Wednesday, 23 September 2020

নতুন মোড়

কোন পথে যাবে গান

প্রবুদ্ধ বাগচী

মাস পাঁচেক আগে শুভেন্দু মাইতি একটি অনলাইন আলোচনা সভায় প্রশ্ন করেছিলেন, এই যে আমরা বাংলা গানের স্বর্ণযুগ নিয়ে আহা উহু করি, আপনারা ওই চল্লিশ বছরের  (১৯৩০-৩২ থেকে ১৯৭০-৭২) দুশোটি ভাল গানের তালিকা করতে পারবেন কি? স্বভাবতই কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।

সবাই স্বর্ণযুগের ঢেকুর তোলেন কিন্তু সত্যি করে স্মরণীয় গানের সংখ্যা কীরকম তার কোনও হদিশ আমাদের নেই। সব থেকে যেটা সমস্যার তা হল, ওই সময় গানের সুরের ওপর অনেক মনে রাখার মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে কিন্তু সুরের সেই আধুনিকতার পাশে গানের কথা বড্ড বেশি সেকেলে, আড়ষ্ট, প্রাণহীন ও গুরুচন্ডালি। সুরের নিয়মই হল তা কথাকে চাপা দিয়ে দেয় তাই গান শোনার সময় কথার রক্তাল্পতা সেভাবে নজরে আসে না ঠিকই, কিন্তু আলাদা আলাদা করে গান নিয়ে ভাবতে বসলে সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। ধরা যাক, ‘তোমারি পথ পানে চাহি/ আমারই পাখি গান গায়’ গানটিতে ‘চাহি’ শব্দটি গান শোনার সময় মনে আসে না। এটি আসলে সাধুভাষা যা গানটির বাকি অংশের ভাষা নয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বহুশ্রুত গান: ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’- এখানে ‘রবে’ শব্দটি খেয়াল করলেও একই অনুভূতি হতে বাধ্য। উদাহরণ ইচ্ছে করলেই বাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আবার এও ঠিক, সমস্ত গানই এরকম নয়। মান্না দে'র গাওয়া কিংবদন্তী গান ‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে’ এই ত্রুটি থেকে আশ্চর্যভাবে মুক্ত; ঝকঝকে গান হিসেবে মনে পড়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ ইত্যাদি । 

তাহলে স্মরণীয় গান বলব কাকে? যার মধ্যে সুর, কথা ও বিষয়ের একটা সাম্য থেকে গেছে। এই কথা সত্যিই বলা শক্ত যে এমন গান প্রায় অনেক পেয়ে যাব আমরা। কিন্তু সব মিলিয়ে সেই সময়টাকে আমরা বাংলা গানের ইতিহাসে ফেলে দিতে পারব না। কারণ, এই সময়টাতেই বাংলা আধুনিক গান ঘোষিতভাবে শ্রম বিভাজনের আওতায় চলে এসেছিল। মূলত কাজী নজরুল ইসলামের অসুস্থতা ও তাঁর গানের জগৎ থেকে প্রস্থানের পরে এটাই ছিল বাংলা গানের রূপান্তর। একজন গানের কথা লিখবেন, অন্য একজন তাতে সুরারোপ করবেন আর অন্য আরেকজন কন্ঠশিল্পী তা গেয়ে রেকর্ড করবেন। বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাস আসলে এই শ্রম বিভাজনের ইতিহাস ও পরম্পরা ।   

প্রায় পনেরো বছর আগে (জানুয়ারি ২০০৬) কবীর সুমন বাংলা গান নিয়ে তাঁর শেষতম বইটি লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘কোন পথে গেল গান’। সেই বই যারা সংগ্রহ করেছিলেন, সময়ের আক্রমণ পেরিয়ে তার কপি হয়তো ইদানীং মলিন, কিন্তু প্রশ্নটা আজও জাগরূক। কোন পথে গেল গান? স্বর্ণযুগ পেরিয়ে আরও অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। যে আধুনিক বাংলা গানে বাঙালি মজে ছিল একসময়, যার জন্য রেডিওর ‘অনুরোধের আসর’এ চিঠি পাঠাতেন বাঙালি উন্মুখ শ্রোতা, তাঁদের অপেক্ষা ফুরিয়ে এল একটা পর্যায়ে এসে। সেই সময় তাঁরা রেডিওতে আধুনিক গানের ঘোষণা হওয়া মাত্র নব ঘুরিয়ে রেডিও বন্ধ করে দিতে আরম্ভ করলেন। এই বন্ধ্যাপর্ব থেকে সুমন চট্টোপাধ্যায় (অধুনা কবীর সুমন)  নামক এক ভগীরথের হাতে নতুন বাংলা গানের ধারা শুরু হয়েছিল গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। দেখতে দেখতে তাও প্রায় তিরিশ বছরের পুরনো। সুমনের সমকালীন অনেকেই আজ অবসৃত, সুমন সরে গেছেন বাংলা খেয়ালের নবনির্মিত জগতে। খেয়াল করতে হবে, সুমন যে-ধারায় গান করতে আরম্ভ করেছিলেন তা কিন্তু শ্রম বিভাজনের ধারাবাহিকতায় আবার একটা ধাক্কা দেয়। সুমন বা তাঁর সহযাত্রীরা সকলেই নিজেরা গান লিখে তাতে সুর করে গাইতেন। কারণ, এই ধাঁচের গানে, গান লেখা থেকে তার মঞ্চ পরিবেশন অবধি সবটাই ছিল একজনের স্টেটমেন্ট- সঙ্গীত-গবেষক সুধীর চক্রবর্তী যাকে বলেছেন ‘ওয়ান পার্সন মিউজিক’। 

এর পরে ব্যান্ডের গান। তার যতটা কিছুটা যুগের হাওয়া ততটা গান বিষয়ে নিবিড় ভালবাসা নয়, অন্তত বাংলা গানের ট্র্যাডিশন থেকে ব্যান্ডওয়ালারা প্রথম থেকেই দূরে দূরে। দু' একটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। আর এই পর্বে আবার বাংলা গান চলে গেল শ্রম বিভাজনের আওতায়। ব্যান্ডগুলো যেহেতু একেকটা দলবদ্ধ সংস্থা, তাঁদের মধ্যে গান লিখিয়ে, সুরকার ও পরিবেশক আলাদা। কিন্তু গান কি হচ্ছে? খুব মনে রাখার মতো কিছু যা অবসর সময়ে মানুষ গুনগুন করবে নিজের মনে? অথচ এক শ্রেণির মানুষ এঁদের শুনছেন, একেকটি গানের দল বিদেশে অবধি শো করতে যাচ্ছে, তাঁদের বাজার দর বেজায় রকম বেশি। এগুলো কি বাংলা গানের ধারাবাহিক অগ্রগমন ? 

পাশাপাশি একটা অন্য প্রসঙ্গ। গান শোনার ও গানের প্রচার করার জগতে এর মধ্যে ঘটে গেছে একটা বিরাট পরিবর্তন। গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি (১৯৮৫) এইচএমভি তাদের কোম্পানিতে গ্রামোফোন রেকর্ড উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ততদিনে বাজারে এসে গেছে ক্যাসেট। কয়েক বছর ক্যাসেটের পর্ব পেরিয়ে সিডির যুগ এল তার পরে। আবার কয়েক বছর চলার পরে অচিরেই সিডি যুগের অবসান। এই শতকের গোড়ার থেকে মোবাইল ফোন ও মাইক্রোচিপের বহুল ব্যবহার গান শোনার ধারণাকে বদলে দিতে থাকে। উদারনৈতিক অর্থনীতির হাওয়ায় বেসরকারি এফএম চ্যানেলের প্রতিষ্ঠা আকাশবাণী কলকাতার একচ্ছত্র অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় তার অল্প আগে থেকেই। পাশাপাশি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের আমদানি রেডিওর অবস্থাকে আরও গুরুত্বহীন করে দেয়।  টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে আয়োজিত হতে থাকে গানের আসর, প্রতিযোগিতা। গান শোনার থেকে গান দেখার ব্যাপারটা দর্শকদের মনে ধরে বেশি। যদিও বাংলা আধুনিক গানের ধারাবাহিকতার সঙ্গে এইসব আয়োজনের কোনও নাড়ির যোগ ছিল না। এক ধরনের চর্বিতচর্বণ জাতীয় অনুষ্ঠানেই মজিয়ে রাখা হত দর্শকদের।

কিন্তু আজ যেখানে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানে বাংলা গানের আসলে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবক নেই, যারা বাংলা গানকে বাণিজ্যিক ভাবে বিপণন করতে পারে। এইচএমভি কোম্পানির হাত বদলে সারেগামা হয়ে যাওয়ার পরেও সেই প্রতিষ্ঠান আজ মৃত। এই দুনিয়ায় আর যে সব বাণিজ্যিক সংস্থা বিনিয়োগ করেছিল, পুরনো মেগাফোন, ইনরেকো বা পরের সাউন্ড উইং, কসমিক হারমোনি ইত্যাদি সেগুলোরও আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কলকাতা ও শহরতলিতে ক্যাসেট বা সিডি বিক্রির  নামজাদা বিপণিগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের সুবিধে হয়ে যাওয়ায় কেউ আর গান কিনতে আগ্রহী নন; ইউটিউব, গানা, আমাজন মিউজিক বা অন্য ধরনের অ্যাপলিকেশন ব্যবহার করে মুফতে বা নামমাত্র মূল্যে শোনা যাচ্ছে গান- নতুন, পুরনো, বাসি, টাটকা সব রকম। কলকাতার বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশনগুলোতে বাংলার সবরকম গানই বাজানো হয় তবে সারাদিনের মধ্যে তাঁদের হিন্দি অনুষ্ঠানেরও কমতি নেই। আর যেহেতু কোনও সিডি প্রকাশ হয় না, ফলে, নতুন গান নতুন অ্যালবাম এই ধারণাটা আজ একদম ধূসর অতীত। এমন কি ক্যাসেট রেকর্ডার, সিডি প্লেয়ার এইসব যন্ত্রগুলোও আজ আর উৎপাদন হয় না, পুরনো যন্ত্র সারিয়ে নেওয়ার মতো দোকান বিরল। তাহলে কি নতুন গান হচ্ছে না? 

হচ্ছে নিশ্চয়ই। তবে তার বিপণন একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নির্ভর। যারা বা যিনি নতুন গান করছেন তিনি হয়তো নিজেই তা রেকর্ড করে ইউটিউবে বা ফেসবুকের মতো সমাজমাধ্যমে তুলে দিচ্ছেন। কেউ কেউ শুনছেন, কেউ কেউ তারিফ করছেন আর যেহেতু এই উদ্যোগ একদমই ব্যক্তিগত স্তরের, ফলে তার পরিধি নিতান্তই কম। এখনকার গান যেটুকু বিপণন হতে পারছে তা কেবল বাংলা ফিল্মে। তাও আগের তুলনায় সেই গানের সংখ্যা নিতান্তই কম। গত দশ/পনেরো বছরে খুব স্মরণীয় ফিল্মের গান কটাই বা হয়েছে ? ওই ধরুন, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’, ‘বসন্ত এসে গেছে’ বা ‘তুমি যাকে ভালবাসো’ এইরকম হাতে-গোনা কিছু গান সেই অর্থে হিট হয়েছে, বাজারে বিক্রি হয়েছে। বেসিক আধুনিক গানের ভাঁড়ারে এইটুকু সঞ্চয়ও নেই। নতুন গান বিপণন করার কোনও মঞ্চ নেই, প্রচার নেই,  শ্রোতার কাছে বাহিত হয়ে যাওয়ার কোনও উপায়ও নেই। ভরসা বলতে ওই সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর মঞ্চ-অনুষ্ঠান। গত কয়েক মাসে সেই মঞ্চের গান গাওয়ার পরিসরটাও ধূলিসাৎ। 

হয়তো অবস্থাটা খুব বিপন্নতার। বাংলা গানের এতদিনের ধারা কি তবে শুকিয়ে যাবে? চিন্তার কথা নিশ্চয়ই। তবে এর মধ্যে একটা অন্য সম্ভাবনার উঁকিঝুঁকি আছে। বড় এক বা একাধিক সঙ্গীত বিপণন সংস্থার আওতায় না থেকে এই প্রথম বাংলা গান এসে দাঁড়িয়েছে একদম স্বাধীন একটা পরিসরে, ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয়। এর মধ্যে ঝুঁকি এটাই, যে কেউ যা খুশি করার সুযোগ পেয়ে যায়, তা সে ভাল মন্দ যাই হোক। কারণ, সঙ্গীত বিপণন সংস্থা কিন্তু একটা ঝাড়াই বাছাইয়ের মাধ্যমে গান নির্বাচন করে তবেই তার পেছনে পুঁজি বিনিয়োগ করত- সে নির্বাচনের মাত্রা যেরকমই হোক না কেন। এখন সেই অবস্থাটা আর নেই। বৃহৎ পুঁজির আওতার বাইরে একটা গানের বাজার। একে ভাল খারাপ দু'ভাবেই কাজে লাগানো যায়, কিন্তু আগের পরিস্থিতির থেকে এটা গুণগত ভাবে আলাদা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে, ফিল্ম তৈরির ক্ষেত্রে এমন একটা বিকল্প পরিসর একটু একটু করে নির্মাণ হয়েছে গত কয়েক বছরে। শুধু সামাজিক মাধ্যমে আবেদন করে অর্থ সংগ্রহ করে ফিল্ম বানানো হয়েছে এবং সামাজিক মাধ্যমেই তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন উদাহরণ আমাদের বেশি দূরে খুঁজতে যেতে হবে না। বাংলা গান যারা লেখেন, সুর করেন এমনকি গান, তাঁরা সকলেই এখন একটা নতুন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্ভাবনা অনেক, ঝুঁকিও অনেক। কিন্তু বাংলা গানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে একটা রাস্তায় তো তাঁদের এগিয়ে যেতেই হবে। কী করবেন তাঁরা? নতুন নতুন কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নাকি গতানুগতিকতা? বাংলা গানের সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছেন তাঁরা কীভাবে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগান সেটাই আপাতত আমাদের অভিনিবেশের লক্ষ্য হয়ে রইল ।

 

Monday, 21 September 2020

কৃষির বিপদ

দেশ জুড়ে কৃষক বিক্ষোভ

অতনু চক্রবর্তী

 

কর্পোরেটদের স্বার্থে গাজোয়ারি করে মোদী সরকার পাশ করাল সর্বনাশা কৃষি-চাষি বিরোধী বিল। বহু ঢাক পেটানো বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের উচ্চকক্ষে ভোটাভুটি করে নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রকে চূড়ান্ত প্রহসণে পরিণত করে ধ্বনি ভোটে পাশ হয়ে গেল ঐ বিলটি।  ভারতের কৃষি ও খাদ্য সুরক্ষার বিরুদ্ধে এইভাবে ফ্যাসিস্ট মোদী সরকার সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করল।

রাজ্যসভায় এই চরম অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে ১২টি বিরোধী দল একযোগে কক্ষের ডেপুটি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনল অনাস্থা প্রস্তাব। ওদিকে, সেদিনই ক্রোধে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা হরিয়ানা-পঞ্জাবের হাজারে হাজারে কৃষকেরা বহু জায়গায় বিক্ষোভ দেখালেন, অবরোধ করলেন এনএইচ ৩৪৪ হাইওয়ে সহ বেশ কিছু জাতীয় সড়ক, কালো বেলুন উড়িয়ে জানালেন প্রতিবাদ। উত্তাল হল ঐ দুই রাজ্য। কিন্তু কী আছে সেই বিলে, যা অগণন কৃষকদের টেনে নামাল রাজপথে? কী সেই কৃষি সংস্কার যা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল? 

কোভিড১৯'কে সুযোগে পরিণত কর‍তে মোদী সরকার সংসদকে মুলতুবি রেখে একের পর এক অধ্যাদেশ জারি করে। তার মধ্যে কৃষির ক্ষেত্রে আনা হয় তিনটি অধ্যাদেশ, যা এবারের বাদল অধিবেশনে পাশ করাতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। যে তিনটি অধ্যাদেশকে রাজ্যসভায় জোরাজুরি ও অনৈতিক উপায়ে পাশ করানো হল:

১) অত্যাবশকীয় পণ্য আইনে সংশোধন করে চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ-গম-তৈলবীজ ইচ্ছেমতো মজুত করার ঢালাও অনুমোদন। 

২) কৃষিপণ্যের সাথে যুক্ত কর্পোরেট, ব্যবসায়ী, রফতানিকারী ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলো এরপর চাষিদের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে চাষ করিয়ে সরাসরি ফসল কিনে নিতে পারবে। এর ছাড়পত্র দিয়েছে সদ্য পাশ হওয়া কৃষি আইন। 

৩) বেসরকারি সংস্থার সাথে চাষিদের ব্যবসায় ফসলের দাম নিয়ে দরাদরির অনুমোদন।

এর ফলাফল কী হবে? 

এতদিন সরকার  চাষিদের কাছ থেকে যে কৃষি পণ্য  সংগ্রহ করত, তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। ফসলের দাম সম্পর্কে যেটুকু নিরাপত্তার আশ্বাস এতদিন চাষিরা পেত, এবার তাও আর থাকবে না। কারণ, নতুন আইন বেসরকারি মান্ডি বা ফসলের বাজার তৈরি করার সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। এতদিন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ধরা হত আলু-পেঁয়াজ-দানাশস্য-তৈলবীজ-ডাল। এখন আর সেভাবে তা গণ্য করা হবে না। বৃহৎ কর্পোরেট-ব্যবসায়ীদের অঙ্গুলি হেলনে এবার থেকে নির্ধারিত হবে তার দাম ও বিপণন। ফলে, কর্পোরেটদের ধার্য করা দামে চাষিরা তাদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে। চাষিদের কাছ থেকে কম দামে কিনে চড়া দামে বাজারে বিক্রি করবে সেই সমস্ত কর্পোরেট সংস্থাগুলো। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বজায় থাকবে বলে খোদ প্রধানমন্ত্রী যে প্রচার চালাচ্ছেন তা নির্জলা মিথ্যাচার। মনে রাখা দরকার, এই সরকারেরই গঠিত শান্তা কুমার কমিটি জানিয়েছে, মাত্র ৬ শতাংশ চাষি এমএসপি'র (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য) সুবিধা পেয়ে থাকেন। এই কমিটির সুপারিশ হল, এফসিআই, নাফেড শস্য সংগ্রহ করা বন্ধ করে দিক, গণ বন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যশস্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হোক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২০-র আর্থিক সমীক্ষা প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে যারা যারা পড়েন, সেই সংখ্যাটা ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক, কারণ চাষিদের কাছ থেকে ফসল কিনে এফসিআই'কে দেওয়ার মতো গ্যাঁটের টাকা নাকি সরকারের নেই। এইভাবে আগামী দিনে খাদ্য সুরক্ষার উপরও বড় আঘাত নেমে এল। 

চাষিদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা, এই নতুন আইন বলে এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটি বা এপিএমসি মান্ডির বাইরে গিয়ে তৈরি হবে নতুন এক বাজার। ফলে, মান্ডির পরিসরে এখন যে কৃষি বাজারটি রয়েছে, সেখানে আর খরিদ্দার খুঁজে পাওয়া যাবে না। মান্ডির বাইরে কোনওরকম ফি বা সেস বা লেভি না দিয়ে কোম্পানির এজেন্টরা ফসল কেনার অধিকার পাবে। এইভাবে মোদী সরকার কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে তোফা দিল। ছোট চাষিরা কর্পোরেট সংস্থার সাথে লেনদেন করতে গিয়ে ঠকবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারবেন না। মান্ডি বা গ্রামীণ হাটে ফসল বিক্রি করলে চাষিদের সম্মিলিত ভাবে দরকষাকষির একটা ক্ষমতা থাকত। এখন সে সব তুলে দিয়ে কর্পোরেটদের অবাধ লুঠের রাস্তা পরিষ্কার করা হল। মান্ডি বা বাজারগুলোকে ধাপে ধাপে অকার্যকরী করে দেওয়া হলে চাষিরা আর ফসলের সহায়ক মূল্য পাবে না। এমএসপি'কে কঠোরভাবে কার্যকর না করার নেপথ্যে এটাই কেন্দ্রের চক্রান্ত। 

নতুন 'ট্রেড এরিয়া' বা বাজারে যেহেতু থাকবে না কোনও সেস, ফি বা লেভি, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের মান্ডিগুলো থেকে রাজ্যগুলো এতদিন যে লেভি আদায় করত (যেমন পঞ্জাবই আদায় করত সমস্ত লেনদেনের পেছনে ৮.৫ শতাংশ), তাও হাতছাড়া হবে। এতদিন সংবিধানে কৃষি ছিল রাজ্য তালিকাভুক্ত। কৃষিকে কেন্দ্রীয় সরকার এবার নিজের কুক্ষিগত করে তুলে দেবে বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে। শুরু হবে নতুন এক কোম্পানি রাজ। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২২ জুলাই মোদীর ভাষণে। মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছে দেওয়া সেই ভাষণে সেদিন মোদী কৃষির এই অধ্যাদেশ সম্পর্কে জানান যে এরপর তারা ভারতে নির্দ্বিধায় কৃষি ক্ষেত্রে অবাধে বিনিয়োগ করার সুযোগ-সুবিধা পাবেন!        

মোদীর জমানায় কৃষকদের ঋণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে কাঁচামালের দাম। এবং সেচের জন্য যন্ত্রপাতিতে যা একান্ত প্রয়োজন, যেমন বিদ্যুৎ ও ডিজেল, তার দামও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেড়ে চলেছে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, প্রতি দু' ঘন্টায় একজন কৃষক বাধ্য হয়ে বেছে নিচ্ছেন ওই চরম পথ। ভারতের অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে, জিডিপি বৃদ্ধির হারের যে সরকারি পরিসংখ্যান (-২৪ শতাংশ) দেখানো হচ্ছে তাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ধরা হয়নি। প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন বলেছেন, জিডিপি'র সংকোচন হয়েছে ৩২ শতাংশ। কৃষি ক্ষেত্রে যেটুকু বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছিল তাও এবার সংকটের  আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। 

একের পর এক কেন্দ্রীয় আইন হরণ করে নিচ্ছে রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতা। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও- যিনি মোদীর কাছের মানুষ বলে পরিচিত- সোচ্চার হয়েছেন বিদ্যুৎ বিলের মাধ্যমে রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পদক্ষেপে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণাকে বিপন্ন করে সমস্ত ক্ষমতার চরম কেন্দ্রীকরণের ভারতীয় ফ্যাসিবাদী মডেল ক্রমেই তার আসল স্বরূপ নিয়ে সামনে আসছে। যেখানে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক স্তম্ভটি সর্বোচ্চ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আইনসভা-বিচারব্যবস্থাকে তার অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। 

এর মধ্যেও দেখা গেল নতুন এক দিক। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মোদী ৭০ বছরে পা দিলেন। বলিউডের নক্ষত্রখচিত সেলিব্রিটিরা ভক্তকুলের সাথে #হ্যাপিবার্থডে দিয়ে রাজাধিরাজকে ট্যুইটারে যতই অভিনন্দিত করুক না কেন, #ন্যাশনালআনএমপ্লয়মেন্টডে আগের ট্যুইটকে অনেক পেছনে ফেলে এক নম্বর ও বিশ্ব জুড়ে দু' নম্বর ট্রেন্ডিং হয়ে উঠল। আরও একটা জন্মদিনের উপহার অপেক্ষা করছিল মোদীর জন্য। সেদিনই এনডিএ'তে আরও একটি ফাটল ধরল। সবচেয়ে পুরাতন শরিক অকালি দল'এর হরসিমরত কউর বাদল, যিনি ছিলেন মোদীর মন্ত্রীসভার খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী, পদত্যাগ করলেন। অকালি দল হুমকি দিয়ে রাখল, এনডিএ থেকে বিচ্ছেদ ঘটানোটা এখন সময়ের অপেক্ষা।     

ভারতীয় কৃষি আবার উঠে এল দেশের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায়। কৃষি সংকট আবার হয়ে উঠেছে আলাপ আলোচনার বিষয়। 

 

Saturday, 19 September 2020

বিস্মৃতির অতলে

 সমাজ মাধ্যমের গোলকধাঁধায়

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে ‘The Social Dilemma’ বলে একটি দেড় ঘন্টার তথ্যচিত্র প্রভূত সাড়া ফেলেছে। বহুদিন পর এত লম্বা কোনও তথ্যচিত্র হামলে পড়ে বিশ্ব জুড়ে নানান ধরনের মানুষ দেখেছে। টান টান হয়ে দেখার মতো এ ছবি, যেখানে অদৃশ্য এক কঠিন নাগপাশে বাঁধা পড়ে যাওয়া মানুষ দেখছে তার বন্দীত্বের সকরুণ অসহায়তা ও চরম বিপন্নতা। দৈত্যপুরীর মায়ালোকে রূপ-মোহের গন্ধে পথ হারানো মানুষ যেন অবলোকন করছে তার তলিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়ার নেশাতুর দৃশ্যান্তর। যেখানে সে এক পণ্যমাত্র, যাকে উপস্থিত ও কাটাছেঁড়া করে গড়ে উঠছে এক অপার মুনাফা-লোভী, স্বার্থগন্ধী ভার্চুয়াল-সাম্রাজ্য। হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়া বা ‘সমাজ মাধ্যম’ নিয়ে এই তথ্যচিত্রটি উন্মোচন করেছে আমার-আপনার বিলীন হয়ে যাওয়ার সেই গল্পগাথা। তা কেমন, বুঝতে, জানতে তথ্যচিত্রটি দেখে নিতে হবে। আর এ নিয়ে আমিও নানা ভাবে, নানা স্থানে বলে বা লিখে চলেছি। তাই এ ছবি দেখে মনটাও অস্থির হল এই ভেবে যে, আরও অনেকে এ বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন এবং আজকের সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ‘সমাজ মাধ্যম’এর খেলাঘর যে আধুনিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির অন্যতম কাণ্ডারী তা আরও বহুজনের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।   

বলাই বাহুল্য, ‘সমাজ মাধ্যম’এর সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের এই উন্মত্ত যোগাযোগ আজ এক অভাবিত মাত্রায় পৌঁছে গেছে। এক নতুন ভুবন নির্মাণের দিকে তার দ্রুত এগিয়ে চলা। তাই, এই সংযোগের ব্যাপ্তিকে আগে সম্যক ভাবে বোঝা দরকার। মানুষের কী বিপুল সময় এই ‘সমাজ মাধ্যম’এ ব্যয়িত হয় তা এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক। সম্প্রতি একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রতি মিনিটে ‘সমাজ মাধ্যম’এর বিবিধ পরিসরে মানুষ কত সময় ব্যয় করে। যেমন,

প্রতি মিনিটে, 

৪৪.৯৭ লক্ষের বেশি গুগল সার্চ হয়ে চলেছে;

৪৫ লক্ষেরও বেশি ইউটিউব ভিডিও দেখা হয়;

৫ লক্ষের ওপর ট্যুইট হয়;

১৮ কোটির ওপর ইমেল পাঠানো হয়;

৬.৯৪ লক্ষ ভিডিও স্ট্রিমিং হয় নেটফ্লিক্সে;

৩.৯ লক্ষ অ্যাপস ডাউনলোড হয়

এবং আরও বহু কিছু।

বোঝাই যাচ্ছে, এমন এক অসীমলোকের নাগাল পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! আর একে উপেক্ষা করে পুরনো রাজনীতি-অর্থনীতির কথা আওড়ে চলে কোন সাবেকি জনে? তারা দক্ষিণ বা বাম, যে কোনও ধারাপাতেরই হোক না কেন, রাজনৈতিক-অর্থনীতির নতুন পাঠ না হলে লবডঙ্কা! কোভিড পরিস্থিতি এই ভার্চুয়াল ব্রহ্মাণ্ডকে আরও বৃহৎ ও অবশ্যম্ভাবী করেছে। ‘ভূলোক ছেদিয়া’ এই সর্বগ্রাসী উত্থান ঘিরে ফেলেছে মানবজাতি ও তার সমগ্র কর্মকাণ্ডকে। এই অসীম সাগর মানুষকে আড়াল দিয়েছে, তার নিজের মায়ালোক গড়ে তোলারও অবকাশ দিয়েছে, কিন্তু বিনিময়ে আদায় করে নিয়েছে তার সমগ্র অস্তিত্বের বয়ান। তাই মানুষও এই মায়াজগতে জড়িয়ে পড়ে নিজের সর্বস্ব উজাড় করেছে। সে অর্থে নিজেকেও চিনেছে। বলা ভালো, ‘সমাজ মাধ্যম’কে নিজের সখা ভেবে মনের আপন কথাগুলোকে উন্মুক্ত করে আরাম পেতে চেয়েছে। আর সেভাবেই এক নতুন আত্মঘাতী ও একই সঙ্গে পরঘাতী সত্তায় তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।

একজন বাস্তব মানুষ, চারপাশে যখন হাঁটছে, কথা বলছে, মিশছে, মতামত জানাচ্ছে, তখন সে একরকম; আবার সেই মানুষটিই যখন ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পরিব্যাপ্ত তখন সে অন্য কোনও জন। যেমন, হঠাৎ করে কেউ যখন নিজের অতি পরিচিত পরিসর ছেড়ে পাড়ি দেয় কোনও অজানা, অস্থায়ী, মুক্ত ভূমিতে। সে যা নয়, অথবা সে যা হতে চায়, কিংবা সে যা প্রত্যক্ষ করে চারপাশে- সেইসব অভিঘাতে তার যাপনের মোড় ঘুরতে থাকে এক অনালোকিত, অনাস্বাদিত দিকচক্রবালে। এক বাস্তব, শরীরী মানুষের বিপ্রতীপে তার ছায়া দিয়ে গড়া যে ভার্চুয়াল মানুষ জন্ম নেয়, তার আবার নতুন করে বেড়ে ওঠা থাকে, নতুন অবয়ব ও বিশ্বাসে সে ধরা দিতে চায়, অথবা বলা যাক, তার অকথিত বিশ্বাস ও বাচন নিয়ে, তার কিছুটা গোপন ‘অপর’কে নিয়ে সে আরেক মানুষের পরিচয়ে উদ্ভাসিত হতে চায়। আর যে স্বভাব-লাজুক, তার তো বাঁধন ছেঁড়ার আকুলতা আরও প্রবল। এইভাবে আসলে দেখা যায়, তার দুটি সত্তা, সে একই সময়ে দুটি চৈতন্যলোকে বিরাজ করে।

এই বিভাজন সমাজকে তীব্র দ্বন্দ্বে আড়াআড়ি ভাবে দু-টুকরো করে দিচ্ছে। শরীরী মানুষটি ক্রমান্বয়ে আরও প্রান্তিক ও কোণঠাসা হয়ে তার নিজের ভার্চুয়াল সত্তার কাছে বিকিয়ে যাচ্ছে। অথবা এইভাবেও বলা যায়, সামাজিক, সংশয়াদীর্ণ ও অপ্রকট মানুষটি ক্রমেই তার ভার্চুয়াল সত্তায় হয়ে উঠছে অহংসম্পন্ন, কতকটা আক্রমণমুখি ও প্রায় পূর্ণ প্রকটিত এক নতুন মানুষ, যেখানে তার হাতের আঙ্গুলের সামান্য কারসাজিতে ওলটপালট হয়ে যেতে পারে তার জানা যাবতীয় পরিসর ও পরিজন। এ যেন এক যুদ্ধ যুদ্ধ আয়োজন, যেখানে ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ হল নিতান্তই আঙ্গুলের এক মামুলি খেলামাত্র। ‘সমাজ মাধ্যম’ না এলে আমরা এক-মানুষের এই দ্বিতীয় পরিচয়টি সেভাবে জানতেই পারতাম না। কখনও কখনও কবি-লেখকেরা সে মানুষের দ্বিতীয় কি তৃতীয় সত্তা খুঁজে পেয়েছেন, সে অন্য কথা। কিন্তু একজন ব্যক্তি নিজেকেই দেখতে পাচ্ছেন আরেক রূপে, সে কম্মটি ‘সমাজ মাধ্যম’ না এলে হয়তো অধরাই থেকে যেত।

এখন প্রশ্ন হল, এই নব-নির্মিত মানুষটি কে? সে কি তার নিজেরই অন্তঃসত্তা, নাকি সমাজ-অর্থনীতি নির্মিত এক সামাজিক-অর্থনৈতিক মানুষ? ঠিক যেমনটি চাওয়া হচ্ছে। কে চাইছে? যে এই গোটা কর্মকাণ্ডটিকে নিপুণ প্রকৌশলে চালনা করছে: এক অপরিমেয় প্রাযুক্তিক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, গোড়া থেকেই যে যন্ত্র-নির্ভরশীল ও যন্ত্রের ক্রমউন্নত মন্ত্রেই যার মূলগত অভিযোজন। সেই যন্ত্রের অভিমুখ যে এমন এক ছায়া-দুনিয়ায় এসে পৌঁছবে তার নির্দিষ্ট রূপ সম্পর্কে নিশ্চয়ই স্পষ্ট ধারণা কারওরই ছিল না। উপরন্তু, সেই ছায়া-দুনিয়া (বা ভার্চুয়াল পরিসর) যে এক বাস্তব কর্মজগৎ হয়ে উঠতে পারে, তেমন ধারণা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও খুব জোরালো ভাবে করা যেত কী? মহামতী কেইনস’ও তাঁর জীবৎকালের প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশকে অনুমান করতে পারেননি বলে কবুল করেছেন। অথচ, সেই বাস্তব ভার্চুয়াল জগৎ যখন দেখা দিল, শুধু দেখা দিল নয়, সৃজনে, কর্মে, ফলাফলে এক অতুলনীয় রত্নগর্ভাও হয়ে উঠল, তখন তো টনক নড়ারই পালা। কিন্তু, তার সঙ্গে আরও এক কীর্তি সে রেখে গেল। সে ছাড়া তার উপায় ছিল না! কারণ, সেই কর্মভুবনে কাজ করবে কে? সাবেকি অফিসে, আদালতে, কারখানায়, মাঠেঘাটে এতদিনের কাজ করা সেই পুরনো মানুষগুলোই কী? নৈব নৈব চ! চাই নতুন ভার্চুয়াল মানুষ। শারীরিক কিছু ক্রিয়াবৃত্তি (খাওয়া, ঘুম ইত্যাদি) বাদে যার যাপন পড়ে থাকে ভার্চুয়াল দুনিয়ার প্রসারিত গহ্বরে। নিত্য কাজের বাইরে যেখানে তার চাই তেমনই এক ভার্চুয়াল সমাজ, বিনোদন ও অন্যান্য জাগতিক সুখ। অতএব, ‘সমাজ মাধ্যম’, অনলাইন যাপন বা আর যা কিছু সহ ভার্চুয়াল সুখের নিপাট আয়োজন। এই আয়োজনে হারিয়ে যাওয়া ও ফিরে আসা, দুইই তাই অবধারিত। কিন্তু যে ফিরে এল এবং টিকে গেল, সে এক নতুন অবয়ব, অন্যভাবে বললে, নতুন ভার্চুয়াল-মানব।

‘সমাজ মাধ্যম’ নির্মিত এই নতুন ভার্চুয়াল-মানব ও তার যাবতীয় অস্তিত্বের বয়ানকে ভিত্তি করেই আজকের অর্থনীতি ও রাজনীতির পথ চলা। মানব চেতনকে ছাপিয়ে উঠছে অ্যালগরিদমের যুক্তিনিষ্ঠা, ব্যক্তির চিন্তাসূত্রকে ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ডাটা অ্যানালিটিক্স’এর গভীর আঙ্কিক বিন্যাস, আমার-আপনার স্বজাত পছন্দের নানা অভ্যাসকে মাড়িয়ে দিয়ে হাজির হচ্ছে মেশিন লার্নিং নির্গত কোনও ‘আপনার’-চয়ন। আপনার চৈতন্য কার্যত পরাজিত হচ্ছে যন্ত্রের অ্যালগরিদমের কাছে। ক্রমেই আমরা চিরায়ত ভূ-রাজনৈতিক-সামরিক ব্যবস্থা থেকে এক ভার্চুয়াল-তথ্যকেন্দ্রিক-প্রাযুক্তিক ব্যবস্থাপনার দিকে চলেছি। এই যাত্রাপথ অতীব জটিল, এক সূক্ষ্মতর রূপান্তর ও মানব চৈতন্যের সঙ্গে যান্ত্রিক অ্যালগরিদমের বৌদ্ধিক লড়াই। একে তথ্য যুগ না বলে, কেউ কেউ বলছেন, মিথ্যা ও গুজবের যুগ। কিন্তু, এই এখন রাজনৈতিক-অর্থনীতির মূল বয়ান।

শুরু হচ্ছে আইপিএল। মহামারি বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কাজ হারানো কোটি কোটি মানুষের অসহায় যাপনের ওপরেই বাঁধা হচ্ছে উল্লাস-মঞ্চ। উপচে পড়তে চলেছে অনলাইন ফ্যান্টাসি গেমিং’এর বাজার। অনুমান, এবারের আইপিএল’এ এই বাজার গিয়ে দাঁড়াবে ৭০০০ থেকে ১০,০০০ কোটি টাকার মূল্যে। ফুলে ফেঁপে উঠছে সিলিকন ভ্যালি’র কতিপয় সংস্থা। মূর্তিমান Surveillance Capitalism’এর জাঁতাকলে অসহায়, নিঃস্ব, বিধ্বস্ত মানুষ কোন নতুন চৈতন্যের আলোকে নিজেকে পুনঃআবিষ্কার করতে পারে, তাই এখন দেখার। 

  

Sunday, 13 September 2020

'বামপন্থী'দের তল্লাশে!

 শব্দকল্পদ্রুম অথবা লক্ষ্যভেদ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

এক অভূতপূর্ব মহামারি, বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ভার্চুয়াল দুনিয়া- এই ত্র্যহস্পর্শে ভারতবাসীর এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। মহামারিটা আচম্বিত ছিল (যদিও এর উত্তরোত্তর বাড়বৃদ্ধিতে আজ যে অসহনীয় অবস্থা তার দায় প্রায় সম্পূর্ণতই শাসকশ্রেণির; কারণ, থালাবাটি বাজিয়ে তো আর সুরাহা হয় না), কিন্তু অর্থনীতির ভগ্নদশা ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার সর্পিল আগ্রাসন নতুন কিছু ছিল না, অন্তত গত পাঁচ–সাত বছরের হিসেবে। যদিও তার আগে বিশ্ব অর্থনীতির এক বেসুরো সজোরে ধাক্কা খাওয়া ছিল, যা ততটা আঁচ করা যায়নি: সাব-প্রাইম ক্রাইসিস। আর তাতেই বিশ্বায়নের ললিপপ যেন কতকটা তেতো হয়ে গেল, চাচা আপন ঘর বাঁচামন্ত্রেই বহুজনে সায় দিল।

অতএব, ২০১০ সালের পর থেকে দেশে দেশে সময়ের অবগাহনে উগ্র জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, ধর্মবাদী, জাতিবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি নানা ধরনের তথাকথিত রক্ষণশীল শক্তিগুলি একজোট হয়ে গেল, নিজেদের প্রাসঙ্গিকতাকে সাব্যস্ত করে জনপ্রিয়তা পেল ও স্বভাবতই ক্ষমতায় চড়তে থাকল। সেইদিক থেকে বিচার করলে, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইউকে প্রভৃতি বহু দেশে সংকীর্ণ, উদারতা-বিরোধী শক্তি ক্ষমতার বলয়ে আসীন হল। পিছু হঠল তথাকথিত উদারবাদী ও বিশ্বায়নপন্থী শক্তিগুলি। অবশ্য তা বলে এ ভাবার কোনও কারণ নেই যে উদারবাদী ও রক্ষণশীল শক্তিগুলির মধ্যে অর্থনীতির বিশ্বায়ন নিয়ে কোনও বড়সড় মতপার্থক্য আছে। ফারাকটা মাত্রায় এবং অর্থনীতির সঙ্গে জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে যুক্ত করার প্রশ্নে। আর অর্থনীতি ব্যতিরেকেও রাজনৈতিক দলগুলি ও তাদের নেতাদের তো ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনাও থাকে! তাই, অর্থনীতি সহ সমাজের আর সব সমস্যাকে মোকাবিলা করার কৌশলে এইসব দলগুলির মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার নানারকম গোপন ও প্রকাশ্য অ্যাজেন্ডাও থাকে। যেমন, যখন এ দেশে দিল্লির দাঙ্গার জন্য শুধু জেএনইউ বা জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের বেছে বেছে ধরা হয়, দাঙ্গার মূল প্ররোচনাকারী কপিল মিশ্র’র বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করা হয় না, অথবা, ও দেশে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল গণ জমায়েতে সমবেত মানুষদের ‘লুঠেরা’ বলে অভিহিত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের গুলি করে মারার কথা বলেন, তখন বোঝা যায় এইসব শক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্যটা। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে আগের সরকারগুলি সব সময় মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভের প্রতি ঔচিত্য দেখিয়েছে বা তাদের ওপর কোনও দমন-পীড়ন নামায়নি। কিন্তু আজকের রক্ষণশীল শক্তির প্রয়োগ-কৌশল আরও নির্মম। তাদের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যই হল, জনতার মধ্যে বর্ণ, ধর্ম, জাতি, জাতপাত, লিঙ্গ- এইসব বিবিধ বিভিন্নতার নিরিখে তাদের ভাগ করে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া এবং গোষ্ঠী-সংখ্যা অনুপাতে এমন এক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভাষ্য নির্মাণ করা যা তাদের পুনর্বার ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করে। তার সঙ্গে প্রচুর অর্থ ঢেলে সোশ্যাল মিডিয়া বাহিনী দিয়ে ঘৃণা উদ্রেককারী বয়ান নির্মাণ ও বিরুদ্ধপক্ষকে ট্রোলিং তো আছেই, আর এই বাবদে জনতার মধ্যে লাগিয়ে দেওয়া রেষারেষিতে কর্পোরেট পুঁজির পোয়াবারো ও ফলত তাদের পূর্ণ মদতও নিশ্চিত।

তাই, গোটা সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে আজ পর্যন্ত যখন করোনার দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুতে ভারত বিশ্বে প্রথম স্থানে উপনীত, সর্বমোট হিসেবে ব্রাজিলকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে আপাত স্থিত (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র), উপরন্তু, জিডিপি’র বৃদ্ধির হার (-)২৩.৯ শতাংশে ভয়াবহ ভাবে নিম্নমুখি, তখন এক অভিনেতার মৃত্যুকে ঘিরে যে কুনাট্যের নির্মাণ ও রঙ্গ-রসিকতা, তাকে নির্মমতার পরিহাস ভিন্ন আর কী বলা যেতে পারে!

এই সামগ্রিক আবহে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ কীভাবে পুনর্জন্ম নিতে পারে, চরম বিষবাষ্পে আবৃত সমাজ কীভাবে তার স্বাভাবিকত্ব ফিরে পাবে, তা এক অমূল্য প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় কথা, এক সময়ে অর্থনৈতিক যাপনকে অক্ষে রেখে সমাজের সর্বস্তরের গরিব ও শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে নানা অর্থে সমাজ বদলের যে রাজনীতি বিশ্ব জুড়ে তুমুল আলোড়ন ফেলেছিল (যার বহু সুফল আমরা পেয়েছি, যেমন, বহু জায়গায় চালু হওয়া সমাজ-সুরক্ষা নীতি, আট ঘন্টা কাজের রীতি), তার নেতৃত্বকারী শক্তিগুলি (কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, বামপন্থী, প্রজাতন্ত্রী, ক্রান্তিকারী ইত্যাকার মতাদর্শগুলি) আজ কানাগলিতে পড়ে বর্তমান অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তুলেছে। গত ৫০ বছরে অর্থনীতিতে যে ধীর ক্রমপরিবর্তন, তাকে অনুধাবন না করে উঠতে পারার মধ্যেই তাদের ব্যর্থতার বীজ লুকিয়ে আছে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে দেখা যাচ্ছে, তারা কার্যত অপ্রাসঙ্গিক ও বাতিলের দলে পড়ে গেছে। যদিও বিক্ষিপ্ত ঘটনাপ্রবাহে মনে হতে পারে, এদের অস্তিত্ব ও প্রভাব এখনও ততটা মলিন নয়, কিন্তু সামগ্রিক পট-পরিবর্তনে দেখাই যাচ্ছে, এরা অনেকটাই প্রান্তিক শক্তি আজ। অথচ এই শক্তি যদি আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অর্থনীতির পটবদলকে অনুধাবন করে নিজেদের প্রাসঙ্গিক অর্থে পুনঃসংগঠিত না করতে পারে, তাহলে জনতার মধ্যে বর্ণ, ধর্ম, জাতি নিয়ে যে চলমান বিভেদের রাজনীতি তার থেকে উত্থিত ভয়ঙ্কর শক্তি সমাজ ও অর্থনীতিকে ছারখার করে দেবে।

কিন্তু মুশকিল হল, উক্ত শ্রমজীবী মতাদর্শ ও মত-পথগুলি (বোঝার সুবিধের জন্য যদি গোটা পরিমণ্ডলটাকে ‘বামপন্থী’ বলে চিহ্নিত করি) বহুদিন যাবৎ উদারবাদীদের গোলকধাঁধায় পড়ে বিভ্রান্ত ও ক্ষয়িষ্ণু। সমাজের মূল শ্রমজীবী শ্রেণির স্বার্থরক্ষার রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে এদের অনেকেই উদারবাদের পৃষ্টপোষকতায় ও আয়েসে কিছু ছাত্র-যুব, কতিপয় মধ্যবিত্ত, বিভিন্ন এনজিও এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির গবেষক ও অধ্যাপককুলের লেখালিখি, সেমিনার, বিদেশে কনফারেন্স ও অ-অর্থনৈতিক ইস্যু’র অনুশীলন-বৃত্তে নিমগ্ন থেকেছে। তবে মেহনতী মানুষের মধ্যেও অনেকের কাজ আছে, কিন্তু তার প্রভাব আজ আর তেমন ব্যাপক বা প্রসারিত নয়। উপরন্তু, এদের মধ্যকার দলাদলি ও খেয়োখেয়িও কম দস্তুর নয়। এমতাবস্থায় বলাই যায়, বৃহৎ বামপন্থী-সমাজতন্ত্রী পরিমণ্ডলটি একপ্রকার বিধ্বস্ত, কুক্ষিগত ও কূপমণ্ডুকতায় আক্রান্ত। তা আরও বোঝা গেল, গোড়ায় করোনা-আক্রান্ত ইউরোপের বিধ্বংসী রূপ দেখে এদের অনেকেই পুঁজিবাদের অন্তিম দশার কথা উচ্চকিত ভাবে বলতে শুরু করেছিল- যেন ভগবান অবশেষে মাথা তুলে চেয়েছেন, পুঁজিবাদ এই নিকেশ হল বলে! আর কুক্ষিগত তো বহুকাল আগেই হয়ে গেছে, যখন বামপন্থার মন্থন আর শ্রমিক বস্তিতে বা গরিব কৃষকের গ্রামে নয়, হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অথবা অভিজাত কফি শপে। বামপন্থা আজ লিবারেলিজম বা উদারবাদের পোশাক পরে নিয়েছে; তাদের কাছে শ্রেণি বা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন অথবা শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের মৌলিক অনুশীলন থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ধর্ম-নিরপেক্ষতা, জাতপাতের রাজনীতি, নারীবাদ অথবা শিক্ষা সংস্কার।

আসলে, ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ যে রাষ্ট্রের তরফে সব ধর্মকে তা’ দেওয়া নয়, সমস্ত ধর্ম থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, সে রাজনীতিকে তারা ধরে রাখতে পারেনি। জাতপাত বিভাজনের বিভীষিকাকে মুছতে বছরের পর বছর সরকারি সংরক্ষণ, আরও বেশি সংরক্ষণ যে পথ নয়, বরং গরিব জনতার জন্য সামাজিক সুরক্ষার দাবিতেই মুখর হওয়া কাম্য, তা তারা বিস্মৃত হয়েছে। দেখাই গেছে, সরকারি সংরক্ষণের পরিসর সমাজে এতই ক্ষুদ্র যে সেখানে সংরক্ষণের কোটা বাড়িয়েও অবস্থার গুণগত কোনও হেরফের গত ৭১ বছরেও হয়নি। বরং, জাতপাতের বিভাজন আরও প্রকট হয়েছে। নারীর অবদমন যে নিছক নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বের মধ্যে অবস্থিত নয়, নারীর মুক্তির মৌলিকতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় ব্যাপ্ত, সে প্রস্তাব তাদের কাছে থাকলেও তাকে তারা হেলায় হারিয়েছে। উল্টে, অতি-নারীবাদের পাল্লায় পড়ে নারী-পুরুষ বিভাজনের বাতাবরণকেই তারা মান্যতা দিয়েছে। শিক্ষার পেশাগত তাগিদে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সমাজবিজ্ঞানের সম্মেলন কক্ষে পেপার থেকে পেপারে ঘুরে কেরিয়ারের পথ বেয়ে তত্ত্বের প্রকোষ্ঠে বর্গ নির্মাণের যে তাড়না, তাকেই উপাদেয় ও সার ভেবে আলেয়ার পিছনে ছুটে বামপন্থীরা বাস্তবের পথ হারিয়েছে। পোস্ট-স্ট্রাকচারিলিজম থেকে পোস্ট-মডার্নিজম ঘেঁটে, সাব-অল্টার্ন হয়ে পোস্ট-ট্রুথে এসে দেখা গেল, আসলে সবটাই শব্দকল্পদ্রুম।

অর্থাৎ, অনেক আগেই উদারবাদের কাছে পরাজিত বামপন্থীদের চিন্তার বিন্দুগুলি একাডেমিক-ঘেটোতে গিয়ে ঠাই নিয়েছে। সে চিন্তা থেকেই বামপন্থী দলের সরকারও ‘পুঁজিবাদ বিকাশের’ ‘ঐতিহাসিক’ দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে দ্বিধা বোধ করে না। আজকের ভয়ানক রক্ষণশীলদের পরাজয়ও তাই উদারবাদের রাজনীতি দিয়েই তারা সারতে চায়। কিন্তু উদারবাদ ও রক্ষণশীলতা, অথবা সহজ করে বললে, কংগ্রেস বনাম বিজেপি যে আদতে তেমন কোনও জলবিভাজিকা নয়, ইউপিএ আমলেও বহু কালা-কানুন জারি হয়েছে, গণতন্ত্র লঙ্ঘিত হয়েছে, বামপন্থীরাও এক সময়ে কংগ্রেস সরকারকে আধা-ফ্যাসিস্ট বলেছে, তেমন নজির তো বেশি পুরনো কিছু নয়।

তাই, একুশ শতকের দুটি দশক পার করে বিপন্ন বামপন্থীদের আজ আবার নতুন করে রাজনৈতিক অর্থনীতিকে পুনঃআবিষ্কার করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিষেকে আজ অর্থনীতি ও রাজনীতির যে বাঁকবদল, পুরনো সত্তাগুলি ভেঙ্গে গিয়ে নতুন যে পরিসরের নির্মাণ ও নানা আঙ্গিকে শ্রমজীবী মানুষের উত্থান, তাকে অনুধাবন করেই শ্রেণি-দ্বন্দ্বের উদ্ভুত বাস্তবতাকে লড়াইয়ের ময়দানে নিয়ে আসতে হবে। না হলে উদারবাদ ও রক্ষণশীলদের ‘কাম-অন-ফাইট’এ বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রীরা সমাজে উলুখাগড়া আর ‘বোদ্ধাজনের’ সেমিনারে সুবক্তা হয়েই থেকে যাবে।          

Saturday, 12 September 2020

থোড়বড়ি খাড়া

 চুপ থাকুন!

 সিদ্ধার্থ  বসু

এটা বেশ ভালো ব্যবস্থা: এক এক সরকার আসবে তাদের স্বরূপ জনগণ আগে বুঝতে পারবে না।  কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বশক্তিমান জনগণের ইচ্ছের নাকি প্রকাশ ঘটে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। নির্বাচনের আগে তাদের নানা ভাবে প্রলুব্ধ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক  দল। তাদের সেইসব ভালো ভালো কথায় ভুলে এবং এরা এলে সত্যিই নতুন কিছু হবে ভেবে মানুষ ভোট দেয়। এর মধ্যেও প্রশ্ন থেকে যায়, যদি অবশ্য প্রকৃত অর্থে ভোট হয়! নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যি সত্যিই কি জনমত প্রকৃত অর্থে প্রতিফলিত হয়? 

প্রশ্নটা সম্ভবত সেখানে নয়। প্রশ্নটা, যে নির্বাচনই হোক না কেন, তা পঞ্চায়েত কি পৌরসভা কি বিধানসভা বা লোকসভা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাসক ও বিরোধী পক্ষ সকলেই জনগণের সেবা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় জনগণ তাদের কথা বিশ্বাস করে এবং ভোট দেয় তাদের মনোমত দলের প্রার্থীকে। তারপর যদি সেই দল নির্বাচনে জেতে এবং ঘোড়া কেনাবেচার খেলা পেরিয়ে ক্ষমতাসীন হয়, তখন সে দলের একের পর এক জনবিরোধী কাজের ফলে অচিরই জনগণের মোহভঙ্গ হয়। ক্রমশ তারা বুঝতে পারে, যে দলকে ভালোবেসে ভোট দিয়ে ক্ষমতাসীন করেছে সে দল তাদের ঠকিয়েছে। 

কীভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত দল সরকারে এলে প্রতারণা করে?  ধরা যাক, দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে ছিল, বছরে এত কোটি বেকার যুবক ও যুবতীদের কর্মসংস্থান করা হবে। এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রেখে যুবসমাজ নেমে পড়ে ভোটের ময়দানে তাদের স্বপ্ন দেখানো দলটিকে জেতাতে। এইভাবে বিপুল সংখ্যক বেকারদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়; শুধু তাই নয়, ক্ষমতাও কায়েম রাখে। বিরোধী ও প্রতিবাদী স্বর যেন মাথা চাড়া না দেয় সেদিকেও নজর রাখে এরা। তার বিনিময়ে সেই যুবদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না দিয়ে সামান্য কিছু সুবিধে পাইয়ে দেওয়া ও নেশার জোগান থেকে খুল্লমখুল্লা এলাকা কাঁপানোর অলিখিত ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এটা ততক্ষণই দেওয়া হয় যতক্ষণ সে দলে অনুগত থাকে। যদি কখনও তার কন্ঠস্বরে বিরোধী সুর শোনা যায় অথবা নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের দাবি জানায় তখন কিন্তু ঐ দলই তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। 

কীভাবে এই শিক্ষিত বেকারদের দল কাজে লাগায় তার একটি উদাহরণ হিসেবে স্মরণ করা যায় এ রাজ্যের গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় সারা রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ভোট নিয়ে যে হিংসার প্রকাশ রাজ্যবাসী দেখেছিল। এক কথায়, তুলনাহীন। নদিয়া জেলার মাজদিয়া অঞ্চলে গণনার দিনও ছাপ্পা চলে। মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ তা প্রত্যক্ষ করে। এখানে সেই যুবকদেরই ব্যবহার করা হয়। আর শান্তিপুর অঞ্চলে বুথ দখল করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে যিনি প্রাণ হারান তিনি ছিলেন এমএ পাশ করা এক শিক্ষিত যুবক। গ্রামবাসীরা ওই বুথ দখলকারীদের বাইকও জ্বালিয়ে দেয়। বাঁশবাগানে পড়ে থাকা সেই পোড়া বাইকও মিডিয়ার দৌলতে সবাই প্রত্যক্ষ করে। কেন ওই শিক্ষিত যুবক বুথ দখলের মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হলেন? কারণ হিসেবে জানা যায়, চাকরি পাবেন এই আশায় নাকি দলের হয়ে এই কাজ করতে গিয়েছিলেন। যদিও স্বাভাবিকভাবেই দলীয় নেতারা এই কথা মানতে রাজী হননি। কিন্তু এটা সত্যি যে শিক্ষিত কর্মহীন ওই যুবক প্রাণ হারিয়েছিলেন বুথ দখলের মতো ঘৃণ্য কাজ করতে গিয়ে।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাও শাসকের চোখে অন্যায়। তাই আনুগত্য, আনুগত্যই শাসকের পছন্দ। যদি বিরোধী দল সত্যিটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় এবং তার প্রতিকার দাবি করে তাতে সেই দল শাসকের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। কিন্তু গণতন্ত্রে এরকমটা হওয়ার কথা কী? আসলে বিরোধী আসনে থাকলে গণতন্ত্রের প্রকৃত মানে এবং তার স্বরূপ একরকম আর ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গড়লে গণতন্ত্রের মানেটা অন্যরকম হয়ে যায়। তখন যে যে দাবি নিয়ে গলার শির ফুলিয়ে গলা ফাটিয়ে তারা রাস্তা অবরোধ করেছিল, কথায় কথায় বনধ ডেকে জনজীবন অতীষ্ট করে তুলেছিল, সেই একই সমস্যা ও দাবি নিয়ে কেউ কোনও কথা বললেই ক্ষমতাসীন দল বা শাসক তাকে বা তার দলকে চিহ্নিত করে। এবং তখন প্রচার করা হয়, ওই ব্যক্তি বা দলটি রাজ্যের অথবা দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালা্চ্ছে; অতএব এদের বিরুদ্ধে প্রথমে লাগাতার প্রচার করা হয় ধামাধরা প্রচারযন্ত্র দ্বারা ও তাতে কাজ না দিলে আইনের নানান কঠিন কঠিন ধারা প্রয়োগ করা হয়। এত সব করার কারণ হিসেবে বলা হয়, এসবই দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্যে করতে হচ্ছে। 

প্রতি ভোটের আগেই জনগণ শোনে এবারের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সরল বিশ্বাসে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু তারপরই শুরু হয় নরক যন্ত্রণার। সঞ্চয়ের উপর কোপ, গ্যাসের দাম, পেট্রল, ডিজেলের দাম থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, আনাজপাতি সবজি বাজার আগুন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকার নির্বাচিত করে এটাই কি প্রাপ্তি জনগণের। এটাই যেন রেওয়াজ হয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উপায় নেই। কারণ, সরকার বাহাদুর রাগ করবেন তাই একটু সহ্য করুন এবং শুনুন সেই অমৃতবাণী যে এসবই হচ্ছে আগের সরকারের কৃতকর্মের ফল তাই সইতে থাকুন এবং আমাদের সমর্থন করুন, নচেৎ আপনি প্রতিবাদী হলে রাজরোষের শিকার হবেন।

 

Wednesday, 9 September 2020

বিজ্ঞান শিক্ষার করুণ অবস্থা!

আয়োজনের ফাঁকি

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত 

 

1938  সালে সুভাষচন্দ্র যখন কংগ্রেস সভাপতি তখন গড়া হয় জাতীয় পরিকল্পনা পর্ষদ, যার সভাপতি মনোনীত হন জওহরলাল।  তিনি যথার্থই অনুধাবন করেন যে এই দেশকে এগোতে হলে মানুষের বিজ্ঞান-মনস্কতা অত্যন্ত জরুরি। এই ধারণা নিয়ে এগোলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান চর্চা গুরুত্ব পাবার কথাই। কিন্তু তা পেল কী? সংস্থা গড়া হল অনেক, তারা নেহরুজির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবে এমন ভাবাও হল, কিন্তু কাজ হল কতটা?

INSA এমন একটি সর্বভারতীয় সংস্থা। 2005 সালে প্রথম (এবং শেষ) India Science Report তৈরি করল NCAER( National  Council for Applied  Economic Research )নামক আর এক সংস্থার সাহায্যে এবং বোঝা গেল বিজ্ঞান চর্চায় দেশ তেমন কোনও গুরুত্বই দেয়নি।* কার দোষ? কেবল রাষ্ট্রের, কেন্দ্রীয় সরকারের? তা নিশ্চয় নয়। জনতার দায় নিশ্চয়, তাদের দায় তো সবচেয়ে বেশি৷ তবু, এই স্বল্প পরিসরে তাদের আপাতত ছাড় দেওয়া যাক। (সুযোগ পেলে তা নিয়ে পরে আলোচনা  করব)। রাজ্য সরকারগুলিও দায় অস্বীকার করতে পারে কী? ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর পর রাজ্যের তালিকা থেকে সরিয়ে নিয়ে শিক্ষাকে জুড়ে দেওয়া হয় যুগ্ম তালিকায়। তারপর যা হবার তা হয়েছে, ভাগের মা যথানিয়মে গঙ্গা পান নি। কিন্তু তার আগে?  

মেঘনাদ সাহা, বিশ্বেশ্বরাইয়া, মহালনবীশ বা সত্যেন্দ্রনাথ বসুরা চেয়েছিলেন মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা, রবীন্দ্রনাথ-গান্ধী-নেহরু সহায়। সেই মতো পরিভাষা নির্মাণে মন দেওয়া হল। স্বাধীনতার পর মাতৃভাষায় পুস্তক রচনায় উৎসাহ দিতে রাজ্যে রাজ্যে পুস্তক পর্ষদও গঠিত হল। কিছু কাল পরে দেখা গেল হিন্দি ছাড়া অন্য ভাষাগুলির ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি কিছু হয়নি। এদিকে স্বাধীনতার পর দেশের কিছু রাজনৈতিক নেতার  দাবি পূরণে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন হল। সে সময় বা তার অল্প আগে ঐ রাজনৈতিক নেতারা ও তাদের কিছু অনুগামী কিঞ্চিৎ চতুরতার সঙ্গে চেষ্টা করেছিলেন হিন্দিকে রাজভাষার আসনে বসাতে। তাদের অন্যতম হাতিয়ার ছিল আদমসুমারি রিপোর্ট। গ্রাহ্যই করলেন না তারা আচার্য সুনীতিকুমারদের যুক্তি, কিন্তু অগ্রাহ্য করতে পারলেন না দক্ষিণ ভারতের প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদে ভেসে গেল 'ত্রিভাষা সূত্র'। তবে, সে সব আন্দোলন ও অন্যান্য হল্লার ফাঁকে, কৌশলে তারা হিন্দিকে এগিয়ে নিলেন, অন্য অনেক আঞ্চলিক ভাষার গলায় পা রেখে। বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে আঞ্চলিক ভাষা তার গুরুত্ব হারাতে থাকল। India Science Report থেকে স্পষ্ট হল যে বিজ্ঞান শিক্ষার মূলকেন্দ্র গড়ায় মন দেয়নি রাজ্য সরকারগুলি। কে না জানে যে বিজ্ঞান চর্চার প্রধান সুযোগ মেলে নিশ্চিতভাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায়। মানতে হবে যে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্টাইপেন্ড, স্কলারশিপ ইত্যাদি অনেকটা বেড়েছে। তবু তা বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে, এই অবৈজ্ঞানিক নানা সংস্কারে ডুবে থাকা দরিদ্র লাঞ্ছিত ভারতবর্ষে যথেষ্ট নয় (বিজ্ঞান চেতনার বিকাশের বিষয়টি বাদ দিয়েও এই কথা বলা যায়)। যে কোনও স্তরে, কেবল আসন সংখ্যার দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায় অবহেলার মাত্রা। আর সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা কোন পর্যায়ে ও কতখানি অসফল তা কিছুটা হলেও বোঝা যায়। আমলারা নেতাদের দিকে আঙুল তোলে, নেতারা বলে অর্থাভাবের কথা, কেউ  নিজ পক্ষের ব্যর্থতা মানে না!  তারা কেবল বলির পাঁঠা বা  নন্দ ঘোষ  খোঁজে। শিক্ষকদের মধ্যে সহজেই তেমন পাঁঠা বা নন্দ ঘোষ মেলে। তাই নিরক্ষরতা দূরীকরণই হোক বা বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসার, সবেতেই আমরা ব্যর্থ।

একটা অভিজ্ঞতার কথাও এই সঙ্গে বলতে চাই। সেবার শিশু কমিশনের কাজে গিয়েছি উত্তরবঙ্গের নিমতা। সেখানে চা বাগান সংলগ্ন একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হাল বুঝতে ঢুকেছি। খবর নিয়ে জানলাম, সেখানে বিজ্ঞান শাখা আছে বটে কিন্তু সে শাখায় বিদ্যার্থী প্রায় নেই। কেন এই হাল? স্কুলের লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি সবই ভালো মানের, তবু এই হাল কেন? বোঝা গেল শিক্ষক নেই, তাই! হেডমাস্টার মশাই জানালেন, তিনি বিজ্ঞান শাখা চালাতে  অন্তত তিনটি শিক্ষক পদ চেয়েছিলেন, পেয়েওছেন- তবে, তিনি চেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞান,  রসায়ন ও গণিতের তিনটি পদ, শিক্ষা দফতরের তৎপরতায় তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তর্কবিজ্ঞান ও ভূগোলের তিনটি পদ! পরে খবর পেয়েছি যে, রাজ্যের বহু বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে তালা পড়েছে শিক্ষকের অভাবে। ভালো লাইব্রেরি নেই, নেই ভালো ল্যাবরেটরি এমন বিদ্যালয়ও সংখ্যায় প্রচুর। বহু জায়গায় জোর করে বিজ্ঞান শাখা খোলা রাখা হয়েছে। তাদের শিক্ষার্থীরা দূর দূর স্থানে ছোটে প্রাইভেট টিউটরের সন্ধানে, অথবা তারা খোঁজে নোটবই। এরপরও বলতে হবে কেন বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বা সুযোগ কম? 

নেহরু চেয়েছিলেন দেশ জুড়ে গড়ে উঠুক বিজ্ঞান চেতনা। নয়া শিক্ষানীতিতেও দেখি তার প্রতিফলন। রাষ্ট্র চাইছে ও চেয়েছে শিক্ষিত বিজ্ঞান কর্মী ও বিজ্ঞানী। নাগরিক পেয়েছে অশিক্ষা, অবিজ্ঞান। ফাঁকা ময়দান পেয়ে যেন গোল করতে মাঠে নেমেছে অপবিজ্ঞান। তাকে রুখবে কে?

* আগ্রহী পাঠক আরও তথ্য পেতে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন প্রশংসিত এই পুস্তিকাটিও দেখতে পারেন: Pratichi Occasional Paper No 4: Science Education & the Privilege Divide: A Case of West Bengal, Asokendu Sengupta, 2012.



শাসকের ভয়!

ভীতির ভাইরাসে আক্রান্ত শাসক

সোমনাথ গুহ

রাজা ক্রমশ উলঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। দেশ জুড়ে সে এখন আতশ কাঁচ নিয়ে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর খুঁজে বেড়াচ্ছে। সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’এ জীববিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসার পার্থসারথি রায়কে এনআইএ এলগার পরিষদ-ভিমা কোরেগাঁও ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। ওনাকে ১০ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে।

প্রথমেই ভিমা কোরেগাঁও সম্পর্কে দু-চারটে কথা বলা প্রয়োজন। ১৮১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিম্নবর্ণ মাহার সম্প্রদায়ের সেনারা প্রবল প্রতাপশালী পেশোয়া বাজি রাও(দ্বিতীয়)'কে যুদ্ধে হারিয়েছিল। মাহাররা উচ্চবর্ণের দ্বারা নিপীড়িত ছিল তাই ব্রিটিশদের সাহায্য করতে তারা কোনও কুন্ঠা বোধ করেনি। এই ঘটনার ২০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে দলিতদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা হয় এবং পুরো মহারাষ্ট্র জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। যারা হিংসা ছড়িয়েছিল তাদের গ্রেফতার করার পরিবর্তে সরকার এই সমাবেশের সাথে মাওবাদীদের যোগাযোগের অভিযোগ আনে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার পরিকল্পনার প্রমাণ তারা পেয়েছে বলে পুলিশ দাবি করে। এর ফলে ভারভারা রাও, গৌতম নাভলাখা, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, আনন্দ তেলতুম্বেদের মতো বিশিষ্ট দশজনকে, যারা সারা জীবন নিপীড়িত মানুষদের স্বার্থে কাজ করেছেন, পুলিশ এই ঘটনার জন্য গ্রেফতার করে। প্রায় দু' বছর হয়ে গেল এঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু এখন অবধি এঁদের বিচার শুরু হয়নি।

পার্থসারথি রায় প্রেসিডেন্সি এবং ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অফ সায়েন্স’এর অত্যন্ত কৃতী ছাত্র। আইআইএসসি'তে উনি মলিকিউলার বায়োলজিতে পিএইচডি করেন। এরপরে উনি আমেরিকার লের্নার রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক থেকে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেন। বর্তমানে তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী, যাঁর কাজ বিশ্বখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’ এবং ‘সেল’এ প্রকাশিত হয়েছে। কোভিড১৯ অতিমারি শুরু হওয়ার পর হু (WHO) যে কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাথে নিয়মিত পরামর্শ করেছে, তার মধ্যে উনি অন্যতম। গুরুত্বপূর্ণ হল, অতিমারির শুরু থেকেই উনি ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে সরকারি নীতির মুখর সমালোচক। ১২ এপ্রিল, অর্থাৎ লকডাউন শুরু হওয়ার মাত্র ১৮ দিন বাদেই, উনি এক সাক্ষাৎকারে বলে দিয়েছিলেন যে ভারত ভাইরাসের চরিত্র নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। সারা বিশ্বে যেখানে ভাইরাসের ২৯টি জিনোটাইপ খুঁজে পাওয়া গেছে, ভারতে পাওয়া গেছে মোটে দুটি। বিভিন্ন জিনোটাইপ খুঁজে বার করার কোনও প্রচেষ্টাই আমাদের দেশে নেওয়া হয়নি। এই কারণে মারি কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সে সম্পর্কে কেউ কোনও ধারণাই করতে পারছে না। আরও বলেছিলেন, একুশ দিনের লকডাউন কোনও কাজে দেবে না যদি না এই সময় টেস্টিং বাড়ানো হয়। লকডাউন শুধুমাত্র ব্যাধিটাকে সাময়িক ভাবে ধামাচাপা দেয়। লকডাউন উঠে গেলেই উপসর্গহীন রোগীরা (৬৫ শতাংশ) জনজীবনে মেলামেশা করবে এবং আরও অনেককে সংক্রামিত করবে যার ফলে সংক্রমণ প্রবল গতিতে বাড়বে। পাঁচ মাস বাদে তাঁর কথার সারবত্তা বোঝার জন্য এখনকার পরিসংখ্যানই যথেষ্ট; কোভিড১৯ এর মারণ দৌড়ে ভারত তো প্রায় শীর্ষ ছুঁয়ে ফেলেছে, হয়তো উৎসব মরসুমের আগেই আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে।

অধ্যাপক রায় কিন্তু শুধুমাত্র বিজ্ঞানী নন, যে কারণেও তিনি সমস্ত শাসকদেরই চক্ষুশূল হতে পারেন। তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী; ‘পারসিকিউটেড প্রিজনারস সলিডারিটি কমিটি’র আহ্বায়ক, ‘সংহতি’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল রুবি হাসপাতালের কাছে নোনাডাঙ্গা বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কারণে ওনাকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ ঐ দিন তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিতই ছিলেন না; তিনি ছিলেন প্রায় ৭০ কিমি দূরে আইআইএসইআর ক্যাম্পাসে। এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠার কারণে সরকার ওনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২০১৮'র সেপ্টেম্বর মাসে একটি মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতর রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে অধ্যাপক রায় এবং আরও নয়জনের ওপর নজর রাখতে। এই সময়েই অধ্যাপক ইয়াহু কোম্পানি থেকে একটি বার্তা পান যে তাঁর মেল সরকারি কোনও সংস্থার নিশানায় আছে, যার অর্থ তাঁর মেলের যাবতীয় তথ্য তাদের করায়ত্ত হতে পারে। এর থেকে বোঝা যায়, সরকারের সমালোচনা ও বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে তাঁকে বারবার হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁর ওপর নজরদারি হয়েছে। তিনি কোনওদিনও ভিমা কোরেগাঁও নামক জায়গায় যাননি, তিনি ২০১৮'র জমায়েতের সংগঠকদেরও চেনেন না এবং ঐ ঘটনা তিনি সংবাদপত্র থেকেই জানতে পেরেছিলেন। অথচ তাঁকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুম্বাই ডেকে পাঠানো হচ্ছে! এটি একটি অশনি সংকেত। জিজ্ঞাসাবাদ মানেই যে তিনি গ্রেফতার হবেন না, তার কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই।

শুধু অধ্যাপক রায় নন, এনআইএ সংগ্রামী কবি ও লেখক ভারভারা রাওয়ের দুই জামাইকেও ৯ সেপ্টেম্বর মুম্বাইয়ে হাজির থাকার জন্য শমন পাঠিয়েছে। কবির কন্যা পাবানার স্বামী কে সত্যনারায়ণন ‘ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক। দ্বিতীয় কন্যা আনালার স্বামী কে ভি কূর্মানাথ হিন্দু বিজনেস লাইন পত্রিকার বর্ষীয়ান সাংবাদিক। সত্যনারায়াণন জানান, তাঁরা কোনওভাবেই ভিমা কোরেগাঁও ঘটনার সাথে যুক্ত নন অথচ শুধুমাত্র ভারভারা রাওয়ের জামাই হওয়ার কারণে তাঁদের বারবার হেনস্থা করা হচ্ছে। দু' বছর আগে পুলিশ তাঁর বাড়ি তল্লাশি করে এবং এমন ব্যবহার করে যেন তিনি সন্ত্রাসবাদী। তারা এমনকি দম্পতির ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও পড়তে শুরু করে। তাঁর ল্যাপটপ, পেনড্রাইভ, হার্ড ডিস্ক এবং তাঁর ২০ বছরের অ্যাকাডেমিক কাজ তাঁরা বাজেয়াপ্ত করে। এমনকি পাবানাকে তারা প্রশ্ন করে কেন তিনি হিন্দুদের মতো দেখতে নন বা হিন্দু মহিলাদের মতো সাবেকি গয়না পরিধান করেন না। সেই সময় পুলিশ এই সব ঘটনা পুরো অস্বীকার করে এবং বলে ভিমা কোরেগাঁও কেসে তল্লাশির জন্য কোনও ওয়ারেন্টের প্রয়োজন হয় না। ভারভারা রাও সম্প্রতি কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে আবার জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবার এমনিতেই তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন, এর মধ্যে দুই জামাইকে শমন তাঁদেরকে আরও মানসিক ভাবে বিচলিত করে দিয়েছে।

ভিমা কোরেগাঁও ঘটনা দলিতদের দাপটের একটি প্রতীক। এই আন্দোলন যদি তথাকথিত ‘আর্বান নকশাল’রা হাইজ্যাক করে নেয় তবে তা হিন্দুত্বর পরিকল্পনা রূপায়িত করতে হয়ে দাঁড়াবে একটা বড় বাধা। তাই এই পুরো আন্দোলনটাকেই মাওবাদী ছাপ্পা মেরে দাও এবং যে কোনও প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে এদের সাথে একাকার করে দাও। সরকার কখনই চায় না দলিত, সংখ্যালঘু, প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলির দাবিদাওয়া, অস্তিত্বের লড়াইয়ের সাথে এই বিশিষ্ট ও বরেণ্য সমাজকর্মী, লেখক, গবেষকরা এক জোট হোক কারণ এঁদের ঐক্য সরকারের ক্ষমতার ভিত টলিয়ে দিতে পারে। আসলে সরকারের এখন নাজেহাল অবস্থা। কোভিড নিয়ন্ত্রণে ডাহা ফেল; অর্থনীতির শোচনীয় অবস্থা; শুধুমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রেই বেকারত্ব দু কোটি; বাজারে ক্রেতা নেই, ব্যাংকের ঋণ নেওয়ার লোক নেই; নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে; অভুতপূর্ব ভাবে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান লক্ষাধিক শ্রোতা ডিসলাইক করেছে। সরকার এতটাই মরীয়া যে বিহারে সুশান্ত সিং রাজপুতের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুকে তারা আসন্ন নির্বাচনে তুরূপের তাস করেছে। ‘না ভুলেঙ্গে, না ভুলনে দেঙ্গে’- সুশান্তকে নিয়ে পোস্টারে রাজ্য ছেয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, বিহারে প্রায় ২৩ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে এসেছিল। পরিবার পিছু যদি চারজনও সদস্য হয় তাহলে সংখ্যাটা কত দাঁড়ায়? এছাড়া কৃষির অবস্থা সঙ্গিন। এইসব জ্বলন্ত সমস্যাকে আড়াল করতে অতএব সুশান্তই ভরোসা। পাশাপাশি ‘দেশ বিপন্ন’, ‘রাষ্ট্রনেতা বিপন্ন’ এটা প্রমাণ করেও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটা প্রচেষ্টা চলছে। যার জন্য বারবার ভিমা কোরেগাঁও, দিল্লি দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার করা হচ্ছে, শমন জারি হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ‘শত্রু’র ওপরেই আঘাত হেনে প্রচারের ঝড় তুলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে 'আর্বান নকশাল', জিহাদি, টুকরে টুকরে গ্যাং এদের জন্যই দেশের আজ টালমাটাল অবস্থা।