'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে'
শ্রেয়া ঘোষ
আমাদের সমাজে দুর্নীতির শিকড় গভীরে প্রোথিত। ঘুষ দিয়ে, পদমর্যাদার প্রভাব খাটিয়ে সুবিধে নেওয়ার জালের বিস্তার সর্বব্যাপী।
বাচ্চাকে তথাকথিত ভালো স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করতেও, এমনকি বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময় বা কেউকেটা কোনও ব্যক্তিকে ধরা-করা এক পুরনো প্রথা। আমাদের একবারও মনে হয় না, যে স্কুল একটি তিন বছরের শিশুকে বেআইনিভাবে টাকা নিয়ে বা নিয়ম-বহির্ভূত আর কোনও উপায়ে ভর্তি করছে, সেখানে কী শিক্ষাই বা পাবে আমাদের সন্তান; আর অভিভাবক হিসেবে আমরাও সন্তানের জীবনের প্রথম পদক্ষেপকেই কালিমালিপ্ত করছি অকারণ।
সামান্য একটু বাড়তি সুবিধা পাবার জন্যও আমরা নীতিবোধ জলাঞ্জলি দিই। রাজদ্বারে, শ্মশানে চ - সর্বত্রই ঘুষের খেলা। দেবস্থানে পুজো দেব, ঈশ্বরের কৃপাভিক্ষা করব, কিন্তু বেশিক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে পারব না। টাকা দিয়ে, লাইন টপকে, তাড়াহুড়ো করে ধর্মপালন করে বেরিয়ে আসব। এমনকি শ্মশানে পর্যন্ত লাইন ভেঙে পরে এসে আগে মৃতের (যিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিকটজন) দেহ দাহ করতে অন্ধিসন্ধির সন্ধান করি। হৈ চৈ লাগিয়ে দিই। যে মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলেই গেছে, যে কোনওদিনই আর আমাদের এক মুহূর্ত সময়ও দাবি করবে না, তাকে পুড়ে যাওয়ার সময়টুকুও দিতে পারি না। তারপর বেশ অহমিকা নিয়ে বলে বেড়াই, গিয়ে তো দেখি আমাদেরটা তের নম্বরে, একটা ফোন করিয়ে দিলাম 'দাদা'কে দিয়ে। ব্যাস, বাপ বাপ করে এসে গেল আমাদের নম্বর।
বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে সন্তানকে ডাক্তারি বা এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির প্রথা তো সেই কবে থেকেই। তখন এই বেআইনি লেনদেনকে বলা হত ক্যাপিটেশন ফি। পরে ম্যানেজমেন্ট কোটা বলে বেশ আপাত আইনসঙ্গত একটা ব্যবস্থা চালু হল। বিরাট অঙ্কের টাকা দিয়ে যে কোনও শিক্ষায়তনে ভর্তি শিক্ষার দুর্নীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কারণ, যে এভাবে ভর্তি হয়, সে পাশ করে প্রথম থেকেই চাইবে বেআইনি পথে নিজের উপার্জনকে বাড়িয়ে নিতে। আর এই বিপুল অঙ্কের টাকার ওপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও কোনও কর দিতে হয় না। তাছাড়া এটি এমনই এক কুপ্রথা যেখানে শিক্ষায় মেধার থেকে ছাত্রের পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি অধিক গুরুত্ব পায়। 'রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট' অনুসারে স্কুলে বা কলেজে ভর্তির সময়ে (প্রাইভেট স্কুল-কলেজ হলেও) ক্যাপিটেশন ফি নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে। উপরন্তু এই বিশাল টাকা দেওয়ার ক্ষমতা অনেকেরই নেই, অতএব এই প্রথা সংবিধান বিরোধী। এই সবই অতি সরল যুক্তি, না জানা বা বোঝার কোনও হেতু নেই। অথচ আমরাই বছরের পর বছর এই অন্যায় করে আসছি, বিন্দুমাত্র বিবেক দংশন ছাড়া। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, এইসব ছাত্ররা স্কুল কর্তৃপক্ষের বিশেষ স্নেহও পেয়ে থাকে। ভর্তি হবার পরেও স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশনের সুবাদে প্রশ্ন জেনে আর বিষয়বস্তু না জেনে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার ব্যাপারও নতুন নয়।
আমরা এইসব অভ্যেস পালন করে দিব্যি কাটিয়ে এসে আজ এত যুগ পরে 'বিবেক' নামক একটি বায়বীয় বস্তুকে টানাটানি করতে লেগেছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে ডাক্তারের অ্যাপয়ন্টমেন্ট, ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট থেকে মিথ্যে ডাক্তারি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে এসেছি অবলীলায় মসৃণ এক বিনিময় প্রথার সুবাদে। সুদীর্ঘকালের সহজ প্রচলনে এই সব অন্যায় প্রথা এত স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধও জাগে না মনে।
এই অবধি লিখে একটু থমকে গেলাম। আমরা টাকা দিয়ে, ধরা-করা করে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড় করছি, কিন্তু এর বৃহত্তর অভিঘাত সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না। স্কুল-কলেজে জাল সার্টিফিকেট দিচ্ছেন একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসক। অনুপস্থিত হওয়ার কারণ হিসেবে এই মিথ্যে কাগজ সংগ্রহ করে স্কুলে জমা দিচ্ছেন অভিভাবক যেখানে তাঁর সন্তান সুস্থ এবং হয়তো বেড়াতে যাওয়া বা অন্য কোনও কারণে স্কুলে যায়নি। চিকিৎসক তাঁর ডিগ্রির অপব্যবহার করছেন অবলীলায়। চিকিৎসক এই প্রকারে, তাঁর ওপর যে সামাজিক বিশ্বাস আর সম্মান ন্যস্ত করা হয়েছে, তা মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই নবীন প্রজন্ম মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হচ্ছে। উল্টোদিকে পুরোপুরি রোগ নিরাময়ের আগেই কেউ মিথ্যে কাগজ ব্যবহার করে সুস্থ মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি করছেন। এইসব আমাদের মনে হয় না। তাৎক্ষণিক কার্যসিদ্ধি হলেই আমরা খুশি। অসৎ উপায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করে সহনাগরিকদের জীবনকে বিপজ্জনক করে তুলছি। যিনি বা যাঁরা ঘুষ নিয়ে এই অনুমতিপত্র বিলোচ্ছেন আর নিরীহ মানুষের জীবনহানির কারণ হচ্ছেন, তাঁরা কি কখনও অনুতপ্ত হয়েছেন? আচ্ছা, এইসব অনুতাপ-টাপের মতো অস্তিত্বহীন অনুভূতি বাদ দিয়েই বলি না হয়, দুর্ঘটনা ঘটলে এই মিথ্যে শংসাপত্র প্রদানকারী ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে খুনের চার্জ আনা হয়?
তিরিশ-বত্রিশ বছরের পুরনো কথা মনে পড়ছে। নার্সারি স্কুলের ছুটির সময়ে বাচ্চাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য স্কুল গেটের বাইরে অভিভাবকদের ভীড়ে জমজমাট রাস্তায় এক শিশুর মা গর্বের সঙ্গে বলছেন, আমার হাজব্যন্ডের তো মাইনের টাকায় হাতই পড়ে না...। সে ভদ্রলোক বেলতলা রোডের মোটর ভেহেকিল্স'এ কর্মরত ছিলেন। অপরাধ করে, কারও তোয়াক্কা না করে বুক ফুলিয়ে জাহির করার মতো ভয়ঙ্কর মানসিকতা নিতান্ত ছাপোষা লোকজনের মধ্যে কেমন পুষ্ট হয়ে এসেছে বরাবর।
ছোট থেকে দেখে এসেছি টেলিফোন লাইন খারাপ হলে BSNL'এর যে কর্মী সারাতে আসেন, তাঁকে কিছু টাকা দিতে হত। যদিও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের মাস মাইনে পাওয়া কর্মী। তবু মা মাসের খরচের বাক্স থেকে টাকা বার করে তাঁকে দিতেন। মা ভয় পেতেন, টাকা না দিলে লাইন আসতে অহেতুক দেরী হবে। এখন BSNL ল্যান্ডলাইনের সংযোগ প্রায় উঠেই গেছে। পরিবর্তে মোবাইলে আরও বেশি লোক ঠকানোর ছক। বস্তুর সঙ্গে ছায়ার মতো, জীবনের সঙ্গে ঘুষ ও যাপনের সঙ্গে ভয় অবিচ্ছেদ্য হয়ে জুড়ে আছে।
আমরা সকলেই একদিন প্রথম জেনে ফেলি, 'পয়সা দিয়ে সবই পাওয়া যায়'। বিচার থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ, সব। প্রভাব খাটিয়ে আরও বেশি পাওয়া যায়, আরও সহজে। ধর্ষণের অপরাধে কারাবাসের শাস্তিপ্রাপ্ত আসামীর প্যারোলে মুক্তি থেকে নকল বা জাল ওষুধের ব্যবসার ছাড়পত্র। ভয় পেয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে আমরাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছি কিন্তু। আইন ব্যবসায়ী উকিল রসিদ ছাড়া নগদ টাকা দাবি করছেন, পাছে মামলায় হেরে যাই সেই ভয়ে দিয়েও দিচ্ছি। চিকিৎসক যা খুশি তাই দক্ষিণা দাবি করছেন তো প্রিয়জনের জীবনের ঝুঁকি নিতে না পেরে বিনা প্রতিবাদে সেই অন্যায়কে মেনে নিচ্ছি। প্রতিবাদ কি কখনও করি না? করি, কালেভদ্রে, হাওয়া বুঝে আর অবশ্যই ভিক্টিমের সামাজিক অবস্থান বুঝে। আমর সকলেই জানি সমীকরণের দুই দিকের রাশির মাঝের দুটি রেখা কখনই সমান্তরাল নয়। রেখা দুটি হয় অভিসারী, নতুবা অপসারী হয়ে একটা গিলে খাওয়ার মতো চেহারা নেয়। খাদ্য-খাদক যেন। ভয়ানক এই সম্পর্কের কথা স্বতঃই মনে আসে।
বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছি, জল দিয়েছি, সার দিয়েছি, হাওয়া দিয়েছি। আমরা কি অমৃত ফলের আশা করেছিলাম? বিন্দু বিন্দু জলকণা জমিয়ে জমিয়ে আমরাই তৈরি করেছি মারের সাগর।
'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে' আজ শুধু হাতে উঁচিয়ে রাখা পোস্টারে।
আমার জানা আছে সুস্থ্য লোককে বিকলাঙ্গ সার্টিফিকেট দেওয়ার র্যাকেট পর্যন্ত আছে। তা দেখিয়ে একজন চাকরিও পেয়েছে
ReplyDeleteঅনেকদিন পরে একটা বার্তা পেলাম যাতে মৌলিক নীতিগুলো কীভাবে আমরা প্রতিদিন পায়ে মাড়িয়ে পথ চলছি।
ReplyDeleteলেখক কে প্রাণভরা শুভেচ্ছা।
আজ মধ্যবিত্ত জাস্টিস চাইছে। নিশ্চয় চাইতে হবে কারণ আমাদের ভয় গ্রাস করেছে। দুর্নীতি বড় বাড়।
ReplyDeleteভালো লাগলো সহজ উচ্চারনে কথাগুলো বলার জন্য।
অসিত