Saturday, 28 September 2024

'এক দেশ এক ভোট'?

যুক্তরাষ্ট্রীয় ও বহুদলীয় ব্যবস্থার উপর আঘাত

বর্ণালী মুখোপাধ্যায়



বিজেপি'র ফ্যাসিস্ট রাজ কায়েমের সব থেকে বড় বাধা হল বহু দলের অস্তিত্ব। ইডি-সিবিআই'কে দিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার করে দলগুলির মাজা ভাঙার চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু জনগণ প্রত্যাঘ্যাত করলেন, নরেন্দ্র মোদী বেনারস থেকে মাত্র এক লাখের কিছু বেশি ভোটে জিতলেন। এখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অনুব্রত মন্ডল, সেন্থিল বালাজি সহ অনেকেই একে একে বেলে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। তাই এবার বিজেপির নতুন ফন্দি হল ‘এক দেশ এক ভোট’। পুঁজিবাদের বৃদ্ধ বয়সের (যদিও বার্ধক্যের বয়সও দেড়শো বছর হতে চলল) সন্তান ফ্যাসিবাদ আবার যুবক পুঁজিবাদের গণতন্ত্রকে সহ্য করতে পারে না। হিটলার থেকে বাজপেয়ী হয়ে মোদী আদ্যপান্ত ভোট বিরোধী। বাজপেয়ী আমলেও এই চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিল। আজ মোদী শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

রামনাথ কোভিন্দের সভাপতিত্বে অমিত শাহ, গুলাম নবি আজাদ, এন কে সিং, সুভাষ কাশ্যপ, হরিশ সাল্ভে, সঞ্জয় কোঠারি, নীতিন চন্দ্র এবং আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে আইন মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল— এই কমিটি সুপারিশ করেছে ‘এক দেশ এক ভোট’ (One Nation One Election- ONOE) আইন। ৩২২ পাতার রিপোর্ট এটি, যা ১৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রীসভায় গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবটি সংসদে পেশ হবে শীতকালীন অধিবেশনে। রিপোর্ট অনুযায়ী, পাঁচ বছর অন্তর ৪ মাস ধরে ভোট চলবে। প্রথমে বিধানসভা আর লোকসভা ভোট একসঙ্গে হবে, তারপর তিন মাসের মধ্যে পঞ্চায়েত ও পৌরসভা ভোট। রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে ১৯১ দিনে। অন্তত একজন সাংসদ আছে এমন ৪৭টা রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জানায়। এছাড়া ভারতের তিনটি বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফিকি-অ্যাসোচেম-সিআইআই'এর থেকে নেওয়া হয়েছে পরামর্শ। পরামর্শ নেওয়া হয়েছে উকিল এবং বিচারপতিদের থেকেও। এই সুপারিশ গঠনে বিশেষ ধন্যবাদ জানানো হয়েছে আইন মন্ত্রক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ দু-চারজন আমলাকে। যদিও যে নামগুলো আছে সেগুলো বাছাই করা তাতে সন্দেহ নেই। সুপ্রিম কোর্টের চারজন বাছাই করা প্রাক্তন বিচারপতি, কিছু বাছাই করা হাই কোর্টের বিচারপতি, আবার অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ অর্থাৎ আরএসএস'এর উকিল সংগঠনের প্রতিনিধি, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রাক্তন আধিকারিক- এদের থেকেও মতামত নেওয়া হয়েছে। আর জনগণ? হ্যাঁ তাও আছে বৈকি!! ১৪০ কোটির এই দেশে ২১,৫৫৬ জন নাগরিক তাদের মতামত জানিয়েছেন; যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ, ১৭ হাজার মানুষ এই সুপারিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যথেষ্ট নয় কী?! ৩২টি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবের পক্ষে রায় দিয়েছে, ১৫টি দল বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, শিবসেনা পক্ষে মত দিয়েছে আর আরজেডি নীরব থেকেছে। অন্তত বিরোধিতা করেনি।    

বিজেপি বিরোধীরা হয়তো ভেবেছিল যে এই আইন মন্ত্রীসভায় গৃহীত হবে না। বিজেপির আসন এবার কম তাই সেই সুযোগ নিয়ে শরিকরা এটা অনুমোদন করবে না। কিন্তু দেশে বা বিভিন্ন রাজ্যে অনাস্থা প্রস্তাব এলে মধ্যবর্তী ভোট হবে-- এই আশ্বাস দিয়েই কি কোভিন্দ কমিটির সুপারিশ শরিকদের মন জিতে নিল? ‘একসাথে বিধানসভা আর লোকসভা ভোট হলেও বহু আঞ্চলিক দল বহু রাজ্যে জিতেছিল’-- সুপারিশ থেকে এই বার্তা পেয়েও হয়তো শরিকরা সন্তুষ্ট। অথবা বিজেপি বিরোধী দলগুলো যেমন শরিকদের উপর নির্ভর করছিল হয়তো বিপরীতটাও সত্যি। শরিকরাও হয়তো ধরেই নিয়েছে যে এই আইনের বিরুদ্ধে মামলা হবেই, ফলে তারা আর অমিত শাহকে চটাতে চাইল না। কংগ্রেস দলের আমলে এই ব্যবস্থা ছিল বলে রাহুল গান্ধী নীরব থাকবেন, এমনটাও হয়তো বিজেপি আশা করেছে। তাছাড়া, বহুদলীয় ব্যবস্থা থেকে সরে এসে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা হলে কংগ্রেসের আপত্তি থাকবে না, এমন আশা বিজেপি করতেই পারে।

আসলে এই সুপারিশ মোতাবেক এই যে বহু দল থাকবে, একসাথে সব ভোট হবে, অনাস্থা প্রস্তাব এসে কোনও সরকার পড়ে গেলে আবার মধ্যবর্তী ভোটও হবে, অথচ ভোটের সংখ্যা কমবে-- এ এক সোনার পাথরবাটি। অমিত শাহ সেটা জানেন। যেমন জানেন সুভাষ কাশ্যপ (এই কমিটির সদস্য)। কমিটির প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা আছে যে কংগ্রেস আমলে প্রথম চারটে লোকসভা ভোট বিধানসভার সাথেই হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণে ক্রমেই বহুদলীয় গণতন্ত্র পাকাপোক্ত হয়েছে একসাথে ভোট আর করা যায়নি। ফলে, কাশ্যপ মধ্যবর্তী সাধারণ ভোটে রাজি নন। তার বদলে বিধানসভা বা সংসদের ভেতরে ভোটের মধ্য দিয়ে পরবর্তী সরকার গঠন করার সুপারিশ করেছেন, তবে একটাই শর্তে, বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী/ প্রধানমন্ত্রীর মুখ বেছে নিতে হবে তখনই। সারকারিয়া কমিশন আর পুঞ্চ কমিশনের নির্দেশমতো রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতি পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য দল/জোটকে আহ্বান জানাবে আর অনাস্থা প্রস্তাব যারা এনেছে তাদের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকে ওই হাউজেই ভোটের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত করতে হবে। অর্থাৎ, ঘোড়া কেনাবেচা হবে, অনাস্থা আসবে, হাউজের ভেতরেই বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী নির্দিষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে হাউজে ভোটও হবে। আর না হলে? তিনি আর কিছু বলেননি, কিন্তু একটাই বিকল্প হয় সে ক্ষেত্রে: রাষ্ট্রপতি শাসন। কাশ্যপবাবু কিছুতেই মধ্যবর্তী সাধারণ বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচন চাননি। তাঁর দিক থেকে বিষয়টা অযৌক্তিকও নয়। কোভিন্দ কমিটির যুক্তির গোড়ার অজুহাত হল ভোটের সংখ্যা কমাও, খরচ কমাও। অথচ, কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী পাঁচ বছর অন্তর সব ধরনের ভোট একসাথে করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেটা আইন হলে, আবার পাশাপাশি মধ্যবর্তী ভোটও চালু থাকলে, ভোটের সংখ্যা কমার বদলে আরও বাড়বে। যেহেতু নতুন আইন চালু হলে মধ্যবর্তী সরকার পাঁচ বছর থাকবে না, লোকসভার এক বছর আগে নতুন সরকার হলেও আবার নতুন করে একসাথে ভোট হবে, ফলে, কাশ্যপ সোজাসাপ্টা রাজ্যপালের ক্ষমতা প্রয়োগের কথা বলেছেন এবং সেই হেতু এও স্পষ্ট করেছেন যে ভারত আসলে যুক্তরাষ্ট্র নয়, এখানে আমেরিকার মতো রাজ্যগুলি স্বেচ্ছায় একটি ভৌগোলিক সীমানায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। 

অমিত শাহ জানতেন যে কাশ্যপের প্রস্তাব এখনই মানা যাবে না। কোভিন্দ কমিটি কাশ্যপের এই প্রস্তাব বাতিল করে শরিকদের, হয়তো বা বিরোধীদেরও সন্তুষ্ট করে বলেছে যে মধ্যবর্তী ভোট অবশ্যই হবে। কিন্তু রাজ্যপালের সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে রাজ্য সরকার ফেলে দেওয়ার, কাশ্যপের এই মতামতকে সার্বিক সমর্থন জানাতে ভোলেনি কোবিন্দ কমিটি। রাজ্যপালকে মন্ত্রীসভার অনুমোদন নিতে হবে না এবং আদালতেও রাজ্যপালের এই কাজকে প্রশ্ন করা যাবে না। অমিত শাহ জানেন যে এই আইনের মধ্য দিয়ে আসলে তারা এই দুটো বিষয়কেই বৈধ করতে চেয়েছে-- 

এক) রাজ্যপাল মোটেই আলংকারিক নয়। 

দুই) দেশ মোটেই যুক্তরাষ্ট্র নয়। 

'যুক্তরাষ্ট্র' শব্দটার গুরুত্ব স্রেফ এইটুকুই যে সংবিধানে তিনরকম তালিকা আছে, এবং সেটাও দেশের বৈচিত্রের দিকে খেয়াল রেখে যেন বা দয়া করে কেন্দ্র দিয়েছে রাজ্যকে। আপাতত এই দুটো স্বীকৃতি পেলেই অমিত শাহের চলবে। বাকিটা দাঙ্গা করে তারা আদায় করবে। যেমন প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও জম্মু কাশ্মীরের ভোট ৬ বছর দেরিতে হল। 

ভোট নাকি উন্নয়নের পথে বাধা। ভোটের খরচ নাকি আকাশছোঁয়া!! যদিও হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু ভোটের খরচ দেড় হাজার টাকা, অথচ মাথাপিছু দেশের ঋণ হল দেড় লাখ টাকা। এদিকে প্রস্তাবে পাবেন বালতি বালতি কুমিরের চোখের জল। ভোটের জন্য নতুন প্রজেক্টের শীলা স্থাপন করা যাচ্ছে না, অনুদান দেওয়া যায় না, ইস্কুল আর শিক্ষকদের ভোটের কাজে নিয়ে যেতে হচ্ছে, এমন কত আক্ষেপ অমিত শাহের। বাস্তব হল, বছরে একটা ভোট অসহ্য হয়ে উঠছে একাধারে বিজেপি অন্যদিকে এ দেশের বৃহৎ ব্যবসাদারদের পক্ষেই। তাদের মৌখিক যুক্তি হল, পরিযায়ী শ্রমিকরা বার বার ঘরে ফেরে ভোট দিতে, তাই পাঁচ বছর অন্তর এই বন্ডেড লেবারদের আটকাতে ভোট আর যেন বছরে একবার না হয়। এমন নির্লজ্জ বক্তব্য তারা রেখেছে ঠিকই। কিন্তু আসল কারণ আরও গভীরে। জনবিরোধী নীতিগুলি কার্যকর করার আগে তাদের প্রতি পদে হিসেব কষতে হয়। তাছাড়া বিরোধীরা থাকে সমাজতান্ত্রিক মেজাজে। পাঁচ বছর অন্তর ভোট হলে সেই বালাই নেই। প্রতি বছর ভোট না থাকলে মাঝের চার বছর বিরোধী দল সিন্দুকের ভেতর সেঁধিয়ে যাবে, এমনই আশা বিজেপির। বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, ফিলিপিন্সের মতো হাতে গোনা কিছু ছোট দেশ, যাদের ভারতের মতো বৈচিত্র নেই, সেখানে চালু আছে একসাথে ভোট প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে সেটা অসম্ভব। 

ভারতের সংবিধান ঔপনিবেশিক রাজ্যপালের পদ বিলোপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে খাপছাড়া ভাবে কার্যকর করেছে। তিনটি তালিকার মধ্যে রাজ্যের হাতে যা আছে সেটা প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ হেন সাংবিধানিক ফাঁকের সুযোগ নিয়ে আজ কোভিন্দ কমিটি যুক্তরাষ্ট্রকেই অস্বীকার করছে, রাজ্যপালদের ঈশ্বর বানাচ্ছে। 

১৯৫০ আর ২০২৪'এর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আজ বাস্তব ঘাড় ধরে এ দেশে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, যার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আমাদের চাই। আর ফ্যাসিস্টদের তরফে চাওয়া রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালের আলংকারিক অস্তিত্বের ন্যূনতম সাংবিধানিক স্বীকৃতিকেই অস্বীকার করা দরকার।


Monday, 23 September 2024

কর্পোরেটরা হাসছে, রোগীরা অসহায়!

রোগী-ডাক্তার সম্পর্কই নিরাপত্তার চাবিকাঠি  

উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়



লেখকের ডিসক্লেইমার: আরজিকর কাণ্ডে তিলোত্তমা'র জঘন্য হন্তাকারীরা কেউ যেন ছাড়া না পায়। দোষীদের নিরপেক্ষ সঠিক বিচার হোক, দোষীরা সাজা পাক। দুর্নীতি উন্মোচিত হোক; তারও সঠিক, নিরপেক্ষ, ন্যায়বিচার চাই। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদ সঙ্গত।

পশ্চিমবঙ্গে রেজিস্টিকৃত ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় ৯৩,০০০'এর কাছাকাছি। West Bengal Medical Council'এ গিয়ে অনুসন্ধান করলেই জানা যাবে। তার মধ্যে আছে, 

১) ১৫ থেকে ২০ হাজার ডাক্তার মৃত অথবা ডাক্তারি করা থেকে অবসর নিয়েছেন কিংবা ভীষণ বৃদ্ধ, বোধশক্তিই রহিত হয়েছে বার্ধক্যে। মৃত ডাক্তারদের বাড়ির লোক এসে খবরও দেননি যে উনি আর ইহলোকে নেই;

২) বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের ডাক্তার;

৩) কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালের (রেল, ডিফেন্স, পোর্ট, ইএসআই, কেন্দ্রীয় সরকারি) ডাক্তারেরা;

৪) ইএসআই রাজ্য সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার;

৫) স্বাধীন প্রাকটিস করা ডাক্তার।

এরপরে পড়ে থাকল,

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমস্ত সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, প্রাইমারি, ব্লক প্রাইমারি, গ্রামীণ, জেলা ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালের মোট ডাক্তার। যারা সব মিলিয়ে ১৮,০০০।

তাহলে এবার অঙ্কটা কষে ফেলা যাক! 

৭৩০০ জুনিয়র ডাক্তার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে কর্মরত ১৮,০০০ ডাক্তারের কত শতাংশ? প্রায় ৪০ শতাংশ।

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১২৫৭টি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার এবং ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টার আছে। ৮০'র কাছাকাছি সেকেন্ডারি কেয়ার বা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল আছে, কিছু টার্সিয়ারি কেয়ার ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল আছে, যা জেলা হাসপাতালও বটে, যেমন এম আর বাঙুর; ৩০'টার উপরে মেডিকেল কলেজ আছে যার ২৬টাই সরকারি, বাদবাকিগুলো বেসরকারি। এই ২৬টার মধ্যে ১৮টা মেডিকেল কলেজে প্রথম এমবিবিএস ব্যাচ বেরিয়েছে, বাদবাকি ৮টায় এখনও ফাইনাল এমবিবিএস অবধি ছাত্র-ছাত্রীরা পৌঁছয়নি। 

তাহলে বলা হয় কেন, এমনকি আদালতেও যে, জুনিয়র ডাক্তারেরা মাত্র ৭৩০০ জন, এই বিপুল, বিশাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মাত্র ১৮টা জায়গায়, তো তাতে কী এমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ল!

আসুন হিসেব করি।

৭৩০০ সংখ্যাটি কমবেশি ঠিকই আছে, কিন্তু ১৮টার হিসেব কষতে হচ্ছে।

১) সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালেও পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স পড়ানো হয়, যারা পড়েন অথচ চাকরি করতে করতে লিয়েন'এ আসেননি বরং ফ্রেশ‌, মানে ইন্টার্নশিপ'এর পরেই DNB (MD/MS এর সমতুল্য) করছেন, তারাও সংখ্যায় কম নন। তারাও জুনিয়র ডাক্তার। 

২) বহু স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও DNB কোর্স আছে, যেমন বিদ্যাসাগর, বাঘাযতীন হাসপাতাল। এদের যারা ফ্রেশ DNB করছে, তারাও জুনিয়র ডাক্তার। ধরা যাক বাঘাযতীন'এ ৮টা DNB সিট আছে, তার মানে, ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষ মিলে ২৪ জন। এদের মধ্যে যারা সরকারি চাকরি করতে করতে লিয়েন'এ আসেননি, সবাই জুনিয়র ডাক্তার। 

৩) এটা ঠিকই, এখন হাউসস্টাফশিপ আর আবশ্যিক নেই। তার মানে, কেউ সরাসরি ইন্টার্নশিপ থেকে পোস্ট-গ্রাজুয়েশনে সুযোগ পেতেই পারেন প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে। তবু, তা তো প্রথম সুযোগেই সবাই পান না! কেউ কেউ দুবার, তিনবার এমনকি চারবারেও পায়।

তবু, ধরা যাক...

কোনও মেডিকেল কলেজেও দেখা গেল, কোনও ফ্যাকাল্টির সব ইউনিট ধরেও কোথাও হয়তো জুনিয়র ডাক্তার কম। সে ক্ষেত্রে 'Need basis'এ হাউসস্টাফ নিয়োগ করা হয়। কোনও কোনও হাসপাতালে হাউসস্টাফ ২০ থেকে ৪০'ও হতে পারে সব মিলিয়ে। প্রতি বছরেই হাউসস্টাফশিপের একটা কোটাও থাকে মেডিকেল কলেজগুলোতে। এছাড়াও মেডিকেল কলেজগুলো বাদ দিয়ে বিভিন্ন স্পেশালিটি ক্লিনিক, সুপার স্পেশালিটি ক্লিনিক, জেলা হাসপাতাল ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও হাউসস্টাফ নিয়োগ করা হয়। এরা সবাই জুনিয়র ডাক্তার।

কেন বলছি এ কথা? 

শুধুমাত্র ১৮টা কলেজ বললে ভুল বলছি। সারা বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেডিকেল কলেজগুলো বাদ দিয়েও জুনিয়র ডাক্তার বর্তমান। হয়তো সংখ্যায় কম কিন্তু মেডিকেল কলেজের তুলনায় সেই হাসপাতালটিও তো ছোট। অতএব, পরিষেবা শুধু মেডিকেল কলেজগুলোতেই ব্যাহত হচ্ছে না, অন্যত্রও হচ্ছে।

এছাড়াও জেলা হাসপাতালগুলো থেকে একটা অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনও পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনও মেডিকেল কলেজে বা বিশেষ করে কলকাতার মেডিকেল কলেজগুলোতে। কেন? ওখানকার ডাক্তারেরাই ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে নার্সিং হোমে কেস করেন। উল্টে বলেন, হাসপাতালে ওটি খারাপ, যন্ত্রপাতি স্টেরাইল নেই, এটা নেই, স্টাফ নেই, সেটা নেই। যারা ওনাকে দিয়েই নার্সিংহোমে পারেন না, তাদেরকে বড় হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজগুলোতে রেফারেল দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, সব মেডিকেল কলেজগুলোতে যত রোগী হয় তার মধ্যে রেফারেল কেসই ৭০ শতাংশ, যার প্রায় ৬০ শতাংশের ওই পেরিফেরিতেই চিকিৎসা হত, সম্ভবও ছিল। 

সবাই এসব কথা সব কিছু জানে। 

ধরা যাক, কোনও ডাক্তার কলকাতার কোনও সরকারি মেডিকেল কলেজেরই ডাক্তার। কোনও একটা মহল তার থেকে ঘুষ চাইল ১০ বা ১৫ লক্ষ টাকা। তিনি দেবেন না বা দিতে পারবেন না জানালে তাঁকে দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হল। এবার তিনি রাগে, অপমানে আরেকটা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি হয়তো শিলিগুড়িতে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে আছেন। এবারে তিনি করলেন কী- ওখানে ২ দিন আর কলকাতায় ৫ দিন থাকলেন। সময় নষ্ট করবেন না বলে যাতায়াত প্লেনে সারলেন। ফলে, এত খরচের টাকা তো তাঁকে তুলতে হবে! তিনি তখন বাকি পাঁচদিনের চারদিনেই চুটিয়ে বাণিজ্য করতে শুরু করে দিলেন। বাণিজ্য বাড়াতে কী করতে হবে? ফার্মা লবিকে ধরতে হবে। কোনও ফার্মা লবি তাঁর ক্লিনিকটাও কলকাতার বিশেষ জায়গায় তৈরি করে দিল। এখন তার টাকা পয়সা কীরকম? ওই আধিকারিক যে ঘুষ চাইছিলেন, তাঁর থেকেও তিনি এখন বিত্তবান, খুব কম সময়েই।

কী দাঁড়ালো? 

১) মেডিকেল কলেজে রোগীর চাপ এবং সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের অনুপস্থিতিতে একজন রোগীকে প্রথম ও প্রাথমিক ভাবে দেখার লোকই রইল না। উপরন্তু, দৈনন্দিন নিত্যনৈমিত্তিক একজন ইন্ডোর পেশেন্টের প্রতি পরিষেবাও অপ্রতুল হল; 

২) করাতের দুদিকেই ধার। এদিকে কর্তৃপক্ষের কেউ যদি দুর্নীতি করেন, ওদিকে যিনি তার কোপে পড়লেন, তারও কেমন যেন একটা মেটামরফোসিস ঘটে! এ এক অমোঘ নিষ্ঠুর বাস্তবতা; 

৩) কর্পোরেটরা হাসছে। তাদের চুরি, আরও চুরি অনায়াসেই মান্যতা পাচ্ছে;

৪) অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি সিনিয়র ডাক্তাররাই কর্পোরেট হাতছানিতে আছেন - হয় ১০০ শতাংশ, নতুবা ন্যূনতম ১০ শতাংশ। এরাই জুনিয়র ডাক্তারদের আগুন খাওয়াকে উৎসাহ দিচ্ছেন;

৫) পুরো মহলটাই এমন হয়ে যাচ্ছে যে সমগ্র সরকারি ব্যবস্থাটাকেই তার আমলাতন্ত্র এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যে তা কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে হবে;

৬) অধিকাংশ সম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরাই এখন নিট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে, ব্যবস্থাটা তেমনই। আগেকার মতো অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে টিউশনি করে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার মাইনে ও হোস্টেলের খরচ বহন করতে হত - সেরকম সংখ্যা এখন কত? ৫ শতাংশও না। কাজে কাজেই তাদের আন্দোলনের সবকিছু যৌক্তিক দাবিগুলো অকপটে মেনে নিয়েও বোঝানোর দায়দায়িত্ব থাকে সিনিয়রদের উপর যে, দেখো, হাসপাতালের বেনিফিশিয়ারি কারা! কাদের চিকিৎসা দিচ্ছ না। কে চিকিৎসা দিচ্ছে না? সম্পন্ন ঘরের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই। কারা চিকিৎসা পাচ্ছে না? গরিব, নিম্নবিত্তরা, যারা মোট রোগীর অধিকাংশ। 

কোভিডের সময়ে টেলিভিশনে এসে প্রত্যহ ভয় বিতরণকারী চিকিৎসকেরা যারা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন, তাঁরাই নাগরিকদের কেউ ভ্যাক্সিন না নিলে তাদের অসামাজিক বলেছেন; সেই তাঁরাই ১৮০ ডিগ্রি পাল্টি খেয়ে ২০২২ সালের পর বলেছেন যে জেনেটাক্যালি মডিফায়েড ভ্যাক্সিন (mRNA)'এ প্রচুর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে! এই তাঁরাই কোভিডের সময়ে প্রত্যেকে প্রত্যহ লক্ষ টাকা কামিয়েছেন, কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দিয়েছেন তাদের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। জুনিয়র ডাক্তারদের উচিত ছিল, সিনিয়রদের মধ্যে ভারী এই অংশটাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা।

তাই, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য একে-ওকে ট্রান্সফার করে বা ফ্লাডলাইটে হাসপাতাল ভরিয়ে দিয়ে অথবা কোলাপসিবল গেট চারগুণ বাড়িয়ে কিংবা সিসিটিভি ১০ গুণ বেশি বসালেই হাসপাতালের সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসে না। যে কোনও মর্ষকামী শক্তিশালী কায়েমী স্বার্থ, তা যে কোনও সরকারি দলের কারও তাণ্ডবেই হোক বা অন্য যে কোনও স্বার্থান্বেষী শক্তির দাপটে, তা আন্দোলন করে একসাথেই প্রতিহত করতে হবে। তার বিকল্প কিছু নেই। জনস্বাস্থ্যের এক সামগ্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি, রোগী ও রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে হবে। তা রোগীকে পাশে ঠেলে নয়। সম্পর্কের উন্নতি হলে তাঁরাই আসল সুরক্ষা ও নিরাপত্তার চাবিকাঠি।

(লেখক একজন রোগী অধিকার আন্দোলনের কর্মী)


Sunday, 22 September 2024

'ডুবল রে ক্ষেত বসত ভিটে...'

গ্রামবাংলার বেঁচে থাকা!

লাবণী হালদার



পোষক প্রকৃতির বিধ্বংসী ও বিরূপ মনোভাবের একপ্রকার আত্মপ্রকাশ ঘটে প্লাবনের মাধ্যমে। প্রাণী জগতের অসহায়তা আরও একবার প্রবল ভাবে ধরা দেয় প্রকৃতির খামখেয়ালি রূপে। আজ প্রাণীকুলের জীবন সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে বন্যা বিধ্বস্ত বঙ্গদেশের আনাচেকানাচে। কোনও কিছুর পরিবর্তনই আকস্মিক রূপে হয় না। ঋতু বদলও হয় নিয়মমাফিক মাস গুনে। কিন্তু বর্ষা এসে হঠাৎ জবরদখল করে নেয় গ্রীষ্মের রাজত্বকে। জয়ঢাক বাজিয়ে সে তার আগমন বার্তা জানান দেয় এবং শীঘ্রই আসমুদ্রহিমালয় সমগ্র দেশের উপরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ফেলে। মানুষের মননে প্রবেশ করে প্লাবনভীতি। 

আবহমান কাল ধরেই নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলার মানুষ বন্যা নামক দুর্যোগের সাথে সুপরিচিত। বন্যার শিকারও বটে। মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্গত অঞ্চলে অবস্থিত আমাদের বঙ্গদেশ। ফলত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাত এ দেশের মাটিতে অপরিচিত নয়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস জুড়ে বৃষ্টিপাত বাংলার নদী নালা খাল বিল ছাপিয়ে তোলে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন নদীর কূল ছাপিয়ে বর্ষার জল কোনও বাধানিষেধ না মেনে মানব জীবনের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করে বাড়িঘর রাস্তাঘাট সর্ষের ক্ষেত ছাপিয়ে প্লাবিত করে। 

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে জলস্ফীতি এবং প্লাবন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জলমগ্ন হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, দুই বর্ধমান এবং নদীয়ার কিছু অংশ। ডিভিসি'র জল ছাড়াতে বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্লাবন পরিস্থিতি চোখ রাঙাচ্ছে। বাঁকুড়ার সোনামুখী ব্লক জলে ভেসে গেছে। বহু মানুষ ঘরছাড়া। মাইথন এবং পাঞ্চেত জলাধার থেকে প্রায় তিন লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। সে কারণেই বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে রাজ্যে। যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতায় এবং পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ডিভিসি জল ছাড়ার পরিমাণ হালে কিছুটা কমিয়েছে। অন্যদিকে কংসাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা ও দাসপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। জলের তোড়ে হু হু করে জল ঢুকছে বহু বাড়িতে। জলমগ্ন বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়াতেও পরিস্থিতি বেশ জটিল। ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর রাত থেকে কাসাই নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। নিম্নচাপ পরিস্থিতিকে আরও ভয়ানক করে তুলেছে। আস্ত পাকা বাড়ি তলিয়ে গিয়েছে। আশ্রয়হীন মানুষ রাস্তায় বা কখনও আশ্রয় কেন্দ্রে দিন যাপন করছেন। উঁচু এলাকার স্কুলগুলি খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে। সেই সমস্ত এলাকায় স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। ছেদ পড়েছে স্কুলের পরীক্ষাতেও। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা ও ঘাটাল, হুগলির খানাকুল ও আরামবাগ, হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ও আমতা, বীরভূমের ইলামবাজার সহ কিছু এলাকাতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শিলাবতীর জলে ঘাটাল থানা সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জলে নিমজ্জিত। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠছে ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান নিয়েও। প্রশাসনিক তৎপরতা ও সদিচ্ছা প্রশ্নের মুখে। 

বীরভূমে বাঁধ ভেঙে কুঁয়ে নদীর জল ঢুকেছে বাড়িঘরগুলিতে। মুর্শিদাবাদের বড়ঞাতে মায়ের সাথে ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে এক নাবালিকা। ‌ মৃত্যু হয়েছে একাধিক মানুষের। বৃষ্টি ও ক্রমাগত বাঁধের জল ছাড়ায় পরিস্থিতি ভীষণ ভীতিদায়ক। অন্যদিকে হাওয়া অফিস আভাস দিয়েছে, ২৩ সেপ্টেম্বর উত্তর-পশ্চিম এবং সংলগ্ন মধ্য বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে। ফলত, বৃষ্টির আশঙ্কা দক্ষিণের জেলাগুলিতে বেড়েই চলেছে। ফের যদি প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয় পরিস্থিতির অবনতি অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

বন্যা যে কেবল প্রকৃতি সৃষ্ট একটি দুর্যোগ তা বলা সম্পূর্ণভাবে সঠিক নয়। প্রকৃতি চলে প্রকৃতির নিয়মেই। কিন্তু মানব সমাজে লোভের পরিমাণ মাত্রাহীন হয়ে পড়লে সে তার লিপ্সা পরিপূর্ণ করার নিমিত্তে প্রাকৃতিক সম্পদকে আত্মসাৎ করতেও পিছপা হয় না। কাজেই বিভিন্ন প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কার্যকলাপের হিস্যাদার হয়ে ওঠে মানবজাতির লোভাতুর দল অনায়াসেই। প্রকৃতির দুর্যোগ সেরে উঠতে পারে প্রকৃতিতেই। কিন্তু গত দশক-শতক ধরে নির্বিচারে পুকুর খাল বিল ইত্যাদি ভরাট বন্যার ঘটনা ও প্রকোপ উভয়কেই যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর রয়েছে সুপরিকল্পনাবিহীন রাস্তাঘাট ও নিকাশি ব্যবস্থার অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা। প্রকৃতির চিরাচরিত জলচক্র, লোকসৃষ্ট প্রকৃতি বিনাশ ইত্যাদির ফলস্বরূপ আমাদের দেশে বন্যা একটি বাৎসরিক দুর্বিপাকের মতো হয়ে উঠেছে - 

'আষাঢ় মাসে বান ডেকেছে বাঁধ ভেঙেছে হায়/ বানের জলে ঘরবাড়ি আজ ভেসে বুঝি যায়।' 

বন্যার কবলে পড়ে মাঠঘাট বাড়ি-দোকান সবই জলের নিচে ঠাঁই পেয়েছে। চারিদিকে তাকালে বিস্তীর্ণ জলমগ্ন ভূমি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। দিন-সপ্তাহ তো দূরের কথা, এক রাতের ফারাকে জনজীবন সম্পূর্ণভাবে ওলটপালট হয়ে যায়। রাতে যে ঘরের নিশ্চিন্ত বিছানায় মানুষ সারা দিনের ক্লান্তি নিরসনের হেতু নিদ্রাদেবীর কোলে মাথা রেখে নিশ্চিদ্র ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে, সকালে চোখ খুললেই সব শেষ। দেখা যায়, পাশের পুকুরের জলরাশি তার ঘরে ঢুকে পড়েছে। চোখের জল আর বন্যার জল মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে নির্নিমেষে। বসতবাড়ি হয়ে ওঠে সমুদ্রময়। শহর থেকে শহরান্তর, গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ভেসে যায়। বিনা গত্যন্তর, উপায়ান্তরে বানভাসি মানুষের দিন-রাত কাটে উন্মুক্ত আকাশের নিচে; অথবা সামান্য আশ্রয় খুঁজে নেয় গাছের ডালে, পাকা বাড়ির ছাদে, রেলের প্লাটফর্মের উপরে। মানুষের সহাবস্থান হয় প্রকৃতির আদিম মানুষের মতো সাপ-শেয়াল-কুকুরের সান্নিধ্যে। জলস্রোতের মতোই ভেসে চলে মানব জীবনের স্রোত। জীবন মুহূর্তেই হয়ে পড়ে নিরাপত্তাহীন। সভ্যতার আরম্ভ যেন নিমেষেই উধাও হয়ে মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই বন্য আদিমতায়, ছাদবিহীন ঠিকানায়।

প্রকৃতির নিয়মে বর্ষা নামবে, পুকুর নদী ভরিয়ে তুলবে, তা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। কিন্তু মনুষ্য-সৃষ্ট কারণগুলিই বন্যার প্রকোপকে বাড়িয়ে তোলে। সুদীর্ঘকাল যাবৎ এ রাজ্যের ও দেশের মানুষ বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় সরব। কিন্তু যে চেষ্টা পথভ্রষ্ট তা যে সাফল্য পাবে না, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ্যের ভরাট হয়ে যাওয়া নদী ও পুকুর খাল বিল জলাশয়গুলিকে খনন করে তাদের নাব্যতা বাড়ানো অবশ্য করণীয় একটি কাজ। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করা হয়েছে নদীয়া জেলার চাকদহ ব্লকের বুড়িগঙ্গা সংস্কারের মাধ্যমে। এরূপ কাজ কি আরও আবশ্যিক নয় বন্যার দাপটকে হ্রাস করবার উদ্দেশ্যে? প্রশাসনের সদিচ্ছা ও নাগরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তা অবশ্যই করা সম্ভব। সাথে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে খাল ও নালাতে সুচারু নিকাশি ব্যবস্থা যাতে বৃষ্টির জল দ্রুত নদীতে পতিত হতে পারে। বড় বড় নদীতে বাঁধ দিয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বলতে হয়, বাঁধ নির্মাণ করার আগে প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি সমূহকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। বাঁধের জল যাতে অন্য অঞ্চলকে প্লাবিত না করে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। 

বন্যার প্রভাব শুধু যে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে তাই নয়, খাদ্যাভাব, পানীয় জলের সংকট, রোগব্যাধি, হীনম্মন্যতা, শিক্ষায় ছেদ, কর্মবিরতি বা কর্মচ্যুতি মানুষকে এক সার্বিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। ঘর-বাড়ির সাথে সাথে বিনষ্ট হয় বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি অনিবার্য আপত্তি রূপে প্রকট হয়। দূষিত জল বয়ে আনে কলেরা, টাইফয়েড, ডায়েরিয়া প্রভৃতি রোগ। পানীয় জলের অভাবে মানুষের জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব হয় আরও তীব্র। মানুষ দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হতে থাকে। বন্যা-ত্রাসিত মানুষের দুর্দশা সত্যিই অনির্বচনীয়। তবুও যদি বলতেই হয় তাহলে বলা যায়-- 

'ডুবল রে ক্ষেত বসত ভিটে চারদিক জলে ভরা/ নিভলো আশার প্রদীপগুলো যত্ন করে গড়া।'


Friday, 20 September 2024

ফ্যাসিবাদ পরবর্তী বাংলাদেশ

এক গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনের চ্যালেঞ্জ

শাহেদ শুভো



বাংলাদেশের ৫ অগস্ট'এর গণ অভ্যুত্থান কি বেহাত বিপ্লব? এই আলাপ ৫ অগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের একটা অংশ প্রশ্ন করছে। এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজে কয়েকবার খোঁজার চেষ্টা করেছি। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন, তার তৈরি বাহিনীর গুম খুন, লুঠপাট দুর্নীতি রুখতে গিয়ে ছাত্র জনতা কি আরেকটা অপশাসনের পথ সুগম করল? এরকম প্রশ্ন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশ্ন করা, কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অনেক সহজ, কিন্তু এই আন্দোলনের স্পিরিটকে ধারণ করে হাসিনা পরবর্তী শাসনকে বুঝতে পারা তখনই কঠিন, যখন কিনা এই আন্দোলনের আবেগ আমার চিন্তাকে অন্ধ করে দিতে পারে।

বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ পতনের পর একটি 'ট্যাগিং' প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যেখানে সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর লক্ষ রাখা হচ্ছে যারা ফ্যাসিস্ট শাসনে সংযুক্ত ছিল। এই ব্যক্তিবর্গ এবং সংগঠনগুলোকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বিদেশি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাথে মিলিত হয়ে এমন এক আদর্শ প্রচারের জন্য, যা ওই শাসনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। এই সমালোচনা বিশেষভাবে তীব্র হয়েছিল ৫ অগস্টের রাজনৈতিক সংকটের পরে। তারা যে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আদর্শ সমর্থন করেছিল, তা অবশ্যই অবমাননাকর প্রমাণিত হয়েছে; তবে এমন লেবেলিং-এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

যদিও এই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলোকে একঘরে করে ফেলা হয়েছে, তবু বিতর্ক রয়েছে যে তাদের কেবল অভিযুক্ত করেই কি একটি স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার সক্ষমতা অর্জন সম্ভব! এখানে চ্যালেঞ্জটি হল, তাদের অতীতের ফ্যাসিবাদে জড়িত থাকার বিষয়ে সঠিকভাবে বিচার করার সঙ্গে সঙ্গে একটি সম্ভাব্য নব্য ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের বিকাশকে ঠেকানো। এমনতর গতিবিধি, যা পৃথিবীর বিভিন্ন ফ্যাসিবাদোত্তর সমাজে দেখা যায়, উদ্বেগ সৃষ্টি করে যে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদকে প্রতিহত করতে গিয়ে অন্য কোনও ধরনের কর্তৃত্ববাদ আবার মাথা না তোলে। মূল প্রশ্ন, ঘৃণা এবং একঘরে করার কুচক্রে না জড়িয়ে একটি সমাজ কি সত্যিই এগোতে পারে? ঐক্য এবং স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে?

ফ্যাসিবাদ পতনের পর পৃথিবীর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, সমাজগুলো প্রায়শই অত্যাচারী শাসনের সমর্থনকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চালায়। তবে এই প্রক্রিয়া অবশ্যই সাবধানে পরিচালিত হওয়া উচিত, যেন কোনও নতুন রূপে কর্তৃত্ববাদের পুনরুত্থান না ঘটে। এসব সমাজ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো দেখায় যে, জবাবদিহিতা এবং পুনর্মিলন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে নব্য ফ্যাসিবাদ বা অন্যান্য চরমপন্থার বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা যায়। আমরা জানি, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ফ্যাসিবাদের পতন শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের জন্য নয়, বরং যারা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের সাথে যুক্ত ছিল, সেইসব লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্যও সুদূরপ্রসারী পরিণতি নিয়ে এসেছিল। ফ্যাসিবাদী শাসনগুলো ভেঙে পড়ার সাথে সাথে যারা একসময় এই সামরিক ব্যবস্থাগুলোকে সমর্থন করেছিল, তারা পেশাগত ভাবে একঘরে হওয়া থেকে শুরু করে ফৌজদারি বিচার পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রার প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছিল। তাদের উত্তরাধিকার ফ্যাসিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে কলঙ্কিত হয়েছিল, যা তাদের কর্মজীবন, খ্যাতি এবং সামাজিক অবস্থানকে প্রভাবিত করেছে। ইউরোপে তাদের মধ্যে অনেককে ফ্যাসিবাদী শক্তির সাথে সহযোগিতার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং ইতালির মতো দেশে, যেখানে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের শত্রুকে সহায়তা করা বা এমন মতাদর্শ প্রচার করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল যা হলোকাস্ট ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো অত্যাচারের জন্য দায়ী ছিল।

ইতালি: ১৯৪৩ সালে মুসোলিনির শাসনের পতনের পর তার অনেক সমর্থককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বা কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। যারা প্রকাশ্যে ফ্যাসিবাদ সমর্থন করেছিলেন, যেমন কবি গ্যাব্রিয়েল ডি'আন্নুনজিও এবং এজরা পাউন্ড, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। পাউন্ড একজন আমেরিকান কবি, যিনি মুসোলিনিকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁকে মার্কিন সরকার গ্রেফতার করে।  

জার্মানি: যারা প্রথমে নাৎসিদের সমর্থন করেছিলেন, যেমন গটফ্রিড বেন, তাঁদের কাজ এবং খ্যাতি স্থায়ীভাবে কলঙ্কিত হয়ে যায়। নোবেল বিজয়ী ক্নুত হ্যামসুন, যিনি হিটলারের একজন শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন, যুদ্ধের পরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে মানসিকভাবে অক্ষম বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

স্পেন: ফ্রাঙ্কোর শাসন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত টিকে থাকায় অনেক বুদ্ধিজীবী যারা ফ্যাসিবাদী সরকারকে সমর্থন করেছিলেন তাঁরা ক্ষমতায় রয়ে গিয়েছিলেন। তবে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর তাঁরা স্পেনের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সময় ব্যাপক নিন্দা এবং প্রভাব হারানোর সম্মুখীন হন। 

ব্যক্তিগত ভাবে আমি নির্মোহ ভাবে বুঝতে চেষ্টা করছি, আসলে আমাদের দেশে এই যে কিছু অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে, এর কারণ কী? আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, সারা রাত আমার নির্ঘুম কেটেছে। গতকাল বাংলাদেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তোফাজ্জল নামে একজন মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষকে পেট পুরে ভাত খাইয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে! এই পাশবিকতা যখন সামাজিক মাধ্যমে দেখছি, স্রেফ নিজেকে একজন 'মেটামরফসিস' মনে হচ্ছে! কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, চারপাশে এমন এক অস্থিরতা, সবাই বলতে চায়, কিন্তু শুনতে কেউ চায় না! রাজধানীর হলগুলোতে প্রচুর জ্ঞানালাপ চলছে - সংবিধান সংস্কার না পুনর্লিখন? কীভাবে রাষ্ট্র সংস্কার করা যায়? সাংস্কৃতিক সংগঠন, চলচ্চিত্রকর্মী, নাট্যকর্মী, শিল্পকলায় বাছাই চলছে, আপনি ফ্যাসিবাদের পক্ষে না বিপক্ষে ছিলেন! ভিতরে ভিতরে এক একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতন্ত্র জাগ্রত হচ্ছে! তারাই মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক সেমিনার করছে, আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক মালিকানার দাবি করছে। ওদিকে আমার পাহাড়ে বাঙালি-আদিবাসী সংঘাত শুরু হয়েছে, পাহাড়ীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে সেনাবাহিনীর নিগ্রহের চিত্র কিছু ছড়িয়ে পড়েছে, সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে একদলের সমর্থন আছে আবার অনেকেই ভুল পদক্ষেপ বলছে! কিন্তু এটা সত্য যে ৫ অগস্ট'এর পর অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগদান করেনি। আবার এও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আন্দোলনের সময় পুলিশ বাহিনী ছাত্র জনতার উপর নির্মম আক্রমণ, শিশু-কিশোর, তরুণদের নির্মমভাবে হত্যা, স্নাইপার দিয়ে টার্গেট কিলিং, এমন কি ৫ তারিখ আশুলিয়াই'এ আন্দোলনকারী ছাত্রজনতার লাশ পুড়িয়ে ফেলার মতো নির্মম ঘটনাও ঘটিয়েছে। ৫ থেকে ৮ অগস্ট দেশে কার্যকর সরকার না থাকার সুযোগে একদল সুযোগ-সন্ধানী জনগণের সম্পত্তি লুঠপাট ও দখল করেছে। কতিপয় অংশ এটাকে রাজনৈতিক রং লাগালেও প্রশ্ন উঠেছে, রাজনীতি আর লুঠ কি এক জিনিস? আওয়ামী লীগ'এর নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের প্রচারনা ছিল, তারা ক্ষমতা হারালে নাকি প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ মারা যাবে, হিন্দু বাড়িঘর মন্দির সব পুড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু হাসিনার পতনের পর কি এমন কিছু ঘটেছে? যে দুদিন কার্যত কোনও সরকার ছিল না, সেই দুদিন যে সব ভাঙচুর, হামলা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক 'প্রথম আলো' লিখেছে, রাজনৈতিক সহিংসতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২ জন নিহত, ৫-২০ অগস্টের মধ্যে তাদের হাজারের কাছাকাছি সম্পদ আক্রান্ত; যদিও কিছু কিছু সংবাদকে এএফপি'র ফ্যাক্ট চেকার ভুল সংবাদ হিসেবে চিহ্নিত  করেছে।

এসব কিছুর পরেও আমরা ধরে নিই যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়; যদিও অনেক ঘটনার থেকে ভিতরের ঘটনা ভিন্ন এই অর্থে যে, যতখানি না ধর্মীয় পরিচয়, তার থেকে বেশি রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে আক্রান্ত হতে হয়েছে। যদিও আমি মনে করি, যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলো অবশ্যই অনভিপ্রেত, কিন্তু সেই সময় থেকে এই আন্দোলনকারী ছাত্রদের মধ্যে একটা অস্বীকারতন্ত্র চালু হল। ফলে, একটা সামাজিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন কীভাবে একটা রাজনৈতিক ও স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে পরিণতি পেল এবং এই পরিণতি যে সুদীর্ঘ এক সংগ্রামের ফসল, শুধুমাত্র এক মাসের লড়াইয়ের ফল না, সেটা এই আন্দোলনে জয়ী বুদ্ধিবৃত্তিক ছাত্ররা মনে হয় ভুলতে শুরু করেছে; মনে হচ্ছে, ছাত্ররা যেন জনতার সাথে আর রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছে না। জনতা ইনভিজিবল হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে যে মাদ্রাসার ছাত্ররা মন্দির পাহারা দিচ্ছিল তারা সেখানে আবার নামাজ পর্যন্ত পড়েছে! ইসলামী রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের বলছে, যত খুশি মূর্তি বানান, আবার তাদেরই অন্য কোনও চিন্তাধারার সংঘবদ্ধ শক্তি মাজারগুলোতে হামলা চালাচ্ছে; গরিব, পাগল, সাধারণের আস্থার জায়গা মাজার আক্রান্ত হচ্ছে, অনেক মাজারের স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই অবস্থায় রাষ্ট্র তার অবস্থান পরিষ্কার করছে না। কী অদ্ভুত দ্বৈত চরিত্র।

ড. ইউনুস এবং তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। তাঁর উপদেষ্টা চয়নের প্রতিও মানুষের সম্মতি আছে। এও বাস্তব, মাত্র দেড় মাসে গত ১৬ বছরের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির উন্নতি সাধন সম্ভব নয়। তবে মনে রাখতে হবে, এই সরকার কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শিক সরকার নয়, এরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বুর্জোয়া এলিট প্রতিনিধিত্বকারীদের সাথে ছাত্র প্রতিনিধিদের মিলিত সরকার। তাই, ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনে দৃশ্যমান বি-রাজনৈতিক পরিচয়ে যুক্ত হলেও তারা বেশ কয়েকটা ক্ষুদ্র বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘের প্রতিনিধিত্বকারী; সাথে দৃশ্যমান না হলেও আমলাতন্ত্র এবং সেনাবাহিনীরও একটা যোগ আছে, যেটা আসলে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ছাত্র প্রতিনিধিদের রাজনীতি কী? 

ইতিমধ্যে একজন ছাত্র প্রতিনিধি-উপদেষ্টাকে মিডিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করেছে 'মাস্টারমাইন্ড' শব্দে, যদিও এই শব্দ আপত্তিকর, কিন্তু বাংলাদেশের বড় অংশ মানুষ জানে না এদের রাজনীতি কী! এদের বি-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কি আরেকটা রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আছে? জনমনে প্রশ্ন, ১/১১'এর 'মাইনাস টু ফর্মুলা' যেটা ব্যর্থ হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া এখনও সক্রিয় কিনা! বলাই বাহুল্য, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার দলের এবং বাঙালি জাতিবাদী চিন্তাশক্তির পরাজয় ঘটিয়েছে। বাঙালি জাতিবাদ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে গুম খুন, লুঠপাটের সম্মতি স্থাপন মানুষ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, আবার হাসিনার পতনের পর বিএনপি'র রাজনীতিকে খুব সুচতুর ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। অথচ এই দলটি গণমুখি হয়ে উঠেছে গত ১৫ বছরে। একটা মতাদর্শ-বিরোধী রাজনৈতিক দল কীভাবে আস্তে আস্তে সংগ্রামের মাধ্যমে একটা গণমুখি দলের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে, এটা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। দেখা যাচ্ছে, তাদের দলের ৩১ দফা যেটাকে  তারা 'রেইনবো নেশন' বলছে, তাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে বেশ কিছু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, আবার তারা ইসলামি দলগুলোর সাথে দূরত্বও রাখছে! কিন্তু কেমন যেন অনেকেই বলছে, অবাধ নির্বাচন হলে বিএনপি জিতে যাবে, এই ভয়ে হাসিনা কোনওদিন সুষ্ঠু ভোট হতে দেয়নি, আর বিএনপি'র সাথে জামাতের নাম জুড়ে বিএনপিকে ক্রুসিফাই করেছে। কিন্তু কেউ কেউ বলছে, এই ছাত্র সমন্বয়কেরাও বিএনপি'র রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ মনে করছে! 

এদিকে বামপন্থী প্রগতিবাদী সংস্কৃতিও প্রশ্নবিদ্ধ। বাঙালি সংস্কৃতির আড়ালে একটা পেটি বুর্জোয়া রাজনীতির পরিণতি হয়তো বাংলাদেশের বামপন্থার ইতিহাসে লেখা থাকবে। একজন ব্যক্তি মানুষের বক্তব্য ও জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে তাদের যে উদ্বেগ এবং আচরণ, তার আড়ালে রয়েছে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের অপচেষ্টা। আবার উর্দু ভাষীদের এক আয়োজনে জিন্নাহ'কে নিয়ে যে সাম্প্রতিক ঘোষণাটি শোনা গেল, সেটাকে সরকারের সিদ্ধান্ত বলে চালাবার চেষ্টা চলেছে। 

সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্র কি এক অভিজাততন্ত্র থেকে আরেক অভিজাততন্ত্রের হাতে চলে যাচ্ছে? তবে নানা ধরনের কথাবার্তা, তর্কবিতর্ক ও মানুষের লড়াইও চলমান। ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি'র অনুসারী কবি এজরা পাউন্ড লিখেছিলেন, 'We are chained by our own stupidity.'।


Wednesday, 18 September 2024

'বন্ধুসুলভ আগুন'

'বাড়িতে মা-বোন নেই?'

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



জীবনানন্দ লিখেছিলেন,

“মৃত্যুর আগে কি এ পৃথিবী থেকে সমস্ত সুন্দর মুছে যাবে?

যারা শান্তির নিকেতনে বাস করতে জানত,

তারা তো অস্তিত্বের নির্যাস হারাল যুদ্ধের ধোঁয়ায়।”

গত অগস্টের গোড়ার দিকেই কলকাতার এক নামী সরকারি চিকিৎসালয়ে কর্মরত অবস্থায় ভোর রাতে চিকিৎসকের ধর্ষণ-মৃত্যু বা মৃত্যু-ধর্ষণ এবং সেই প্রেক্ষিতে আন্দোলন, ঘটনার মাস খানেক পরেও প্রায় সম-লয়ে দৈনন্দিনকে আন্দোলিত করে চলেছে। বিচার অবিচারের শঙ্কা, ভিন্ন স্তরীয় ও ভিন্ন শ্রেণিয় মানুষের দাবিদাওয়া, শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের দফা দফা আবদারে আরেক দফার মাসখানেক ব্যাপী সফল কর্মবিরতি - সবের অন্বয়েই কলিকাতা চলিতেছে নড়িতে নড়িতে। হিঁদু বাঙালির বচ্ছরকার উৎসব দুর্গাপুজোও প্রায় দুয়ারে সমাগত, বিপ্লবে উৎসব যাপন নাকি বিচার পরিণতি না পাওয়া ইস্তক যাপন পরিত্যাগ, তা নিয়েও স্বআরোপিত উচ্চ মননের বাঙালির মন দোদুল্যমান। পুজো এবং ভোট ব্যতিরেক বাঙালির এ হেন বিচলতা দেখে হঠাৎ করে মনে হতেই পারে তার অকল্পনীয় ব্যথা পাওয়া মৃতদেহের কল্পিত চিত্রখানি এখানে 'কিউ'এর ভূমিকায় আসীন এবং ব্রেক শটটিও দুর্দান্ত সফল! অথচ, এত্ত সব কিছুর মধ্যে যে বিষয়টা একেবারে বিলীন হয়ে গেল তা হল নারী নির্যাতন, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে নারীর অবস্থান এবং সেই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের ভূমিকা।

সেই অগস্টেরই অন্তিমে হরিয়ানার ফারিদাবাদে উনিশ/কুড়ির এক তরুণের গাড়ি ধাওয়া করে তাকে হত্যা করা হয় গরু পাচারকারী সন্দেহে। বর্তমান ভারতে, সুনির্দিষ্ট করে বললে গো-বলয়ে, তা চমকপ্রদ কোনও ঘটনাই নয়। তবু নজর কাড়ে যখন জানা যায়, হত্যাকারী কিশোরের বাবার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চায় মুসলমান ভেবে এক ব্রাহ্মণ সন্তানকে হত্যার জন্য! শুধুমাত্র সন্দেহের বসে স্বঘোষিত রক্ষক এক নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু জাতিকে হত্যার অধিকার নিজ স্কন্ধে তুলে নেয় প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে, কিংবা প্রশাসনের প্রশ্রয়েই। 

শেষ ঘটনাটি দেশের থেকে এট্টু দূরে। প্যারিস অলিম্পিক্সে মহিলাদের ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন উগান্ডার অ্যাথলিট রেবেকা। থাকতেন অবশ্য কেনিয়ার এনডেবেসে। সেখানেই জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদে তাঁর প্রেমিক আচমকাই তাঁর গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। হাসপাতালে দিন পাঁচেক কাটিয়ে অলিম্পিক্স শেষের এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যান তিনি। সেই মৃত্যুর আরও পাঁচদিন পরে মারা যান প্রেমিকটিও। যে অনলে পোড়াতে চেয়েছিলেন শুধুই তাঁর প্রেমিকাকে, সে দহনেই তিনি নিজেও পৃথিবীর মায়া কাটালেন।

তিনটি ঘটনায় কোনও সাদৃশ্য চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে না অপ্রচল কিছু। তবু ঘটনাগুলি ব্যতিক্রমী  তার পরবর্তী উপবর্তে - দৈনিক গড়ে ৮৬টি নথিভুক্ত ধর্ষণের দেশে অপরিচিতার তরে এই জন আন্দোলন, পয়স্বিনী রক্ষকই জাতির রক্ষকের দেশে গুলিবিদ্ধ সন্তানের পিতার কাছে ভক্ষকের দোষ মার্জনার ভিক্ষা, আর সব শেষে এক গরিব অনাম্নী দেশের থেকে আসা ৪৪তম স্থানে ম্যারাথনের দৌড় শেষ করা প্রতিযোগিনীর উদ্দেশ্যে প্যারিসের মেয়রের শহরের একটি ক্রীড়াঙ্গন নামাঙ্কিত করার সিদ্ধান্ত।  

যুদ্ধ টুদ্ধ

যুদ্ধ কী তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে গোদা ভাষায় বললে, নিজ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে দুই বা ততোধিক দলের মধ্যে ঘটা সহিংস কার্যকলাপই আসলে যুদ্ধ। আবার জর্জ অরওয়েলের ভাষায় বললে, 'War is peace. Freedom is slavery. Ignorance is strength.’। 

এ তো গেল রণকৌশলে সজ্জিত এবং দীক্ষিত মানুষের যুদ্ধের সংজ্ঞা। সুপ্রাচীন যুগ থেকেই এই সকল  যুদ্ধের সেনারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকের বেতনভুক কর্মচারী। তবে আমাদের আলোচনা এ ক্ষেত্রের বাইরে পড়ে থাকা, সেই সব নিজ ভূমে লিঙ্গ-চামড়া-ধর্ম-বর্ণ-অর্থের অথবা আরও অন্য কিছুর ভিত্তিতে হয়ে ওঠা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় না-মানুষদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ নিয়ে। যে লড়াই তাঁরা লড়তে চাননি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের এ লড়াইয়ে তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও তাঁরা অজ্ঞাত।    

সামরিক পরিভাষায় 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' বা 'ফ্র্যাত্রীসাইড' খুব অপরিচিত শব্দ নয়। শব্দটির উৎস মধ্য ইংরেজি এবং মধ্যযুগীয় যুদ্ধ থেকে। খুব সম্ভবত প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯১৮ সালে, আমেরিকান সেনাবাহিনীতে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে শব্দবন্ধটি জনপ্রিয়তা পায় এবং পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে এর আরও প্রসার ঘটে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ক্কচিৎ কদাচিৎ এমন ঘটনা ঘটে যেখানে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনাক্রমে সপক্ষের ওপরই আক্রমণ ঘটে যায়। যুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ অমেয়। সে গ্রিক-পারস্য যুদ্ধের সময় পারস্যের সম্রাট কিরাসের সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে ভুলবশত নিজেদের সৈন্যদের ওপর আক্রমণ হোক কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নরম্যান্ডি আক্রমণের সময় মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় তাদের নিজস্ব সেনাদের উপর বোমা ফেলা। এমনকি  অধুনাকালে উন্নত প্রযুক্তি সত্ত্বেও এ ধরনের যুদ্ধকালীন দুর্ঘটনার সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তি যে ঘটেনি তার উদাহরণ পাই হালের ইরাক যুদ্ধে ২০০৩ সালে, ব্রিটিশ সৈন্যদের একটি দল ভুলবশত আমেরিকান সৈন্যদের উপর গুলি চালনায়।   

ফেরা যাক ব্যুৎপত্তি স্থলে। সেই যে হরিয়ানার মাথায় গুলি লাগা তরুণ, তাকে মুসলমান অতএব গো-পাচারকারী ভেবে  প্রায় ধাওয়া করে খুন করে স্বনিয়োজিত গোরক্ষকেরা যে ধর্ম রক্ষার্থে, জাতে ব্রাহ্মণ আরিয়ান মিশ্র ছিলেন সে ধর্মেরই অনুগামী। সেই তরুণীর প্রেমিকও নিশ্চয়ই ভাবেননি নিজে আহত হওয়ার কথা, ভাবলে তিনি আত্মহননের অন্য পন্থা বেছে নিতেন। দু' ক্ষেত্রেই, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তি পরের ক্ষতি সাধনে নিজ কিংবা নিজ গোষ্ঠীর 'পরে আঘাত হানে। শত্রু-মিত্র পক্ষ এ ক্ষেত্রে সুচিহ্নিত এবং স্পষ্ট। ব্যতিক্রমী এ ক্ষেত্রে ঘটনার সামাজিক বিচারকের ভূমিকা। হত্যকের কাছে মৃতের বাবা জানতে চেয়েছিলেন, মুসলমান হলেও মানুষকে হত্যার অধিকার তাদের কে দিয়েছিল? প্যারিসের মেয়রও চেয়েছিলেন এক সুষম নারী-পুরুষের অবস্থান।

কলকাতার আন্দোলনটি এত সরলরৈখিক নয়। এক নির্দিষ্ট শ্রেণির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আন্দোলনের অবয়ব ধারণ করেছে, সদ্য পুনঃ স্বাধীনতা প্রাপ্ত প্রতিবেশী দেশের আন্দোলনটি উৎসেচকের ভূমিকায়। মেধা এবং বিত্ত দুইয়ের সঙ্গতে যে শ্রেণি দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে হীনজ্ঞান করে, তারাও এবার আন্দোলনে এক্কেবারে সামনের সারিতে, বিচারের দাবিতে। যে কোনও সুস্থ গণতন্ত্রে আন্দোলন অপরিহার্য। কিন্তু এ আন্দোলনের গতিবিধি যেন সমাজে এক স্তর ওপরে ওঠার উঁচু মই। আন্দোলনে হাজিরা না দিলে জাত খোয়ানোর শঙ্কা প্রবল। তাই দিনের পর দিন কাটলেও রাজ্যের সরকারি চিকিৎসক শিশুদের (শিশুদের চিকিৎসক নয় কিন্তু) অচলাবস্থা কাটে না। তাঁরা পথে আন্দোলনরত। গড়পড়তা সমাজ ভাবে, হুঁ হুঁ, বাওয়া কী এক বিষম বস্তু চলিতেছে নিশ্চয়ই, তাই স্যালুট ঠোকাই আশু কর্তব্য। প্রশ্ন করার স্পর্ধাই জোটে না কীভাবে তাদের আন্দোলনে ভুরি ভুরি খাবার আসতে পারে এই অভাগা দেশে।  রোগীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, মৃতদেহ আটকে দরকষাকষি, ভুল চিকিৎসা, নির্দিষ্ট স্থানেই পরীক্ষার নির্দেশ, অধস্তনদের শ্রমশোষণ, এসব অভিযোগ আন্দোলনে পরিণতি পায় না কখনই। 

আন্দোলনকারীদের মূল দাবি দাওয়ায় অনেক কিছু থাকলেও জোরালো হয় না যৌন শিক্ষা তথা মানুষ গঠনের শিক্ষার দাবি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই ছোটখাটো কিংবা বড়সড় যৌন হেনস্থাকারীরা শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী, কবি-সাহিত্যিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে উপস্থিত। সম্ভবত তাঁরা নিজ ক্ষেত্রে গুণী, অপরাধে সুচারু, তাই আন্দোলনে তাঁদের উপস্থিতি খবর হিসেবে গুরুত্ব বাড়ায়। এছাড়া যৌন হয়রানিকে এক স্বাভাবিক ক্রিয়ার পর্যায়ভুক্ত করাই যেন সমাজের কাজ, তাকে দূরীকরণের আশা বা প্রচেষ্টা কোনওটার প্রয়োজন অনুভব করার দায়টুকুও পরিলক্ষিত হয় না। 

রাস্তাঘাটে একটা কথা প্রায়ই কানে আসে, 'বাড়িতে মা বোন নেই?' অর্থাৎ, মা-বোনকে রক্ষার কাজ  পুরুষের, কিংবা মা-বোন জ্ঞানে কিংবা স্মরণে, ভক্ষণ না করে সংযমের দায় পুরুষের। খেয়াল করলে দেখবেন, এ তালিকায় কখনও বৌ, প্রেমিকা, বন্ধু, শিক্ষিকার উল্লেখ থাকে না। তাত্ত্বিকেরা বলেন, প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর সম্মান এবং পবিত্রতাকে পরিবার, বিশেষত পুরুষদের সম্মানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। নারীর সতীত্ব বা পবিত্রতা (বিশেষ করে মা, বোন ও কন্যা) পরিবারে পুরুষ সদস্যদের ক্ষমতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। তাই নারীদের নিয়ে কটূক্তি বা গালি ব্যবহারও পুরুষদের সম্মান আঘাত করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। নারীর ওপর আক্রমণ মানে পুরুষদের সামর্থ্য ও অধিকারকে প্রশ্ন করা। এখানে আক্রমণ মূলত নারীর ওপর নয়, বরং নারীদের নিয়ে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ বা অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এটি ব্যবহৃত হয়, যা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে উদ্ভূত।

এই ভাবনায়, নারীদের ভূমিকা পরিবার বা পুরুষদের সম্মান, প্রজনন বা যৌন পবিত্রতার রূপক হিসেবে দেখা হয়। এ জন্যই আমাদের কথ্য ভাষায় নারীদের অবমাননাকর ভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে তাদের মানুষ হিসেবে নয়, বরং সম্পত্তি বা সম্মান রক্ষার মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। অথচ, 'বউ নেই?', এই ধরনের শিক্ষামূলক বাণী শোনা যায় না, বদলে বৌ'কে কিছু করে দেওয়ার হুমকিই প্রচলিত। ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়, সমাজে স্ত্রীরা স্বামীর পরিবারের একটি সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত আজও। তারা ঠিক সে অর্থে যোনিতে আবদ্ধ, পবিত্রতার প্রতীক নয়। তদুপরি, আমাদের দেশে নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ সম্পূর্ণ ভাবে বৈধ। সমাজের দুর্বল বা নিম্নস্থ হিসাবে বিবেচিতকে আক্রমণ করার ভাষার কাঠামোই এ রূপে  নির্মিত, আর তাই পুরুষদের সম্মানহানি করার জন্য নারীদের ব্যবহার করার প্রয়াস, যা তাদের পরিচয় পুরুষদের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। 

এবং সমস্যার আকরটিও এখানেই। মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার এই ঝাড়াই বাছাইয়ের পর্বে কখনও অসচেতনে আবার কখনও স্বেচ্ছাতেই তা আমাদের নিকটজনের ক্ষেত্রেও সেই 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' হয়ে দাঁড়ায়। মা বোন এবং মা বোন সম কেউই শুধু এই 'আমি'টার অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবে - এই উদ্ভট এবং দ্বৈত মানসিকতা পরিণাম পায় আমার মা-বোন যাদের মা-বোন নয় তাদের দ্বারা আমার মা-বোনের ওপর আক্রমণে। এবং এ অভ্যাসের চরম রূপই লিঙ্গ-ভেদে পারিবারিক ধর্ষণ বা নির্যাতন। যেহেতু ভারতের সিংহভাগ ধর্ষণই  ঘরের মধ্যে এবং চেনা পরিসরে হয়, সে ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা নিজেদের অজান্তেই সমাজে 'ফ্রেন্ডলি ফায়ার' চক্র সৃষ্টি করি, যেখানে নিজেরাই অপরাধী হয়ে উঠি। 

যৌন শিক্ষা ও কিছু কথা

ভারতের মতো সমাজে এই আচরণের মূলে রয়েছে পিতৃতন্ত্র এবং যৌন শিক্ষা, লিঙ্গ সচেতনতা ও  সম্পর্কের নীতি, লিঙ্গ নির্যাতন সম্পর্কিত আইনি পাঠ - এসব  সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব। যে কারণে কিশোর-কিশোরীরা সম্মতি এবং সম্পর্কের মর্যাদা নিয়ে বিভ্রান্ত, সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্মান ও সীমারেখা নির্ধারণের ধারণাগুলি অস্পষ্ট। যদিও কিছু রাজ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যৌন শিক্ষা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে এখনও তা সার্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক নয়। বহির্বিশ্বে যে ভাবে বিষয়টি দেখা হয় তার কিছু উদাহরণ দিলে হয়তো বোঝা সম্ভব। 

প্রথমেই আসা যাক নেদারল্যান্ডস'এর কথায়। দেশটি যৌন শিক্ষা এবং সম্পর্কের শিক্ষায় বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। এ দেশের ‘Comprehensive Sex Education’ নামে পরিচিত এই প্রোগ্রামে শিশুদের মধ্যে লিঙ্গসমতা, সম্মান এবং নিজেদের ও অন্যদের সীমাবদ্ধতা সম্মান করার শিক্ষা দেওয়া হয়। সুইডেনে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্কিত শিক্ষার ধারণা চালু; ‘Sex och samlevnad’ নামের এই পাঠ্যক্রম বাচ্চাদের যৌন স্বাস্থ্য, সম্মতি এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন করতে উৎসাহিত করে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পর্ক এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা একটি বড় অংশ। এখানে শিক্ষার্থীরা কিশোর বয়স থেকেই সম্মতি, যৌন সম্পর্কের সীমা এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কে শেখে। ইংল্যান্ডে ২০২০ সাল থেকে ‘Relationships and Sex Education (RSE)’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সম্মতি, লিঙ্গ সমতা, যৌন হয়রানি এবং সম্পর্কের উন্নয়ন সম্পর্কে শেখানো হয়। 

হয়তো কোনও পন্থাই পূর্ণাঙ্গরূপে সফল নয়, কিন্তু কার্যকর নিশ্চিতভাবেই। পরিসংখ্যান যার প্রমাণ। লিঙ্গ অধ্যয়ন এখন দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যদিও, কিন্তু তা সম্ভবত তাত্ত্বিক চর্চার পরিসর ছেড়ে বেরতে পারেনি। অথচ, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই লিঙ্গসমতার শিক্ষা ও তার সর্বাত্মক ব্যবহার ভীষণ জরুরি। বোঝা জরুরি, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নারীও পিতৃতন্ত্রেরই বাহক, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রান্তিক লিঙ্গ'র মানুষের পাশাপাশি পুরুষও নির্যাতিত হয় এবং যৌন নির্যাতনই এমন এক বিরল অপরাধ যে অপরাধে প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই নিপীড়কের পরিবর্তে নির্যাতিতাকে লজ্জিত তকমা দিয়ে তার পরিচয় গোপন রাখার রাষ্ট্রীয় নিদান দেওয়া হয়।

জার্মান দার্শনিক  Friedrich Nietzsche (Source: Beyond Good and Evil) বলেছিলেন, 'He who fights with monsters should be careful lest he thereby become a monster. And if you gaze long enough into an abyss, the abyss will gaze back into you.'। তাই 'বন্ধুসুলভ আগুন' সর্বাত্মক ভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে একটু সাবধান হই; নচেৎ অচিরেই সেই আগুনে পুড়তে হবে আমাদেরকেই।  


Tuesday, 17 September 2024

অনেক রাত তো দখলেও আছে

প্রতিটি রাত দখল করে আছে কত মেয়ে

মালবিকা মিত্র



দিদির বাড়ি পুজোর জামা কাপড় দিতে গিয়েছিলাম। বাড়ি এন্টালি মার্কেটের উল্টো দিকে ডাক্তার লেন। ভাগনির আবদার নাইট শো সিনেমা দেখব। সাউথ সিটিতে বিদ্যা বালানের 'কহানি'। লেট নাইটে ভাগ্নিকে নিয়ে, আবার মধ্য কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতা, একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম। করে লাভ হল না, কারণ ভাগনি ততক্ষণে অনলাইনে দু' খানা টিকিট বুক করে ফেলল, রাত্রি বারোটায় শো। অগত্যা ভয় আশঙ্কা সম্বল করে, রাতের খাওয়া সেরে, ক্যাব বুক করে চললাম আমরা দুজন। পৌঁছে আমি অবাক, এ কোথায় এলাম! একি মধ্যরাত না সবে সন্ধ্যা! নাইট শো হাউজফুল। মহিলার সংখ্যা প্রচুর। ভাগনি বলল, অভিজাত মহিলারা এই শো'টা পছন্দ করে। একটু নিরিবিলি পথঘাট থাকে। সেলিব্রেটিরা খুব আসে এই সময়। শো শেষ করেও কারও ব্যস্ততা নেই। আমি আবারও মধ্যরাতেই ক্যাব বুক করে এন্টালি ফিরলাম।

মফস্বল শহর চন্দননগর। আমি এখানে শিক্ষকতা করি। রাস্তাঘাটে পথ চলতি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে দেখা হয়ে যায়। রাতে দেখেছি, সাতটা-সাড়ে সাতটায় ছাত্রীর দল সাইকেল নিয়ে চলেছে, পিঠে ব্যাগ। প্রশ্ন করেছি, এখন বাড়ির উল্টো দিকে চলেছ? ফিরবে কখন? বলেছে পড়তে যাচ্ছি, ফিরতে ফিরতে সাড়ে নটা-দশটা। মজার কথা হল, সাড়ে নটা-দশটার সময়ও বহু ক্ষেত্রে এদের বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা দেখিনি। কোথায় যাচ্ছ? এই পড়া শেষ করলাম, এবার একটু স্ট্যান্ডে ফুচকা খেয়ে, আড্ডা মেরে, তারপর বাড়ি ফিরব। একটু অবাক হয়েছি, দশটা বেজে গেছে অথচ ব্যস্ততা নেই বাড়ি ফেরার।

আমার বাড়ির বলা যায় প্রায় লাগোয়া একটা এটিএম বুথ আছে। ভৌগোলিক অবস্থানটা হল ভদ্রেশ্বর পৌর এলাকা, আর বিঘাটি পঞ্চায়েত এলাকা, তার ঠিক সীমান্ত বরাবর। একদিন রাত যখন সাড়ে বারোটা, পাড়ার একটি ছেলে ডাকতে এল, একবার একটু এটিএম'এর কাছে আসুন। বিষয় হল, একটি বছর ২৮ বয়সী তরুণী, সেক্টর ফাইভে চাকরি করে। রাত বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে অফিসের গাড়ি বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাবে। তরুণীটি ড্রাইভারকে বলে এটিএম'এ আমার কাজ আছে, আমার বাড়ি এখানেই। ড্রাইভার তাকে ড্রপ করে দেয়। তরুণী এটিএম থেকে টাকা তোলে। তারপর এটিএম যেন এসি কেবিন, তায় রাত্রে শুনশান। ব্যাগ খুলে বোতল বের করে বিদেশি মদ পান করতে থাকে। ওদিকে দিল্লি রোড থেকে পুলিশ পেট্রলিং ভ্যান  আসছিল। তারা একা তরুণীকে দেখে ভ্যান থামায়। মেয়েটি আকন্ঠ নেশায় বেসামাল। পুলিশ খুবই ফ্যাসাদে পড়েছে। অগত্যা তারা আশপাশের দু-একজন পুরুষ এবং মহিলাকে হাজির করে, কী করা যায় আলোচনা করে। মাতালের একটাই কথা, হোয়াট ইজ ইওর প্রবলেম... আই অ্যাম নট এ মাইনর... ইয়েস অ্যান অ্যাডাল্ট লেডি... সো হোয়াট? এই সময় বুদ্ধি করে একজন এক বোতল জল এনে মাথায়, চোখে মুখে ঢেলে দেয়। একটু নেশা কাটে। তারপর তার ব্যাগ থেকে বাড়ির ঠিকানা উদ্ধার করে, ফোন করে সেখানেই পৌঁছে দেয়। পুলিশ সাক্ষীদের সই সাবুদ করিয়ে নেয়। ভাগ্যিস মেয়েটি নেশার ঘোরে একবারও বলেনি 'সিবিআই বুলাও'।

'য়োগা' শিখতে যায় পাড়ার পাঁচটি বউ এক গাড়িতে। এদের 'য়োগার' বাইরেও একটা মাখোমাখো বন্ধুত্ব। মাঝে মাঝেই এরা হাইওয়ের পাশে ধাবায় গাড়ি নিয়ে খেতে যায়। আর মহালয়ার রাতে, দুর্গাপুজোয় বা কালীপুজোর রাতে, স্বাধীনতা দিবস, ক্রিসমাস বা নিউইয়ার্স ডে'তে এদের রাতের দস্যিপনা থাকেই। খাবে দাবে ঘুরবে, আনন্দ উল্লাসে ভাসবে। এবারেও প্রশ্ন করেছিলাম, কিরে তোরা এবার স্বাধীনতা দিবসে কী করলি? কোন রেস্তোরাঁয় গেলি? বলল, এবার হল না গো। একদিন পরে করেছি। ওইদিন তো রাত দখল ছিল। আমরা পাঁচজনেই গাড়ি নিয়ে জগদ্ধাত্রী মন্দিরে পার্কিং করে পথে বেরিয়েছিলাম। হাজার হাজার মানুষ, ঠিক যেন জগদ্ধাত্রী পুজোর রাত। ভাবতে পারবে না। শুনলাম, চন্দননগর লক্ষ্মীগঞ্জে আরও বড় ভিড় ও অনুষ্ঠান হচ্ছে, গান কবিতা আবৃত্তি। জগদ্ধাত্রী মন্দিরের অনুষ্ঠানটা ম্যাড়মেড়ে। তাই গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে চন্দননগর গেলাম। দারুণ জমেছিল। খুব আনন্দ করেছি। কত ছবি পোস্ট করেছি। তুমি তো আবার ফেসবুক করো না। পরদিন রাতে এক্সপ্রেস ধাবায় গিয়েছিলাম। 

অন্য গল্পে যাই

সবই একঘেয়ে গল্প বরং একটু মুখ পাল্টাই। অল্পবয়সী, স্বামী ছাড়া (বিধবা নয়) মুনিয়া। ভোর চারটেয় উঠে পাইকারি বাজার থেকে কিছু সবজি কেনে। তারপর তিন বাড়ির ঠিকে কাজ করে, দুপুরে ঘরের কাজ সেরে ২:৪৭'এর লোকাল ট্রেন ধরে শেওড়াফুলি হাটে গিয়ে আরও কিছু সবজি কেনে। আরপিএফ'কে পয়সা দিয়ে, রেলের টিকিট চেকার'কে পয়সা দিয়ে, স্টেশনে এসে মালপত্র সাজায়। অফিস ফেরতা বাবু-বিবিরা স্টেশন প্লাটফর্ম থেকেই সবজি বাজার করে নিয়ে যাবে। তাই সন্ধ্যে থেকেই শুরু হয়ে যায় হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি। একটু বেশি বিক্রির আশায় রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত বসে থাকে। তারপর সব মালপত্র গুছিয়ে, একে একে বস্তা ঝুড়ি নিজের ঝুপড়িতে টেনে নিয়ে যায়। শুনশান রাস্তা। প্রায় রাত বারোটায় ঘরে ঢুকে, কিছু মুখে গুঁজে, জল খেয়ে শুয়ে পড়ে। প্রবল ক্লান্তিতে, অতি শীঘ্রই ভাসতে ভাসতে ঘুমপাড়ানি মাসি পিসির কোলে হারিয়ে যায়, কোনও ট্র্যাঙ্কুলাইজার ছাড়াই। মুনিয়ার ঘরে রাত দখল করে শীত আর শিশিরের জল। 

মুনিয়ার বোন সুলতানা, আমার বাড়িতে কাজ করে। আমার প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজন সকলেরই বেশ অস্বস্তি হয়। ওর নামটা শুনলেই বলে ... তাই নাকি, দেখলে তো বোঝা যায় না ...। ও আমার ঠাকুরের ঘর থেকে রান্নাঘর, বাগান থেকে বাথরুম, সর্বত্র খেয়াল রাখে। এক কথায় মেইনটেন্যান্স বিভাগ। কিন্তু লোকজনের অসুবিধার কারণটা বুঝতে পারি। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী পোশাক আর নামে চেনেন । অগত্যা নতুন করে সমস্যা যাতে না বাড়ে তার জন্য আমি ওকে সুলতা বলে ডাকি। কোনও অসুবিধা হয় না। ও আমার বাড়ি ছাড়া আরও দু' বাড়ির ঠিকে কাজ করে। ওর ভাসুর অসুস্থ হয়ে ভর্তি হল কলকাতা মেডিকেল কলেজে। সেখানে ডাক্তারের সাথে কথা বলা, ওষুধপত্র আনা, এসব কাজ ও করতে পারে। ওকে বললাম, তুই কদিন ছুটি নে। ও বলল, বাকি সব বাড়িতে ছুটি নিলে আমার কাজটা চলে যাবে। প্রতিদিন রাত দশটা সাড়ে দশটার হাওড়াগামী লোকাল ট্রেন ধরে পৌঁছত মেডিকেল কলেজে। সারারাত থেকে ভোরবেলায় হাওড়া থেকে ফিরে আসত। এসে কাজের বাড়ি কাজ সারত। তারপর ঘরের টুকিটাকি কাজ সেরে রান্না করে মেয়েদের খাইয়ে, সংসারটাকে সামলে দিয়ে, আবার রাতের গাড়িতে কলকাতা মেডিকেল কলেজ। কোনও কোনও দিন নিজের ছোট মেয়ে তার সঙ্গী হত, যেদিন ওর স্কুল ছুটি থাকত। সারারাত মা আর মেয়ে মেডিকেল কলেজের ভেতর ঘুরে বেড়াত, মেয়ে মাকে চিনিয়ে দিত নার্সদের হোস্টেল কোনটা, গাইনোকোলজি কোনটা, আইসিইউ ব্লাড ব্যাংক কোনদিকে, দুজনের দখলে একটা হাসপাতাল। কিন্তু একদিন ভাসুরের অবস্থা এখন তখন। ফিরতে পারল না। দু' বাড়ির কাজই চলে গেল। তখন ওকে হাসপাতালে থেকে যেতে বললাম, আমার বাড়িতে ছুটি দিলাম। ও বলত, রাতে থাকতে কোনও অসুবিধা হয়নি। বহু মানুষ রাত জাগে, এখন পেশেন্ট পার্টির জন্য আলাদা বিল্ডিং হয়েছে। সেখানে বাথরুম আছে ভালো। সকালে গাড়িতে করে খাবার আসে, বিনা পয়সায় টিফিনও খাওয়া যায়। আবার দুপুরে গাড়ি এসে ডিম ভাত দিয়ে যায়। রাতেও খাবার পাই বিনা পয়সায়। হাসপাতালে যাতায়াত, খাওয়াদাওয়ার খরচটা সম্পূর্ণ বেঁচে যায়। এও একরকম রাত কাটানো, রাত্রি দখল। 

ভদ্রেশ্বরে সকাল ৫:৪২ বর্ধমান লোকাল, আর ৬:০২'এ কাটোয়া লোকাল ঢোকে। ওই সাত সকালে দুটো ট্রেন থেকে মহিলা সহ সহস্রাধিক যাত্রী নামে। চুঁচুড়া মানকুন্ডু ভদ্রেশ্বর বৈদ্যবাটিতে এরা সবাই জমিতে জনমজুর হিসেবে কাজ করতে আসে। এরা রাত থাকতে উঠে পড়ে, ঘরের টুকিটাকি কাজ সেরে তিনটে সাড়ে তিনটের গাড়ি ধরে। তারপর এসে পৌঁছয় মফস্বল শহরে। আবার কাজকর্ম সেরে দুপুর দুটো সতেরো নাগাদ বর্ধমান লোকাল ও কাটোয়া লোকাল ধরে ফিরে যায়। নিজের বাসস্থানে কিছু সামান্য জমি বা ভাগের জমি থাকলেও, ওতে পেট চলে না। তাই বাকিটা মজুরি হিসেবে কাজ করে পুষিয়ে নেয়। চুঁচুড়া চন্দননগর ভদ্রেশ্বর এই সমস্ত স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে এখনও বেশ কিছু চাষের জমি আছে। যাদের জমিতে কাজ জোটে না, তারা এ বাড়ি ও বাড়ি জঙ্গল পরিষ্কার করে, নারকেল পাতা ছাড়িয়ে বা কোনও বাড়িতে সাফাইয়ের কাজ করে পুষিয়ে নিতে চায়। অতঃপর কিছু শুকনো কাঠ, গাছের ডাল, শুকনো পাতা এসব কুড়িয়ে জ্বালানি হিসেবে নিয়ে ফিরে যায় বাড়িতে। এদের রাতটা ভারী বিচিত্র, এরা সন্ধ্যে আটটা সাড়ে আটটায় ঘুমিয়ে পড়ে। দশটায় কমই জেগে থাকে। কারণ দুটোয় উঠতে হবে, কাজ সেরে ট্রেন ধরবে। এদের জীবনচর্চায় পেটের চিন্তা ও জীবিকা রাতটাকে দখল করে নেয়। 

আবার ময়নার রাত কাটে আরও রোমাঞ্চকর। সকালে বা সন্ধ্যের দিকে মাঝেমধ্যে সাদা পোশাকে পুলিশ আসে আবগারির হানা দিতে। ময়না দেশি মদ বিক্রি করে, লাইসেন্স ছাড়া। পাড়ার ছোট ছোট শিশুরাও চিনে গেছে আবগারিওয়ালাদের। বাচ্চারা সমস্বরে 'ময়না ভাগ, ভাগ ময়না ভাগ' বলে চিৎকার করে, ময়না উড়ে যায়। সকাল সন্ধ্যার যে গল্প, কিন্তু ময়নার রাত গভীর হলে চিত্রটা আরও পাল্টে যায়। ঘর বন্ধ করে ময়না ভেতরে ঘুমায়। একটা জানালা ভেজানো থাকে, যারা জানার তারা জানে। পয়সা দিলে ভেজানো জানলা দিয়ে এক বোতল চোলাই মদ সংগ্রহ করে নিঃশব্দে চলে যায়। কেউ কেউ ওর ঘরের সামনের উঠোনে বসেই চোলাই খেয়ে মনের সব কথা উগরাতে থাকে। ময়নার ঘুমোনোর অবকাশ নেই। সব মাতালদেরই জানা আছে এইখানে রাতবিরেতে যখন তখন মদ পাওয়া যায়। কেবল পুলিশেরই জানা থাকে না। আসলে পুলিশও জানে, কিন্তু পুলিশ তো ময়নাকে ধরতে আসে না, ওটা লোক দেখানো হানা দেওয়া, চোর পুলিশ খেলা। তাই সকালে দিনের আলোতে আসে। ময়নাকে না পেয়ে ফিরে যায়। আর যথাসময়ে ময়না লোক মারফত থানায় প্রাপ্য পৌঁছে দেয়। এও আর এক রাত দখল। 

দুর্গোৎসবের আগে ঝুনু দেবনাথের দিন রাত একাকার। তাঁর স্বামী ছিলেন প্রধানত প্যান্ডেল শিল্পী। মেয়ের বয়স যখন বারো ও ছেলে কলেজে পড়ে, সেই সময় তাঁর স্বামী মারা গেলেন। অনন্যোপায় ঝুনু নিজেই ব্যবসার হাল ধরেন। এ বছর তাঁর পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণেশ্বর, হিন্দমোটর, অশোকনগর এবং গোবরডাঙ্গা, পাঁচটি সর্বজনীনের কনট্রাক্ট। 'বিয়ের পর থেকেই ওর কাজ দেখেছি। উনি আমার সঙ্গে সব কিছু আলোচনা করতেন, কী থিম, কত লোক খাটছে, কত পারিশ্রমিক, সব আলোচনাই করতেন। ফলে কাজটা সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল। কিন্তু কখনও ফিল্ডে যাইনি'-- ঝুনু স্পষ্ট বললেন। 'মহিলা হিসেবে যথেষ্ট সম্মান পাই। আমাকে অন্য চোখে দেখেন সকলে। অনেক ক্লাব শুনেছি কাজ করতে গিয়ে টাকা মেরে দেয়। কিন্তু আমার সঙ্গে এমন কখনও হয়নি।' সবাই জানে একজন গৃহবধূ এ কাজে নেমেছে মানে তা কতটা ঝুঁকির। তার টাকা এদিক ওদিক করা যাবে না। অন্যদের তুলনায় একটু কম পারিশ্রমিকে এই কাজ করি। কিন্তু যে পরিমাণ টাকা চুক্তি হয়, সেটা কেউ বাকি রাখে না। ষাট জন কর্মচারী ঝুনুর প্যান্ডেল শিল্পে কাজ করে। না কোথাও কখনও তাঁর আত্মসম্মানে ঘা লাগেনি। একজন মহিলা হিসেবে সসম্মানে কন্ট্রাক্ট নেন, এগ্রিমেন্ট করেন, নিয়মিত কথাবার্তা বলেন। ছেলে আর্ট কলেজের ছাত্র ছিল। পাশ করার পর ছেলেও এখন এই শিল্পে যুক্ত হয়েছে। মেয়েদের রাত দখলের আহ্বানের বহু আগেই ঝুনু দেবনাথ সসম্মানে রাত দখল ও পথ দখলে নিযুক্ত আছেন।

এভাবেই প্রতিটি রাত দখল করে আছে কত মেয়ে, কত মায়ের হাসি কান্না উদ্বেগ হতাশা আত্মসম্মান অপমান উল্লাস... পান পেয়ালার চিয়ার্স।


Monday, 16 September 2024

সাপলুডো

'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে'

শ্রেয়া ঘোষ



আমাদের সমাজে দুর্নীতির শিকড় গভীরে প্রোথিত। ঘুষ দিয়ে, পদমর্যাদার প্রভাব খাটিয়ে সুবিধে নেওয়ার জালের বিস্তার সর্বব্যাপী। 

বাচ্চাকে তথাকথিত ভালো স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করতেও, এমনকি বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময় বা কেউকেটা কোনও ব্যক্তিকে ধরা-করা এক পুরনো প্রথা। আমাদের একবারও মনে হয় না, যে স্কুল একটি তিন বছরের শিশুকে বেআইনিভাবে টাকা নিয়ে বা নিয়ম-বহির্ভূত আর কোনও উপায়ে ভর্তি করছে, সেখানে কী শিক্ষাই বা পাবে আমাদের সন্তান; আর অভিভাবক হিসেবে আমরাও সন্তানের জীবনের প্রথম পদক্ষেপকেই কালিমালিপ্ত করছি অকারণ।

সামান্য একটু বাড়তি সুবিধা পাবার জন্যও আমরা নীতিবোধ জলাঞ্জলি দিই। রাজদ্বারে, শ্মশানে চ - সর্বত্রই ঘুষের খেলা। দেবস্থানে পুজো দেব, ঈশ্বরের কৃপাভিক্ষা করব, কিন্তু বেশিক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে পারব না। টাকা দিয়ে, লাইন টপকে, তাড়াহুড়ো করে ধর্মপালন করে বেরিয়ে আসব। এমনকি শ্মশানে পর্যন্ত লাইন ভেঙে পরে এসে আগে মৃতের (যিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই  নিকটজন) দেহ দাহ করতে অন্ধিসন্ধির সন্ধান করি। হৈ চৈ লাগিয়ে দিই। যে মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলেই গেছে, যে কোনওদিনই আর আমাদের এক মুহূর্ত সময়ও দাবি করবে না, তাকে পুড়ে যাওয়ার সময়টুকুও দিতে পারি না। তারপর বেশ অহমিকা নিয়ে বলে বেড়াই, গিয়ে তো দেখি আমাদেরটা তের নম্বরে, একটা ফোন করিয়ে দিলাম 'দাদা'কে দিয়ে। ব্যাস, বাপ বাপ করে এসে গেল আমাদের নম্বর।

বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে সন্তানকে ডাক্তারি বা এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির প্রথা তো সেই কবে থেকেই। তখন এই বেআইনি লেনদেনকে বলা হত ক্যাপিটেশন ফি। পরে ম্যানেজমেন্ট কোটা বলে বেশ আপাত আইনসঙ্গত একটা ব্যবস্থা চালু হল। বিরাট অঙ্কের টাকা দিয়ে যে কোনও শিক্ষায়তনে ভর্তি শিক্ষার দুর্নীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কারণ, যে এভাবে ভর্তি হয়, সে পাশ করে প্রথম থেকেই চাইবে বেআইনি পথে নিজের উপার্জনকে বাড়িয়ে নিতে। আর এই বিপুল অঙ্কের টাকার ওপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও কোনও কর দিতে হয় না। তাছাড়া এটি এমনই এক কুপ্রথা যেখানে শিক্ষায় মেধার থেকে ছাত্রের পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি অধিক গুরুত্ব পায়। 'রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট' অনুসারে স্কুলে বা কলেজে ভর্তির সময়ে (প্রাইভেট স্কুল-কলেজ হলেও) ক্যাপিটেশন ফি নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে। উপরন্তু এই বিশাল টাকা দেওয়ার ক্ষমতা অনেকেরই নেই, অতএব এই প্রথা সংবিধান বিরোধী। এই সবই অতি সরল যুক্তি, না জানা বা বোঝার কোনও হেতু নেই। অথচ আমরাই বছরের পর বছর এই অন্যায় করে আসছি, বিন্দুমাত্র বিবেক দংশন ছাড়া। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, এইসব ছাত্ররা স্কুল কর্তৃপক্ষের বিশেষ স্নেহও পেয়ে থাকে। ভর্তি হবার পরেও স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশনের সুবাদে প্রশ্ন জেনে আর বিষয়বস্তু না জেনে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার ব্যাপারও নতুন নয়।

আমরা এইসব অভ্যেস পালন করে দিব্যি কাটিয়ে এসে আজ এত যুগ পরে 'বিবেক' নামক একটি বায়বীয় বস্তুকে টানাটানি করতে লেগেছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে ডাক্তারের অ্যাপয়ন্টমেন্ট, ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট থেকে মিথ্যে ডাক্তারি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে এসেছি অবলীলায় মসৃণ এক বিনিময় প্রথার সুবাদে। সুদীর্ঘকালের সহজ প্রচলনে এই সব অন্যায় প্রথা এত স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধও জাগে না মনে।

এই অবধি লিখে একটু থমকে গেলাম। আমরা টাকা দিয়ে, ধরা-করা করে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড় করছি, কিন্তু এর বৃহত্তর অভিঘাত সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না। স্কুল-কলেজে জাল সার্টিফিকেট দিচ্ছেন একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসক। অনুপস্থিত হওয়ার কারণ হিসেবে এই মিথ্যে কাগজ সংগ্রহ করে স্কুলে জমা দিচ্ছেন অভিভাবক যেখানে তাঁর সন্তান সুস্থ এবং হয়তো বেড়াতে যাওয়া বা অন্য কোনও কারণে স্কুলে যায়নি। চিকিৎসক তাঁর ডিগ্রির অপব্যবহার করছেন অবলীলায়। চিকিৎসক এই প্রকারে, তাঁর ওপর যে সামাজিক বিশ্বাস আর সম্মান ন্যস্ত করা হয়েছে, তা মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই নবীন প্রজন্ম মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হচ্ছে।  উল্টোদিকে পুরোপুরি রোগ নিরাময়ের আগেই কেউ  মিথ্যে কাগজ ব্যবহার করে সুস্থ মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি করছেন। এইসব আমাদের মনে হয় না। তাৎক্ষণিক কার্যসিদ্ধি হলেই আমরা খুশি। অসৎ উপায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করে সহনাগরিকদের জীবনকে বিপজ্জনক করে তুলছি। যিনি বা যাঁরা ঘুষ নিয়ে এই অনুমতিপত্র বিলোচ্ছেন আর নিরীহ মানুষের জীবনহানির কারণ হচ্ছেন, তাঁরা কি কখনও অনুতপ্ত হয়েছেন? আচ্ছা, এইসব অনুতাপ-টাপের মতো অস্তিত্বহীন অনুভূতি বাদ দিয়েই বলি না হয়, দুর্ঘটনা ঘটলে এই মিথ্যে শংসাপত্র প্রদানকারী ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে খুনের চার্জ আনা হয়?

তিরিশ-বত্রিশ বছরের পুরনো কথা মনে পড়ছে। নার্সারি স্কুলের ছুটির সময়ে বাচ্চাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য স্কুল গেটের বাইরে অভিভাবকদের ভীড়ে জমজমাট রাস্তায় এক শিশুর মা গর্বের সঙ্গে বলছেন, আমার হাজব্যন্ডের তো মাইনের টাকায় হাতই পড়ে না...। সে ভদ্রলোক বেলতলা রোডের মোটর ভেহেকিল্স'এ কর্মরত ছিলেন। অপরাধ করে, কারও তোয়াক্কা না করে বুক ফুলিয়ে জাহির করার মতো ভয়ঙ্কর মানসিকতা নিতান্ত ছাপোষা লোকজনের মধ্যে কেমন পুষ্ট হয়ে এসেছে বরাবর।

ছোট থেকে দেখে এসেছি টেলিফোন লাইন খারাপ হলে BSNL'এর যে কর্মী সারাতে আসেন, তাঁকে কিছু টাকা দিতে হত। যদিও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের মাস মাইনে পাওয়া কর্মী। তবু মা মাসের খরচের বাক্স থেকে টাকা বার করে তাঁকে দিতেন। মা ভয় পেতেন, টাকা না দিলে লাইন আসতে অহেতুক দেরী হবে। এখন BSNL ল্যান্ডলাইনের সংযোগ প্রায় উঠেই গেছে। পরিবর্তে মোবাইলে আরও বেশি লোক ঠকানোর ছক। বস্তুর সঙ্গে ছায়ার মতো, জীবনের সঙ্গে ঘুষ ও যাপনের সঙ্গে ভয় অবিচ্ছেদ্য হয়ে জুড়ে আছে।

আমরা সকলেই একদিন প্রথম জেনে ফেলি, 'পয়সা দিয়ে সবই পাওয়া যায়'। বিচার থেকে হুকিং করে বিদ্যুৎ, সব। প্রভাব খাটিয়ে আরও বেশি পাওয়া যায়, আরও সহজে। ধর্ষণের অপরাধে কারাবাসের  শাস্তিপ্রাপ্ত আসামীর প্যারোলে মুক্তি থেকে নকল বা জাল ওষুধের ব্যবসার ছাড়পত্র। ভয় পেয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে আমরাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছি কিন্তু। আইন ব্যবসায়ী উকিল রসিদ ছাড়া নগদ টাকা দাবি করছেন, পাছে মামলায় হেরে যাই সেই ভয়ে দিয়েও দিচ্ছি। চিকিৎসক যা খুশি তাই দক্ষিণা দাবি করছেন তো প্রিয়জনের জীবনের ঝুঁকি নিতে না পেরে বিনা প্রতিবাদে সেই অন্যায়কে মেনে নিচ্ছি। প্রতিবাদ কি কখনও করি না? করি, কালেভদ্রে, হাওয়া বুঝে আর অবশ্যই ভিক্টিমের সামাজিক অবস্থান বুঝে। আমর সকলেই জানি সমীকরণের দুই দিকের রাশির মাঝের দুটি রেখা কখনই সমান্তরাল নয়। রেখা দুটি হয় অভিসারী, নতুবা অপসারী হয়ে একটা গিলে খাওয়ার মতো চেহারা নেয়। খাদ্য-খাদক যেন। ভয়ানক এই সম্পর্কের কথা স্বতঃই মনে আসে।

বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছি, জল দিয়েছি, সার দিয়েছি, হাওয়া দিয়েছি। আমরা কি অমৃত ফলের আশা করেছিলাম? বিন্দু বিন্দু জলকণা জমিয়ে জমিয়ে আমরাই তৈরি করেছি মারের সাগর।

'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে' আজ শুধু হাতে উঁচিয়ে রাখা পোস্টারে।


Tuesday, 10 September 2024

সাবির মালিক হত্যার বিচার চাই

অনেকেই নিশ্চুপ কেন?

বর্ণালী মুখোপাধ্যায়



পরিযায়ী শ্রমিক আজ বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদের মাথাব্যথা। ধুঁকতে থাকা পুঁজিবাদী অর্থনীতি শ্রমের এই মুক্ত যাতায়াত সহ্য করতে পারছে না; যদিও গতরের মুক্ত দাম নির্ধারণ ছিল পুঁজিবাদের মুক্ত অর্থনীতির প্রাথমিক শর্ত। ইউরোপিয় ইউনিয়ন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিযায়ী শ্রমিক উদ্ভূত সংকট একটি অন্যতম ভিত্তি ছিল বৈকি। কিন্তু বেকার সমস্যা ও অসাম্যকে মোকাবিলা করতে অক্ষম পুঁজিবাদ এই সমস্যা মেটাতে তো পারেইনি, ক্রমেই তা এক বিস্ফোরণের চেহারা নিয়েছে। জেল ও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে পরিযায়ী শ্রমিকের ঢল নামছে। পুঁজিবাদী কায়দায় মোকাবিলা হচ্ছে এই ঢলের, অর্থাৎ, পরিচিতি সত্তাকে হাতিয়ার করে মৌলবাদের বিস্তার হচ্ছে দেশে দেশে।

পশ্চিমবঙ্গ যখন তিলোত্তমার ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে প্রতিবাদে সরব, ঠিক তখন অগস্টের শেষ সপ্তাহে সাবির মালিক নামে এক বছর পঁচিশের মুসলিম বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে হরিয়ানার দুষ্কৃতিরা। তারা নিজেদের গোরক্ষক বাহিনী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছিল। সাত জন গ্রেফতার হয়েছে বলে জানা গেছে, যার মধ্যে দু' জন আবার প্রাপ্তবয়স্কই নয়। 

হরিয়ানার ভান্ডওয়া গ্রামে সাবির সপরিবারে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। বাড়ি বাড়ি থেকে লোহালক্কর বা স্ক্র্যাপ কিনতেন তিনি। সাড়ে তিন বছর হল সাবির সেখানে গেছেন, বাড়ির বড় ছেলে। কলকাতার উপকণ্ঠে বাসন্তী অঞ্চলের মেয়ে তাঁর স্ত্রী, একটি আড়াই বছরের কন্যাও আছে তাঁদের। এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে তাঁদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন সাবিরের শ্বশুর আর শ্যালক। ওই এক চিলতে ঘরেই তাঁদের দিন কাটছিল, অভাব, অনটন আর স্নেহ ভালবাসায়। মেয়েটিকে লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা মায়ের, পয়সা জমানোর জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা তাঁর। 

হঠাৎ একদিন সব স্বপ্ন চুরমার করে একদল গোরক্ষকের আগমন। সামনে হরিয়ানায় ভোট যে! ওই পাড়ায় যত মুসলমান পরিযায়ী থাকেন, তাদের বাড়িতে বাড়িতে হানা আর হুমকি চলল। তাদের কাছে নাকি খবর আছে গরুর মাংস খাওয়া হচ্ছে সেখানে। দিনটা কেটে গেল, কিন্তু মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে এল। দু' দিনের মাথাতেই সাবির সহ আরও তিন-চারজন অহমিয়া মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের টানতে টানতে থানায় নিয়ে যাওয়া হল, ব্যবসার জিনিস কেড়ে নিল গোরক্ষা বাহিনী। জামাইবাবুর সাথে দৌড়ল তাঁর শ্যালকও। পুলিশ ধমকালো, চমকালো, তারা নাকি গরুর মাংস খেয়েছে এবং এসব এখানে আর চলবে না। যদিও সাবির'রা বারবার বলেছিলেন যে ওই অঞ্চলে কোনও গরুর মাংস বিক্রি হয় না, তবু পুলিশ হুমকি দেওয়া থামায়নি। কিন্তু আজ শ্যালক আর স্ত্রীর আফশোস, যদি পুলিশ সেদিন গ্রেফতার করে নিত, তাহলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন সাবির। পুলিশ ছেড়ে দিল, এবার বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু গোরক্ষা বাহিনী ওই অহমিয়া পরিযায়ী শ্রমিক আর সাবিরকে ছাড়তে চাইল না। তাদের বক্তব্য ছিল, অনতিদূরে সাবিরের মাল রাখা আছে, সেখানে ওদের সঙ্গে গিয়ে সে মাল নিয়ে আসুক। গোরক্ষা বাহিনী দু' ভাগ হয়ে একদল সাবিরকে নিয়ে চলে গেল, অহমিয়া দুই জনকে নিয়ে গেল আরেক দল। কেউ আর ফিরল না। চব্বিশ ঘণ্টা অধীর অপেক্ষার পর সাবিরের স্ত্রী আর শ্যালক যখন খোঁজ নিতে আবার গেলেন থানায়, তখন তাঁদের জানানো হল যে সাবির হাসপাতালে আছে; আসলে ছিল মর্গে। অনেক কাকুতিমিনতির পর কোনও এক সদয় পুলিশ আধিকারিক এফআইআর করলেন, যদিও তাতে লেখা হল মারপিট করে মৃত্যু। অহমিয়াদের জন্য কেউ কিছুই বলল না, তাদের খবর সম্পূর্ণ চেপে দেওয়া হল (ডবল ইঞ্জিনের দৌলতে হয়তো)। স্ত্রী আর সাবিরের বাবার অভিযোগ যে ওখানে গত তিন বছর ধরে বিজেপির লোকেরা বারে বারে তাঁদের জিজ্ঞেস করত যে তাঁরা কি বাংলাদেশী? ওরা কি মোদিকে ভোট দেয় নাকি মমতাকে?

এখন বঙ্গে তিলোত্তমার নৃশংস মৃত্যুকে ব্যবহার করে ভোট ছাড়াই ডবল ইঞ্জিন সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি। রাজ্য সিপিআইএম এবং কংগ্রেস তাদের সাগরেদ। এখনও ডবল ইঞ্জিন সরকার এ রাজ্যে নেই, তাই হরিয়ানার প্রত্যুত্তরে এখানে পরিযায়ী শ্রমিক খেদাও অভিযান শুরু হয়নি। বিজেপির কাছে পরিযায়ী মানে অবশ্য অন্য রাজ্যের হিন্দু শ্রমিক নয়। তাদের কাছে পরিযায়ী হল এ রাজ্যেরই মুসলমান মানুষ। সাবিরের প্রতিবাদ আমরা করছি কিন্তু প্রতিশোধের স্পৃহা প্রকট হয়নি। 

ডবল ইঞ্জিন সরকার হল বিজেপির বাল্কানাইজেশনের প্রাথমিক শর্ত। রাজ্যগুলিকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা তাদের লক্ষ্য। পরিচিতি সত্তাকে ব্যবহার করে দেশটাকে টুকরো টুকরো করতে চায় তারা। মেহনতী মানুষের ঐক্যকে ধ্বংস করতে চায় তারা। বিজেপি খুব ভাল করেই জানে যে হরিয়ানার সাধারণ মানুষের বাড়িতেই সাবির'রা ভাড়া থাকত। শুধু সাবির নয়, অসম থেকে যে পরিযায়ী শ্রমিকরা গিয়েছিল, তারাও। হরিয়ানার অধিবাসী বাড়ির মালিক কিন্তু ভাড়া দিয়েছিলেন তাঁদের, বাঙালি বলে কোনও বিদ্বেষ ছিল না হরিয়ানার বাসিন্দাদের মনে। অর্থাৎ, ঘৃণা জন্মগত নয়, হরিয়ানার সাধারণ মানুষ বাঙালি বা বাংলাদেশি বলে ভারতের পূর্ব প্রান্ত থেকে যাওয়া পরিযায়ীদের বিতাড়ন করেননি, এটা জানে বিজেপি-আরএসএস আশ্রিত এই গোরক্ষক বাহিনী। জনগণের এই ঐক্য মেনে নিতে তারা রাজি নয়। তাই তারা শুধু পরিযায়ীদের হত্যা করেছিল তাই নয়, বাড়ির মালিকদের এসেও শাসিয়ে গেছে।

তবে সমস্যা হল, শুধু পুলিশ নয়, আইন আদালত যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই সামাজিক মুখোশ পড়া রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিত তবে তা থেমে যেত অনেক আগেই। পুঁজিবাদের রক্ষাকবচ এই অনির্বাচিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং তার মাথায় বসে থাকা মহামান্যগণ জেগেও ঘুমিয়ে আছেন। আমাদের দেশের আইন আজও স্বৈরতান্ত্রিক, বৃটিশ ছায়ায় ঢাকা। তাই এ হেন হত্যার কোনও শাস্তি পাওয়া যায় না। একটা বা দুটো ঘটনার পর আদালত সুয়োমোটো মামলা গ্রহণ করলে আজ মহামারীর মতো পরিযায়ী শ্রমিক পিটিয়ে হত্যা এভাবে ছড়িয়ে পড়ত না। একে কেন্দ্র করে যে পারস্পরিক পরিচিতি সত্তার হিংস্রতা তৈরি হয় তাকে মোকাবিলা করা যেত সহজে। এই পরিচিতি সত্তাই হল ফ্যাসিবাদী উত্থানের উর্বর ভিত্তি, যা পুঁজিবাদের আজ বড়ই প্রয়োজন।

পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য সুরক্ষা কবচ এ দেশে রয়েছে। রাজ্যের মধ্যেই কাজের সন্ধান, অন্য রাজ্যে গেলেও চিকিৎসা, রেশনের সুবিধা আছে, কিন্তু অন্যান্য ঘোষণার মতো এই সব ঘোষণাও টাকা আর সদিচ্ছার অভাবে বিশ বাঁও জলে। যদিও অভাব হওয়ার কথা ছিল না। পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমানোর জন্য কৃষিকে লাভজনক করা প্রথম কাজ। কর ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন যদি নাও হয়, একচেটিয়া কালো সম্পদ যদি বাজেয়াপ্ত নাও হয়, তবু কৃষিকে লাভজনক করার জন্য কর ব্যবস্থায় সামান্য অদলবদল করলেই চলত, যা অনেক ক্ষেত্রেই পরিযায়ী শ্রমের ঢল কমাতে পারত। তাছাড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষার খরচ তো নামমাত্র। সম্পদ করের অদলবদল করলে অন্তত বাড়তি দু' লাখ কোটি টাকা উঠতে পারে, এদিকে কর্পোরেট কর আগের ৩০ শতাংশ হারে ফিরিয়ে আনলেই আরও ৪ লাখ কোটি উঠবে। এই বাড়তি ছয় লাখ কোটিতে দেশ জুড়ে মোট ১২ কোটি মেট্রিক টন ধান আর ১১ কোটি মেট্রিক টন গম কুইন্টাল পিছু ২৫০০ টাকায় কেনা সম্ভব। এর ফলে সাবিরদের পারিবারিক কৃষি কাজ এতটাই লাভজনক হবে যে তাদের হয়তো হরিয়ানায় যেতেই হত না।   

আসলে গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে না পারলে এই পরিযায়ী শ্রমিকের যাতায়াত বন্ধ করা যাবে না, বা দেশকে টুকরো টুকরো করা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের স্তম্ভ জনপ্রতিনিধিত্বমুলক ব্যবস্থা, যাকে ঘিরে রেখেছে আমলাতন্ত্র, আদালত, সামরিক ব্যবস্থা। জনপ্রতিনিধিত্বকে ক্রমাগত দমানোর প্রক্রিয়া চলছে, দুর্নীতিতে রঞ্জন গগৈরা ইডির আওতায় আসেন না। অথচ দেশের যে কোনও জনপ্রতিনিধি, মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রীদের বাড়ি ঢুকে গ্রেফতার করে আনছে ইডি। তাদের কোনও রক্ষাকবচ নেই, যদিও আদালত থেকে রাজ্যপাল, এমনকি সরকারি আমলাদেরও রক্ষাকবচ আছে।

এখনও এই রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন নেই। তাই সাবিরকে নিয়ে লিখতে পারছি। তাই পরের ভোটে বিজেপি'কে দেশ ছাড়া করার স্বপ্ন দেখতে পারছি।


Sunday, 8 September 2024

এই ক্রোধকে প্রণাম

কিন্তু শুশ্রূষাহীন রাষ্ট্র  

যশোধরা রায়চৌধুরী 



শুশ্রূষা অর্থ সেবাযত্ন বা সুস্থ করে তোলা, এ হল বাইরের মানে। আসল ব্যুৎপত্তিগত অর্থ 'শুনিবার ইচ্ছা'। যে কোনও সমস্যায়, রাজদ্বারে সংকটকালে, আজও। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাজা হয়েই থাকল। তার শুনিবার ইচ্ছা বেমালুম অনুপস্থিত। 

অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে, প্রায় যেন রকেট স্পিডে, ‘অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল, ২০২৪,’ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হল ৩ সেপ্টেম্বর।  মাত্র এক দিনের মধ্যে পাশ করানো এই বিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে একটা হাতিয়ার। তারা আরজিকর কাণ্ডে অসংখ্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত পথে নামায় আতঙ্কিত, এবার বলা যাবে, ওই তো ধর্ষণ বিরোধী আইন তো আমরা এনেছি। আমরা আমাদের কথা রেখেছি। বাকি কাজ তো সিবিআই আর সুপ্রিম কোর্টের হাতে। বিচার তাদের কাছে চাও। 

প্রেক্ষিতটা কী? 

সদ্য ঘটে যাওয়া আরজিকর ঘটনার অভিঘাতে, মেয়েরাই প্রথম ডাক দিয়েছিলেন রাত দখলের। তারও পৃষ্ঠপট ছিল একটা। মেয়েরা রাত দখল করো। এক বা একাধিক পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল সমাজ মাধ্যম। প্রথমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ইনটার্ন ডাক্তারদের মধ্যে থেকে, ২৪ সালের এই কালো আগস্টের ৯ তারিখের রাত্রিতে ৩৬ ঘন্টা ডিউটির পর নিজের হাসপাতালের সেমিনার রুমে ঘুমোতে যাওয়া আরজিকরের ইনটার্ন ডাক্তার, ৩১ বর্ষীয়া তরুণীটির ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের নিরিখে যা ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। অগ্নিসংযোগ হয়েছিল একটি মন্তব্যে। চেনা ঢঙের মন্তব্য। আরজিকরের তৎকালীন প্রধানের প্রথম প্রতিক্রিয়ার ঝোঁক এইই যে, মেয়েটিকে রাতে ওখানে কে থাকতে বলেছিল?

তারপরে দেওয়া হল নিদান। ১৭ দফা 'সুরক্ষা বিধান'এর শলাপরামর্শ। আবারও সেই ইতিমধ্যেই একপেশে বৈষম্যমূলক কর্মক্ষেত্রটিকে আরও বেশি দাগিয়ে দিয়ে পশ্চাৎপদতার নতুন নজির সৃষ্টি করল। এবার এল এই নতুন আইন। অপরাজিতা আইন। 

কী কী সমস্যা আছে এ আইনে? 

মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এই বিল পাশ করা হল। যে কোনও আইন পাশ করার আগে তার খসড়া প্রকাশ করা, নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করার দীর্ঘ প্রথা চলে আসছে। রাজ্য সরকার তা করেনি, যা অগণতান্ত্রিক। এই বিল-এর নামে ‘অপরাজিতা’ শব্দটির প্রয়োগ কাব্যিক ও অসঙ্গত। হিংসাকে লঘু করে দেখাতে পারে। আইনের নামকরণের একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রথা রয়েছে। নামকরণে এমন বিভ্রান্তির পরেও এই বিল-এ ধর্ষিত মেয়েদের জন্য ‘ভিক্টিম’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে, ‘সারভাইভার’ শব্দটির উল্লেখ করা হয়নি, এমনকি যাঁরা ধর্ষণের পর ন্যায়ের জন্য লড়াই করছে, সেই মেয়েদের জন্যেও নয়। 

এই আইনের নামকরণে ‘মহিলা ও শিশু’ একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মেয়েদের স্বাধীন সত্তা ব্যাহত হয়েছে, মাতৃত্বকে নারীত্বের প্রধান আধার বলে দেখানো হয়েছে। 

এই বিল-এ রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (২০২৩) ট্রান্স ও কুইয়র মানুষদের উপর যৌন আক্রমণ বিষয়ে নীরব, এবং রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইনে (ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস প্রোটেকশন অব রাইটস অ্যাক্ট, ২০১৯) এই ব্যক্তিদের উপর যৌন অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ দু’ বছরের কারাদণ্ড। এই সময়ে রাজ্যের সংশোধনে এ বিষয়টি আনলে রূপান্তরকামীদের উপর হিংসার যথাযথ প্রতিকারের সম্ভাবনা ছিল। এই বিল ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায় রূপে প্রধানত গ্রহণ করেছে শাস্তির কঠোরতার বৃদ্ধিকে। প্রতিটি অপরাধের ন্যূনতম শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। সমাজতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন, শাস্তি যত কঠোর হয়, অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার হার তত কমে। 

এই বিল-এ ধর্ষণ ও হত্যার (অথবা আঘাতের ফলে চেতনা হারিয়ে জড় অবস্থায় চলে যাওয়ার) একমাত্র শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে প্রাণদণ্ড ও জরিমানা। এটা অসাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৮৩ সালের একটি রায়ে বলেছে যে, কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই ফাঁসি একমাত্র সাজা হতে পারে না। ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের বিচারের জন্য স্পেশাল কোর্ট তৈরির প্রস্তাবও প্র্যাক্টিকাল নয়। পকসো-সহ বিভিন্ন ধরনের স্পেশাল কোর্টের অনেকগুলিরই পরিকাঠামো, অর্থবল এবং লোকবল সাধারণ আদালতের চাইতে কম। প্রায়ই আইনের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বিচার শেষ হয় না। তেমনই, স্পেশাল টাস্ক ফোর্সও কার্যকর হবে না, যদি না যথেষ্ট সংখ্যায় দক্ষ কর্মী এবং যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংহতির অভাব থাকবে কি না, সে চিন্তাও থাকছে। জেলা স্তরে এক একজন ডিএসপি এখনই অতিরিক্ত মামলায় ভারাক্রান্ত। কাজের ভার আরও বাড়ালে অভিযোগ নথিভুক্তি কমার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এই বিল (ধারা ২৯সি, ৩ ও ৪) বলছে, স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তদন্তে নেমে মৌখিক বা লিখিত ভাবে যে ব্যক্তির কাছে সহায়তা চাইবে, তাকেই অবিলম্বে সাহায্য করতে হবে। না হলে তার জেল, জরিমানা হবে। কে সহায়তা দানে বা সাক্ষ্য দানে ‘অনিচ্ছুক’ - তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কেন স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের মতো একটি তদন্ত সংস্থাকে দেওয়া হবে? কেবল আদালতের ক্ষমতা রয়েছে সমন পাঠানোর এবং তা অগ্রাহ্য করলে শাস্তি দেওয়ার।

এই বিল-এ ধর্ষণের তদন্তের সময়সীমা ৬০ দিন থেকে ২১ দিন করা হয়েছে। আগের ৬০ দিনের সময়সীমা আইনের সুসংহত ধারণা থেকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। ইচ্ছেমতো সময় কমালে তদন্তের গুণমানে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। এই বিল-এ অপরাধীর জরিমানা করার কথা বলা হলেও, রাজ্য সরকারের তহবিল (ভিক্টিম কমপেনসেশন ফান্ড) থেকে ধর্ষণ-অতিক্রান্ত মেয়েদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও উল্লেখ নেই। সরকার এই বিলকে কার্যে পরিণত করতে কোনও বাড়তি আর্থিক দায় গ্রহণ করছে না, বাড়তি বরাদ্দ দিচ্ছে না। সুশীল সমাজের একাংশ ওপরের এই প্রশ্নগুলি তুলেছেন। এবং বোঝাই যায়,  এই বিল একটি অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি। আরজিকর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় জনরোষের সামনে ‘অপরাজিতা বিল’ একটা তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতি মাত্র। 

আইনটির নির্মাণ ত্রুটিযুক্ত, তা পাশ করানো হয়েছে তাড়াহুড়ো করে। যথেষ্ট চিন্তা, যথেষ্ট আলোচনা, যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কিছুরই ছাপ নেই। বসা হয়নি মেয়েদের সাথে বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে। অন্তত তেমন কোনও বিষয় আমাদের চোখে পড়েনি। 

আরজিকরের পরেও পাশাপাশি আরও অজস্র নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে চলেছে। এর অধিকাংশ ঘটছে গ্রামেগঞ্জে। যেখানে মানুষের একজোট হওয়া অসুবিধার। সারা ভারতই নারী নিগ্রহীদের স্বর্গরাজ্য, কিন্তু আমাদের রাজ্য যেন বেশি বেশি করে অগ্রণী! এগিয়ে বাংলার এই রূপ কি আমরা দেখতে চেয়েছি? ১০ অগস্ট থেকে যে প্রতিবাদ আছড়ে পড়েছে, তা তো এই সমস্ত ইস্যুতেই প্রশ্ন তুলেছে। সেই দিন থেকে লাগাতার সমগ্র সমাজ প্রতিবাদ করছে এক বা একাধিক অন্যায়ের। মেয়েরা বলেছে রাত দখল করবে। কেন বলেছে?  কারণ রাতের অধিকার একমাত্র পুরুষের নয়। এবং অবশ্যই ধর্ষক পুরুষের নয়। 

ধর্ষক পুরুষদের জেলখানার কয়েদের শিকের  আড়ালে রাখার বন্দোবস্ত না করে, প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, যে রাষ্ট্রযন্ত্র মেয়েদের সুরক্ষা দিতে অপ্রস্তুত, অক্ষম বলে  স্বীকার করে,  knee jerk reaction বশত এমন একুশে আইন আনে যা আসলে মেয়েদের কাজের জায়গা এবং কাজের সুযোগ খর্ব করে, কাজের সময়ের ওপরে খাঁড়া নামিয়ে আনে, সে রাষ্ট্র অক্ষম। যে রাষ্ট্র তাড়াহুড়ো করে একটা আইন আনে যেখানে না আছে নতুন কোনও ধ্যানধারণা, নতুন টাকা বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি বা একটা কোনও কিছু লাগু করার মতো ব্যবস্থা (ইমপ্লিমেন্টেবল), সে রাষ্ট্র আসলে তার নাগরিকদের সঙ্গে কোনও কথোপকথন করছে না। তার ডায়ালগ করার কোনও ক্ষমতা নেই। সে প্যানিক বাটন টিপছে না হলে প্রলাপ বকছে না হলে  ঔদাসিন্যে ছেলে ভোলাচ্ছে। এমন রাষ্ট্রযন্ত্রের যে দিন ঘনিয়ে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্রযন্ত্র কি তার ৫০ শতাংশ নাগরিকের সুরক্ষা দিতে আদৌ ইচ্ছুক? প্রশ্ন জাগে। সুরক্ষা, বিধান, আরাম দেওয়া, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি কোনও কিছুই দিতে ইচ্ছুক না। এমন কি সম্পূর্ণ বধির। তাইই, কোথাও কোনও শুশ্রূষা নেই যে আমাদের।

২০১১'তে 'পরিবর্তন চাই'-এর প্রত্যাশায় মানুষ যে বদল এনেছিলেন, সেই বদলকারীর হাতে পার্টিতন্ত্র আর সরকার একীভূত। পশ্চিমবঙ্গে এখন কোনও স্বায়ত্তশাসন সংস্থাও নেই যা নিজের মতে চলতে পারে। সরকারের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তিনি এতটাই নিজস্ব অভিজ্ঞান চিহ্ন দিয়ে কব্জা করে নিয়েছেন যে তা বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়। এত বছরে দুর্নীতি এক রকমের গা-সওয়া হয়েছে, মানুষ ক্রমশ সহ্য করতে করতে বল্মীকস্তূপে পরিণত হয়েছেন। নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান অর্থকরী বেনিয়ম ও লাগামছাড়া পেশিশক্তির হাতে ক্রীড়নক। সর্বত্র বাহুবলী দলদাসদের বাড়বাড়ন্ত। ইতিমধ্যেই শিক্ষা দুর্নীতির কথা সর্বজনগ্রাহ্য হলেও, বা নারী সুরক্ষার প্রশ্নে একের পর এক প্রশ্নচিহ্ন উঠলেও (পার্ক স্ট্রিট কামদুনি হাঁসখালি) তা আমাদের চোখকান সয়ে এসেছিল যেন। আগস্টের ৯ তারিখ আরজিকর কাণ্ড একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ-খুন শুধু নয় - এটা মনে হয় সমাজের যা কিছু আশাপ্রদ,  ভবিষ্যতের দিকে উৎসারিত - তারই বিনাশ যেন। ফলত নারীদের এবং সাধারণ মানুষকে তা প্রবলভাবে নাড়া নয়। তারপরেও, এটা শুধু একটাই ধর্ষণ নয়। গণতন্ত্রের প্রায় প্রতিটি স্তম্ভের লাগাতার ধর্ষণ। পুলিশি ব্যবস্থার দলদাসত্ব ও নিষ্ক্রিয়তার পদাবলী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সিনিয়র ডাক্তারদের বিশাল অংশের নেক্সাসের কুৎসিত চিত্রাবলী। রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম জরুরি দুটো অংশকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দিয়েছে এই ঘটনার পূর্বাপর ঘটনাক্রম। প্রমাণ লোপাট করে প্রকৃত দোষীকে জানার পথ আড়াল করা হয়েছে। গোটা বিষয়ে রাজ্যবাসী কেঁপে শুধু ওঠেননি, ঐতিহাসিক ভাবে রাস্তায় নেমে এসেছেন। 

অনেক অন্ধকারের মধ্যে এটুকুই আশা যে, শেষ অবধি আমাদের ঘুম ভেঙেছে। রাত দখলের কর্মসূচিই হোক বা মানববন্ধন, জনজোয়ারে নেমে আসা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ হোক বা তীক্ষ্ণ প্রশ্নে সিস্টেমকে ক্ষতবিক্ষত করা, জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযানের সাফল্য, বহুদিন পর বাঙালি জেগে উঠেছে স্বতোৎসারিত পবিত্র ক্রোধে। এই ক্রোধকে প্রণাম।


Saturday, 7 September 2024

ছেলেটিকেও শেখাই...

মানবতার সূর্যালোকে আমাদের ঘুম ভাঙুক

অনিন্দিতা মণ্ডল



প্রথমেই জানাই আজ কেন কলমটা ধরলাম। একজন ডাক্তার এবং সর্বোপরি একজন মানুষ হিসাবে আজ কিছু কথা না বলতে পারলে নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হবে। বিগত কয়েকদিন ধরে যে আন্দোলন চলছে তা আর কেবল চিকিৎসক সমাজের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই, জনসাধারণের অনুভূতিকেও নাড়া দিয়েছে। 

এই আন্দোলনের সূচনা গত ৯ অগস্ট ২০২৪, এক অভিশপ্ত শুক্রবারে; যেদিন ভোররাতে কর্মরত অবস্থায় নির্মমভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হয় আমাদের অভয়া বা তিলোত্তমাকে, তাও আবার এই কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকেই এক হাসপাতালে। সেদিন সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে জুনিয়র চিকিৎসকরা এক বিপ্লবের সূচনা করে। সেই আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং স্বচ্ছ ময়নাতদন্তের দাবি। অনেক চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে সেদিন তারা একত্রিত হয়েছিল। হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রোদ, বৃষ্টি আর সমস্ত ভয়কে জয় করে তারা ন্যায়ের দাবি জানিয়েছিল। হারিয়ে ফেলা সহকর্মীর জন্য বিচার চাওয়া কি এত বড় ধৃষ্টতা? না হলে কেন কিছু অশুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেদিন লণ্ডভণ্ড করে দিল পুরো হাসপাতাল? স্বাধীনতার মধ্যরাত্রে যখন চিকিৎসক সমাজের ডাকে সাড়া দিয়ে আপামর বঙ্গবাসী পথে নেমেছিল, ঠিক সেই সময় হাসপাতালে চলল তাণ্ডব। 

ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও এই শান্তিপূর্ণ, সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলনকে থামিয়ে দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল কিছু মানুষ। কিন্তু সেদিনের পর আন্দোলন হল আরও তীব্রতর। পাহাড়ি ঝর্ণাতে বাঁধ দেবার মতোই ব্যর্থ প্রয়াস। আন্দোলন হল আরও খরস্রোতা। ন্যায়ের দাবিতে স্লোগানে মুখরিত হল সারা কলকাতা। 'আমি ভয় করব না ভয় করব না' বলে সবাই এগিয়ে চলল। এই কলকাতা অতীতে কবে দু' বেলা মরার আগে মরেনি তা আমার জানা নেই। জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে থেকে অনবরত আন্দোলন চালিয়ে গেলেন, আর তাদের পাশে ঢাল হয়ে সিনিয়র চিকিৎসকরা রোগীদের পরিষেবা দিতে লাগলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, কোনওদিনই কিন্তু এমারজেন্সি পরিষেবা থেকে রোগীকে বঞ্চিত করা হয়নি। নিন্দুকেরা অবশ্য তা নিয়ে কুৎসা করা থেকে বিরত থাকেননি। কিন্তু আমরা, চিকিৎসকরা, চিকিৎসা না করতে পারলে ততটাই কষ্ট পাই যতটা একজন কৃষক মাঠে যেতে না পারলে পান, যতটা একজন শিল্পী গান না গাইতে পারলে পান, যতটা কষ্ট একজন শিক্ষক পান পড়াতে না পারলে। 

এই লড়াই কেন তারা বেছে নিলেন? এই পথ কি খুব সুখের? একবার ভেবে দেখুন তো, আজ একজন চিকিৎসক যদি কর্মরত অবস্থায় এই জঘন্য ঘটনার শিকার হন, তাহলে আমার আপনার বাড়ির নারীরা সুরক্ষিত তো? কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ ছাড়াই একবার ভাবুন তো, যদি এই অন্যায়ের শাস্তি না হয় তাহলে আমরা পারব তো এই সমাজে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিতে? এই ঘটনার দায় কি আমরা কেউ এড়াতে পারি? আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ই কি এর কারণ নয়? যেদিন দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল তার দায় কিন্তু সমাজ এড়াতে পারেনি। সেই পাপেই ১৮ দিনের মহাযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কৌরবকুল। আজকের ঘটনা কি তার সমতুল্য নয়? 

কিন্তু আজও, ২৬ দিন কেটে গেলেও, আমরা সুবিচারের অপেক্ষায়। এই দীর্ঘ বিচারব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘ করে তুলেছে বিভিন্ন প্রমাণ লোপাটের প্রচেষ্টা। আমরা কি আদৌ নিরাপদ? রাতে কাজ করা না হলেই কি ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে আমরা মুক্তি পাব? তিলে তিলে গড়ে ওঠা নারী স্বাধীনতার পরিসর নির্ধারণের অধিকার কিন্তু এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের হাতে নেই। ধিক্কার এই সমাজকে, যেখানে নারীদের পথে নামতে হচ্ছে রাতের দখল নিতে, নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে। এই আমাদের সভ্যতা? একজন মহিলা চিকিৎসক যদি রাতে কাজ না করেন তাহলে শুধু পুরুষদের দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা চলবে না। আপনার, আমার বাড়ির লোক যখন রাতে অসুস্থ হলে ডাক্তারের অভাবে ছটফট করবেন, তখন আমরা বুঝতে পারব যে এটা কোনও সমাধানসূত্রই নয়। আর শুধু ডাক্তার কেন, যে কোনও পেশার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। তাই আমাদের চিন্তাধারার বদল আবশ্যিক। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আমাদের শেখায় যে কেবল নিজের বাড়ির মা, বোন, স্ত্রী, কন্যার সম্মানটাই গুরুত্বপূর্ণ, আর বাকি সকল নারীকে বস্তুবাদিতার নিরিখে মাপা যায়, ধিক সেই সমাজকে। সেই সমাজেরই কিছু উচ্চপদস্থ কর্মী নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাবার জন্য প্রকাণ্ড লৌহকপাট নির্মাণ করেন। কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর ধৈর্যের কাছে নতিস্বীকার করতে হয় তাদের। 

এরকম শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অদূর অতীতে আমরা কবে দেখেছি মনে করতে পারছি না। এসবের পরও কর্মবিরতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি আমাদের সাজে? তবুও যদি এই প্রশ্ন এখনও কারও মনে সংশয় সৃষ্টি করে থাকে তাহলে তারা জেনে রাখুন যে জুনিয়র চিকিৎসকরা তাদের নির্যাতিতা সহকর্মীর নামে 'অভয়া ক্লিনিক' চালু রেখেছে যেখানে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত টেলিমেডিসিন পরিষেবা দেওয়া হয়, যাতে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও সঙ্কটমুক্ত হন। তবে সব মানুষ যে কুৎসা রটাচ্ছেন এমনটা বললে অধর্ম করা হবে। লালবাজারের অবস্থান ধর্মঘটে সাধারণ মানুষরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের পাশে থেকেছেন। আমরা ঋণী সেই মানুষটার কাছে যিনি নিজের দৈনিক উপার্জনকে প্রাধান্য না দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে স্যান্ডউইচ আর সিঙ্গারা নিয়ে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন। আমরা ঋণী সেই মানুষটার কাছেও, যিনি অনেকগুলো হাতপাখা সরবরাহ করেছিলেন আমাদের ক্ষণিকের স্বস্তির জন্য এবং যা হয়তো তাঁর সারাদিনের রুটিরুজি। ক্রমাগত অবস্থানের জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করছিলেন কিন্তু ওই সাধারণ মানুষরাই। এনাদের কথা স্বীকার না করলে আমাদের আন্দোলনটাই অপূর্ণ রয়ে যাবে। 

এই আন্দোলন ধীরে ধীরে আরও বৃহত্তর রূপ ধারণ করছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন। আজ মানুষ খুঁজে নিচ্ছে মিছিলকে। এ কোনও সামাজিক শ্রেণির আন্দোলন নয়, এ আন্দোলন আমাদের হৃদয়ের, আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার আন্দোলন। আসুন, আমরা সবাই জেগে উঠি, এগিয়ে যাই আরও বৃহত্তর মানবতার দিকে। আমাদের ঘরের ৫ বছরের নাবালিকাটি যেন তার চিকিৎসক, পুলিশ, অভিনেত্রী বা আরও বড় হবার স্বপ্নকে গলা টিপে মেরে না ফেলে কেবলমাত্র নিরাপদ রাতের অভাবে। আসুন, আমরা আমাদের ৫ বছরের ছেলেটিকেও শেখাই সকল নারীকে সম্মান করতে। নারী কোনও আলাদা প্রজাতি নয়, তারা পুরুষের মতোই। এই সমতার শিক্ষাই হয়তো আমাদের নারী-পুরুষ সবাইকেই একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ দিতে পারবে। তাই এই আন্দোলন আমার, আপনার সবার আন্দোলন। আমাদের মনুষ্যত্বে উন্নীত হবার পথে যে কোনও বাধাই আসুক না কেন, আমরা তা পার করে ফেলব এই বিশ্বাস আমার আছে। 

কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ, শ্রেণি বৈষম্য বাদ দিয়ে একবার নিজের মনুষ্যত্ব দিয়ে অনুভব করে দেখুন; দেখবেন, আপনিও কখন নিজের অজান্তেই এই আন্দোলনে সামিল হয়ে গিয়েছেন। আশা রাখি, একটা সুস্থ সমাজের ভোরে মানবতার সূর্যালোকে আমাদের ঘুম ভাঙবে।


Thursday, 5 September 2024

মূল সুদ্ধ উপড়ে ফেলা

মেয়েরা যখন রাতের রাস্তা দখলের ডাক দিল

মহাশ্বেতা সমাজদার



জীবনের এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। এমন পবিত্র জাগরণ কে কবে দেখেছে? নিশুতি রাতের দখল নিতে পথে নেমেছেন (১৪ অগস্ট ২০২৪) সব বয়সের নারী। তাদের পাশে পাশেই হাতে রামধনু পতাকা নিয়ে হেঁটে আসছেন প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষেরা। অল্প দূরেই আছেন পুরুষরা, যাঁরা মানেন, নারীর যথার্থ স্বাধীনতা এখনও সুদূরপরাহত। এমনকী সে রাতে পুরো ঘরবন্দি ছিলেন না তাঁরাও, যাঁদের বিরুদ্ধেও এই স্বাধীনতার লড়াই। তাঁরাও ঘরের মা-বোনেদের একা রাতে ছাড়তে না পেরে পিছু পিছু এসে জুটে গেছেন বিপুল জনস্রোতে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, শোকের ক্রোধের দ্রোহের সে এক বিপুল জনপ্লাবন।

শুরুটা সবার জানা। আরজিকরের ডাক্তার-ছাত্রীর নৃশংস ধর্ষণ-মৃত্যুর খবরে, নিজেরই কর্মক্ষেত্রে মৃতার শেষ মুহূর্তের অসহায়তাটি স্পর্শ করেছিল সকলকেই। এক সর্বব্যাপী শোকের মধ্যেই সবাই নিজের নিজের মতো করে বুঝে নিচ্ছিলেন সবটুকু। কারও বুকে কাঁপন ধরেছিল নিজের সন্তানের মুখটি মনে পড়ে, কারও চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল একটি জীবন ও তার স্বপ্নের এমন নিষ্ঠুর ভয়াবহ পরিণতিতে।কারও কাছে অপমানের বেদনাটি বড় চেনা লেগেছিল। 

ঘটনার অব্যবহিত পরেই শোনা গেল হাসপাতালের অধ্যক্ষের উক্তি: 'ও ওখানে কী করছিল?' অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানের সব ভালোমন্দের দায়িত্ব যার স্কন্ধে, তিনি অবলীলায় মৃত্যু ও ধর্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দিলেন মৃতা-নির্যাতিতা-ধর্ষিতা ছাত্রীর উপর। জুনিয়র ডাক্তাররা অধ্যক্ষের পদত্যাগ ও ঘটনার ন্যায্য বিচার চেয়ে আন্দোলন শুরু করে দিলেন। আর অধ্যক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি এক অদৃষ্টপূর্ব মেঘ ঘনিয়ে আনল এ রাজ্যের আকাশে। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল অধ্যক্ষের পদত্যাগের চার ঘন্টার মধ্যেই অন্য একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে তাঁকে নিযুক্ত হতে দেখে।

তাই মেয়েরা যখন রাতের রাস্তা দখলের ডাক দিল, তখন সে ডাকে সাড়া পড়ে গেল ঘরে ঘরে। সে ডাকেই গলা মেলালেন ট্রান্স ক্যুইয়ার মানুষেরাও। সে ডাক শহর কলকাতাকে ছাপিয়ে ভেসে গেল সারা রাজ্যের শহর শহরতলি মফস্সল গ্রামে-গ্রামান্তরে। ছাড়িয়ে গেল রাজ্য আর দেশের সীমানাও। বিদেশেরও নানা জায়গা থেকে শোনা গেল 'জাস্টিস ফর আরজিকর'। 

দিকে দিকে গড়ে উঠতে লাগল মানববন্ধন। প্রতিদিন মিছিলে শ্লোগানে প্রতিবাদে শহরের আকাশে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। জাস্টিস ফর আরজিকর। জুনিয়র ডাক্তাররা ন্যায়ের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তার সমান্তরালে আন্দোলন গড়ে উঠল নাগরিক সমাজেও। কোথাও সঙ্গীতশিল্পীরা, কোথাও বাচিকশিল্পীরা, কোথাও সিনিয়র ডাক্তাররা, অভিনয় ও কলাকুশলীরা, কবি লেখকরা, বেসরকারি হাসপাতালের সবাই, শহরের আবাসনে আবাসনে, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রাক্তনীরা, অনলাইন অ্যাপ ডেলিভারি কর্মীরা, যে যেখানে ছিল পা মেলাল, গলা মেলাল মিছিলে, শ্লোগানে। কলকাতার খেলার মাঠের দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান যখন পরস্পরের চিরবৈরিতা ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়াজ তুলল, আমাদের বোনের বিচার চাই, আর তাদের পাশেই এসে দাঁড়াল মহামেডান স্পোর্টিংও, সেদিন শহর সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল এক অভূতপূর্ব দ্রোহ। 

ইতিমধ্যে, কলকাতা পুলিসের থেকে তদন্তের ভার গেছে সিবিআই'এর কাছে। ঘটনার স্বতঃস্ফূর্ত শুনানি করেছে সুপ্রিম কোর্ট। 

জুনিয়র ডাক্তাররা পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যেতে চাইলে মাঝরাস্তায় পুলিশ তাদের ব্যারিকেড করে থামিয়ে দেয়। তাঁরা সেখানেই বসে পড়েন ও তাঁদের দাবিতে অনড় থাকেন। সারা শহর ঝাঁপিয়ে পড়ে হবু ডাক্তারদের দেখভালে। খুলে যায় ইতিউতি দোকান প্রেস বাড়ির বাথরুমগুলি। ইতিমধ্যে কেউ এসে চলমান শৌচালয় বসিয়ে দিয়ে গেছে। জুনিয়ররা সারা রাত অপেক্ষা করে আছে একটি সুসজ্জিত শিরদাঁড়া নিয়ে। পুলিশ কমিশনারের তো সেটারই বড় অভাব। ইতিমধ্যে রাত পেরিয়ে ভোর হয়। চা-বিস্কুট স্যান্ডউইচ পৌঁছে যায় আন্দোলনকারীদের কাছে। রোদ ওঠে, গরম বাড়ে । শহর এসে ত্রিপল টাঙিয়ে দেয়। ছায়া আসে। শহর বলে ওদের অভুক্ত তৃষ্ণার্ত থাকতে দেব না। চলে আসে গ্লুকন-ডি জল দুপুরের খাবার। সারা শহর উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চায়, আর কিছু কি লাগবে ওদের ? 

শহর কলকাতার বুকের ভিতরে যে প্রাণের ধুকপুকুনিটুকু থেমে যায়নি, তা দেখে ভরসা জাগে। বুকের ভিতর কান্না চেপে আন্দোলন কঠিন হয়ে ওঠে। এদিকের এদের অনড়তায় ওদিকের ওদের কাঁপন বাড়ে। খবর আসে ব্যারিকেড খোলা হবে। ২২ ঘন্টা অপেক্ষার পর ২২ জন জুনিয়র ডাক্তার ঢুকলেন লালবাজার। পুলিস কমিশনারকে একটি গোলাপ ফুল সজ্জিত মেরুদণ্ড উপহার দিয়ে তাঁরই ইস্তফা বিষয়ক স্মারকলিপি তাঁরই হাতে জমা দিয়ে তাঁরা আবার ফিরে গেলেন তাঁদের আন্দোলনের মঞ্চে।

রাত দখলের মেয়ে-ট্রান্স-ক্যুইয়াররা ইতিমধ্যে জেলায় জেলায় আর শহর কলকাতায় একের পর এক মিছিল করেছে। মানববন্ধন গড়েছে। রাস্তার ধারের গৃহস্থরা সেই মিছিলকে দু' হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছেন, শ্লোগানে গলা মিলিয়েছেন। মিছিলে আটকে পড়া ট্রাম থেকে যাত্রীরা নেমে এসেছেন মিছিলে। কবিতা গানে নাটকে পথচিত্রে স্লোগানে, পোস্টারে ভরে উঠেছে শহরের রাস্তা।  

এ যেন সেই সারা শহর উথালপাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ চলছে।

প্রতি মুহূর্তের জীবনযাপনের মধ্যেও ভোলা যাচ্ছে না সেই মেয়ের কথা, সম্ভবত যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। সম্ভবত তাকে এমনভাবে যন্ত্রণা নিয়ে চলে যেতে হয়েছে, সম্ভবত এমন ভাবে তার মৃতদেহকে ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে তা ভয়ের সৃষ্টি করে তাদের বুকে, যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা মনে মনেও ভেবেছে কখনও, বা ভবিষ্যতে ভাবতেও পারে।

এর সঙ্গে ক্ষোভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যখন জানা যাচ্ছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিক কেমন ব্যবহার করেছিল তাঁর মা-বাবার সঙ্গে। কী ভাবে মেয়ের মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। মেয়ের মৃতদেহ কীভাবে তড়িঘড়ি দাহ করা হয়। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও'য় দেখা গেছে নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিরা মৃতদেহের কাছে ভিড় করে আছেন। প্রমাণ লোপাটের বিবিধ ব্যবস্থা সাধারণ মানুষ সাধারণ বুদ্ধিতেই বুঝতে পারছেন। এমনকী সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই এ কথা স্বীকারও করেছে, যে যথাযথ সংরক্ষিত হয়নি তথ্যপ্রমাণ।

এ যেন সেই মৃত্যু যা জাগিয়ে দিয়ে গেল গোটা সমাজকে। এ জাগরণ এমনই যে অন্যায়ের মূল পর্যন্ত না উপড়ে এ যেন থামবে না। যেহেতু মানুষের ক্রোধের লক্ষ্য রাজ্যের সরকার, তাই সেই রাগের আগুনকে নিজের কাজে লাগাতে যথাসাধ্য তৎপর হয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। কিন্তু আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা এবং রাত দখলের মেয়ে ট্রান্স ক্যুইয়াররা সমাজকে পলে পলে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, নারীর প্রতি অনাচার অত্যাচারে বিজেপির স্থান দেশে এক নম্বরে। বিলকিস বানো, উন্নাও, কাঠুয়া, হাথরাস, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজেপি ধর্ষকের সমর্থক। তাই এই দ্রোহকালে বিজেপিকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া যাবে না।  

মানুষ রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে অন্যায়ের শেষ দেখার অপেক্ষা করছে। চারের রাতের পথের দখলের পোস্টারে লেখা হল, বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, রাত জাগছে সেই জনতা। চারের বিকেলে যখন ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে সন্ধের মানব বন্ধনের স্থানের তালিকা, জানা যাচ্ছে আরজিকরের প্রাক্তনীরাও রাত এগারোটা থেকে শহরের কোনও কোনও স্থানে রাত দখল করবেন, তখনই খবর পাওয়া গেল, ৫ সেপ্টে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি স্থগিত। কিন্তু এক মুহূর্তও আন্দোলনের গতিতে কোনও বিরাম এল না। শুধু বোঝা গেল লড়াই আরও দীর্ঘ হবে, কিন্তু অন্যায়ের শেষ না দেখে এ লড়াই থামবে না। 

চারের রাতে রাজ্য জুড়ে শত শত মানব বন্ধন আর রাত দখল থেকে আওয়াজ উঠল, বিচার যত পিছোবে, মিছিল তত এগোবে। এই সর্বব্যাপী আন্দোলনের অমোঘ বার্তা, মানুষ আর ভয় পাচ্ছে না। যে মানুষ দুদিন আগেও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আন্দোলনে পা মেলায়নি, একটি মৃত্যু তার চোখের সামনে থেকে ভয়ের পর্দাটা যেন একটানে নামিয়ে দিয়েছে। আর এটাই হৃৎকম্প সৃষ্টি করছে শাসকের বুকে। তাই ইতস্তত চলছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া মেয়েদের ভয় দেখানো। থেমে নেই পুলিশি জুলুম।

কিন্তু যারা একবার পথে নেমে পড়ার সাহস পেয়েছে, নিজেদের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে সামিল হয়েছে, তারা শুধু আরজিকরের ঘটনার অপরাধীর শাস্তি দেখেই শান্ত হবে না। তারা মূল সুদ্ধ উপড়ে ফেলতে নেমেছে এই গোটা দুষ্টচক্রটিকেই। তারা পালটে দিতে নেমেছে মেয়ে ট্রান্স ক্যুইয়ারদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটিকেও। তারা আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আর ঘরে ঢোকানো যাবে না।