Wednesday, 18 September 2024

'বন্ধুসুলভ আগুন'

'বাড়িতে মা-বোন নেই?'

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



জীবনানন্দ লিখেছিলেন,

“মৃত্যুর আগে কি এ পৃথিবী থেকে সমস্ত সুন্দর মুছে যাবে?

যারা শান্তির নিকেতনে বাস করতে জানত,

তারা তো অস্তিত্বের নির্যাস হারাল যুদ্ধের ধোঁয়ায়।”

গত অগস্টের গোড়ার দিকেই কলকাতার এক নামী সরকারি চিকিৎসালয়ে কর্মরত অবস্থায় ভোর রাতে চিকিৎসকের ধর্ষণ-মৃত্যু বা মৃত্যু-ধর্ষণ এবং সেই প্রেক্ষিতে আন্দোলন, ঘটনার মাস খানেক পরেও প্রায় সম-লয়ে দৈনন্দিনকে আন্দোলিত করে চলেছে। বিচার অবিচারের শঙ্কা, ভিন্ন স্তরীয় ও ভিন্ন শ্রেণিয় মানুষের দাবিদাওয়া, শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের দফা দফা আবদারে আরেক দফার মাসখানেক ব্যাপী সফল কর্মবিরতি - সবের অন্বয়েই কলিকাতা চলিতেছে নড়িতে নড়িতে। হিঁদু বাঙালির বচ্ছরকার উৎসব দুর্গাপুজোও প্রায় দুয়ারে সমাগত, বিপ্লবে উৎসব যাপন নাকি বিচার পরিণতি না পাওয়া ইস্তক যাপন পরিত্যাগ, তা নিয়েও স্বআরোপিত উচ্চ মননের বাঙালির মন দোদুল্যমান। পুজো এবং ভোট ব্যতিরেক বাঙালির এ হেন বিচলতা দেখে হঠাৎ করে মনে হতেই পারে তার অকল্পনীয় ব্যথা পাওয়া মৃতদেহের কল্পিত চিত্রখানি এখানে 'কিউ'এর ভূমিকায় আসীন এবং ব্রেক শটটিও দুর্দান্ত সফল! অথচ, এত্ত সব কিছুর মধ্যে যে বিষয়টা একেবারে বিলীন হয়ে গেল তা হল নারী নির্যাতন, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে নারীর অবস্থান এবং সেই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের ভূমিকা।

সেই অগস্টেরই অন্তিমে হরিয়ানার ফারিদাবাদে উনিশ/কুড়ির এক তরুণের গাড়ি ধাওয়া করে তাকে হত্যা করা হয় গরু পাচারকারী সন্দেহে। বর্তমান ভারতে, সুনির্দিষ্ট করে বললে গো-বলয়ে, তা চমকপ্রদ কোনও ঘটনাই নয়। তবু নজর কাড়ে যখন জানা যায়, হত্যাকারী কিশোরের বাবার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চায় মুসলমান ভেবে এক ব্রাহ্মণ সন্তানকে হত্যার জন্য! শুধুমাত্র সন্দেহের বসে স্বঘোষিত রক্ষক এক নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু জাতিকে হত্যার অধিকার নিজ স্কন্ধে তুলে নেয় প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে, কিংবা প্রশাসনের প্রশ্রয়েই। 

শেষ ঘটনাটি দেশের থেকে এট্টু দূরে। প্যারিস অলিম্পিক্সে মহিলাদের ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন উগান্ডার অ্যাথলিট রেবেকা। থাকতেন অবশ্য কেনিয়ার এনডেবেসে। সেখানেই জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদে তাঁর প্রেমিক আচমকাই তাঁর গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। হাসপাতালে দিন পাঁচেক কাটিয়ে অলিম্পিক্স শেষের এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যান তিনি। সেই মৃত্যুর আরও পাঁচদিন পরে মারা যান প্রেমিকটিও। যে অনলে পোড়াতে চেয়েছিলেন শুধুই তাঁর প্রেমিকাকে, সে দহনেই তিনি নিজেও পৃথিবীর মায়া কাটালেন।

তিনটি ঘটনায় কোনও সাদৃশ্য চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে না অপ্রচল কিছু। তবু ঘটনাগুলি ব্যতিক্রমী  তার পরবর্তী উপবর্তে - দৈনিক গড়ে ৮৬টি নথিভুক্ত ধর্ষণের দেশে অপরিচিতার তরে এই জন আন্দোলন, পয়স্বিনী রক্ষকই জাতির রক্ষকের দেশে গুলিবিদ্ধ সন্তানের পিতার কাছে ভক্ষকের দোষ মার্জনার ভিক্ষা, আর সব শেষে এক গরিব অনাম্নী দেশের থেকে আসা ৪৪তম স্থানে ম্যারাথনের দৌড় শেষ করা প্রতিযোগিনীর উদ্দেশ্যে প্যারিসের মেয়রের শহরের একটি ক্রীড়াঙ্গন নামাঙ্কিত করার সিদ্ধান্ত।  

যুদ্ধ টুদ্ধ

যুদ্ধ কী তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে গোদা ভাষায় বললে, নিজ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে দুই বা ততোধিক দলের মধ্যে ঘটা সহিংস কার্যকলাপই আসলে যুদ্ধ। আবার জর্জ অরওয়েলের ভাষায় বললে, 'War is peace. Freedom is slavery. Ignorance is strength.’। 

এ তো গেল রণকৌশলে সজ্জিত এবং দীক্ষিত মানুষের যুদ্ধের সংজ্ঞা। সুপ্রাচীন যুগ থেকেই এই সকল  যুদ্ধের সেনারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকের বেতনভুক কর্মচারী। তবে আমাদের আলোচনা এ ক্ষেত্রের বাইরে পড়ে থাকা, সেই সব নিজ ভূমে লিঙ্গ-চামড়া-ধর্ম-বর্ণ-অর্থের অথবা আরও অন্য কিছুর ভিত্তিতে হয়ে ওঠা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় না-মানুষদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ নিয়ে। যে লড়াই তাঁরা লড়তে চাননি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের এ লড়াইয়ে তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও তাঁরা অজ্ঞাত।    

সামরিক পরিভাষায় 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' বা 'ফ্র্যাত্রীসাইড' খুব অপরিচিত শব্দ নয়। শব্দটির উৎস মধ্য ইংরেজি এবং মধ্যযুগীয় যুদ্ধ থেকে। খুব সম্ভবত প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯১৮ সালে, আমেরিকান সেনাবাহিনীতে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে শব্দবন্ধটি জনপ্রিয়তা পায় এবং পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে এর আরও প্রসার ঘটে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ক্কচিৎ কদাচিৎ এমন ঘটনা ঘটে যেখানে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনাক্রমে সপক্ষের ওপরই আক্রমণ ঘটে যায়। যুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ অমেয়। সে গ্রিক-পারস্য যুদ্ধের সময় পারস্যের সম্রাট কিরাসের সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে ভুলবশত নিজেদের সৈন্যদের ওপর আক্রমণ হোক কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নরম্যান্ডি আক্রমণের সময় মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় তাদের নিজস্ব সেনাদের উপর বোমা ফেলা। এমনকি  অধুনাকালে উন্নত প্রযুক্তি সত্ত্বেও এ ধরনের যুদ্ধকালীন দুর্ঘটনার সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তি যে ঘটেনি তার উদাহরণ পাই হালের ইরাক যুদ্ধে ২০০৩ সালে, ব্রিটিশ সৈন্যদের একটি দল ভুলবশত আমেরিকান সৈন্যদের উপর গুলি চালনায়।   

ফেরা যাক ব্যুৎপত্তি স্থলে। সেই যে হরিয়ানার মাথায় গুলি লাগা তরুণ, তাকে মুসলমান অতএব গো-পাচারকারী ভেবে  প্রায় ধাওয়া করে খুন করে স্বনিয়োজিত গোরক্ষকেরা যে ধর্ম রক্ষার্থে, জাতে ব্রাহ্মণ আরিয়ান মিশ্র ছিলেন সে ধর্মেরই অনুগামী। সেই তরুণীর প্রেমিকও নিশ্চয়ই ভাবেননি নিজে আহত হওয়ার কথা, ভাবলে তিনি আত্মহননের অন্য পন্থা বেছে নিতেন। দু' ক্ষেত্রেই, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তি পরের ক্ষতি সাধনে নিজ কিংবা নিজ গোষ্ঠীর 'পরে আঘাত হানে। শত্রু-মিত্র পক্ষ এ ক্ষেত্রে সুচিহ্নিত এবং স্পষ্ট। ব্যতিক্রমী এ ক্ষেত্রে ঘটনার সামাজিক বিচারকের ভূমিকা। হত্যকের কাছে মৃতের বাবা জানতে চেয়েছিলেন, মুসলমান হলেও মানুষকে হত্যার অধিকার তাদের কে দিয়েছিল? প্যারিসের মেয়রও চেয়েছিলেন এক সুষম নারী-পুরুষের অবস্থান।

কলকাতার আন্দোলনটি এত সরলরৈখিক নয়। এক নির্দিষ্ট শ্রেণির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আন্দোলনের অবয়ব ধারণ করেছে, সদ্য পুনঃ স্বাধীনতা প্রাপ্ত প্রতিবেশী দেশের আন্দোলনটি উৎসেচকের ভূমিকায়। মেধা এবং বিত্ত দুইয়ের সঙ্গতে যে শ্রেণি দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে হীনজ্ঞান করে, তারাও এবার আন্দোলনে এক্কেবারে সামনের সারিতে, বিচারের দাবিতে। যে কোনও সুস্থ গণতন্ত্রে আন্দোলন অপরিহার্য। কিন্তু এ আন্দোলনের গতিবিধি যেন সমাজে এক স্তর ওপরে ওঠার উঁচু মই। আন্দোলনে হাজিরা না দিলে জাত খোয়ানোর শঙ্কা প্রবল। তাই দিনের পর দিন কাটলেও রাজ্যের সরকারি চিকিৎসক শিশুদের (শিশুদের চিকিৎসক নয় কিন্তু) অচলাবস্থা কাটে না। তাঁরা পথে আন্দোলনরত। গড়পড়তা সমাজ ভাবে, হুঁ হুঁ, বাওয়া কী এক বিষম বস্তু চলিতেছে নিশ্চয়ই, তাই স্যালুট ঠোকাই আশু কর্তব্য। প্রশ্ন করার স্পর্ধাই জোটে না কীভাবে তাদের আন্দোলনে ভুরি ভুরি খাবার আসতে পারে এই অভাগা দেশে।  রোগীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, মৃতদেহ আটকে দরকষাকষি, ভুল চিকিৎসা, নির্দিষ্ট স্থানেই পরীক্ষার নির্দেশ, অধস্তনদের শ্রমশোষণ, এসব অভিযোগ আন্দোলনে পরিণতি পায় না কখনই। 

আন্দোলনকারীদের মূল দাবি দাওয়ায় অনেক কিছু থাকলেও জোরালো হয় না যৌন শিক্ষা তথা মানুষ গঠনের শিক্ষার দাবি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই ছোটখাটো কিংবা বড়সড় যৌন হেনস্থাকারীরা শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী, কবি-সাহিত্যিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে উপস্থিত। সম্ভবত তাঁরা নিজ ক্ষেত্রে গুণী, অপরাধে সুচারু, তাই আন্দোলনে তাঁদের উপস্থিতি খবর হিসেবে গুরুত্ব বাড়ায়। এছাড়া যৌন হয়রানিকে এক স্বাভাবিক ক্রিয়ার পর্যায়ভুক্ত করাই যেন সমাজের কাজ, তাকে দূরীকরণের আশা বা প্রচেষ্টা কোনওটার প্রয়োজন অনুভব করার দায়টুকুও পরিলক্ষিত হয় না। 

রাস্তাঘাটে একটা কথা প্রায়ই কানে আসে, 'বাড়িতে মা বোন নেই?' অর্থাৎ, মা-বোনকে রক্ষার কাজ  পুরুষের, কিংবা মা-বোন জ্ঞানে কিংবা স্মরণে, ভক্ষণ না করে সংযমের দায় পুরুষের। খেয়াল করলে দেখবেন, এ তালিকায় কখনও বৌ, প্রেমিকা, বন্ধু, শিক্ষিকার উল্লেখ থাকে না। তাত্ত্বিকেরা বলেন, প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর সম্মান এবং পবিত্রতাকে পরিবার, বিশেষত পুরুষদের সম্মানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। নারীর সতীত্ব বা পবিত্রতা (বিশেষ করে মা, বোন ও কন্যা) পরিবারে পুরুষ সদস্যদের ক্ষমতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। তাই নারীদের নিয়ে কটূক্তি বা গালি ব্যবহারও পুরুষদের সম্মান আঘাত করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। নারীর ওপর আক্রমণ মানে পুরুষদের সামর্থ্য ও অধিকারকে প্রশ্ন করা। এখানে আক্রমণ মূলত নারীর ওপর নয়, বরং নারীদের নিয়ে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ বা অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এটি ব্যবহৃত হয়, যা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে উদ্ভূত।

এই ভাবনায়, নারীদের ভূমিকা পরিবার বা পুরুষদের সম্মান, প্রজনন বা যৌন পবিত্রতার রূপক হিসেবে দেখা হয়। এ জন্যই আমাদের কথ্য ভাষায় নারীদের অবমাননাকর ভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে তাদের মানুষ হিসেবে নয়, বরং সম্পত্তি বা সম্মান রক্ষার মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। অথচ, 'বউ নেই?', এই ধরনের শিক্ষামূলক বাণী শোনা যায় না, বদলে বৌ'কে কিছু করে দেওয়ার হুমকিই প্রচলিত। ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়, সমাজে স্ত্রীরা স্বামীর পরিবারের একটি সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত আজও। তারা ঠিক সে অর্থে যোনিতে আবদ্ধ, পবিত্রতার প্রতীক নয়। তদুপরি, আমাদের দেশে নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ সম্পূর্ণ ভাবে বৈধ। সমাজের দুর্বল বা নিম্নস্থ হিসাবে বিবেচিতকে আক্রমণ করার ভাষার কাঠামোই এ রূপে  নির্মিত, আর তাই পুরুষদের সম্মানহানি করার জন্য নারীদের ব্যবহার করার প্রয়াস, যা তাদের পরিচয় পুরুষদের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। 

এবং সমস্যার আকরটিও এখানেই। মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার এই ঝাড়াই বাছাইয়ের পর্বে কখনও অসচেতনে আবার কখনও স্বেচ্ছাতেই তা আমাদের নিকটজনের ক্ষেত্রেও সেই 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' হয়ে দাঁড়ায়। মা বোন এবং মা বোন সম কেউই শুধু এই 'আমি'টার অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবে - এই উদ্ভট এবং দ্বৈত মানসিকতা পরিণাম পায় আমার মা-বোন যাদের মা-বোন নয় তাদের দ্বারা আমার মা-বোনের ওপর আক্রমণে। এবং এ অভ্যাসের চরম রূপই লিঙ্গ-ভেদে পারিবারিক ধর্ষণ বা নির্যাতন। যেহেতু ভারতের সিংহভাগ ধর্ষণই  ঘরের মধ্যে এবং চেনা পরিসরে হয়, সে ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা নিজেদের অজান্তেই সমাজে 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' চক্র সৃষ্টি করি, যেখানে নিজেরাই অপরাধী হয়ে উঠি। 

যৌন শিক্ষা ও কিছু কথা

ভারতের মতো সমাজে এই আচরণের মূলে রয়েছে পিতৃতন্ত্র এবং যৌন শিক্ষা, লিঙ্গ সচেতনতা ও  সম্পর্কের নীতি, লিঙ্গ নির্যাতন সম্পর্কিত আইনি পাঠ - এসব  সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব। যে কারণে কিশোর-কিশোরীরা সম্মতি এবং সম্পর্কের মর্যাদা নিয়ে বিভ্রান্ত, সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্মান ও সীমারেখা নির্ধারণের ধারণাগুলি অস্পষ্ট। যদিও কিছু রাজ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যৌন শিক্ষা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে এখনও তা সার্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক নয়। বহির্বিশ্বে যে ভাবে বিষয়টি দেখা হয় তার কিছু উদাহরণ দিলে হয়তো বোঝা সম্ভব। 

প্রথমেই আসা যাক নেদারল্যান্ডস'এর কথায়। দেশটি যৌন শিক্ষা এবং সম্পর্কের শিক্ষায় বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। এ দেশের ‘Comprehensive Sex Education’ নামে পরিচিত এই প্রোগ্রামে শিশুদের মধ্যে লিঙ্গসমতা, সম্মান এবং নিজেদের ও অন্যদের সীমাবদ্ধতা সম্মান করার শিক্ষা দেওয়া হয়। সুইডেনে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্কিত শিক্ষার ধারণা চালু; ‘Sex och samlevnad’ নামের এই পাঠ্যক্রম বাচ্চাদের যৌন স্বাস্থ্য, সম্মতি এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন করতে উৎসাহিত করে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পর্ক এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা একটি বড় অংশ। এখানে শিক্ষার্থীরা কিশোর বয়স থেকেই সম্মতি, যৌন সম্পর্কের সীমা এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কে শেখে। ইংল্যান্ডে ২০২০ সাল থেকে ‘Relationships and Sex Education (RSE)’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সম্মতি, লিঙ্গ সমতা, যৌন হয়রানি এবং সম্পর্কের উন্নয়ন সম্পর্কে শেখানো হয়। 

হয়তো কোনও পন্থাই পূর্ণাঙ্গরূপে সফল নয়, কিন্তু কার্যকর নিশ্চিতভাবেই। পরিসংখ্যান যার প্রমাণ। লিঙ্গ অধ্যয়ন এখন দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যদিও, কিন্তু তা সম্ভবত তাত্ত্বিক চর্চার পরিসর ছেড়ে বেরতে পারেনি। অথচ, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই লিঙ্গসমতার শিক্ষা ও তার সর্বাত্মক ব্যবহার ভীষণ জরুরি। বোঝা জরুরি, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নারীও পিতৃতন্ত্রেরই বাহক, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রান্তিক লিঙ্গ'র মানুষের পাশাপাশি পুরুষও নির্যাতিত হয় এবং যৌন নির্যাতনই এমন এক বিরল অপরাধ যে অপরাধে প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই নিপীড়কের পরিবর্তে নির্যাতিতাকে লজ্জিত তকমা দিয়ে তার পরিচয় গোপন রাখার রাষ্ট্রীয় নিদান দেওয়া হয়।

জার্মান দার্শনিক  Friedrich Nietzsche (Source: Beyond Good and Evil) বলেছিলেন, 'He who fights with monsters should be careful lest he thereby become a monster. And if you gaze long enough into an abyss, the abyss will gaze back into you.'। তাই 'বন্ধুসুলভ আগুন' সর্বাত্মক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে একটু সাবধান হই; নচেৎ অচিরেই সেই আগুনে পুড়তে হবে আমাদেরকেই।  


6 comments:

  1. যশোধরা রায়চৌধুরী18 September 2024 at 22:15

    নারী অধিকারের প্রশ্ন এখন পিছনের সারিতে। এটাই সবচে দু:খিত করেছে!৷

    দারুণ লেখা

    ReplyDelete
  2. দারুন উপস্থাপনা।
    জরুরি প্রশ্ন, ও ভন্ডামির আলোড়ন তুলে ধরা হয়েছে সঙ্গত ভাবেই।
    তথাকথিত বাম ও গেরুয়া দলের সক্রিয়তার মুখোশ খুলুক।
    অসিত।

    ReplyDelete
  3. সব চেয়ে বিষ্ময়কর বিষয় এটাই যে শুধু আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা নয়, তাদের সমর্থকরাও ভুলে গেলেন কেন কী কারণে এই জনআন্দোলন । পাশে পড়ে রইল আর জি কর এর মেয়েটির আর আরও অনেক মেয়ের মৃতদেহ , তাদের উপর হওয়া অত্যাচার । কিছু পুরুষও চরম হিংসার শিকার হলো । অথচ দেশের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষাভিমানী মানুষেরা বিভিন্ন হুঁকায় বিভিন্ন স্বাদের তামাক খেতে লাগলেন ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অপূর্ব চয়ন। লিঙ্গবয়ানের এই রাজনীতির সন্দর্ভটি হারানোর কথাই ছিল, তাই তা হারিয়েই গেছে। তাই এই বাস্তবটা এতো সুন্দর ভাবে কিছু ভিতরের কথাকে যেনো আরো নতুন নতুন রাজনীতির প্রতর্ককে সামনে নিয়ে আসে। অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।

      উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়

      Delete
  4. চমৎকার উপস্থাপনা। এর সঙ্গে আদিবাসী সমাজ তথাকথিত
    সভ্যতার সংস্পর্শে আসার আগে
    কীভাবে ধর্ষণবিরল যাপনে অভ্যস্ত
    ছিল, সেটাও দেখা দরকার।

    ReplyDelete
  5. বেশ ভালো লাগল। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের মাকে প্রণাম করার রেওয়াজ চালু হলে প্রতিটি নারীর সম্মান দিনে দিনে বৃদ্ধি পাবে ।

    ReplyDelete