আয়োজনের ফাঁকি
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
1938 সালে সুভাষচন্দ্র যখন কংগ্রেস সভাপতি তখন গড়া হয় জাতীয় পরিকল্পনা পর্ষদ, যার সভাপতি মনোনীত হন জওহরলাল। তিনি যথার্থই অনুধাবন করেন যে এই দেশকে এগোতে হলে মানুষের বিজ্ঞান-মনস্কতা অত্যন্ত জরুরি। এই ধারণা নিয়ে এগোলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান চর্চা গুরুত্ব পাবার কথাই। কিন্তু তা পেল কী? সংস্থা গড়া হল অনেক, তারা নেহরুজির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবে এমন ভাবাও হল, কিন্তু কাজ হল কতটা?
INSA এমন একটি সর্বভারতীয় সংস্থা। 2005 সালে প্রথম (এবং শেষ) India Science Report তৈরি করল NCAER( National Council for Applied Economic Research )নামক আর এক সংস্থার সাহায্যে এবং বোঝা গেল বিজ্ঞান চর্চায় দেশ তেমন কোনও গুরুত্বই দেয়নি।* কার দোষ? কেবল রাষ্ট্রের, কেন্দ্রীয় সরকারের? তা নিশ্চয় নয়। জনতার দায় নিশ্চয়, তাদের দায় তো সবচেয়ে বেশি৷ তবু, এই স্বল্প পরিসরে তাদের আপাতত ছাড় দেওয়া যাক। (সুযোগ পেলে তা নিয়ে পরে আলোচনা করব)। রাজ্য সরকারগুলিও দায় অস্বীকার করতে পারে কী? ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর পর রাজ্যের তালিকা থেকে সরিয়ে নিয়ে শিক্ষাকে জুড়ে দেওয়া হয় যুগ্ম তালিকায়। তারপর যা হবার তা হয়েছে, ভাগের মা যথানিয়মে গঙ্গা পান নি। কিন্তু তার আগে?
মেঘনাদ সাহা, বিশ্বেশ্বরাইয়া, মহালনবীশ বা সত্যেন্দ্রনাথ বসুরা চেয়েছিলেন মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা, রবীন্দ্রনাথ-গান্ধী-নেহরু সহায়। সেই মতো পরিভাষা নির্মাণে মন দেওয়া হল। স্বাধীনতার পর মাতৃভাষায় পুস্তক রচনায় উৎসাহ দিতে রাজ্যে রাজ্যে পুস্তক পর্ষদও গঠিত হল। কিছু কাল পরে দেখা গেল হিন্দি ছাড়া অন্য ভাষাগুলির ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি কিছু হয়নি। এদিকে স্বাধীনতার পর দেশের কিছু রাজনৈতিক নেতার দাবি পূরণে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন হল। সে সময় বা তার অল্প আগে ঐ রাজনৈতিক নেতারা ও তাদের কিছু অনুগামী কিঞ্চিৎ চতুরতার সঙ্গে চেষ্টা করেছিলেন হিন্দিকে রাজভাষার আসনে বসাতে। তাদের অন্যতম হাতিয়ার ছিল আদমসুমারি রিপোর্ট। গ্রাহ্যই করলেন না তারা আচার্য সুনীতিকুমারদের যুক্তি, কিন্তু অগ্রাহ্য করতে পারলেন না দক্ষিণ ভারতের প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদে ভেসে গেল 'ত্রিভাষা সূত্র'। তবে, সে সব আন্দোলন ও অন্যান্য হল্লার ফাঁকে, কৌশলে তারা হিন্দিকে এগিয়ে নিলেন, অন্য অনেক আঞ্চলিক ভাষার গলায় পা রেখে। বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে আঞ্চলিক ভাষা তার গুরুত্ব হারাতে থাকল। India Science Report থেকে স্পষ্ট হল যে বিজ্ঞান শিক্ষার মূলকেন্দ্র গড়ায় মন দেয়নি রাজ্য সরকারগুলি। কে না জানে যে বিজ্ঞান চর্চার প্রধান সুযোগ মেলে নিশ্চিতভাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায়। মানতে হবে যে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্টাইপেন্ড, স্কলারশিপ ইত্যাদি অনেকটা বেড়েছে। তবু তা বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে, এই অবৈজ্ঞানিক নানা সংস্কারে ডুবে থাকা দরিদ্র লাঞ্ছিত ভারতবর্ষে যথেষ্ট নয় (বিজ্ঞান চেতনার বিকাশের বিষয়টি বাদ দিয়েও এই কথা বলা যায়)। যে কোনও স্তরে, কেবল আসন সংখ্যার দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায় অবহেলার মাত্রা। আর সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা কোন পর্যায়ে ও কতখানি অসফল তা কিছুটা হলেও বোঝা যায়। আমলারা নেতাদের দিকে আঙুল তোলে, নেতারা বলে অর্থাভাবের কথা, কেউ নিজ পক্ষের ব্যর্থতা মানে না! তারা কেবল বলির পাঁঠা বা নন্দ ঘোষ খোঁজে। শিক্ষকদের মধ্যে সহজেই তেমন পাঁঠা বা নন্দ ঘোষ মেলে। তাই নিরক্ষরতা দূরীকরণই হোক বা বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসার, সবেতেই আমরা ব্যর্থ।
একটা অভিজ্ঞতার কথাও এই সঙ্গে বলতে চাই। সেবার শিশু কমিশনের কাজে গিয়েছি উত্তরবঙ্গের নিমতা। সেখানে চা বাগান সংলগ্ন একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হাল বুঝতে ঢুকেছি। খবর নিয়ে জানলাম, সেখানে বিজ্ঞান শাখা আছে বটে কিন্তু সে শাখায় বিদ্যার্থী প্রায় নেই। কেন এই হাল? স্কুলের লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি সবই ভালো মানের, তবু এই হাল কেন? বোঝা গেল শিক্ষক নেই, তাই! হেডমাস্টার মশাই জানালেন, তিনি বিজ্ঞান শাখা চালাতে অন্তত তিনটি শিক্ষক পদ চেয়েছিলেন, পেয়েওছেন- তবে, তিনি চেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতের তিনটি পদ, শিক্ষা দফতরের তৎপরতায় তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তর্কবিজ্ঞান ও ভূগোলের তিনটি পদ! পরে খবর পেয়েছি যে, রাজ্যের বহু বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে তালা পড়েছে শিক্ষকের অভাবে। ভালো লাইব্রেরি নেই, নেই ভালো ল্যাবরেটরি এমন বিদ্যালয়ও সংখ্যায় প্রচুর। বহু জায়গায় জোর করে বিজ্ঞান শাখা খোলা রাখা হয়েছে। তাদের শিক্ষার্থীরা দূর দূর স্থানে ছোটে প্রাইভেট টিউটরের সন্ধানে, অথবা তারা খোঁজে নোটবই। এরপরও বলতে হবে কেন বিজ্ঞান শাখায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বা সুযোগ কম?
নেহরু চেয়েছিলেন দেশ জুড়ে গড়ে উঠুক বিজ্ঞান চেতনা। নয়া শিক্ষানীতিতেও দেখি তার প্রতিফলন। রাষ্ট্র চাইছে ও চেয়েছে শিক্ষিত বিজ্ঞান কর্মী ও বিজ্ঞানী। নাগরিক পেয়েছে অশিক্ষা, অবিজ্ঞান। ফাঁকা ময়দান পেয়ে যেন গোল করতে মাঠে নেমেছে অপবিজ্ঞান। তাকে রুখবে কে?
* আগ্রহী পাঠক আরও তথ্য পেতে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন প্রশংসিত এই পুস্তিকাটিও দেখতে পারেন: Pratichi Occasional Paper No 4: Science Education & the Privilege Divide: A Case of West Bengal, Asokendu Sengupta, 2012.
খুব ভালো লেখা
ReplyDelete