশ্নটা নীতি ও অবস্থানের। এই জায়গাটা যতদিন না তাঁরা বুঝতে পারবেন, ততদিন তাঁদের ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র কোনও আবহই তৈরি হবে না। তাঁরা তাঁদের যথার্থ সমালোচকদের যত ইচ্ছে গালমন্দ করতে পারেন, কিন্তু আখেরে ক্ষতিটা যে তাঁদেরই হচ্ছে সেটা তাঁরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।

আর দ্বিতীয় কারণটি স্বতঃসিদ্ধ। পরিত্যক্ত ভূমি কখনও পড়ে থাকে না। গরিব শ্রমজীবী মানুষকে পরিত্যাগ করে যে ‘উন্নয়ন’এর রথ ছোটানোর কথা ভাবা হয়েছিল, সেই পরিত্যক্ত গরিব কৃষকের পাশে রাজনীতির কারণেই তৃণমূল দল দাঁড়িয়ে গেল। নিছক দাঁড়ালেই তো চলে না, বামপন্থী ভূষণকেও তারা শিরোধার্য করল। তাদের বলতে আটকালো না যে তারাও একটি বামপন্থী দল। তারা জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আইন পাশের পক্ষেও কাজ করল। ক্ষমতায় এসে এক নতুন ধরনের জনপ্রিয়মূলক ও জনমুখি কার্যক্রমের ধারা প্রবর্তন করে তারা গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের অনেকটা আস্থাও অর্জন করল। তাদের নানারকমের নেতিবাচক কাজের ধারাগুলিকে তারা সেই জনমুখি কর্মসূচি দিয়ে কিছুটা আড়াল করতেও সক্ষম হল। অর্থাৎ, এখানেও সেই নীতিগত প্রশ্নেই তৃণমূল কিন্তু জনমুখি একটা অবস্থান গ্রহণের প্রচেষ্টা নিল যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনের আস্থা অর্জনে কিছুটা সফল হল। অথচ, বামফ্রন্টের বাইরে যে বামপন্থীরা রয়েছে, তারা কিন্তু বামফ্রন্টের ফেলে যাওয়া জমিতে দাগ কাটতে পারল না। সেও বামপন্থার এক সংকটই বটে!

তাই, মনে হয় না, বামপন্থীরা নিছক সুবোধ বালক হয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে। নীতির প্রশ্নে, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও জীবন-জীবিকার প্রশ্নে তাদের স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে যা কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে দ্বন্দ্ব আহ্বান করবে। বুঝতে হবে, বামপন্থীরা থাকুক বা না থাকুক, শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন কিন্তু থেমে থাকে না। গত দশ মাসেরও বেশি সময় ধরে দিল্লির উপকন্ঠে কৃষকদের দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন সে কথা আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট (অবশ্য এই আন্দোলনে অন্যান্য শক্তির সাথে সাথে নানাবিধ বামপন্থীদের উপস্থিতিও লক্ষণীয়)। সেখানে বিগ মিডিয়ার সমালোচনাকে ভয় করলে চলবে না। নানা ধরনের বুদ্ধিজীবী, অ্যাকাডেমিশয়ানদের ‘পেপার’ উৎপাদনের তাগিদে বিচিত্র গবেষণা অনুসারী নানা ধরনের একাডেমিক মাত্রাধারী উপাদানে ভরপুর তর্জায় প্রভাবিত হয়ে বিভ্রান্ত হলেও চলবে না। শ্রমজীবী জনতার সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রাখলেও তা কাজে দেবে না যদি না নীতিগত ভাবে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তোলা যায়। আর সে নীতি হল, শ্রমজীবী শ্রেণির পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রাজনীতির পথকে নির্ধারণ করা। সে কাজে ঝুঁকি আছে, আশঙ্কা আছে। ভুললে চলবে না, এই ঝুঁকিপূর্ণ অনুশীলনের মধ্য দিয়েই বামপন্থীরা শুধুমাত্র এ রাজ্যেই নয়, সারা দেশের বহু জায়গায় প্রবল ভাবে শক্তিশালী হয়েছিল।

আজ বামপন্থার পুনরুত্থানের প্রশ্নকে তাই নবউত্থিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির বাতাবরণে শ্রেণি অবস্থান নেওয়ার পথ ধরেই এগোতে হবে। তেভাগা, তেলেঙ্গানা, নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাব ও প্রসার কিন্তু বাস্তব শ্রেণি সংঘাতের জমি থেকেই উদ্ভুত হয়েছিল। তাই, বামপন্থীরা যদি শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি ও তৎ-অনুসৃত অনুশীলন থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে তাদের শৃঙ্খল ব্যতীত সব কিছুই কিন্তু খোয়াতে হবে; এ রাজ্যে কফি হাউস, কর্পোরেট মিডিয়ার উত্তর-সম্পাদকীয় ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার আর পেপারেই আবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। আশাকরি, সকলে না হলেও অনেকেই, এই প্রগাঢ় সত্য ও প্রখর বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সক্ষম। 

               

Friday, 30 July 2021

অতি চালাকের গলায় দড়ি!

ভারতের সার্বভৌমত্বের অন্তর্জলি যাত্রা

শোভনলাল চক্রবর্তী


বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের যা মনোভাব তাতে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক বিরোধী নেতা-নেত্রী, সাংবাদিক বা রাষ্ট্রদূতদের পিছনে টিকটিকি লাগিয়ে তাঁদের সম্পর্কে খবর জোগাড় করা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে খুব একটা চমকে ওঠার কিছু নেই। কিন্তু ইজরায়েল থেকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার আনিয়ে তার সাহায্যে গোয়েন্দাগিরি বিশিষ্টতার দাবি করে। 

এই 'প্লাগ এন্ড প্লে' স্পাইওয়্যার যে কোনও মোবাইল ফোনকে পরিণত করে অতন্দ্র তত্ত্বাবধায়কে। আপাতত যা খবর পাওয়া গেছে তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই স্পাইওয়্যার ব্যবহারের ফলে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মূলে নেমে এসেছে কুঠারাঘাত। এর মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সংসদীয় বিরোধী পক্ষ, ক্যাবিনেট স্তরের মন্ত্রী, সিবিআই প্রধান, শিল্পপতি এবং সংবাদমাধ্যম। পেগাসাস কাণ্ডে নানা মুনির নানা মত আমরা শুনছি। তবে এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে বিপদজনক সেটা হল, এ ক্ষেত্রে ভারতের সার্বভৌমত্ব সংকটের মুখে পড়ে গেল শুধু নয়, তার অন্তর্জলি যাত্রা করে দেওয়া হল। সেটা নিয়ে সরকার পক্ষ গভীর ভাবে ভেবে দেখেছে বলে মনে হয় না। 

পেগাসাস যে তথ্য সংগ্রহ করছে সেটা যে তৃতীয় কোনও দেশের হাতে পৌঁছে যাবে না, তার কোনও গ্যারান্টি আছে কী? মোদি সরকার পেগাসাস ব্যবহার করে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে এনেছে। আজ যদি কোনও তৃতীয় দেশ ভারতকে পেগাসাস থেকে গৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে তখন কী হবে? যে প্রতিষ্ঠানের কাছে সমস্ত হ্যাক হওয়া মোবাইল নম্বর আছে, তাদের কাছে সেই হ্যাক করা তথ্যও যে আছে, এটা একটা শিশুও বুঝবে। 

এখন প্রশ্ন হল, এই যে প্রায় ৫০,০০০ ফোন পেগাসাস দিয়ে হ্যাক করা হয়েছে, এই খবরটা বেরল কোথা থেকে? এই খবর ভারত থেকে বেরয়নি বা পেগাসাস যে সব দেশে ফোন হ্যাক করেছে সেই সব দেশ থেকেও নয়। তাহলে এই যে অক্টোপাসের শুঁড়গুলো দেখা যাচ্ছে কিন্তু মাথাটা কোথায়? এখানে সন্দেহের তির ধাবিত হচ্ছে এনএসও গ্রুপের দিকে যারা পেগাসাস স্পাইওয়্যার প্রস্তুত ও বিক্রি করে। যদিও তারা বলছে যে তাদের ক্রেতারা এটাকে কীভাবে ও কী কাজে ব্যবহার করছে সেটা তারা জানে না। সেটাই যদি সত্যি হবে তবে তারা এটা কী করে বলছে যে কেউ যদি তাদের স্পাইওয়্যারের অপব্যবহার করে তবে তারা সেই ক্রেতার স্পাইওয়্যার ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিতে পারে!

এর আগে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে তুর্কির সৌদি দূতাবাসের ভিতরে নিহত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসগী'র ফোন, তাঁর বউ, ছেলে এবং তাঁর বহু বন্ধু-বান্ধবের ফোন এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে হ্যাক করা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তুর্কির প্রধান প্রসিকিউটরের ফোনও হ্যাক হয়েছিল এই পেগাসাস দিয়েই। সেই সময় এনএসও গ্রুপের তরফে জানানো হয়েছিল যে তাদের স্পাইওয়্যার দিয়ে খাসগী'র কোনও ছবি তোলা হয়নি বা কথা রেকর্ড করা হয়নি। এটা তারা কি জানাতে পারত যদি তাদের কাছে খাসগী'র ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকত? এনএসও'র স্পাইওয়্যারের অপব্যবহার করলে তারা যে ক্রেতার যোগাযোগ কেটে দেয় সেটা শুধু সামনের দরজার। পেছনের দরজা দিয়ে চলতে থাকে কাজকর্ম। 

এই এনএসও গ্রুপের নিবিড় সম্পর্ক ইজরায়েল সরকারের সঙ্গে। ইজরায়েল প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সবুজ সংকেত ছাড়া এই স্পাইওয়্যার কেনাবেচা করা সম্ভব নয়। এনএসও'র মোট কর্মচারীর সংখ্যা ৭০০ যাঁদের প্রায় সবাই ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রাক্তনী। এঁদের প্রধানত নেওয়া হয় সেনাবাহিনীর গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত থাকেন তাঁদের মধ্য থেকে। ইজরায়েল সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উন্নত অংশ এই গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থার অংশটি। বর্তমান সময়ে যিনি এনএসও গ্রুপের প্রধান তিনি এক সময় ছিলেন ইজরায়েলের 'স্টেট সেন্সর' পদে। সেনাবাহিনীর কোন খবর বাইরে বেরবে তিনিই ছিলেন তার প্রধান নিয়ন্ত্রক। এই যখন এনএসও'র পরিচিতি, সেই পরিস্থিতিতে ইজরায়েল সরকার যখন বলে যে তারা এনএসও দ্বারা গৃহীত তথ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না, তখন হাসি পায়। 

এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে পেগাসাস যে সব খবর পাচ্ছে তা ইজরায়েল সরকারও পাচ্ছে। এনএসও সম্প্রতি জানিয়েছে যে তাদের পেগাসাস দিয়ে কোনও আমেরিকান ফোন হ্যাক করা সম্ভব নয়। যাঁরা পেগাসাস তৈরি করেছেন তাঁরা কি তবে জেনেশুনে এটা করেছেন? এ ব্যাপারে তদন্তে নেমে 'ওয়াশিংটন পোস্ট' সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা জানতে পেরেছেন যে পেগাসাস দিয়ে বিদেশে কর্মরত বহু আমেরিকানের ফোন হ্যাক করা হয়েছে। 'ওয়াশিংটন পোস্ট' আরও জানাচ্ছে যে পেগাসাস দিয়ে সেই সব দেশেই ফোন হ্যাক করা হয়েছে যে সব দেশে আমেরিকা ও ইজরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ যুক্ত। এখন প্রশ্ন, এই সব দেশ থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে পেগাসাস এবং তাদের দোসর ইজরায়েল বা আমেরিকা কী করতে পারে? 

ভারতের কথাই যদি ধরি, তাহলে এই তথ্য ভারতের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের জায়গা দখলের লড়াইয়ে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন চিন এই তথ্য কিনে তা ভারতের বিপক্ষে ব্যবহার করতেই পারে। সেটা ইতিপূর্বেও প্রকাশ্যে এসেছে, আগামী দিনেও আসবে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী কেন চিনের আগ্রাসন নিয়ে ভাসুর ননদের মতো আচরণ করেন তা আরও স্পষ্ট হবে। ইজরায়েলের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গলায় গলায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, তা এখন স্পষ্ট। বিরোধী মুক্ত ভারত গড়ার খোয়াব দেখতে গিয়ে সরকার বাহাদুর সবার পেছনে পেগাসাস লাগিয়ে দিল, কিন্তু বুঝল না আসলে পেগাসাস লেগে গেল দেশের পেছনে। তাই সরকারের পেগাসাস নীতি আসলে ডালে বসে সেই ডাল কাটার সামিল। কয়েক শো কোটি টাকা দিয়ে এই মূর্খের সরকার পেগাসাস কিনেছে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে আনতে। এবার দেখতে থাকুন, ভারতকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে চিন কি খেলাটা শুরু করে। পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে পুষ্ট করছে চিন, বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে জিডিপি'র উন্নতি ঘটিয়েছে চিন, শ্রীলঙ্কায় সামরিক ঘাঁটি খুলে বসে আছে চিন, আর আমাদের অর্বাচীন কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধীদের কান মূলে দিতে গিয়ে যে এখন নিজেরাই কানমলা খেয়ে গেল সেটা কি এই গো ভক্তদের মাথায় ঢুকছে?


Wednesday, 28 July 2021

ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাস্তবতা

এক নতুন ভুবনের দিকে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

একটি তথ্যে (statista.com) দেখা যাচ্ছে, ২০২০ ও ২০২১ এই দু' বছরের জানুয়ারি-মার্চ মাসের তুলনামূলক বিচারে কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থা চূড়ান্ত মুনাফা করেছে। আর এই অতি-মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে প্যানডেমিক ও মানুষের গৃহবন্দিত্বের কারণেই। যারা এই মুনাফার শীর্ষবিন্দুতে আছে তারা হল: অ্যাপেল, অ্যালফাবেট, মাইক্রোসফট, ফেসবুক ও অ্যামাজন। উল্লিখিত সময়-ব্যবধানে এদের মধ্যে তিনটি সংস্থার মুনাফা বৃদ্ধির হার: অ্যাপেল (১১০ শতাংশ), অ্যালফাবেট (১৬২ শতাংশ) ও অ্যামাজন (২২০ শতাংশ)। এক বছরে এই অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয় মুনাফা বৃদ্ধির হার অতীতে কখনও কোনও বাণিজ্যে বা শিল্পে দেখা যায়নি। বোঝাই যাচ্ছে, এ এক সন্ধিক্ষণের মুহূর্ত। এক বিরল পালাবদলের প্রেক্ষাপট; যা শুধু অর্থনৈতিক বিচারেই ধর্তব্য নয়, এক সুদূর সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যেরও ইঙ্গিতবাহী। কারণ, যে সমস্ত সংস্থা এই সুউচ্চ মুনাফা অর্জন করেছে, তারা কেউই চিরাচরিত ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা নয়, বরং কতকটা আনকোরা (যদিও এদের প্রতাপ গত এক দশক ধরে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে) নবতর ডিজিটাল দুনিয়ার এক নতুন আঙ্গিকের শিল্প।

প্রযুক্তির এই যে নবতর আঙ্গিক আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনাকে সুগঠিত করছে, সেখানে দস্তুর এই, মহা তথ্যের (বিগ ডাটা) ওপর নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে যে যত ব্যাপক মানুষের ওপর দখলদারি নিতে পারবে সেই এই ভুবনে রাজ করবে। এই দখলদারির অর্থ ব্যক্তি মানুষের মন, মেজাজ ও যাপনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাকে নিজ নিয়ন্ত্রণে চালিত করা। অর্থাৎ, বিনিময়ের এমন এক দৃশ্যত সরল-কাঠামো গড়ে তোলা যেখানে প্রযুক্তির দৌলতে অনায়াসে আপনি কর্মী অথবা ক্রেতা অথবা কর্ণধার কিংবা স্বউদ্যোগী এবং আরও যা যা কিছু সম্ভব, সেই সেই রূপে আপনার অর্থনৈতিক ক্রিয়াটিকে সম্পন্ন করতে পারেন। আর আপনার এই অর্থনৈতিক যাপনের মধ্য দিয়েই আপনি সমাজে মূল্য সংযোজন করছেন এবং নিজের মূল্যটুকুও বুঝে নিচ্ছেন (মজুরি অথবা উদ্বৃত্ত)। যেমন, আপনি ঘরে শুয়ে-বসেই আপনার স্মার্ট ফোনে খেলার ছলে আপনার পছন্দের পণ্যটিকে বুক করে দিলেন, যা আপনার বাড়িতে দুই কি তিনদিনের মধ্যে পৌঁছে গেল এবং ডেলিভারি বয় দাম নিয়ে বিদায় নিল। পছন্দ না হলে আপনি সাত দিনের মধ্যে সে পণ্য ফেরত দিয়ে টাকাও পেয়ে যেতে পারেন। অথবা, আপনি অনলাইন মারফতই কোনও কাজে ডাক পেলেন (অথবা আপনার কাজের কোনও চাহিদা তৈরি হল), সে কাজ সেরে আপনার প্রাপ্যটুকু বুঝে নিলেন। নিদেনপক্ষে, ফেসবুকে বিনি পয়সার আপনার অলস বিচরণও কিন্তু আপনার সম্পর্কিত তথ্যগুলিকে তুলে নিয়ে আরেক পক্ষ অন্য কোথাও বেচে দিয়ে কিছু রোজগার সেরে ফেলছে। 

এই যে অভিনব ভার্চুয়াল গতায়াত, তা আপনাকে পণ্যদাসে অথবা নতুন ধরনের মজুরি-দাসত্বে রূপান্তরিত করছে; আর অ্যামাজন, গুগল অথবা ফেসবুক বা অন্য কোনও ডিজিটাল কর্পোরেটকে এক অপরাজেয় বাণিজ্যিক সত্তায় উত্তরণ ঘটাচ্ছে। সারা বিশ্ব জুড়ে এই অভিনব বাণিজ্য প্রক্রিয়া সম্ভব হয়েছে একমাত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির মাধ্যমেই। তার যে অপরিসীম গণনা ক্ষমতা, বিস্তৃত বাণিজ্যিক বিশ্লেষণ-ধী ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা এবং সকলের কাছে সমান ভাবে পৌঁছে যাওয়ার কারুকৌশল- তা এই ধরনের বাণিজ্যিক বা শিল্প সংস্থাকে স্বভাবতই এক প্রখর ও দুরন্ত অভিমুখ দিয়েছে।

কিন্তু শুধু এটুকু বললেই নটে গাছটি মুড়োয় না। এই প্রক্রিয়ার অন্দরে এক বিপুল কেন্দ্রীভবনের গল্পও সুপ্ত রয়েছে। অর্থাৎ, এমন এক কেন্দ্রীভবন যা একক আধিপত্যের বিস্তারকে নিশ্চিত করে, যে কেন্দ্রীভবনের জোরে একচেটিয়া মালকিন হয়ে বসার ষোলকলা পূর্ণ হয়। একদিকে ঘরে বসে শপিং করার বাসনা (চাহিদার দিক) আর অন্যদিকে খদ্দেরের দুয়ারে সে চাহিদা মাফিক পণ্য নিমেষে পৌঁছে দেওয়া (জোগানের দিক)- এ শুধুমাত্র সম্ভব এক অতি দক্ষতা সম্পন্ন স্বয়ংক্রিয় শক্তিশালী যন্ত্রব্যবস্থা এবং তদ্ভুত এক তুমুল কেন্দ্রীভূত কারুকৌশলগত ব্যবস্থাপনা দ্বারা। এছাড়াও সমস্ত মানুষকে তাদের হাঁড়ির খবর সহ এক সুতোয় বেঁধে ফেলা এবং তৎপ্রসূত প্রতিটি মানব অস্তিত্বকে বাণিজ্যের জালে জড়িয়ে ফেলে কোনও না কোনও অর্থনৈতিক লেনদেনে যুক্ত করে ফেলা- এও সম্ভব ছিল না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুরন্ত আন্তর্জাল ছাড়া। 

বাকী যা কিছু স্বাধীন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড আছে এখনও, যেমন কৃষিকাজ, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের উৎপাদন বা অন্যান্য চিরায়ত উৎপাদন-প্রক্রিয়া- সব কিছুকেই কোনও না কোনওভাবে বাধ্যত জুড়ে যেতে হবে এই ডিজিটাল কেন্দ্রীভবনে সঙ্গে। যদি কৃষকেরা এবং ছোট ছোট উদ্যোগপতিরা নিজেদের অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্যকে ধরেও রাখতে পারেন, তবুও বাণিজ্যের বড় পরিসরকে ধরতে হলে এইসব ডিজিটাল কর্পোরেটদের প্রযুক্তি-বিন্যাসে তাদের এসে পড়তে হবে। আসছেও। এইভাবে আসলে নির্মিত হচ্ছে এক নতুন রাজনৈতিক ভুবন। যে ভুবনে এতদিনকার সাবেকি ভূ-রাজনৈতিক-সামরিক অবয়বটিকে প্রতিস্থাপন করছে ভার্চুয়াল-প্রযুক্তিবদ্ধ-তথ্যসম্ভার নির্দিষ্ট এক অপার দুনিয়া। রাজনৈতিক-অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে কতিপয় ভার্চুয়াল কর্পোরেটদের হাতে যাদের নিয়ন্ত্রিত পরিসরে জীবনযাপনের সমস্ত উপাদানগুলি আবর্তিত হবে।

শুনতে কিছুটা অবিশ্বাস্য বা বিস্ময়কর হলেও, এই হল পরিবর্তিত দুনিয়ার কঠিন বাস্তবতা। এই মুহূর্তে (জানুয়ারি ২০২১) আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬২.৪ কোটি; ২০২০ থেকে ২০২১'এ এ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪.৭ কোটি। অন্য একটি তথ্য (statista.com) আবার বলছে, ২০২১ সালে আমাদের দেশের ১৩৭ কোটি জনগণের অর্ধেকই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। কারণ, বহু পরিবারে দেখা যায়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী একজন হলেও তাঁর সাহায্যে অন্যেরাও ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। ব্যবহারকারীর এই সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক। অর্থাৎ, তথ্য প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের ব্যবস্থাপনার অভ্যন্তরে যদি এত সংখ্যক মানুষ পৌঁছে গিয়ে থাকেন, তাহলে খুব স্বাভাবিক যে তাঁরা তার কারুকৌশল ও ফাংশানালিটির আওতাভুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়াই হোক অথবা কৃষকবন্ধু প্রকল্পের অনুদান কিংবা স্টুডেন্ট লোন পাওয়া- সবেতেই ইন্টারনেটের সাহায্য জরুরি। এমনটা করুণার চোখে দেখার কোনও কারণ নেই যে নিরক্ষর অথবা তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষেরা কীভাবে এইসব কাজ সম্পন্ন করবেন। অনেকের স্মরণে থাকবে, দু-তিন দশক আগেও শহরের গরিব-নিরক্ষর মজুরেরা তাঁদের অর্জিত মজুরির একটা অংশ মানি-অর্ডার করে দেশের বাড়িতে পাঠাতেন, আর সেই মানি-অর্ডারের ফর্ম সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে ভরে দিতেন পোস্টাপিসে বসে থাকা কিছু বেকার যুবক। এখনও যারা পারছেন না ইন্টারনেটের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে (বাড়িতেও হয়তো তেমন ইন্টারনেট-দক্ষ কেউ নেই), সামান্য পয়সার বিনিময়ে সে কাজগুলি হয়তো অন্য কেউ উতরে দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, ইন্টারনেটের দুনিয়া থেকে আপনার মুক্তি নেই।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন খুবই স্বাভাবিক যে ইন্টারনেটের অভ্যন্তরে তথ্যের যে দুনিয়া, তার যে কারবার ও বিনিময়, বিভিন্ন প্রক্রিয়াগুলিকে সমন্বয় করে যে প্রযুক্তিগত কৌশল- তার ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে শুধু সেই কর্পোরেট দুনিয়ারই। সেখানে বাইরে থেকে কোনও রাষ্ট্র বা অন্য কোনও সংস্থা কারিগরি অক্ষমতার কারণেই কোনও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বরং, এইসব প্রযুক্তিদক্ষ কর্পোরেটদের ওপর নিজেদের নানান কাজে রাষ্ট্রকেই প্রায় সর্বাংশে নির্ভর করতে হয়। অতএব, এই দুনিয়ার যা কিছু কার্যকলাপ তাকে বাইরে থেকে প্রত্যক্ষ করার কোনও উপায় নেই। যেমন, সীমান্তে প্রতিবেশী দেশের সৈন্য মোতায়েন অথবা ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে কর্মপদ্ধতির হাল সরেজমিনে দেখা কিংবা কোথাও বেআইনি ভাবে খাদ্যশস্য বা পণ্য মজুতদারি ঘটলে, রাষ্ট্র চাইলে নজরদারি বা রেইড করতে পারে, তেমন ভাবে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ার অভ্যন্তর কী চলেছে তা জানার কোনও প্রত্যক্ষ পদ্ধতি কিন্তু কোনও রাষ্ট্রের নেই। সে অর্থে ভার্চুয়াল কর্পোরেটরা রাষ্ট্রের তুল্য শক্তিধর। তারা তাই আগামী দিনে নতুন ধরনের গ্লোবাল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পথে। আর সে কারণেই দেশে দেশে এইসব ভার্চুয়াল কর্পোরেটদের সঙ্গে সাবেকি রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। এ দেশেও ট্যুইটার ও হোয়াটসআপ'এর সঙ্গে ভারত সরকারের সংঘাত  আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

যেমন ধরা যাক, 'পেগাসাস' স্পাইওয়্যারের কথা যা নিয়ে সারা বিশ্ব আজ তোলপাড়। ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রনেতারা একে ব্যবহার করছেন তাঁদের রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই ধরনের প্রযুক্তি এমন শক্তিধর ও দুর্ভেদ্য যে তা স্বাধীন ভাবে কোনও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বাণিজ্যিক কারণেও ব্যবহৃত হতে পারে। কোনও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাকে ঘেঁটে দিয়ে তা বাণিজ্য জগতে আধিপত্য বিস্তারে কোনও কর্পোরেট সংস্থা দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে (হয়তো হচ্ছেও)। যে কারণে, চীনের ৫জি প্রযুক্তিকে আমেরিকার রাষ্ট্রনেতারা নিদারুণ ভয় পাচ্ছেন এই কারণে যে তা সে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের দখল নিয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ, দখলদারির খেলাটা বন্দুক আর গোলাগুলির হাত থেকে চলে গেছে প্রযুক্তির দক্ষতা ও অসীম ক্ষমতার হাতে। এই ক্রম-উত্থিত রাজনৈতিক-অর্থনীতিগত ব্যবস্থাই আগামী দিনের নতুন দুনিয়া।

ফলে, ভবিষ্যতে শ্রমজীবী মানুষ কোনও একটি দেশ বা চিরায়ত রাষ্ট্রের অধীনে আর থাকবে না। তারা হয়ে উঠবে বৈশ্বিক এবং নিয়ন্ত্রিত হবে ক্রম উদীয়মান এক সাধারণ বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা। যে ভাবে গুগল, ফেসবুক, হোয়াটসআপ, অ্যামাজন প্রভৃতিরা গোটা বিশ্বের দখল নিয়ে 'একক' এক রাষ্ট্রীয়-সত্তার মতো হয়ে উঠেছে, যে ভাবে 'পেগাসাস' আজ কয়েকটি দেশে (ভারত সহ) দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যে ভাবে কোভিড-১৯ আজ বিশ্ব-ভাইরাস হয়ে উঠেছে, সে ভাবেই সমস্ত পণ্য (শ্রমশক্তি সহ) ক্রমেই আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল-চরিত্রের হয়ে উঠবে। আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার আজ যেমন বাস্তব, ঠিক একই ভাবে বিশ্ব থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহ বিদায় নেবে (কিছু ব্যতিক্রম কিছু অঞ্চলে থেকে যেতে পারে), কিন্তু প্রযুক্তির দ্বন্দ্বমুখর কোলাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বলয়ে এক নতুন সংঘাত ও রণনীতি নির্মিত হবে। শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে ভার্চুয়াল দুনিয়ার কর্পোরেটদের নতুন দ্বন্দ্ব দেখা দেবে- সেই আমাদের ভবিষ্যৎ।

 

Tuesday, 27 July 2021

২০২৪'এর লড়াই

বিরোধী জোটের সম্ভাবনা

মালবিকা মিত্র


২০১৯ থেকেই কিছু বিরোধী নেতা মোদী সরকার বিরোধী একটা জোট গঠন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই কাজে প্রধান আগ্রহী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসন্ন বিপদাশঙ্কা তিনি বোধ করি সর্বাগ্রে টের পান। নোটবন্দী জিএসটি বালাকোট এনআরসি ভ্যাকসিন সব ক্ষেত্রে প্রথম সোচ্চার প্রতিবাদে তাঁকেই দেখা গেছে। আর এবারেও ২১ জুলাই মঞ্চ থেকে এক সর্বাত্মক উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। দিল্লিতেও এসেছেন এর সম্ভাবনার সমস্ত রকম অঙ্ক কষে। ধীরে ধীরে এক পা এক পা ফেলে এগোতে চাইছেন। আসার আগে, 'পেগাসাস' বিষয়ে দুই প্রাক্তন বিচারপতির একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন যারা পশ্চিমবঙ্গে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে কাদের কাদের ফোনের ওপর কেমন নজরদারি ও তথ্য চুরি হয়েছে তার তদন্ত করবে। 

স্পষ্টতই তিনি মোদির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় মাঠে নেমেছেন যা একদিকে বিরোধীদের মনোবল জোগাবে ও অন্যদিকে মোদির বাহিনীর ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে। দেশ জুড়েই দেখা যাচ্ছে, মমতা'র এই মনোভাবকে প্রায় সকলেই (রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজ, কৃষক সমাজ, এমনকি শাসকেরা পর্যন্ত) বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমার মনে হয়, এই প্রক্রিয়ায় এতাবৎ একটাই ভুল হয়ে এসেছে- আগে নির্বাচনী জোট গঠন তারপরে লড়াই- এটা ভ্রান্ত। আগে পথে লড়াই, তারপর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জোট গঠন ও ভোটের লড়াই। এমনতর একটা আভাস যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলনবলনে বেশ স্পষ্ট।

জাতীয় স্তরে অন্যান্য অনেক নেতা সেদিন (২০১৯) আসন্ন বিপদের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হলেন। তাঁরা নিজ শক্তি ও ক্ষমতায় অতিরিক্ত আস্থাবান। প্রতিপক্ষ যে কত নিম্নস্তরের হতে পারে, পুলওয়ামা, বালাকোট, সন্ত্রাস, জঙ্গি মুসলিম, পাকিস্তানের চর, নগদ অর্থ ছড়ানো, সরাসরি বিরোধী সাংসদ কেনা, দাঙ্গা লাগানো, খোলামেলা হিন্দু রাষ্ট্রের ঘোষণা করে সংখ্যাগুরুর ভোটে মেরুকরণ- সব অস্ত্রের প্রয়োগ হল। বিজেপি জোট বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা, রাম মন্দির এজেন্ডা, কর্নাটকে সরকার ভাঙানো, মধ্যপ্রদেশের সরকার ভাঙানো- সমস্ত রকম নোংরা খেলা আমরা দেখলাম। আবার মহারাষ্ট্রে আরও নির্লজ্জ নোংরামি করে, রাজ্যপাল বিচারপতি সকলকে জড়িয়েও শেষ অবধি মুখে কালি। এরপরে দিল্লি, ঝাড়খণ্ডে হার অব্যাহত রেখে অতঃপর হরিয়ানা, বিহারে গ্রেস নম্বরে কোনও মতে পাশ। বাংলা, কেরল, তামিলনাড়ুর কথায় আর আসছি না। 

২০১৯'এর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্ষমতায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসার পর অঙ্গরাজ্যের জনতা হিসেবে ভেবেছিলাম আগামী পাঁচ বছর কী এক ভয়ানক টেস্ট ক্রিকেট দেখব। দেখলাম, টেস্ট ক্রিকেট নয়, এক একটা রুদ্ধশ্বাস টি-টোয়েন্টি। প্রথম দিনের হাঁটু মুড়ে নতজানু হয়ে সংসদ ভবনের সিঁড়িতে প্রণামের ঘটা আর বাহারটা ভাবুন। সেদিনই সব স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। মনে পড়েছিল চাণক্য উক্তি- 'তোমাকে আমি পূজা করবো... না না না তোমাকে আমি আগে বধ করব, তারপর তোমার মূর্তি গড়ে তোমাকে পূজা করব।' স্বচক্ষে আমরা দেখলাম, ৩০৩'এর গরিষ্ঠতা নিয়েও সংসদের অধিবেশনে কী অনীহা। ৩৭০ থেকে তিন কৃষি আইন, মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফড়নবিশ থেকে এনআরসি, বিদেশে কোটি ভ্যাকসিন রফতানি থেকে দেশের জন্য ভ্যাকসিনের দাম ধার্য করা- সংসদ সর্বত্রই মূর্তিবৎ। সরকার কখন কোন কোম্পানি বিক্রি করছে কেউ জানে না। মহামহিম শ্রী শ্রী সংসদে কোনও আলোচনা বিতর্ক কিছুই নেই। স্পষ্ট বোঝা যায়, স্বৈরাচারী শাসক সংসদে ৫০০ থাকলেও কোনও আলোচনা চায় না, বিতর্ক চায় না। আর তাই তো সাত বছর হল মোদী সরকারের বয়স, তবুও আজ অবধি তিনি কোনও সাংবাদিক সম্মেলনে বসেননি। তবে পোষ্য অনুগত সাংবাদিকদের বাছাই করা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিজেকে জাহির করেছেন। করবেন নাই বা কেন? পণ্ডিতদের বানিয়ে দেওয়া বক্তৃতাও তালগোল পাকিয়ে 'extra 2ab' তত্ত্ব বা ছাত্র ছাত্রীদের 'climate change' প্রশ্নের উত্তর শুনলেই Entire Political Science'এর ঝুলির ম্যাঁও বেরিয়ে পড়বে। 

২০২৪'এর নির্বাচন বিরোধীদের কাছে একটা ধর্মযুদ্ধ। কথা হল: ১) স্পষ্টতই সংসদ ও সংসদীয় গণতন্ত্র বর্তমান শাসকেরা চায় না। তাই, সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই ২০২৪ সাল। ২) আইনশৃঙ্খলা, কৃষি, বিক্রয় কর, এসবই ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপাদান। এখন অঙ্গ রাজ্যের অনুমতি ছাড়াই দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্যে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা পাঠাচ্ছে, আদালতের কোনও নির্দেশ, কোনও বৈধ আদেশ, কোনও পূর্ব বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই শহরের মহানাগরিককে গ্রেফতার করতে যাচ্ছে ৪০/৫০ জন কেন্দ্রীয় জওয়ান নিয়ে। ভাবটা যেন, এরা আত্মগোপন করা জঙ্গি। অথচ নিজাম প্যালেস থেকে বৈধ চিঠি দিয়ে এঁদের যতবার তলব করা হয়েছে এঁরা সহযোগিতা করেছেন। মহামান্য আদালতও কিছুতেই বুঝতে পারল না মুখ্যমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী কেন নিজাম প্যালেসে হাজির হলেন। একটি নির্বাচিত সরকারের বরিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা মন্ত্রী গ্রেফতার হলেন অপ্রত্যাশিত ভাবে কোনও প্ররোচনা ছাড়াই। আর সরকারের অভিভাবক চুপচাপ হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবেন? এটা প্রত্যাশিত আচরণ? যেভাবে শিষ্টাচার না দেখিয়ে অসভ্যের মতো আচরণ করে রাজ্যের বরিষ্ঠ, সদ্য বিপুল জনসমর্থনে নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীদের গ্রেফতার করা হল- একটু বেলা বাড়ার সাথে সাথে নিজাম প্যালেসের বাইরেটা কী চেহারা নিয়েছিল ভাবুন। শুধু ববি হাকিমের কন্যার কাতর মিনতি জনরোষ সামলাতে পারত না। মুখ্যমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী উপস্থিত না থাকলে কলকাতা অগ্নিগর্ভ হত। সেটা হয়নি, সেই ছক পণ্ড হয়েছে। 

অঙ্গরাজ্যের আয়ের একটি প্রধান উৎস ছিল বিক্রয় কর। সেই কর মিলে গেল জিএসটি'র সাথে। এখন অঙ্গরাজ্যকে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রধান সেবক নির্লজ্জভাবে বলছে অঙ্গরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে একটি দলের সরকার (ডবল ইঞ্জিন) থাকলে উন্নয়নে গতি আসবে। খোলামেলা সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিরোধিতা। মহারাষ্ট্র কেরল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল, দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর নির্লজ্জ ভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে রাজভবনকে বিজেপির সদর দফতর বানিয়েছে। এক কথায় নির্লজ্জ। ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সেই কাঠামোর রক্ষাকবচ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, বহুদলীয় অস্তিত্ব এসবই আজ একদলীয় আগ্রাসনের মুখে। বলা হচ্ছে, লোকসভা-বিধানসভা একবারই ভোট হবে। ডাবল ইঞ্জিন সরকার হবে। সংসদের দুই কক্ষে একদলীয় আধিপত্য। আর কোনও সমস্যা নেই। যেন, 'খেলার ছলে ষষ্টিচরণ হাতি লোফেন যখন তখন'। 

'নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান'- এই অতুল অনুপম ভাবনা শিশু পাঠ্যপুস্তক থেকেও বিদায় নেবে। এক দেশ, এক দল, এক নেতা, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক আইন, একটা সমসত্ত্ব সংস্কৃতি, গোলি মারো শালো বহুত্ববাদকো। লুঙ্গি পাজামা দেখে, চিঁড়ে খাওয়া দেখে দেশদ্রোহী চেনা যাবে। এর বিরুদ্ধে এখনই জোটবদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা চাই। এটা প্রধানমন্ত্রী হবার যুদ্ধ নয়। ভারতের বহুত্ববাদ, ভারতের ঐতিহ্য সংস্কৃতি, ভারতের সংবিধান, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জাতি ধর্ম গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার লড়াই। জোটের নেতারা আগেই ঘোষণা করুক আমি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নই। এটা মহাভারতের যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ। 

অনিবার্য ভাবেই এসে পড়ে প্রশ্ন। কারা এর জোট শরিক হবে? একটাই উত্তর: সকল আঞ্চলিক দল, যারাই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের উচ্ছিষ্ট ভোগী নয়, অঙ্গরাজ্যের হকদার। কংগ্রেস দল কি এই জোটের অংশ হতে পারে? অংশ হতে পারে কিন্তু নেতা নয়। এখানে কেউ নেতা নয়। তার আগে কংগ্রেসকে অঙ্গীকার করতে হবে যে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির ইউনিয়ন হল ভারতের যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, একদা কংগ্রেস নিজেই স্থায়ী সরকার, কেন্দ্রে-রাজ্যে এক দলের সরকার ইত্যাদি শ্লোগান দিয়েছে। মনে রাখবেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার ক্ষয় রোগের শুরু নেহেরু প্যাটেল গুলজারিলাল নন্দার যুগেই। সাংবাদিক নুরানী দেখিয়েছেন, ৫৬ বার ৩৭০ ধারার অধিকার ক্রমশ দুর্বল করা হয়েছে। ৮০-৯০'এর দশকে সারা ভারতে জ্যোতি বসু, রামা রাও, রামকৃষ্ণ হেগড়ে, নাম্বুদ্রিপাদ, বিজু পট্টনায়ক, প্রকাশ সিং বাদল, ফারুক আবদুল্লাহ, মুলায়ম, লালুপ্রসাদ, নৃপেন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখদের যৌথ উদ্যোগে অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করার প্রতিবাদে ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্রমাগত কেন্দ্র মুখিনতার প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। যে আন্দোলনের মূল শত্রু ছিল জাতীয় কংগ্রেস। 

অতএব, এবারের লড়াই পবিত্র সংবিধান রক্ষার লড়াই। সবাই এখানে ধর্মযোদ্ধা। কেউ প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার নয়। পঞ্চপাণ্ডব যেমন যুদ্ধ জয় করেও লোলুপ দৃষ্টিতে ফল বন্টন করেনি নিজেদের মধ্যে, ২০২৪'এর লড়াই তেমনই। ক্ষমতা দখলের নয়- ক্ষমতার কেন্দ্রকে ভাঙা ও অঙ্গরাজ্যগুলির ইউনিয়ন গঠনের লড়াই। আক্ষরিক অর্থে, গণতন্ত্র ও পার্লামেন্টকে গুড়িয়ে দিয়ে সেন্ট্রাল ভিস্তা গড়ে তোলার কুনাট্য এবং এক দল এক দেশ এক নেতা এক ধর্ম এক ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই। আরও স্পষ্ট করে বললে, সমগ্র দেশের গুজরাটিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই। অর্থাৎ, আবারও একটি স্বাধীনতার আন্দোলন।


Monday, 26 July 2021

'পেগাসাস'এর জুজু

ভারতীয় জাসুস পার্টি ও দেশের ভবিষ্যৎ

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


পশিমবঙ্গে বাস করি আর রাজনীতি নিয়ে ভাবব না, তাও হয়? তবে, রাজনীতি নিয়ে আর লিখব না ভেবেছিলাম। তবু লিখতে হচ্ছে, কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের বিচিত্র আচরণ।

এ দেশের সরকারের কোনও আচরণেই রাজনীতি খুঁজতে হয় না, তা এতই জ্বলন্ত। এই যে 'পেগাসাস' কাণ্ড তাতেও রাজনীতি। কী এই  'পেগাসাস'? এ এক অতি কৌশলী গোয়েন্দা সফটওয়ার। এক বিশেষজ্ঞর কথায়, এই স্পাইওয়্যার সরাসরি স্থান করে নেয় মোবাইলের 'সিমে'। একে বিদায় করা যায় না, এর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না- গোপনে ছবি, কথা সবই চালান করতে পারে রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্রের কাছে কেন? কারণ, সেই তো এর মালিক। স্রষ্টা এই স্পাইওয়্যার কেবল রাষ্ট্রের কাছেই বেচে। আমার অন্য এক বন্ধু একবার বলেছিলেন, যারা এসব বানায় তাদের মেধা অসামান্য। হলে কী হয়, এরা যে অর্থলোভে নিয়োগকর্তা তথা বাজারের কথায় চলে!

নিজের ক্ষতি নাকি পাগলেও বোঝে। রাজনীতিজ্ঞরা পাগলও না, ছাগলও না। তাঁরা বেশ বোঝেন। তবে বোঝেন তাই, যা চোখে দেখেন। এর বেশি না। যদি সামান্যও বেশি বুঝতেন, বুঝতেন মানুষের মনের কথা, তবে ইজরায়েলি সংস্থা থেকে এমন স্পাইওয়্যার কেনার আগে বারবার ভাবতেন নিশ্চয়। এমন এক স্পাইওয়্যার তাঁরা কিনেছেন যা মারফত যে কোনও দেশের যে কোনও নাগরিকের (এর মধ্যে লেখক, সাংবাদিক, নেতা, মন্ত্রী, সান্ত্রী, পাঠক, লেখক সবাই আছেন) ব্যক্তিগত জীবন, বন্ধু, আড্ডা, যোগাযোগ ইত্যাদি সব তথ্যাদি চুরি করা সম্ভব। এখন নেতারা বুঝি বাছছেন কার জমিতে ছড়াবেন এই বীজ। ভবিষ্যতে অনেক ছড়ানো হলে নাও বাছাবাছি হতে পারে। যে কোনও মোবাইলেই তার ঘর বাঁধা সম্ভব। এভাবে খুব দূরে নয় যেদিন বিষবৃক্ষে ছেয়ে যাবে দেশ। কারও সাথে আর প্রাণ খুলে কথা বলা যাবে না। এমনকি কেনাকাটা, সিনেমা দেখা, বাইরে ঘুরতে যাওয়া সবই বন্ধ হবে এই স্পাইওয়্যারের কুপ্রভাবে।
 
বর্তমান শাসক তো জানে ভবিষ্যতে শাসক বদল হলে এই স্পাইওয়্যার ব্যুমেরাং হতে পারে। তবু তো দেখি তারা অকুতোভয়। তবে কি তারা ধরেই নিয়েছে সেটি হবে না, হবার নয়। হে শাসক! বাজারকে পাশে নিয়ে আর বন্দুক বাগিয়ে, বুটের আওয়াজে ভয় দেখিয়ে তুমি ভাবছ মানুষের অধিকার অস্বীকার করে সিংহাসন দখলে রাখতে পারবে চিরদিন? কিন্তু যেদিন মানুষ ছেড়ে এই স্পাইওয়্যার বাজারকে আক্রমণের লক্ষ্য করবে! ভয়ংকর সেদিনের দিকে তাকাচ্ছে না আজকের এই দেশের রাজনীতিবিদেরা।

ফরাসি সরকার নাকি তদন্তে নেমেছে। ভারত বা পাকিস্তান সরকার এমন কোনও তদন্তের নির্দেশ এখনও দেয়নি। পাকিস্তান সরকার না দিতে পারে কিন্তু ভারত সরকার দেবে না কেন তেমন আদেশ? এই দেশ নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ! পাকিস্তানের চেয়ে অনেক উন্নত নাকি আমাদের সংস্কৃতি! কিন্তু, এ কেমন গণতন্ত্র? সারা দেশ চাইছে, দেশের সব বিরোধী দল চাইছে (তারা সবাই মিলে কিন্তু দেশের নির্বাচকমণ্ডলীর দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেয়েছে গত নির্বাচনেও, যার যোগফল শাসকের প্রাপ্ত ভোটের প্রায় দেড় গুন বা আরও বেশি); দলের সমর্থকরাও কী চাইছেন না সত্য সামনে আসুক? চাইছেন, তবে মুখ খুলে বলতে পারছেন না। বলতে পারছেন না তদন্ত হোক। সোনা-জহরৎ মোড়া সত্য নয়, মানুষের আস্থা অর্জনকারী সত্য আসুক দিনের আলোর মতো। কেমন করে বলবেন! তাদের মাথার ওপর যে এক জোড়া ভয়ংকর সর্বগ্রাসী স্বৈরশাসক 'সন্ন্যাসী' আছেন, কে আর হরেন পান্ড্যিয়া হতে চান! অন্তত এখন এ কালে, এ দেশে আর কেউ চান না। এখন আর দেশে বিপ্লবী মেলে না, মেলে সন্ত্রাসবাদী, আতঙ্কবাদী। কানাইলাল বা ক্ষুদিরামদের দিন গিয়াছে! আমাদের দেশে শাসনদণ্ড যাদের হাতে সেই খুনে যুগল গুজরাটে ভয় দেখিয়ে, প্রাণ কেড়ে জনসমর্থন আদায় করেছে। ওরা জানে সে সব ছলাকলা, যে ছলাকলার সাহায্যে জনমত পদানত করা যায়। এই বাংলায় তাদের জারিজুরি বা ছলাকলা খাটেনি। তাতে কী, উত্তরপ্রদেশে খাটবে না?
 
এখন সময় এসেছে সেই শপথ নেবার, যে শপথে ওদের রঙ্গ, ওদের কৌশল, ওদের ভয় দেখানোর অস্ত্র ভোঁতা করে দেওয়া সম্ভব হয়। এখন সময় এসেছে ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার মানুষ খুনের, মানবতা খুনের, মানবাধিকারকে হাস্যাস্পদ করে তোলার। সম্মানের সাথে বাঁচার অধিকার আমাদের অস্ত্র। মানবতার এমন শত্রুকে যদি পরাস্ত করতে না পারি তবে ইতিহাস তথা আমাদের পরের প্রজন্ম আমাদের করুণাও করবে না। 
 
আসুন শপথ নিয়ে বলি, ভয় করি না তোমাকে, তোমার চৌর্যবৃত্তির ঐ স্পাইওয়্যারকে। শপথ নিন, বিকল্প হতে পারেন যারা তাঁরাও। শপথ নিন যে একই রকম অন্যায় আপনারাও করবেন না। মনে রাখবেন, যদি তেমন কিছু করেন তো লোকে কেবল আপনাদের নয়, এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাঠামোটাকেও ঘৃণা করবে। কানাইলালরা ফিরবে।


Saturday, 24 July 2021

রোগ-ভোগ

চিকিৎসার এ কূল সে কূল

সঞ্জয় মজুমদার


সেই কোন হবকালে হগ সাহেবের মার্কেট থেকে ট্রামে চড়ে বছর চল্লিশের শ্যামবর্ণ, বেঁটে, গোলগাল চেহারার নন্দবাবু বাড়ি ফিরছিলেন। বিডন স্ট্রিট ছাড়িয়ে বাড়ির মুখে এসে বন্ধু বঙ্কুকে দেখে বেকায়দায় নামতে গিয়ে ধুতির কোঁচায় পা বেঁধে নিচে পড়ে যান। চোট একেবারেই পাননি নন্দ। তারপর? বাকি কাহিনির সরস বর্ণনা আছে পরশুরামের (রাজশেখর বসু) গড্ডলিকা সিরিজের (১৯২২) 'চিকিৎসা সঙ্কট'-এ। বাপের এক ছেলে নন্দবাবুর পৈতৃক সম্পত্তি এবং পয়সার অভাব ছিল না। কাজেই বন্ধুদের পরামর্শে চিকিৎসার কোনও ত্রুটি তিনি রাখেননি। এই সরস কাহিনি প্রকাশিত হওয়ার প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর পর ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়। নন্দ'র চিকিৎসা সঙ্কট বিপুলানন্দে (ডাক্তার মিস বিপুলা মল্লিক) মধুরেণ সমাপয়েত হলেও অধুনা ১৩৮ কোটি দেশবাসীর চিকিৎসা সঙ্কট গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।

এই সঙ্কটের কারণ বিশ্লেষণ বা উৎস সন্ধান করার কোনও ইচ্ছা আমার নেই। সচেতন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। ঠিকঠাক সার্চ প্যারামিটার দিলেই ইন্টারনেটে যে কোনও সঙ্কটের ভুরিভুরি কারণ এবং তার চুলচেরা বিশ্লেষণ বেরিয়ে আসে। সে সবের বঙ্গানুবাদ করার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। সেই চর্বিত চর্বণ। সরকারি ব্যর্থতার খতিয়ান। রোগী প্রতি ডাক্তারের সংখ্যা, বেডের সংখ্যা, হাসপাতালের সংখ্যা- এইসব মাথামুণ্ডু রাশিবিজ্ঞানের ছড়াছড়ি। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও এইসব কারণ একই থেকে গেছে। কী হবে এসব বিশ্লেষণের পাহাড় মাথায় নিয়ে? তার চেয়ে বরং নন্দবাবুর কথায় ফিরে আসি।  

পরশুরাম লেখক হিসেবে অত্যন্ত বাস্তববাদী। কাহিনির শুরুতেই নন্দ'র আর্থিক সচ্ছলতার পরিমাণ উল্লেখ করতে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি। ১৯২২ থেকে আজ ২০২১- প্রায় একশো বছরেও ছবিটা এক চুল বদলায়নি। দেদার গাঁটের পয়সা খরচা করতে পারলে তোমার চিকিৎসা হবে, যদিও সঙ্কট কাটবে কিনা তার নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। মজার কথা হল, ট্রাম থেকে পড়ে গিয়েও নন্দ'র কিছুই চোট লাগেনি। তা সত্ত্বেও স্রেফ বন্ধুদের সু বা কু-পরামর্শে অ্যালোপ্যাথি থেকে হোমিওপ্যাথি, কোবরেজি এবং শেষমেশ হেকিম- সবার কাছেই মাথা খুঁড়ে মরেছে সে। অর্থাৎ, কিছু হোক না হোক, সঙ্কট কাটুক না কাটুক, পকেটে পয়সা না থাকলে চিকিৎসা ব্যবস্থার দরজায় কড়া নাড়া খুব মুশকিল। 

তাহলে কি দেশের লোক চিকিৎসা করায় না? করায় বৈকি। আলবাত করায়। এই যেমন নমিতাদি। আমাদের পাশের গলিতে সুমনদের বাড়িতে আজ প্রায় পাঁচ বছর কাজ করছেন। দুজন অসুস্থ বয়স্ককে দিনের বেলা দেখাশোনা করতে হয়। থাকেন মল্লিকপুরে। স্বামী রংয়ের মিস্ত্রি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আমি বীরেনদার দোকানে ওষুধ কিনি। সেখানেই আলাপ ওনার সাথে। মাধ্যমিক পাশ বীরেনদা ওষুধ বেচতে বেচতে হাফ ডাক্তার হয়ে গেছেন। চোখ কপালে তুলে লাভ নেই। এরকম সিকি, হাফ বা পৌনে ডাক্তারেই দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের চিকিৎসা চলে। ফল জেনে আর কী হবে। যাক গে, নমিতাদি তাঁকেই ডাক্তার মানেন। বীরেনদা চশমাটা নাকের উপর নামিয়ে গম্ভীরভাবে ওষুধও দেন সমস্যা শুনে। নমিতাদি তো বলেন, দিব্যি কাজ দেয় বীরেনদার ওষুধে। কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি, বীরেনদার ওষুধের দোকান বেশ বড়। আঁটঘাট বেঁধে সেই কবে থেকে দোকান চালিয়ে যাচ্ছেন। দুটো কম্পিউটারে সমানে জনা চারেক কর্মচারী অনর্গল অন্তহীন ওষুধের ব্যাচ নম্বর, হেন নম্বর, তেন নম্বর তুলেই যাচ্ছেন। সঙ্গে বিনি পয়সার ডাক্তারি। নিজের বিদ্যেয় না কোলালে লাগোয়া চেম্বারে মিত্তির ডাক্তারের কাছে ভিড়িয়ে দেন। এছাড়াও নানান মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট, অক্সিজেন সিলিন্ডার, মায় আয়া নার্স পাঠানো, ফাউলার বেড ভাড়া দেওয়া- কত কী যে বীরেনদা একসাথে চালান! মানে, বেশ গোছানো কারবার, আর এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অজস্র এমন ডাক্তারের চেম্বার সমেত ওষুধের দোকান-কাম-মাইক্রো হাসপাতাল আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। 

তাও তো নমিতাদির মতো মানুষজন বীরেনদাদের ওষুধের দোকান পর্যন্ত পৌঁছন। বিস্তর লোকজনকে চিনি, এমনকি আমি নিজেও স্রেফ ফোনে ডাক্তারের কথা শুনে বা না শুনে, নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী টুকটাক ওষুধ চালিয়ে টুপটাপ ভালোও হয়ে যাই। লাগলে তুক না লাগলে তাক। পরের স্টেজে বীরেনদা, তা না হলে মিত্তির ডাক্তার, তাতেও না সারলে হাসপাতাল। 

আর মন্টু সিং? মাথায় পাগড়ী, গালপাট্টা দেওয়া ইয়া গোঁফ। হার্ডওয়ারের দোকান থেকে একগাদা সিমেন্ট বালির বস্তা ভ্যান রিকশায় চাপিয়ে প্রায় দিনই কোথায় কোথায় পৌঁছতে যায়। সে তো আরেক মক্কেল। শরীর খারাপ হওয়াটা খুব অপরাধের মনে করে। ভ্যান থামিয়ে সেদিন দেখি রাস্তার ধারে গাছতলায় দাঁড়িয়ে বেশ হাঁফাচ্ছে। বিরল দৃশ্য। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেয়া হুয়া, তবিয়ত ঠিক হ্যায়? দাওয়াই লোগে?' শুনেই মন্টু সিং নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, 'নেহি রে বাওয়া, এইসে হি ঠিক হো যায়গা।' এইরকম নিজের ডাক্তার নিজেতে ভর্তি। তবে প্রথাগত ডাক্তারি ছাড়াও শুশ্রূষা হয় কিন্তু। খোঁজ নিলেই জানা যাবে, গ্রাম ভারতের এমনকি খাস শহর, শহরতলি, মহানগরেও তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক স্রেফ বিশ্বাসে ভর করে, চুপিচুপি বা ঢাকঢোল পিটিয়ে জ্যোতিষ, ওঝা, তান্ত্রিক নির্ভর চিকিৎসার পেছনে সময় আর পয়সা খরচা করে। আসলে 'বিশ্বাস' শব্দটা চিকিৎসায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, আর সেখানে ব্লিচিং পাউডার, ডেটল, স্যানিটাইজারের সাথে ভোগ-প্রসাদ চরণামৃতও এক পঙক্তিতে বসে যায়। 

'ডাক্তার তফাদার (MD, MRAS) গ্রে স্ট্রিটে থাকেন। প্রকাণ্ড বাড়ি, দু' খানা মোটর, একটা ল্যান্ড। খুব পসার, রোগীরা ডাকিয়া সহজে পায় না। দেড় ঘন্টা পাশের কামরায় অপেক্ষা করার পর নন্দবাবুর ডাক পড়িল।' 

স্বাধীনতার আগে পরে এই বিশ্বাসের কোনও পরিবর্তন আমাদের হয়েছে কী? হয়নি বোধহয়। দু' তিন লাইন জোড়া ডিগ্রি (তার মধ্যে কয়েকটা আবার বিদেশি হলে বিশ্বাসটা বেশ মজবুত হয়), অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা (ডাক্তারবাবুর ব্যক্তিগত সচিবের মাধ্যমে), এইসব না হলে চিকিৎসকের ভারটা ঠিক জমে না, ধার যাই হোক না কেন। 

'কীরকম বুঝলেন?' জিজ্ঞেস করায়  নন্দকে তফাদার বলেছিলেন, 'ভেরি ব্যাড... আরো দিন কতক ওয়াচ না করলে ঠিক বলা যায় না। তবে সন্দেহ করছি cerebral tumour with strangulated ganglia। ট্রিফাইন করে মাথার খুলি ফুটো করে অস্ত্র করতে হবে, আর ঘাড় চিরে নার্ভের জট ছাড়াতে হবে। শর্ট-সার্কিট হয়ে গেছে।' এইসব জটিল মেডিকেল টার্ম শুনে রোগীর ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। নন্দ তাও সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'বাঁচবো তো?' 

সুমনের দাদু-দিদা সে প্রশ্নও করেন না। দামী হাসপাতালের একগাদা পাশ করা ঘন ঘন বিলেত যাওয়া  নামী ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখে বীরেনদাই হাজার পনেরো টাকার ওষুধ ফি-মাসে নমিতাদির হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেন। শারীরিক অবস্থার বিশেষ হেরফের না হলেও পনেরো হাজারি ওষুধের গুণমান বোঝার দরকার নেই সুমনের দাদু-দিদার। মোটা টাকার মেডিকেল ইন্সুরেন্স করা আছে। আউটডোর-ইনডোর সব সুবিধাই অন্তর্ভুক্ত। ফলে, ঘটিবাটি বেচার কোনও ভয় নেই। সকালে ঘুরঘুর করতে বেরিয়ে প্রায়ই মানুষ দুটোর সঙ্গে রাস্তা থেকে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দু-চারটে সুখ-দুঃখের কথা হয় আমার। বুঝতে পারি, চলৎশক্তি ঘরের বাইরে না গেলেও তাঁরা খুশি এবং আশ্বস্ত ওষুধ খেয়ে। ব্যতিক্রম থাকলেও এটাই আসল কথা।

বন্ধুদের সিমপ্যাথি আর কমে না। পরশুরামের গল্পে নন্দ এবার অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে হোমিওপ্যাথির দিকে পা বাড়ালেন। চোরবাগানের নেপাল ডাক্তারের বাড়ি। 'MBFTS - মস্ত হোমিওপ্যাথ। একটি প্রকাণ্ড ঘরের মেঝেতে ফরাশ পাতা। চারিদিকে স্তূপাকারে বহি সাজানো। বহির দেওয়ালের মধ্যে গল্পবর্ণিত শেয়ালের মতো বৃদ্ধ নেপালবাবু বসিয়া আছেন। মুখে গড়গড়ার নল, ঘরটি ধোঁয়ায় ঝাপসা হইয়া গিয়াছে।' নন্দকে নেপাল ডাক্তারের প্রশ্ন, 'শ্বাস উঠেছে?',  নন্দ, 'আজ্ঞে?' নেপাল, 'রুগীর শেষ অবস্থা না হলে তো আমায় ডাকা হয় না, তাই জিজ্ঞেস করছি।' হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদের মানসিকতার মোক্ষম বর্ণনা। 

এগিয়ে যাই ১৯৭২'এর আশেপাশে আমার ছেলেবেলায়। পাত্রের নাম ও বয়স বদলাবে। নেপাল ডাক্তারের জায়গায় স্টিল-প্লান্টের দশটা-পাঁচটার কেরানি দেবুকাকু, যিনি সন্ধ্যায় হয়ে যেতেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। নন্দ'র জায়গায় আমি নিজে, সঙ্গে আমার মা। যথারীতি দেবুকাকুর ঘর হোমিওপ্যাথির মোটা মোটা বইতে ঠাসা আর ধোঁয়ার পরিমাণ একটু কম। গড়গড়ার জায়গায় সিগারেট। এখানে একটা কথা না বললেই নয়। মন্টু সিং-এর মতো আমার বাবাও শরীর খারাপ হওয়াটা গর্হিত অপরাধ মনে করতেন। বিশেষ করে নিজের ছেলে-মেয়ের। তাতে অবশ্য স্নেহ যত্নআত্তিতে কিছু ক্ষান্তি রাখেননি। দেদার পুষ্টিকর জিনিসপত্র, মানে ফল শাকসবজি মাছ মাংস কিনে আনতেন পরিবারের জন্য। তাঁর নিজেরও সুঠাম নীরোগ শরীর ছিল। ওষুধ খেয়ে সুস্থ থাকাটা খুব একটা পছন্দ করতেন না। আমি কোনওরকমে মায়ের বকার হাত থেকে বাঁচার জন্য স্কুলের পড়াটুকু করে এ পাড়া ও পাড়ায় ক্রিকেট-ফুটবল গুলি ডাংগুলি খেলে বেড়াতাম। একদম শেষে বাড়ি ঢোকার মুখে দিদিদের সাথে তাচ্ছিল্যভরে কিতকিতও খেলতাম। সর্দিকাশি থেকে জ্বর লেগেই থাকত। মন্টু সিংয়ের মতো এমনিতে ঠিকও হয়ে যেত। মাঝেমধ্যে বাড়াবাড়ি হলে বেশ কাবু হয়ে পড়তাম। বাবাকে বলা যাবে না। চাঁটি খাব। মা ঠিক বুঝতে পারতেন। ছেলে চুপ করে ঘরের কোণে বসে আছে মানে সন্ধ্যায় দেবুকাকুর বাড়ি যেতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতাম। হোমিওপ্যাথির পুরিয়া খেলে প্রথম দিকে জ্বর বেড়ে যেত। খুব বিরক্তিকর ছিল আমার কাছে। দেবুকাকু যত্ন করে পুরিয়া (সাদা চৌকোনো বিশেষ ধরনের ছোট ছোট কাগজের উপর সাদা রংয়ের মিষ্টি মিষ্টি গুঁড়ো) গুছিয়ে মাকে সব বুঝিয়ে দিতেন- কখন কোনটা কীভাবে খেতে হবে। শেষে রোগীকে ডাকতেন, কারণ তার হাতে অতিরিক্ত দু-চামচ সাদা মিষ্টি গুঁড়ো না দিলে সে তো ঘর থেকে বেরবে না। আমার তো দেবুকাকুর কাছে যাওয়ার ওটাই ছিল লোভ।

সস্তায় পুষ্টিকর খাবারের মতো অবস্থা হোমিওপ্যাথির, উচ্চারণ বিভ্রাটে কাউকে 'হোমোপাখি'ও বলতে শুনেছি। অ্যালোপ্যাথির সাথে তার প্যাথেটিক সম্পর্ক। গ্রাম ভারতের প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলে এমনকি পাড়ায় একটা অন্তত হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বার পাওয়া যাবেই। স্থানীয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে হোমিওপ্যাথির ডাক্তারবাবুরাই ভগবান। সেখানে তাঁদের দাপট এবং প্রতিপত্তিও গাড়ি-বাড়ি হাঁকিয়ে বিশাল। তবু দুঃখের বিষয়, ২০২১-এও সে যেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ত্যাজ্যপুত্র। কেউ অসুস্থ হয়ে হোমিওপ্যাথি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এমনটা আমি শুনিনি। হতেও পারে কোথাও কোথাও। টাইফয়েড হয়ে একবার অ্যালোপ্যাথি হাসপাতলে ভর্তি হওয়া ছাড়া কৈশোরের প্রায় পুরোটাই প্রয়োজনে হোমিওপ্যাথি পুরিয়া খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। অথচ কেন যে এই পরীক্ষিত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা অর্জন করতে পারিনি, আমার নিজের কাছেই সেটা রহস্য। হতে পারে আমার চিন্তার দুর্বলতা। এই ধারার চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর ভরসা করেই দেশ-বিদেশের বিরাট অংশের মানুষ স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পেয়ে থাকেন। অথচ অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ফেল করলে জোড়া পাঁঠা মানত করে কালীমন্দিরে বলি দিয়েছে তবু হোমিওপ্যাথি ওষুধ খায়নি এমন উদাহরণও আমি দেখেছি। যাই হোক, দেবুকাকুর কল্যাণে আমার জ্বর সর্দি-কাশি কমলেও নন্দবাবুর কোনও উপকার নেপাল ডাক্তার করতে পারলেন না। 

চিকিৎসা সঙ্কটের প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছি‌। পরশুরাম নন্দকে এখন তারিণী কবিরাজের ডেরায় হাজির করেছেন। 

'কবিরাজ মহাশয়ের বয়স ষাট, ক্ষীণ শরীর, দাড়ি-গোঁফ কামানো। তেল মাখিয়ে আটহাতী ধুতি পরিয়া একটি চেয়ারের উপর উবু হইয়া বসিয়া তামাক খাইতেছেন। এই অবস্থাতেই তিনি প্রত্যহ রোগী দেখেন। ঘরে একটি তক্তপোশ, তাহার উপর তেলচিটে পাটি এবং কয়েকটি মলিন তাকিয়া। দেওয়ালের কোলে দুটি ঔষধের আলমারি।' 

এ কথা সে কথার পর নন্দ'র রোগভোগের আনুপূর্বিক বর্ণনা শুনে তারিণী কোবরেজ এবার পথ্যে হাত দিলেন। 'কবিরাজ মহাশয় আলমারি হইতে একটি শিশি বাহির করিলেন, এবং তাহার মধ্যস্থিত বড়ির উদ্দেশ্যে বলিলেন- 'লাফাস নে থাম্ থাম্। আমার সব জীয়ন্ত ওষুধ, ডাকলি ডাক শোনে। এই বড়ি সকাল-সন্ধ্যি একটা করি খাবা। আবার তিনদিন পরে আসবা। বুঝেচ?' প্রত্যুত্তরে নন্দ বুঝেছেন বলায় তারিণীর উত্তর, 'ছাই বুজেচ। অনুপান দিতি হবে না? ট্যাবা লেবুর রস আর মধুর সাথি মাড়ি খাবা। ভাত খাবা না। ওলসিদ্ধ, কচুসিদ্ধ এইসব খাবা। নুন ছোবা না। মাগুর মাছের ঝোল একটু চ্যানি দিয়া রাধি খাতি পারো। গরম জল ঠাণ্ডা করি খাবা।' 

বাবার কাছে তাঁর কবিরাজ ঠাকুরদার অনেক গল্প শুনেছি। বাংলাদেশের গাইবান্দায় তেনার কবিরাজির পসার ভালোই ছিল। গাঁয়ের লোকের ধন্বন্তরি ছিলেন নাকি। ইয়া বড় বড় গামলা, ঢাউস হামানদিস্তা, এ গাছ সে গাছের শিকড়-বাকড়, পাতা, ডালপালা নিয়ে সে সব কারবার। দার্জিলিং-এর কাছে রঙভঙের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয়েছিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝলাম তিনি পাহাড়ের কবিরাজ। রাস্তার ধারে হিমালয়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গাছপালা থেকে চার-পাঁচ রকমের গাছ নিজের হাতে আমাকে দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন। কোনওটায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হয়, কোনওটায় সুগার বা কোনওটায় জ্বর সর্দি কাশি কমে। অবিশ্বাস করার কোনও জায়গাই নেই। পাহাড়ি গাঁয়ের উদয়াস্ত খেটে খাওয়া লোকজন তাঁর কাছ থেকেই ওষুধ নিয়ে সুস্থ হন। ওঁর কাছ থেকেই শোনা পাহাড়ে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রচুর, যা আমি ভাবতেও পারিনি।

হাজিক-উল-মুলক্ বিন লোকমান নুরুল্লা গজন ফুরল্লা অল হাকিম য়ুনানীর লোহার চিৎপুর রোডের বাসায় গিয়ে নন্দ'র সঙ্কট যাত্রা শেষ হয়েছিল। নন্দ'র মাথা টিপে হাকিম শুধু বলেছিলেন, 'হড্ডি পিলপিলায় গয়া', মানে নন্দ'র মাথার হাড় নাকি নরম হয়ে গেছে। সাধুসন্ত ওঝা পীরবাবা হাকিম কবিরাজ হোমিওপ্যাথি অ্যালোপ্যাথি এমন অজস্র চিকিৎসা ব্যবস্থায় মোড়া আমাদের দেশ। সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা বিশ্লেষণ পেতে গেলে ইন্টারনেটও ফেল করে যাবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আগ্রহ থাকলে আপনি যে কোনও একটায় ঝাঁপ দিতে পারেন। যাতে বিশ্বাস আপনার। 

মহামারির কোপ আমাদের দেশ আগেও সহ্য করেছে, এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু এছাড়াও বহু নিঃশব্দ ঘাতক রোগভোগ আছে যার চিকিৎসা আবহমানকাল ধরে দেশবাসী যে যার বিশ্বাস অনুযায়ী করিয়ে এসেছেন। এর কোনও ব্যতিক্রম হবে না। দু' একটা ছুটকো ছাটকা দুর্ঘটনা ছাড়া যে কোনও মাধ্যমের চিকিৎসক যেচে রোগীর ক্ষতি করতে চান না। এই বিশ্বাসটা রাখতে হবে আর মন খারাপ করলে অতি অবশ্যই রাজশেখর বসুর (পরশুরাম) 'চিকিৎসা সঙ্কট'এ বিপুলানন্দের সরস কাহিনি রসিয়ে পড়ে নেবেন। মন ভালো হয়ে যাবে। নিশ্চিত। রবি ঠাকুরও রাজশেখর বসুর লেখনির গুণগ্রাহী ছিলেন। আর আমার দাদামশাই ইন্দুভূষণ গুপ্তের হাতে রবীন্দ্রনাথের যে কোনও বই তুলে দিলে মুহূর্তে রোগভোগ ভুলে যেতেন, এও এক ধরনের চিকিৎসা।


Friday, 23 July 2021

ছেড়ে যাওয়ার কথা

পিছুটান

অনুপম চক্রবর্তী


ঢাকা থেকে মাইল দশেক দক্ষিণে মনেশ্বর গ্রামস্থানীয় থানায় পুলিশ অফিসার আমার দাদামশাই রাজেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার অনেকটা জায়গা জমি নিয়ে তাঁর বাড়ি প্রশস্ত চাতাল ঘিরে একাধিক দালান কোঠা পূবে বৈঠকখানা, উত্তরে দুই দালান জুড়ে শোবার ঘর ঠিক উল্টোদিকে হেঁসেলএক কোণে ইঁদারা, তার দু' পা দূরেই স্নানঘর মজুমদার বাড়ির আকর্ষণ তাঁদের মস্ত বাগান হরেক প্রজাতির আম, কাঁঠাল ও লিচুগাছের সম্ভার সকলের নজর কাড়ে        

রাজেন্দ্র চন্দ্র ও তাঁর ভাই বীরেন্দ্র চন্দ্র একসঙ্গে থাকেনবীরেন্দ্র চন্দ্র পেশায় ডাক্তার। তাঁর পরিবার বলতে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ও মেয়ে বন্দনা রাজেন্দ্র চন্দ্র ও সুরবালা দেবীর ভরাট সংসার। তাঁদের নয় সন্তান হিরণ্ময়ী, কিরণময়ী ও লাবণ্যময়ীর পর একমাত্র ছেলে বিজয় গোবিন্দ দেখা দেয় বিজয় গোবিন্দর পরের পাঁচজন যথাক্রমে জ্যোতির্ময়ী, প্রতিভা, রেণুকা, অনুপমা এবং সকলের ছোট নিরুপমা, আমার স্নেহময়ী মা।

ছোটবেলা থেকেই মা তাঁর ঠাকুমা, প্রসন্নকুমারী দেবীর বড় ন্যাওটা ঠাকুমাও তাঁর আদরের নীলাকে চোখে হারানরোজ সন্ধ্যাপ্রদীপ দেওয়ার আগে নাতনির কোমর ছাপানো চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে বেঁধে দেন। রাতে কাছে নিয়ে ঘুমান। ফি বছর আমের মরসুমে তাঁরা পারলে বাগানেই বাসা বাঁধেন আম কুড়ানো, ভালো আর দাগি আম আলাদা করা, কাঁচা-পাকা আম বাছাই করা, কতই না কাজ তাঁদের! দিনরাত এ হেন ব্যস্ততা দেখে আমার মামা বিজয় গোবিন্দ মাকে মজা করে বলেন,   

'ভুতুম, তরে এবার আম-পেত্নীতে ধরবো।' 

ভুতুম ভাবে পেত্নী ধরলেই বরং ভালো পড়া মুখস্ত করার ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পাবে   

সেদিন কী কারণে গৃহশিক্ষক আসেননি। আমার দিদিমা সুরবালা দেবী রান্নার ফাঁকে মা-র পড়া দেখতে এসেছেন। পড়ুয়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সামনে খোলা বই।       

'ও মনু, আর পড়ন লাগবো না। তর বাবায় টকের ডাল খাইতে চাইছে। খানকয়েক কাঁচা আম রান্নাঘরে দিয়া যা।'  

যেই না মা উঠতে যাবে, চুলে পড়েছে টান সুরবালা দেখেন চুলের আগা খাটের সঙ্গে বাঁধা।     

'তাই ভাবি, খাটের পায়ায় গোছা গোছা চুল লাইগ্যা থাকে কেন্!'        

'কি করুম! পড়তে বইলেই ঝিমুনি আসে। তাই চুলটা খাটের লগে বাঁইনধা থুই। ঢুইল্যা পড়লেই চুলে টান পড়ে'

'তরে এই কায়দাটা শিখাইল কে?'

'ঠাকুমায় জানো মা, জানলার পাশে দেয়ালে ঝোলানো ঐ দড়িটায় টান দিলেই লিচু গাছে ঘন্টা বাজে দড়ির অন্য মাথায় আরও অনেক দড়ি গিঁঠ দেওয়াঐ দড়িগুলায় ঘন্টা ঝোলান। সেইগুলা আবার লিচুগাছের সরু ডালে বাঁধারাতে যখনই ঠাকুমার ঘুম পাতলা হয়, দড়িতে হ্যাঁচকা টান মারেন, ঘন্টার আওয়াজে বাদুর পালায়। তা না হইলে আমাগো আর লিচু জুটতো না, ব্যাবাক অগো প্যাটেই যাইত'   

সুরবালা একগাল হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অনুপমা বোনের কানে কী যেন বলে চলে গেল।  

মা বাগানে গিয়ে দেখে অনুপমা একটা গাছ পাঁকা কাঁঠাল আগলে বসে।   

'মনু, এইটারে খাবি কৈ? কেউ যদি দেইখ্যা ফেলায়!'      

'চল্, গুদামঘরের পেছন দিয়া স্নানঘরে গিয়া ঢুকি।'    

অনেকক্ষণ যাবৎ ঘর বাগান খুঁজেও কন্যাদ্বয়ের দেখা না পেয়ে স্নানঘর বন্ধ দেখে সুরবালা কৌতূহল বশে জিজ্ঞাসা করেন,

'ভেতরে মনু নাকি?'

'হ'

'কাঁঠালের বাস নাকে লাগে যেন্'  

'আমি একা না, লগে অনুদিও আছে।'

এরমধ্যে মা-র থেকে বছর ছয়েকের ছোট খুড়তুতো বোন বন্দনা ঘটনাস্থলে উপস্থিত   

'অ্যাই ছোড়দি, আমার ভাগেরটা?'  

'আমাগো প্যাটে একটু সবুর কর, তরে আচার বানানো শিখাইয়া দিমু।'  

মা-র নির্দেশ মতো বন্দনা, আমার ফেসুমাসি, কুলের আচার বানিয়ে ছোট ছোট দলা করে রোদে শুকোতে দিয়েছে। দলাগুলোর আকার ক্রমশই ছোট হয়ে যাওয়ার কারণ মাসি জানতে চাইলে উত্তরে মা বলে,  

'তর মাথায় গোবর ভরা! এও বোঝস না, রোদে শুকাইয়া গিয়া ছোট হইয়া যাইতেয়াছে!'

দিন যায়, দলার আকার ছোট হতে হতে বিলুপ্তির পথে। এবার আর রহস্যের উৎস বুঝতে মাসির অসুবিধা হয় নামা-র চুলের মুঠি ধরে পিঠে দমাদ্দম কিলমাসি যত মারে, মা ততই হাসে আর বলে,

'ফেসু, তর হাতে মার খাইতে আমার কি যে ভালো লাগে!'     

বাড়িতে অফুরান খুশির মেজাজ থাকলে কী হবে, দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা সকলকে বিচলিত করে তোলে। বঙ্গভঙ্গের ফলস্বরূপ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভয়ানক রূপ ধারণ করেছেছিনতাই, খুন, ধর্ষণ যেন রোজকার ঘটনারেণুকা, অনুপমা এবং নিরুপমার সত্বর বিয়ে দিতে না পারলে যে কোনও মুহূর্তে বড় বিপদের আশঙ্কা। চরম দুশ্চিন্তায় আমার দিদিমা প্রায় উন্মাদএকদিন অপারগ হয়ে তিনি প্রতিভার স্বামী জগদীশ রায়কে বলেন,

'বাবাজীবন, তোমার কোনও অকল্যাণ হইব না, এই তিনগারে কুপাইয়া বুড়িগঙ্গার জলে ভাসাইয়া দাও। আমি আর এগো মুখ দেখতে পারি না!'

রায়মশাই এক মাসের মধ্যেই রেণুকা এবং অনুপমাকে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে শাশুড়িমাকে সঙ্কটমুক্ত করেছিলেন   

মজুমদার বাড়িতে আজ শোকের ছায়া। প্রসন্নকুমারী দেবী অমৃতলোকের পথেনীলার বিয়ে দেখে যাওয়ার বড় সাধ ছিল তাঁরনীলা যখন বাবাকে হারায়, কতই বা তার বয়স! দশ-এগারো হবে। কাকা বীরেন্দ্র চন্দ্র ছেড়ে গেছেন আরও আগে, তার শৈশবে। এখন সে অষ্টাদশী। এই প্রথম মৃত্যুকে চিনল সে। শেষবারের মতো ঠাকুমাকে প্রণাম করে নীলা ধীর পায়ে পৌঁছে যায় আমবাগানেমুকুলের গন্ধে ছুঁতে চায় তার ঠাকুমাকে  

১৯৪৬ সনের শীতের সকাল। ঠাকুরঘরের সামনে তার ঠাকুমার পিঁড়িতে মা একলা বসে উদাস মনে আকাশপানে চেয়েরাতভোর ছাতিমের তীব্র গন্ধ কুয়াশায় মিশে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ধরিত্রী বড় নির্মম আজ। বিজয় গোবিন্দ, তাঁর মা, কাকিমা এবং ছোট দুই বোন, নিরুপমা ও বন্দনাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিলেন কলকাতার অভিমুখে। জন্মাবধি চেনা চরাচরের সঙ্গে সখ্য ছিন্ন হয়ে গেল এক লহমায়। রেলগাড়ি চলতে শুরু করে। জানলার ফাঁক দিয়ে মা খুঁজে ফেরে তাদের দালান কোঠা, চেনা বৃক্ষরাজি। চোখে পড়ে কেবল আদিগন্ত সবুজ ফরাশ পাতা ঢালাও তৃণভূমি। ঘাসের মাথায় জমে থাকা শিশির বিন্দু সকালের মিঠে রোদে যেন শত সহস্র মুক্তদানা, চলেছে তাদের সঙ্গে।  

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বন্দনা ব্যানার্জী, গৌরি ঠাকুর, সুপর্ণা চক্রবর্তী এবং গৌতম চক্রবর্তী