কিন্তু শুশ্রূষাহীন রাষ্ট্র
যশোধরা রায়চৌধুরী
শুশ্রূষা অর্থ সেবাযত্ন বা সুস্থ করে তোলা, এ হল বাইরের মানে। আসল ব্যুৎপত্তিগত অর্থ 'শুনিবার ইচ্ছা'। যে কোনও সমস্যায়, রাজদ্বারে সংকটকালে, আজও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাজা হয়েই থাকল। তার শুনিবার ইচ্ছা বেমালুম অনুপস্থিত।
অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে, প্রায় যেন রকেট স্পিডে, ‘অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল, ২০২৪,’ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হল ৩ সেপ্টেম্বর। মাত্র এক দিনের মধ্যে পাশ করানো এই বিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে একটা হাতিয়ার। তারা আরজিকর কাণ্ডে অসংখ্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত পথে নামায় আতঙ্কিত, এবার বলা যাবে, ওই তো ধর্ষণ বিরোধী আইন তো আমরা এনেছি। আমরা আমাদের কথা রেখেছি। বাকি কাজ তো সিবিআই আর সুপ্রিম কোর্টের হাতে। বিচার তাদের কাছে চাও।
প্রেক্ষিতটা কী?
সদ্য ঘটে যাওয়া আরজিকর ঘটনার অভিঘাতে, মেয়েরাই প্রথম ডাক দিয়েছিলেন রাত দখলের। তারও পৃষ্ঠপট ছিল একটা। মেয়েরা রাত দখল করো। এক বা একাধিক পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল সমাজ মাধ্যম। প্রথমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ইনটার্ন ডাক্তারদের মধ্যে থেকে, ২৪ সালের এই কালো আগস্টের ৯ তারিখের রাত্রিতে ৩৬ ঘন্টা ডিউটির পর নিজের হাসপাতালের সেমিনার রুমে ঘুমোতে যাওয়া আরজিকরের ইনটার্ন ডাক্তার, ৩১ বর্ষীয়া তরুণীটির ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের নিরিখে যা ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। অগ্নিসংযোগ হয়েছিল একটি মন্তব্যে। চেনা ঢঙের মন্তব্য। আরজিকরের তৎকালীন প্রধানের প্রথম প্রতিক্রিয়ার ঝোঁক এইই যে, মেয়েটিকে রাতে ওখানে কে থাকতে বলেছিল?
তারপরে দেওয়া হল নিদান। ১৭ দফা 'সুরক্ষা বিধান'এর শলাপরামর্শ। আবারও সেই ইতিমধ্যেই একপেশে বৈষম্যমূলক কর্মক্ষেত্রটিকে আরও বেশি দাগিয়ে দিয়ে পশ্চাৎপদতার নতুন নজির সৃষ্টি করল। এবার এল এই নতুন আইন। অপরাজিতা আইন।
কী কী সমস্যা আছে এ আইনে?
মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এই বিল পাশ করা হল। যে কোনও আইন পাশ করার আগে তার খসড়া প্রকাশ করা, নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করার দীর্ঘ প্রথা চলে আসছে। রাজ্য সরকার তা করেনি, যা অগণতান্ত্রিক। এই বিল-এর নামে ‘অপরাজিতা’ শব্দটির প্রয়োগ কাব্যিক ও অসঙ্গত। হিংসাকে লঘু করে দেখাতে পারে। আইনের নামকরণের একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রথা রয়েছে। নামকরণে এমন বিভ্রান্তির পরেও এই বিল-এ ধর্ষিত মেয়েদের জন্য ‘ভিক্টিম’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে, ‘সারভাইভার’ শব্দটির উল্লেখ করা হয়নি, এমনকি যাঁরা ধর্ষণের পর ন্যায়ের জন্য লড়াই করছে, সেই মেয়েদের জন্যেও নয়।
এই আইনের নামকরণে ‘মহিলা ও শিশু’ একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মেয়েদের স্বাধীন সত্তা ব্যাহত হয়েছে, মাতৃত্বকে নারীত্বের প্রধান আধার বলে দেখানো হয়েছে।
এই বিল-এ রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (২০২৩) ট্রান্স ও কুইয়র মানুষদের উপর যৌন আক্রমণ বিষয়ে নীরব, এবং রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইনে (ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস প্রোটেকশন অব রাইটস অ্যাক্ট, ২০১৯) এই ব্যক্তিদের উপর যৌন অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ দু’ বছরের কারাদণ্ড। এই সময়ে রাজ্যের সংশোধনে এ বিষয়টি আনলে রূপান্তরকামীদের উপর হিংসার যথাযথ প্রতিকারের সম্ভাবনা ছিল। এই বিল ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায় রূপে প্রধানত গ্রহণ করেছে শাস্তির কঠোরতার বৃদ্ধিকে। প্রতিটি অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। সমাজতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন, শাস্তি যত কঠোর হয়, অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার হার তত কমে।
এই বিল-এ ধর্ষণ ও হত্যার (অথবা আঘাতের ফলে চেতনা হারিয়ে জড় অবস্থায় চলে যাওয়ার) একমাত্র শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে প্রাণদণ্ড ও জরিমানা। এটা অসাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৮৩ সালের একটি রায়ে বলেছে যে, কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই ফাঁসি একমাত্র সাজা হতে পারে না। ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের বিচারের জন্য স্পেশাল কোর্ট তৈরির প্রস্তাবও প্র্যাক্টিকাল নয়। পকসো-সহ বিভিন্ন ধরনের স্পেশাল কোর্টের অনেকগুলিরই পরিকাঠামো, অর্থবল এবং লোকবল সাধারণ আদালতের চাইতে কম। প্রায়ই আইনের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বিচার শেষ হয় না। তেমনই, স্পেশাল টাস্ক ফোর্সও কার্যকর হবে না, যদি না যথেষ্ট সংখ্যায় দক্ষ কর্মী এবং যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংহতির অভাব থাকবে কি না, সে চিন্তাও থাকছে। জেলা স্তরে এক একজন ডিএসপি এখনই অতিরিক্ত মামলায় ভারাক্রান্ত। কাজের ভার আরও বাড়ালে অভিযোগ নথিভুক্তি কমার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এই বিল (ধারা ২৯সি, ৩ ও ৪) বলছে, স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তদন্তে নেমে মৌখিক বা লিখিত ভাবে যে ব্যক্তির কাছে সহায়তা চাইবে, তাকেই অবিলম্বে সাহায্য করতে হবে। না হলে তার জেল, জরিমানা হবে। কে সহায়তা দানে বা সাক্ষ্য দানে ‘অনিচ্ছুক’ - তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কেন স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের মতো একটি তদন্ত সংস্থাকে দেওয়া হবে? কেবল আদালতের ক্ষমতা রয়েছে সমন পাঠানোর এবং তা অগ্রাহ্য করলে শাস্তি দেওয়ার।
এই বিল-এ ধর্ষণের তদন্তের সময়সীমা ৬০ দিন থেকে ২১ দিন করা হয়েছে। আগের ৬০ দিনের সময়সীমা আইনের সুসংহত ধারণা থেকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ইচ্ছেমতো সময় কমালে তদন্তের গুণমানে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। এই বিল-এ অপরাধীর জরিমানা করার কথা বলা হলেও, রাজ্য সরকারের তহবিল (ভিক্টিম কমপেনসেশন ফান্ড) থেকে ধর্ষণ-অতিক্রান্ত মেয়েদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও উল্লেখ নেই। সরকার এই বিলকে কার্যে পরিণত করতে কোনও বাড়তি আর্থিক দায় গ্রহণ করছে না, বাড়তি বরাদ্দ দিচ্ছে না। সুশীল সমাজের একাংশ ওপরের এই প্রশ্নগুলি তুলেছেন। এবং বোঝাই যায়, এই বিল একটি অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি। আরজিকর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় জনরোষের সামনে ‘অপরাজিতা বিল’ একটা তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতি মাত্র।
আইনটির নির্মাণ ত্রুটিযুক্ত, তা পাশ করানো হয়েছে তাড়াহুড়ো করে। যথেষ্ট চিন্তা, যথেষ্ট আলোচনা, যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কিছুরই ছাপ নেই। বসা হয়নি মেয়েদের সাথে বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে। অন্তত তেমন কোনও বিষয় আমাদের চোখে পড়েনি।
আরজিকরের পরেও পাশাপাশি আরও অজস্র নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে চলেছে। এর অধিকাংশ ঘটছে গ্রামেগঞ্জে। যেখানে মানুষের একজোট হওয়া অসুবিধার। সারা ভারতই নারী নিগ্রহীদের স্বর্গরাজ্য, কিন্তু আমাদের রাজ্য যেন বেশি বেশি করে অগ্রণী! এগিয়ে বাংলার এই রূপ কি আমরা দেখতে চেয়েছি? ১০ অগস্ট থেকে যে প্রতিবাদ আছড়ে পড়েছে, তা তো এই সমস্ত ইস্যুতেই প্রশ্ন তুলেছে। সেই দিন থেকে লাগাতার সমগ্র সমাজ প্রতিবাদ করছে এক বা একাধিক অন্যায়ের। মেয়েরা বলেছে রাত দখল করবে। কেন বলেছে? কারণ রাতের অধিকার একমাত্র পুরুষের নয়। এবং অবশ্যই ধর্ষক পুরুষের নয়।
ধর্ষক পুরুষদের জেলখানার কয়েদের শিকের আড়ালে রাখার বন্দোবস্ত না করে, প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, যে রাষ্ট্রযন্ত্র মেয়েদের সুরক্ষা দিতে অপ্রস্তুত, অক্ষম বলে স্বীকার করে, knee jerk reaction বশত এমন একুশে আইন আনে যা আসলে মেয়েদের কাজের জায়গা এবং কাজের সুযোগ খর্ব করে, কাজের সময়ের ওপরে খাঁড়া নামিয়ে আনে, সে রাষ্ট্র অক্ষম। যে রাষ্ট্র তাড়াহুড়ো করে একটা আইন আনে যেখানে না আছে নতুন কোনও ধ্যানধারণা, নতুন টাকা বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি বা একটা কোনও কিছু লাগু করার মতো ব্যবস্থা (ইমপ্লিমেন্টেবল), সে রাষ্ট্র আসলে তার নাগরিকদের সঙ্গে কোনও কথোপকথন করছে না। তার ডায়ালগ করার কোনও ক্ষমতা নেই। সে প্যানিক বাটন টিপছে না হলে প্রলাপ বকছে না হলে ঔদাসিন্যে ছেলে ভোলাচ্ছে। এমন রাষ্ট্রযন্ত্রের যে দিন ঘনিয়ে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্রযন্ত্র কি তার ৫০ শতাংশ নাগরিকের সুরক্ষা দিতে আদৌ ইচ্ছুক? প্রশ্ন জাগে। সুরক্ষা, বিধান, আরাম দেওয়া, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি কোনও কিছুই দিতে ইচ্ছুক না। এমন কি সম্পূর্ণ বধির। তাইই, কোথাও কোনও শুশ্রূষা নেই যে আমাদের।
২০১১'তে 'পরিবর্তন চাই'-এর প্রত্যাশায় মানুষ যে বদল এনেছিলেন, সেই বদলকারীর হাতে পার্টিতন্ত্র আর সরকার একীভূত। পশ্চিমবঙ্গে এখন কোনও স্বায়ত্তশাসন সংস্থাও নেই যা নিজের মতে চলতে পারে। সরকারের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তিনি এতটাই নিজস্ব অভিজ্ঞান চিহ্ন দিয়ে কব্জা করে নিয়েছেন যে তা বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়। এত বছরে দুর্নীতি এক রকমের গা-সওয়া হয়েছে, মানুষ ক্রমশ সহ্য করতে করতে বল্মীকস্তূপে পরিণত হয়েছেন। নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান অর্থকরী বেনিয়ম ও লাগামছাড়া পেশিশক্তির হাতে ক্রীড়নক। সর্বত্র বাহুবলী দলদাসদের বাড়বাড়ন্ত। ইতিমধ্যেই শিক্ষা দুর্নীতির কথা সর্বজনগ্রাহ্য হলেও, বা নারী সুরক্ষার প্রশ্নে একের পর এক প্রশ্নচিহ্ন উঠলেও (পার্ক স্ট্রিট কামদুনি হাঁসখালি) তা আমাদের চোখকান সয়ে এসেছিল যেন। আগস্টের ৯ তারিখ আরজিকর কাণ্ড একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ-খুন শুধু নয় - এটা মনে হয় সমাজের যা কিছু আশাপ্রদ, ভবিষ্যতের দিকে উৎসারিত - তারই বিনাশ যেন। ফলত নারীদের এবং সাধারণ মানুষকে তা প্রবলভাবে নাড়া নয়। তারপরেও, এটা শুধু একটাই ধর্ষণ নয়। গণতন্ত্রের প্রায় প্রতিটি স্তম্ভের লাগাতার ধর্ষণ। পুলিশি ব্যবস্থার দলদাসত্ব ও নিষ্ক্রিয়তার পদাবলী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সিনিয়র ডাক্তারদের বিশাল অংশের নেক্সাসের কুৎসিত চিত্রাবলী। রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম জরুরি দুটো অংশকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দিয়েছে এই ঘটনার পূর্বাপর ঘটনাক্রম। প্রমাণ লোপাট করে প্রকৃত দোষীকে জানার পথ আড়াল করা হয়েছে। গোটা বিষয়ে রাজ্যবাসী কেঁপে শুধু ওঠেননি, ঐতিহাসিক ভাবে রাস্তায় নেমে এসেছেন।
অনেক অন্ধকারের মধ্যে এটুকুই আশা যে, শেষ অবধি আমাদের ঘুম ভেঙেছে। রাত দখলের কর্মসূচিই হোক বা মানববন্ধন, জনজোয়ারে নেমে আসা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ হোক বা তীক্ষ্ণ প্রশ্নে সিস্টেমকে ক্ষতবিক্ষত করা, জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযানের সাফল্য, বহুদিন পর বাঙালি জেগে উঠেছে স্বতোৎসারিত পবিত্র ক্রোধে। এই ক্রোধকে প্রণাম।
But spontaneity is no answer to organised state violence. The persons in authority are waiting in patience knowing full well this rudderless movement is bound to lose direction in the wilderness of emotion and anger.
ReplyDeletevery true
Delete