Sunday 22 September 2024

'ডুবল রে ক্ষেত বসত ভিটে...'

গ্রামবাংলার বেঁচে থাকা!

লাবণী হালদার



পোষক প্রকৃতির বিধ্বংসী ও বিরূপ মনোভাবের একপ্রকার আত্মপ্রকাশ ঘটে প্লাবনের মাধ্যমে। প্রাণী জগতের অসহায়তা আরও একবার প্রবল ভাবে ধরা দেয় প্রকৃতির খামখেয়ালি রূপে। আজ প্রাণীকুলের জীবন সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে বন্যা বিধ্বস্ত বঙ্গদেশের আনাচেকানাচে। কোনও কিছুর পরিবর্তনই আকস্মিক রূপে হয় না। ঋতু বদলও হয় নিয়মমাফিক মাস গুনে। কিন্তু বর্ষা এসে হঠাৎ জবরদখল করে নেয় গ্রীষ্মের রাজত্বকে। জয়ঢাক বাজিয়ে সে তার আগমন বার্তা জানান দেয় এবং শীঘ্রই আসমুদ্রহিমালয় সমগ্র দেশের উপরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফেলে। মানুষের মননে প্রবেশ করে প্লাবনভীতি। 

আবহমান কাল ধরেই নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলার মানুষ বন্যা নামক দুর্যোগের সাথে সুপরিচিত। বন্যার শিকারও বটে। মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্গত অঞ্চলে অবস্থিত আমাদের বঙ্গদেশ। ফলত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাত এ দেশের মাটিতে অপরিচিত নয়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস জুড়ে বৃষ্টিপাত বাংলার নদী নালা খাল বিল ছাপিয়ে তোলে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন নদীর কূল ছাপিয়ে বর্ষার জল কোনও বাধানিষেধ না মেনে মানব জীবনের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করে বাড়িঘর রাস্তাঘাট সর্ষের ক্ষেত ছাপিয়ে প্লাবিত করে। 

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে জলস্ফীতি এবং প্লাবন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জলমগ্ন হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, দুই বর্ধমান এবং নদীয়ার কিছু অংশ। ডিভিসি'র জল ছাড়াতে বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্লাবন পরিস্থিতি চোখ রাঙাচ্ছে। বাঁকুড়ার সোনামুখী ব্লক জলে ভেসে গেছে। বহু মানুষ ঘরছাড়া। মাইথন এবং পাঞ্চেত জলাধার থেকে প্রায় তিন লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। সে কারণেই বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে রাজ্যে। যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতায় এবং পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ হালে কিছুটা কমিয়েছে। অন্যদিকে কংসাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা ও দাসপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। জলের তোড়ে হু হু করে জল ঢুকছে বহু বাড়িতে। জলমগ্ন বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়াতেও পরিস্থিতি বেশ জটিল। ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর রাত থেকে কাসাই নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। নিম্নচাপ পরিস্থিতিকে আরও ভয়ানক করে তুলেছে। আস্ত পাকা বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে। আশ্রয়হীন মানুষ রাস্তায় বা কখনও আশ্রয় কেন্দ্রে দিন যাপন করছেন। উঁচু এলাকার স্কুলগুলি খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে। সেই সমস্ত এলাকায় স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। ছেদ পড়েছে স্কুলের পরীক্ষাতেও। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা ও ঘাটাল, হুগলির খানাকুল ও আরামবাগ, হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ও আমতা, বীরভূমের ইলামবাজার সহ কিছু এলাকাতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শিলাবতীর জলে ঘাটাল থানা সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জলে নিমজ্জিত। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠছে ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান নিয়েও। প্রশাসনিক তৎপরতা ও সদিচ্ছা প্রশ্নের মুখে। 

বীরভূমে বাঁধ ভেঙে কুঁয়ে নদীর জল ঢুকেছে বাড়িঘরগুলিতে। মুর্শিদাবাদের বড়ঞাতে মায়ের সাথে ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে এক নাবালিকা। ‌ মৃত্যু হয়েছে একাধিক মানুষের। বৃষ্টি ও ক্রমাগত বাঁধের জল ছাড়ায় পরিস্থিতি ভীষণ ভীতিদায়ক। অন্যদিকে হাওয়া অফিস আভাস দিয়েছে, ২৩ সেপ্টেম্বর উত্তর-পশ্চিম এবং সংলগ্ন মধ্য বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে। ফলত, বৃষ্টির আশঙ্কা দক্ষিণের জেলাগুলিতে বেড়েই চলেছে। ফের যদি প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয় পরিস্থিতির অবনতি অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

বন্যা যে কেবল প্রকৃতি সৃষ্ট একটি দুর্যোগ তা বলা সম্পূর্ণভাবে সঠিক নয়। প্রকৃতি চলে প্রকৃতির নিয়মেই। কিন্তু মানব সমাজে লোভের পরিমাণ মাত্রাহীন হয়ে পড়লে সে তার লিপ্সা পরিপূর্ণ করার নিমিত্তে প্রাকৃতিক সম্পদকে আত্মসাৎ করতেও পিছপা হয় না। কাজেই বিভিন্ন প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কার্যকলাপের হিস্যাদার হয়ে ওঠে মানবজাতির লোভাতুর দল অনায়াসেই। প্রকৃতির দুর্যোগ সেরে উঠতে পারে প্রকৃতিতেই। কিন্তু গত দশক-শতক ধরে নির্বিচারে পুকুর খাল বিল ইত্যাদি ভরাট বন্যার ঘটনা ও প্রকোপ উভয়কেই যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর রয়েছে সুপরিকল্পনাবিহীন রাস্তাঘাট ও নিকাশি ব্যবস্থার অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা। প্রকৃতির চিরাচরিত জলচক্র, লোকসৃষ্ট প্রকৃতি বিনাশ ইত্যাদির ফলস্বরূপ আমাদের দেশে বন্যা একটি বাৎসরিক দুর্বিপাকের মতো হয়ে উঠেছে - 

'আষাঢ় মাসে বান ডেকেছে বাঁধ ভেঙেছে হায়/ বানের জলে ঘরবাড়ি আজ ভেসে বুঝি যায়।' 

বন্যার কবলে পড়ে মাঠঘাট বাড়ি-দোকান সবই জলের নিচে ঠাঁই পেয়েছে। চারিদিকে তাকালে বিস্তীর্ণ জলমগ্ন ভূমি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। দিন-সপ্তাহ তো দূরের কথা, এক রাতের ফারাকে জনজীবন সম্পূর্ণভাবে ওলটপালট হয়ে যায়। রাতে যে ঘরের নিশ্চিন্ত বিছানায় মানুষ সারা দিনের ক্লান্তি নিরসনের হেতু নিদ্রাদেবীর কোলে মাথা রেখে নিশ্চিদ্র ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে, সকালে চোখ খুললেই সব শেষ। দেখা যায়, পাশের পুকুরের জলরাশি তার ঘরে ঢুকে পড়েছে। চোখের জল আর বন্যার জল মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে নির্নিমেষে। বসতবাড়ি হয়ে ওঠে সমুদ্রময়। শহর থেকে শহরান্তর, গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ভেসে যায়। বিনা গত্যন্তর, উপায়ান্তরে বানভাসি মানুষের দিন-রাত কাটে উন্মুক্ত আকাশের নিচে; অথবা সামান্য আশ্রয় খুঁজে নেয় গাছের ডালে, পাকা বাড়ির ছাদে, রেলের প্লাটফর্মের উপরে। মানুষের সহাবস্থান হয় প্রকৃতির আদিম মানুষের মতো সাপ-শেয়াল-কুকুরের সান্নিধ্যে। জলস্রোতের মতোই ভেসে চলে মানব জীবনের স্রোত। জীবন মুহূর্তেই হয়ে পড়ে নিরাপত্তাহীন। সভ্যতার আরম্ভ যেন নিমেষেই উধাও হয়ে মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই বন্য আদিমতায়, ছাদবিহীন ঠিকানায়।

প্রকৃতির নিয়মে বর্ষা নামবে, পুকুর নদী ভরিয়ে তুলবে, তা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। কিন্তু মনুষ্য-সৃষ্ট কারণগুলিই বন্যার প্রকোপকে বাড়িয়ে তোলে। সুদীর্ঘকাল যাবৎ এ রাজ্যের ও দেশের মানুষ বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় সরব। কিন্তু যে চেষ্টা পথভ্রষ্ট তা যে সাফল্য পাবে না, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ্যের ভরাট হয়ে যাওয়া নদী ও পুকুর খাল বিল জলাশয়গুলিকে খনন করে তাদের নাব্যতা বাড়ানো অবশ্য করণীয় একটি কাজ। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করা হয়েছে নদীয়া জেলার চাকদহ ব্লকের বুড়িগঙ্গা সংস্কারের মাধ্যমে। এরূপ কাজ কি আরও আবশ্যিক নয় বন্যার দাপটকে হ্রাস করবার উদ্দেশ্যে? প্রশাসনের সদিচ্ছা ও নাগরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তা অবশ্যই করা সম্ভব। সাথে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে খাল ও নালাতে সুচারু নিকাশি ব্যবস্থা যাতে বৃষ্টির জল দ্রুত নদীতে পতিত হতে পারে। বড় বড় নদীতে বাঁধ দিয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বলতে হয়, বাঁধ নির্মাণ করার আগে প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি সমূহকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। বাঁধের জল যাতে অন্য অঞ্চলকে প্লাবিত না করে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। 

বন্যার প্রভাব শুধু যে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে তাই নয়, খাদ্যাভাব, পানীয় জলের সংকট, রোগব্যাধি, হীনম্মন্যতা, শিক্ষায় ছেদ, কর্মবিরতি বা কর্মচ্যুতি মানুষকে এক সার্বিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। ঘর-বাড়ির সাথে সাথে বিনষ্ট হয় বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি অনিবার্য আপত্তি রূপে প্রকট হয়। দূষিত জল বয়ে আনে কলেরা, টাইফয়েড, ডায়েরিয়া প্রভৃতি রোগ। পানীয় জলের অভাবে মানুষের জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব হয় আরও তীব্র। মানুষ দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হতে থাকে। বন্যা-ত্রাসিত মানুষের দুর্দশা সত্যিই অনির্বচনীয়। তবুও যদি বলতেই হয় তাহলে বলা যায়-- 

'ডুবল রে ক্ষেত বসত ভিটে চারদিক জলে ভরা/ নিভলো আশার প্রদীপগুলো যত্ন করে গড়া।'


1 comment:

  1. "যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতায় এবং পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ হালে কিছুটা কমিয়েছে। "
    হা হা

    ReplyDelete