মানবতার সূর্যালোকে আমাদের ঘুম ভাঙুক
অনিন্দিতা মণ্ডল
প্রথমেই জানাই আজ কেন কলমটা ধরলাম। একজন ডাক্তার এবং সর্বোপরি একজন মানুষ হিসাবে আজ কিছু কথা না বলতে পারলে নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হবে। বিগত কয়েকদিন ধরে যে আন্দোলন চলছে তা আর কেবল চিকিৎসক সমাজের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই, জনসাধারণের অনুভূতিকেও নাড়া দিয়েছে।
এই আন্দোলনের সূচনা গত ৯ অগস্ট ২০২৪, এক অভিশপ্ত শুক্রবারে; যেদিন ভোররাতে কর্মরত অবস্থায় নির্মমভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হয় আমাদের অভয়া বা তিলোত্তমাকে, তাও আবার এই কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকেই এক হাসপাতালে। সেদিন সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে জুনিয়র চিকিৎসকরা এক বিপ্লবের সূচনা করে। সেই আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং স্বচ্ছ ময়নাতদন্তের দাবি। অনেক চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে সেদিন তারা একত্রিত হয়েছিল। হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রোদ, বৃষ্টি আর সমস্ত ভয়কে জয় করে তারা ন্যায়ের দাবি জানিয়েছিল। হারিয়ে ফেলা সহকর্মীর জন্য বিচার চাওয়া কি এত বড় ধৃষ্টতা? না হলে কেন কিছু অশুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেদিন লণ্ডভণ্ড করে দিল পুরো হাসপাতাল? স্বাধীনতার মধ্যরাত্রে যখন চিকিৎসক সমাজের ডাকে সাড়া দিয়ে আপামর বঙ্গবাসী পথে নেমেছিল, ঠিক সেই সময় হাসপাতালে চলল তাণ্ডব।
ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও এই শান্তিপূর্ণ, সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলনকে থামিয়ে দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল কিছু মানুষ। কিন্তু সেদিনের পর আন্দোলন হল আরও তীব্রতর। পাহাড়ি ঝর্ণাতে বাঁধ দেবার মতোই ব্যর্থ প্রয়াস। আন্দোলন হল আরও খরস্রোতা। ন্যায়ের দাবিতে স্লোগানে মুখরিত হল সারা কলকাতা। 'আমি ভয় করব না ভয় করব না' বলে সবাই এগিয়ে চলল। এই কলকাতা অতীতে কবে দু' বেলা মরার আগে মরেনি তা আমার জানা নেই। জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে থেকে অনবরত আন্দোলন চালিয়ে গেলেন, আর তাদের পাশে ঢাল হয়ে সিনিয়র চিকিৎসকরা রোগীদের পরিষেবা দিতে লাগলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, কোনওদিনই কিন্তু এমারজেন্সি পরিষেবা থেকে রোগীকে বঞ্চিত করা হয়নি। নিন্দুকেরা অবশ্য তা নিয়ে কুৎসা করা থেকে বিরত থাকেননি। কিন্তু আমরা, চিকিৎসকরা, চিকিৎসা না করতে পারলে ততটাই কষ্ট পাই যতটা একজন কৃষক মাঠে যেতে না পারলে পান, যতটা একজন শিল্পী গান না গাইতে পারলে পান, যতটা কষ্ট একজন শিক্ষক পান পড়াতে না পারলে।
এই লড়াই কেন তারা বেছে নিলেন? এই পথ কি খুব সুখের? একবার ভেবে দেখুন তো, আজ একজন চিকিৎসক যদি কর্মরত অবস্থায় এই জঘন্য ঘটনার শিকার হন, তাহলে আমার আপনার বাড়ির নারীরা সুরক্ষিত তো? কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ ছাড়াই একবার ভাবুন তো, যদি এই অন্যায়ের শাস্তি না হয় তাহলে আমরা পারব তো এই সমাজে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিতে? এই ঘটনার দায় কি আমরা কেউ এড়াতে পারি? আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ই কি এর কারণ নয়? যেদিন দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল তার দায় কিন্তু সমাজ এড়াতে পারেনি। সেই পাপেই ১৮ দিনের মহাযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কৌরবকুল। আজকের ঘটনা কি তার সমতুল্য নয়?
কিন্তু আজও, ২৬ দিন কেটে গেলেও, আমরা সুবিচারের অপেক্ষায়। এই দীর্ঘ বিচারব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘ করে তুলেছে বিভিন্ন প্রমাণ লোপাটের প্রচেষ্টা। আমরা কি আদৌ নিরাপদ? রাতে কাজ করা না হলেই কি ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে আমরা মুক্তি পাব? তিলে তিলে গড়ে ওঠা নারী স্বাধীনতার পরিসর নির্ধারণের অধিকার কিন্তু এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের হাতে নেই। ধিক্কার এই সমাজকে, যেখানে নারীদের পথে নামতে হচ্ছে রাতের দখল নিতে, নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে। এই আমাদের সভ্যতা? একজন মহিলা চিকিৎসক যদি রাতে কাজ না করেন তাহলে শুধু পুরুষদের দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা চলবে না। আপনার, আমার বাড়ির লোক যখন রাতে অসুস্থ হলে ডাক্তারের অভাবে ছটফট করবেন, তখন আমরা বুঝতে পারব যে এটা কোনও সমাধানসূত্রই নয়। আর শুধু ডাক্তার কেন, যে কোনও পেশার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। তাই আমাদের চিন্তাধারার বদল আবশ্যিক। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আমাদের শেখায় যে কেবল নিজের বাড়ির মা, বোন, স্ত্রী, কন্যার সম্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ, আর বাকি সকল নারীকে বস্তুবাদিতার নিরিখে মাপা যায়, ধিক সেই সমাজকে। সেই সমাজেরই কিছু উচ্চপদস্থ কর্মী নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাবার জন্য প্রকাণ্ড লৌহকপাট নির্মাণ করেন। কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর ধৈর্যের কাছে নতিস্বীকার করতে হয় তাদের।
এরকম শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অদূর অতীতে আমরা কবে দেখেছি মনে করতে পারছি না। এসবের পরও কর্মবিরতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি আমাদের সাজে? তবুও যদি এই প্রশ্ন এখনও কারও মনে সংশয় সৃষ্টি করে থাকে তাহলে তারা জেনে রাখুন যে জুনিয়র চিকিৎসকরা তাদের নির্যাতিতা সহকর্মীর নামে 'অভয়া ক্লিনিক' চালু রেখেছে যেখানে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত টেলিমেডিসিন পরিষেবা দেওয়া হয়, যাতে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও সঙ্কটমুক্ত হন। তবে সব মানুষ যে কুৎসা রটাচ্ছেন এমনটা বললে অধর্ম করা হবে। লালবাজারের অবস্থান ধর্মঘটে সাধারণ মানুষরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের পাশে থেকেছেন। আমরা ঋণী সেই মানুষটার কাছে যিনি নিজের দৈনিক উপার্জনকে প্রাধান্য না দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে স্যান্ডউইচ আর সিঙ্গারা নিয়ে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন। আমরা ঋণী সেই মানুষটার কাছেও, যিনি অনেকগুলো হাতপাখা সরবরাহ করেছিলেন আমাদের ক্ষণিকের স্বস্তির জন্য এবং যা হয়তো তাঁর সারাদিনের রুটিরুজি। ক্রমাগত অবস্থানের জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করছিলেন কিন্তু ওই সাধারণ মানুষরাই। এনাদের কথা স্বীকার না করলে আমাদের আন্দোলনটাই অপূর্ণ রয়ে যাবে।
এই আন্দোলন ধীরে ধীরে আরও বৃহত্তর রূপ ধারণ করছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন। আজ মানুষ খুঁজে নিচ্ছে মিছিলকে। এ কোনও সামাজিক শ্রেণির আন্দোলন নয়, এ আন্দোলন আমাদের হৃদয়ের, আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার আন্দোলন। আসুন, আমরা সবাই জেগে উঠি, এগিয়ে যাই আরও বৃহত্তর মানবতার দিকে। আমাদের ঘরের ৫ বছরের নাবালিকাটি যেন তার চিকিৎসক, পুলিশ, অভিনেত্রী বা আরও বড় হবার স্বপ্নকে গলা টিপে মেরে না ফেলে কেবলমাত্র নিরাপদ রাতের অভাবে। আসুন, আমরা আমাদের ৫ বছরের ছেলেটিকেও শেখাই সকল নারীকে সম্মান করতে। নারী কোনও আলাদা প্রজাতি নয়, তারা পুরুষের মতোই। এই সমতার শিক্ষাই হয়তো আমাদের নারী-পুরুষ সবাইকেই একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ দিতে পারবে। তাই এই আন্দোলন আমার, আপনার সবার আন্দোলন। আমাদের মনুষ্যত্বে উন্নীত হবার পথে যে কোনও বাধাই আসুক না কেন, আমরা তা পার করে ফেলব এই বিশ্বাস আমার আছে।
কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ, শ্রেণি বৈষম্য বাদ দিয়ে একবার নিজের মনুষ্যত্ব দিয়ে অনুভব করে দেখুন; দেখবেন, আপনিও কখন নিজের অজান্তেই এই আন্দোলনে সামিল হয়ে গিয়েছেন। আশা রাখি, একটা সুস্থ সমাজের ভোরে মানবতার সূর্যালোকে আমাদের ঘুম ভাঙবে।
সিন্ডিকেট রাজের অবসান ছাড়া অন্য গতি নেই। অভয়ার মৃত্যুর কারণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার সিন্ডিকেট।
ReplyDeleteআমার পুত্রের বয়স ২৮ বছর। ওর শৈশবে আমি ওকে শিখিয়ে ছিলাম মেয়েদের সম্মান করবো। এ কথা শুধু আজকে ছেলেদের শেখালেই হবে না মেয়েদেরও শেখাতে হবে, পারস্পরিক সম্মানের কথা । কারণ বাড়ির মেয়েটি যখন পুত্রসন্তানের জননী হবে, তখন তারও তো শেখাতে হবে। না জানলে সে কী করে শেখাবে?
ReplyDelete