Monday, 23 September 2024

কর্পোরেটরা হাসছে, রোগীরা অসহায়!

রোগী-ডাক্তার সম্পর্কই নিরাপত্তার চাবিকাঠি  

উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়



লেখকের ডিসক্লেইমার: আরজিকর কাণ্ডে তিলোত্তমা'র জঘন্য হন্তাকারীরা কেউ যেন ছাড়া না পায়। দোষীদের নিরপেক্ষ সঠিক বিচার হোক, দোষীরা সাজা পাক। দুর্নীতি উন্মোচিত হোক; তারও সঠিক, নিরপেক্ষ, ন্যায়বিচার চাই। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদ সঙ্গত।

পশ্চিমবঙ্গে রেজিস্টিকৃত ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় ৯৩,০০০'এর কাছাকাছি। West Bengal Medical Council'এ গিয়ে অনুসন্ধান করলেই জানা যাবে। তার মধ্যে আছে, 

১) ১৫ থেকে ২০ হাজার ডাক্তার মৃত অথবা ডাক্তারি করা থেকে অবসর নিয়েছেন কিংবা ভীষণ বৃদ্ধ, বোধশক্তিই রহিত হয়েছে বার্ধক্যে। মৃত ডাক্তারদের বাড়ির লোক এসে খবরও দেননি যে উনি আর ইহলোকে নেই;

২) বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের ডাক্তার;

৩) কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালের (রেল, ডিফেন্স, পোর্ট, ইএসআই, কেন্দ্রীয় সরকারি) ডাক্তারেরা;

৪) ইএসআই রাজ্য সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার;

৫) স্বাধীন প্রাকটিস করা ডাক্তার।

এরপরে পড়ে থাকল,

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমস্ত সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, প্রাইমারি, ব্লক প্রাইমারি, গ্রামীণ, জেলা ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালের মোট ডাক্তার। যারা সব মিলিয়ে ১৮,০০০।

তাহলে এবার অঙ্কটা কষে ফেলা যাক! 

৭৩০০ জুনিয়র ডাক্তার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে কর্মরত ১৮,০০০ ডাক্তারের কত শতাংশ? প্রায় ৪০ শতাংশ।

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১২৫৭টি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার এবং ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টার আছে। ৮০'র কাছাকাছি সেকেন্ডারি কেয়ার বা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল আছে, কিছু টার্সিয়ারি কেয়ার ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল আছে, যা জেলা হাসপাতালও বটে, যেমন এম আর বাঙুর; ৩০'টার উপরে মেডিকেল কলেজ আছে যার ২৬টাই সরকারি, বাদবাকিগুলো বেসরকারি। এই ২৬টার মধ্যে ১৮টা মেডিকেল কলেজে প্রথম এমবিবিএস ব্যাচ বেরিয়েছে, বাদবাকি ৮টায় এখনও ফাইনাল এমবিবিএস অবধি ছাত্র-ছাত্রীরা পৌঁছয়নি। 

তাহলে বলা হয় কেন, এমনকি আদালতেও যে, জুনিয়র ডাক্তারেরা মাত্র ৭৩০০ জন, এই বিপুল, বিশাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মাত্র ১৮টা জায়গায়, তো তাতে কী এমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ল!

আসুন হিসেব করি।

৭৩০০ সংখ্যাটি কমবেশি ঠিকই আছে, কিন্তু ১৮টার হিসেব কষতে হচ্ছে।

১) সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালেও পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স পড়ানো হয়, যারা পড়েন অথচ চাকরি করতে করতে লিয়েন'এ আসেননি বরং ফ্রেশ‌, মানে ইন্টার্নশিপ'এর পরেই DNB (MD/MS এর সমতুল্য) করছেন, তারাও সংখ্যায় কম নন। তারাও জুনিয়র ডাক্তার। 

২) বহু স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও DNB কোর্স আছে, যেমন বিদ্যাসাগর, বাঘাযতীন হাসপাতাল। এদের যারা ফ্রেশ DNB করছে, তারাও জুনিয়র ডাক্তার। ধরা যাক বাঘাযতীন'এ ৮টা DNB সিট আছে, তার মানে, ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষ মিলে ২৪ জন। এদের মধ্যে যারা সরকারি চাকরি করতে করতে লিয়েন'এ আসেননি, সবাই জুনিয়র ডাক্তার। 

৩) এটা ঠিকই, এখন হাউসস্টাফশিপ আর আবশ্যিক নেই। তার মানে, কেউ সরাসরি ইন্টার্নশিপ থেকে পোস্ট-গ্রাজুয়েশনে সুযোগ পেতেই পারেন প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে। তবু, তা তো প্রথম সুযোগেই সবাই পান না! কেউ কেউ দুবার, তিনবার এমনকি চারবারেও পায়।

তবু, ধরা যাক...

কোনও মেডিকেল কলেজেও দেখা গেল, কোনও ফ্যাকাল্টির সব ইউনিট ধরেও কোথাও হয়তো জুনিয়র ডাক্তার কম। সে ক্ষেত্রে 'Need basis'এ হাউসস্টাফ নিয়োগ করা হয়। কোনও কোনও হাসপাতালে হাউসস্টাফ ২০ থেকে ৪০'ও হতে পারে সব মিলিয়ে। প্রতি বছরেই হাউসস্টাফশিপের একটা কোটাও থাকে মেডিকেল কলেজগুলোতে। এছাড়াও মেডিকেল কলেজগুলো বাদ দিয়ে বিভিন্ন স্পেশালিটি ক্লিনিক, সুপার স্পেশালিটি ক্লিনিক, জেলা হাসপাতাল ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও হাউসস্টাফ নিয়োগ করা হয়। এরা সবাই জুনিয়র ডাক্তার।

কেন বলছি এ কথা? 

শুধুমাত্র ১৮টা কলেজ বললে ভুল বলছি। সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেডিকেল কলেজগুলো বাদ দিয়েও জুনিয়র ডাক্তার বর্তমান। হয়তো সংখ্যায় কম কিন্তু মেডিকেল কলেজের তুলনায় সেই হাসপাতালটিও তো ছোট। অতএব, পরিষেবা শুধু মেডিকেল কলেজগুলোতেই ব্যাহত হচ্ছে না, অন্যত্রও হচ্ছে।

এছাড়াও জেলা হাসপাতালগুলো থেকে একটা অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনও পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনও মেডিকেল কলেজে বা বিশেষ করে কলকাতার মেডিকেল কলেজগুলোতে। কেন? ওখানকার ডাক্তারেরাই ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে নার্সিং হোমে কেস করেন। উল্টে বলেন, হাসপাতালে ওটি খারাপ, যন্ত্রপাতি স্টেরাইল নেই, এটা নেই, স্টাফ নেই, সেটা নেই। যারা ওনাকে দিয়েই নার্সিংহোমে পারেন না, তাদেরকে বড় হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজগুলোতে রেফারেল দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, সব মেডিকেল কলেজগুলোতে যত রোগী হয় তার মধ্যে রেফারেল কেসই ৭০ শতাংশ, যার প্রায় ৬০ শতাংশের ওই পেরিফেরিতেই চিকিৎসা হত, সম্ভবও ছিল। 

সবাই এসব কথা সব কিছু জানে। 

ধরা যাক, কোনও ডাক্তার কলকাতার কোনও সরকারি মেডিকেল কলেজেরই ডাক্তার। কোনও একটা মহল তার থেকে ঘুষ চাইল ১০ বা ১৫ লক্ষ টাকা। তিনি দেবেন না বা দিতে পারবেন না জানালে তাঁকে দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হল। এবার তিনি রাগে, অপমানে আরেকটা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি হয়তো শিলিগুড়িতে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে আছেন। এবারে তিনি করলেন কী- ওখানে ২ দিন আর কলকাতায় ৫ দিন থাকলেন। সময় নষ্ট করবেন না বলে যাতায়াত প্লেনে সারলেন। ফলে, এত খরচের টাকা তো তাঁকে তুলতে হবে! তিনি তখন বাকি পাঁচদিনের চারদিনেই চুটিয়ে বাণিজ্য করতে শুরু করে দিলেন। বাণিজ্য বাড়াতে কী করতে হবে? ফার্মা লবিকে ধরতে হবে। কোনও ফার্মা লবি তাঁর ক্লিনিকটাও কলকাতার বিশেষ জায়গায় তৈরি করে দিল। এখন তার টাকা পয়সা কীরকম? ওই আধিকারিক যে ঘুষ চাইছিলেন, তাঁর থেকেও তিনি এখন বিত্তবান, খুব কম সময়েই।

কী দাঁড়ালো? 

১) মেডিকেল কলেজে রোগীর চাপ এবং সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের অনুপস্থিতিতে একজন রোগীকে প্রথম ও প্রাথমিক ভাবে দেখার লোকই রইল না। উপরন্তু, দৈনন্দিন নিত্যনৈমিত্তিক একজন ইন্ডোর পেশেন্টের প্রতি পরিষেবাও অপ্রতুল হল; 

২) করাতের দুদিকেই ধার। এদিকে কর্তৃপক্ষের কেউ যদি দুর্নীতি করেন, ওদিকে যিনি তার কোপে পড়লেন, তারও কেমন যেন একটা মেটামরফোসিস ঘটে! এ এক অমোঘ নিষ্ঠুর বাস্তবতা; 

৩) কর্পোরেটরা হাসছে। তাদের চুরি, আরও চুরি অনায়াসেই মান্যতা পাচ্ছে;

৪) অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি সিনিয়র ডাক্তাররাই কর্পোরেট হাতছানিতে আছেন - হয় ১০০ শতাংশ, নতুবা ন্যূনতম ১০ শতাংশ। এরাই জুনিয়র ডাক্তারদের আগুন খাওয়াকে উৎসাহ দিচ্ছেন;

৫) পুরো মহলটাই এমন হয়ে যাচ্ছে যে সমগ্র সরকারি ব্যবস্থাটাকেই তার আমলাতন্ত্র এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যে তা কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে হবে;

৬) অধিকাংশ সম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরাই এখন নিট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে, ব্যবস্থাটা তেমনই। আগেকার মতো অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে টিউশনি করে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার মাইনে ও হোস্টেলের খরচ বহন করতে হত - সেরকম সংখ্যা এখন কত? ৫ শতাংশও না। কাজে কাজেই তাদের আন্দোলনের সবকিছু যৌক্তিক দাবিগুলো অকপটে মেনে নিয়েও বোঝানোর দায়দায়িত্ব থাকে সিনিয়রদের উপর যে, দেখো, হাসপাতালের বেনিফিশিয়ারি কারা! কাদের চিকিৎসা দিচ্ছ না। কে চিকিৎসা দিচ্ছে না? সম্পন্ন ঘরের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই। কারা চিকিৎসা পাচ্ছে না? গরিব, নিম্নবিত্তরা, যারা মোট রোগীর অধিকাংশ। 

কোভিডের সময়ে টেলিভিশনে এসে প্রত্যহ ভয় বিতরণকারী চিকিৎসকেরা যারা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন, তাঁরাই নাগরিকদের কেউ ভ্যাক্সিন না নিলে তাদের অসামাজিক বলেছেন; সেই তাঁরাই ১৮০ ডিগ্রি পাল্টি খেয়ে ২০২২ সালের পর বলেছেন যে জেনেটাক্যালি মডিফায়েড ভ্যাক্সিন (mRNA)'এ প্রচুর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে! এই তাঁরাই কোভিডের সময়ে প্রত্যেকে প্রত্যহ লক্ষ টাকা কামিয়েছেন, কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দিয়েছেন তাদের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। জুনিয়র ডাক্তারদের উচিত ছিল, সিনিয়রদের মধ্যে ভারী এই অংশটাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা।

তাই, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য একে-ওকে ট্রান্সফার করে বা ফ্লাডলাইটে হাসপাতাল ভরিয়ে দিয়ে অথবা কোলাপসিবল গেট চারগুণ বাড়িয়ে কিংবা সিসিটিভি ১০ গুণ বেশি বসালেই হাসপাতালের সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসে না। যে কোনও মর্ষকামী শক্তিশালী কায়েমী স্বার্থ, তা যে কোনও সরকারি দলের কারও তাণ্ডবেই হোক বা অন্য যে কোনও স্বার্থান্বেষী শক্তির দাপটে, তা আন্দোলন করে একসাথেই প্রতিহত করতে হবে। তার বিকল্প কিছু নেই। জনস্বাস্থ্যের এক সামগ্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি, রোগী ও রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে হবে। তা রোগীকে পাশে ঠেলে নয়। সম্পর্কের উন্নতি হলে তাঁরাই আসল সুরক্ষা ও নিরাপত্তার চাবিকাঠি।

(লেখক একজন রোগী অধিকার আন্দোলনের কর্মী)


6 comments:

  1. ভাল লেখা। পড়ে সমৃদ্ধ হওয়া যায়। অন্যস্বর-এও কথা নেওয়া উচিত , বলা উচিত , ভাবা উচিত। তবে 'ডিসক্লেইমার' টা কি দিতেই হলো ? নাহলে কি দাগিয়ে দেবে? এটাও তো একটা থ্রেট কালচার;তাই রক্ষাকবচ টা নিতে হলো।

    ReplyDelete
  2. খুবই সঙ্গত ও যুক্তিপূর্ণ মত । হরিপদ কেরানী ও নিম্নবিত্ত মানুষরা যখন এইসব উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের হবু ডাক্তারদের হাতপাখার বাতাস করছিলেন সে ভিডিও দেখে আমার মনেই হচ্ছিল এই দুলালরা চেম্বারে বসে হাজার টাকার বিনিময়ে রুগী দেখবে তখন এঁরা আফশোস করবেন না তো!

    ReplyDelete
  3. গ্রামীন বা শহরতলীর হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামোগত উন্নয়ন মানে কিন্তু চিকিৎসা-সংক্রান্ত নয়, রোগী ভর্তির সময়ে যে কম্প্যুটারে ডেটা তোলা হচ্ছে বা প্রিন্ট-আউট নেওয়া হচ্ছে যে মেশিনে, তার সামগ্রিক আপগ্রেডেশন। আসলে উন্নয়ন না উন্নতি -- এই ধন্দটাই জেগে থাকছে সার্বিকভাবে। সম্প্রতি এক জেলা হাসপাতালে সিরিয়াস কার্ডিও পেশেন্টকে ভর্তি করতে গিয়ে, এমারজেন্সির কাউন্টারে ঘড়ি ধরে ৩৫ মিনিট অধীর অপেক্ষা করতে হয়েছে, উপরিউক্ত সমস্যায়, তাই এতো কিছু বলা।

    ReplyDelete
  4. বিষয়টা বেশ রীতিমতো জটিল।লেখকের লেখা থেকেই তা স্পষ্ট।আসলে এখানে কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তারদের বিরূদ্ধে বললেই তো ঠিক হল না।উৎসে পৌঁছে গেলে বোঝা যাচ্ছে যে এই সম্পূর্ণ চিকিৎসা - ব্যবস্থাই ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্নীতি আসক্ত। আন্দোলন হওয়া দরকার সার্বিক দুনীতির বিরূদ্ধে।এই ব্যবস্থাই কর্পোরেটদের পৌষ মাস করে রেখেছে। লেখককে সাধুবাদ জানাই।

    ReplyDelete